— তাসনুভা চৌধুরী
একটা রাজার ১মাত্র ছেলে ১মাত্র মেয়ে। একদিন বেড়াতে গেলো সমুদ্রে। সেখানে একটা দ্বীপে তারা নামলো তার ছোট ছেলের জন্মদিনের উৎসবের জন্য। হঠাৎ দ্বীপ টা নড়ে উঠল। মন্ত্রী তার মন্ত্র পুত চশমাটা জলে ফেলে দিলো। চশমাটা জলের নিচে দেখতে পায়।অার চশমা যা দেখতে পায় সেটা মন্ত্রী ও দেখতে পায়।দেখল এটা দ্বীপ নয়।তিমির পিঠ। সর্বনাশ! এটা যাদুর তিমি।প্রতি ১০০বছরে তার এক দিন। টানা ৪০বছর সে ঘুমায়।তারপর ৬০বছর জেগে থাকে। এখন তার ঘুম ভাঙ্গছে। তার ঘুম ভেঙ্গে যাবার পরই তান্ডব আরম্ভ করবে।
সবাই যে যার মত মন্ত্র পড়তে লাগল।নিজেদের বাঁচানোর জন্য। কেও ভেসে গেলো। কেও উড়ে গেলো। কেও কাঠের মতন বসে রইল নাক,মুখ,কান, চোখ বুজে।তবু কেও জানেনা বাঁচতে পারবে কিনা। ছোট্ট ছেলে জাজাফী পিট পিট করে সব দেখছিল। মা তাকে একবার শক্ত কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর, তার বড় বোনের কাছে উপহারে পাওয়া সাবানের টুকরো অার জলের কৌটো দিয়ে মন্ত্র বলে একটা বুদবুদ তৈরি করে তার ভেতর জাজাফী কে ভরে দিলেন। তার পর উড়িয়ে দিলেন। ওড়ানোর অাগে, ছুরি দিয়ে হাতের কনে অাঙ্গুল ফুটো করে বুদবুদেরর গায়ে লিখে দিলেন জাজাফী। অার জাজাফীর গলায় দিলেন তার লকেটটা। বুদবুদ টা উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে একটা ছোট্ট নৌকায় গিয়ে পড়ল। তার অাগে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল।
জাজাফী এর জা টা মুছে গিয়ে শুধু জাফী রইল। ঐ বোটে ছিল এক দম্পতি। তারা নিজেদের দুই ছেলের সাথে জাজাফী কে মানুষ করতে লাগল। নাম দিল জাফী। জাফী নামে জাজাফী বড় হতে থাকল সাধারন বাচ্চাদের মতন। ও কোনো মন্ত্র জানত না তাই ওর মাঝে “চৈমনি”রাজ্যের কোনো ছাপ নেই। শুধু ওর গলার লকেটট টা! লকেটে একটা মনি কালো রং এর। মাঝে মাঝে জাজাফী মনি টা ছোঁয়। তখন ওর কেমন অদ্ভুত লাগে। একদিন ও অাবিস্কার করলো,অাসলে মনি টা সাধারন মনি নয়।মনি টা চেপে ধরে রাখলেই জাফী শুনতে পায় একটা নরী কনাঠ তাকে জাজাফী বলে ডাকছে।হ্যাঁ। কোনো ভুল নেই। ওকেই ডাকে।কিন্তু খুব বেশি সময় মনিটা ধরে থাকলেই মাথা ঝিম ধরে অাসে।
তাই তখন ছেড়ে দেয়।অাস্তে অাস্তে জাফী বড় হতে থাকে।সব খানে ও বেশ দক্ষ,পড়ালেখা,খেলাধুলা,বুদ্ধি। সব।জাফীকে ওর পালিত বাবা মা ময়েন এবং শিফু খুব ভালো বাসত।তাই জাফীর কখনো মনেই হয়নি তার ওর অাসল বাবা মা না। জাফী সব কিছু তে ভালো হওয়ায় ময়েন অার শিফু ঠিক করলো ওকে বড় শহরে পাঠাবে অারও ভালো ভাবে সব কিছু শিখতে। তখন জাফীর ২বছরের বড় পালিত ভাইটা অাপত্তি করল।বললো সে বড় সুতরাং তাকে পাঠানো উচিত।এক পর্যায়ে বলে ফেলে যে, “তোমরা নিজের ছেলের চে… “বলতেই শিফু মুখ চেপে ধরে তার ছেলে শকুর।জাফী বাড়ির বাইরে থেকেও শুনতে পায় শকুর উত্তেজিত কন্ঠে। জাফী মুষড়ে যায়।অারও চুপ চাপ হয়ে যায়।তবে সব পাকাপাকি করে জাফীকে ময়েন শহরে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে ফেলে ইতমধ্যে।জাফী ও চাইছিল অার বোঝা হয়ে না থাকতে।
১৬বছর বয়সি জাফী চলে যায় শহরে।তার রাত গুলো ভীষণ এককী কাটতো।সে প্রথম রাত বেশ ভয় পায়।কিন্তু সে কিছুতেই অার বোঝা হয়ে ফিরবে না।তাই থেকে যায়।তাকে তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।পরের রাতেও ভয় করে,তখন সে তার গলার লকেট টা ধরে রাখে।কালো মনি তার জাদু বলে জ্বলে ওঠে দপ করে।এর অাগে কখনো রাতে মনিটা হাতে চেপে রাখেনি।একমুহুর্ত যেতেই সব ভয় কেটে যায় জাফীর। কালো মনির ভেতর থেকে একটা নরী কন্ঠ ভেসে অাসে। জাফী এখন জানে যে শিফু তার অাসল মা না।তাই সহজেই বুঝতে পারে মনির ভেতরের মানুষের গলাটা অার কারো নয় ওর মায়ের।গলায় লকেটটা না থাকায় মন্ত্র কাজ করেনি।ফলে জাজাফীর মা জেনেফার মারা যায়।কিন্তু তার অাত্মা জাদু বলে সেই মনিটা খুঁজে নিয়েছে।অার তাই জাফীর ডাকে সাড়া দিতে পারছে।
জাফী চোখ বন্ধ করে একবার ডাকে,তুমি কি মা?মা বলে,হ্যাঁ সোনা।অামার মানিক।জাজাফী অামি তোর মা।চৈমনি রাজ্যের অভাগা রানী। । তারপর জাজাফী কে সব খুলে বলে জেনেফার। সব শুনে জাজাফীর চোখ ভিজে যায়।ওর মা জানায় মাঝ সমুদ্রে ওদের চৈমনি রাজ্য। যেখানে কখনও এই সমাজের কোনো মানুষ পৌছুতে পারে না।এখান কার সমাজের মানুষের মূল অস্ত্র হচ্ছে জ্ঞান।চৈমনি রাজ্যে জাদু টাই মূল ভিত্তি অার এই সমাজে বিজ্ঞান। জাদু শেখার নিয়ম অাছে।২বছর বয়স থেকে অারম্ভ হয়।তবে জাজাফী হারিয়ে গেছে ১বছর বয়সে।তার কাছে কোনো যাদু শিক্ষা নেই।
এ সমাজের ভাষায় যাকে বলে অলৌকিক ক্ষমতা সেটা নেই।তাই এখানে জাজাফীর জাফী হয়ে বড়হতে সমস্যা হয়নি। মৃত মা জেনেফারের সহচার্যে জাজাফী জাফী নামেই শহরে বড় হয়।পেতে থাকে নানার জ্ঞানের শিক্ষা। অার দিন শেষে সে নির্জন পাহাড়ে বসে মায়ের সাথে কথা বলত।অনেক নতুন জিনিস শিখত।চৈমনি রাজ্যের ব্যাপারেও বেশ কিছু জিনিস সে জানতে পারে।যেমন ঐ যাদুর তিমি।যার জন্য তারর মা মারা গেছেন।ঐ জাদুর চশমা।অার তাকে জাদু সাবানের বুদ বুদে করে উড়িয়ে দেয়া।
দেখতে দেখতে জাফীর বয়স ১৮পূর্ণ হয়ে গেলো।মা বললেন এবারে যদি সে সমুদ্রে ডুব দিয়ে মাঝ সমুদ্রের উদ্দেশ্যে রওনাদেয় তাহলে ১দিন ৫মিনিট ৩৪সেকেন্ডে সে পোঁছে যাবে চৈমনি রাজ্যে।সে ওখানে প্রবেশাধিকৃার পাবে না।তবে বাইরে থেকে দেখে অাসতে পারবে।অার মা একটা মন্ত্রও শিখিয়ে দেন যেটা পড়লে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে কেও তাকে বাঁধাও দেবে না।তবে অবশ্যই সাবধান যে কালো মনির।লকেট টা যেনো হারিয়ে না যায়।জাফী মায়ের কথা মত সব কাজ করল।পৌঁছে গেলো চৈমনি রাজ্যে। কি চমৎকার রাজ্য।ছোট্ট রাজ্য।সবার পরনে নীল জামা।অথচ প্রত্যেকটা একটা অারেকটা থেকে অালাদা।
এক কোনায় বাচ্চাদের স্কুলে জাদু শেখানো হচ্ছে।অন্য পাশে জাদুর গাড়ি চলছে রাস্তায়।কয়েকটা মেয়ে তাদের জাদু দিয়ে একে অন্যকে সাজিয়ে দিচ্ছে।বাজার টাও বড্ড সুন্দর।সব চেয়ে সুন্দর রানী টা।একটা ২৭-২৮বছরের মেয়ে।চেহারা অনেকটা জাফীর মতন।এমন সময় মা বললেন,ওটা রিফানি।ওর বোন।অার রাজার অাসনের মানুষ টা রিজেন।ওর বাবা।তাদের দুজনের ঠোঁটে শুকনো হাসি।প্রফুল্লতা নেই। জাফী বুঝলো এটা ওর অর ওর মায়ের অনুপস্থিতি মর ফল। সব খুঁজে পেয়েও জাফী পেলো না কিছুই ধরে রাখতে। সে ফিরে গেলো।হঠাৎ মাঝ পথে অাওয়াজ পেলো, জাজাফী। নরম কন্ঠ। মা ডাকছে।
বলো মা। মন খারাপ করতে নেই সোনা। অামি তো অাছি। তোর সাথে। সব সময়।
রিফানি খুব বুদ্ধি মতি।ও ঠিক সব সামলে নেবে।জাফী তার মায়ের কাছে শোনা সব কথা অাগে থেকেই তুলে রাখত খাতায়। একবার এক শিক্ষক সেই খাতা দেখে ফেললেন।জানতে চাইলেন এসব কি? সে কিছু বলেনি। তবে তিনি ধরে নিয়েছেন জাফী গল্প লিখেছে। হয়ত লজ্জা পাচ্ছে তাই বলছে না।তিনি বললেন চর্চা চালিয়ে যেতে। এর মাঝে জেনেফার চৈমনি রাজ্যে।রিজেন কে,যে তাদের ছেলে বেঁচে অাছে।ভালো অাছে। সব শুনে তারা ভীষণ খুশি হলেন।তবে চৈমনি রাজ্যের নিয়ম কড়া।পূর্ণ জাদু শাত্র না জানলে প্রবেশ করতে পারবে না। চৈমনি রাজ্যে সব ঠিক হয়েছে শুনে জাজাফী ছুটে গেলে অাবার।দেখে এলো সবাইকে।চুপি চুপি। তারপর থেকে সে ছুটি পেলে মাঝে মাঝে চলে যেতো। এমন সময় একদিন ওর শিক্ষক ওকে ডেকে পাঠালেন।গল্প লেখা প্রতিযোগিতা হবে।
জাফী কে সেখানে যেতে হবে।জাফী তো অাকাশ থেকে পড়ল।সে কি করে গল্প লিখবে।তখন স্যার বললেন তোমার ডায়েরিতে,খাতায় যেমন গল্প লেখো সেগুলোর মত হলেই হবে। জাফী বলতে গেলো, কিন্তু… জেনেফার থামিয়ে দিল। জাফি বললো ঠিক অাছে স্যার। অামি যাবো। মায়ের কাছে জাজাফী জানতে পারল,চৈমনি রাজ্যের সব চেয়ে বুদ্ধিমানই রাজ্যের রাজা রানী হয়।অর্থাৎ,পুরো রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমানে ব্যাক্তির ছেলে সে।সে চেষ্টা করলেই পারবে। রূপকথার গল্প অনেকক কালজয়ী লেখকেরা লিখে গেছেন।সেগুলো পড়েছে সবাই। কিন্তুু রূপকথা লেখা সবচেয়ে কঠিন কাজ মনে করে অনেক কম ছেলেমেয়ে ই অংশ নেয়ার কথা।তবু দেখা গেলে অনেকেই উপস্থিত। অথচ প্রতিযোগিতা অারম্ভের পর বেশির ভাগ কেই দেখা গেলো মলিন মুখে বসে থাকতে।
কিন্তু জাফি লিখেই যাচ্ছে। কিন্তু লেখা শেষে নামের ঘরে জাফী না লিখে জাজাফী লিখে ফেলল ভুল করে। অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ী ঘোষনা করা হলো জাজাফী কে।জাফীর শিক্ষকরাও বুঝতে পারলো না কে সে? তখন জাফী হাত তুললো যে সেই জাজাফী। এবং অন্যান্য তথ্য দেখে নিশ্চিত করা হলো যে সেই জাজাফী। জাফীর স্যারের নিজে থেকে কধা বলার অভ্যেস।তিনি বললেন,এটা তার ছাত্রের গল্প লেখার ছদ্মনাম। তারপর থেকে জাজাফীর কাছে থেকে নিয়মিত লেখা চাওয়া হতে লাগল।সে জাজাফী নামেই লিখতে লাগল। সেও ভীষণ ব্যাস্ত সময় কাটাতো। মাঝে মাঝে ফাঁক পেলেই ছুটে যেতো চৈমনি রাজ্যে। সরাসরি কথা না বলতে পারলেও মায়ের সাহায্যে টুক টাক খোঁজ নিতো। অার এদিকে গল্পকার হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। জাফী অন্যান্য বিষয়েও পড়ালেখা করল অার সাহিত্যের অন্য শাখায়ও তার পদচারণ হলো। তবে চৈমনি রাজ্যের ওপরে তার লেখা গুলোই ছিল তার শ্রেষ্ঠ রচনা। সবার কাছে যেগুলো নেহাত রূপকথা অথচ জাফীর কাছে সত্যি। জাফী যখন প্রথম তার মা জেনেফার কে পায় তখন তার ইচ্ছে করছিল তার নাম টা বদলে ফেলে।কিন্তু পারেনি।
এবার সেই সুজোগ এসেছে।সবাই জাফী কে জাজাফী নামেই চেনে।জাজাফীর কাছে প্রস্তাব অাসলো তার সেরা রূপকথা গুলোর সমগ্র বের করতে অনেকে অনেক রকম নামের ধারনা দিলেও কারোটাই পছন্দ হলো না জাজাফীর।
দুমাস বাদে, “সত্যিকারের রূপকথা”নামে প্রকাশ পেলো জাজাফীর রূপকথা সমগ্র। যদিও নাম নিয়ে অনেকে দ্বিমত করেছিল শুরুর দিকে।কিন্তু জাজাফীর ভাষা অার রচনা শৈলীগত কারনে পাঠকের কাছে গল্প গুলো একেবারে বাস্তত মনে হতে লাগল। তাই পরে অার কেও নাম নিয়ে কোনো তর্কে জড়ায়নি। কিন্তু নাম টা অমন হওয়ার অাসল কারন তার ভাষা বিন্যাস নয়।বরং এটাই তার জীবনের সব থেকে বড় সত্যি সেটা সে ছাড়া অার কেও ই জানলো না। জাজাফী লেখক হিসেবে অনেক নাম করল।
তবু মাঝে মাঝে বিখ্যাত রূপকথাকার জাজাফী মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যেতেন। কেও জানতে চাইলে সে মিষ্টি হেঁসে বলত,”চৈমনি রাজ্যে গিয়োছিলাম।” সবার কাছে যেটা রূপকথা সেটা জাজাফীর সতিকারের গল্প।
#তাসনুভা_চৌধুরী