বাংলাদেশের প্রথম নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের একটি মাইলফলক। তবে সম্প্রতি এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মেটানোর অক্ষমতা এবং প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের চাপ নিয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবন্ধে কর্ণফুলী টানেলের বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, এবং এটি বাংলাদেশের জন্য বোঝা না সম্ভাবনা—এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।
টানেলের বর্তমান অবস্থা
কর্ণফুলী টানেল, যা “বঙ্গবন্ধু টানেল” নামেও পরিচিত, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত। এটি দেশের প্রথম টানেল এবং একটি উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর প্রকল্প। কিন্তু এর নির্মাণ খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
- রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: টানেলটি চালু হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, টোল আদায় থেকে পাওয়া রাজস্ব এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও পূরণ করতে পারছে না। বর্তমানে প্রতিদিনকার গড় টোল আদায় টানেলের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তুলনায় কম।
- ঋণ পরিশোধের চাপ: টানেলটি নির্মাণে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিদেশি ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। এই ঋণের সুদসহ পরিশোধের বোঝা দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য বোঝা নাকি সম্ভাবনা?
বোঝার দিকগুলো:
- অর্থনৈতিক চাপ: কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ ব্যয় ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার একটি বড় অংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ না উঠলে ঋণ পরিশোধে বাড়তি রাজস্ব বরাদ্দ করতে হবে। এটি সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রভাবিত করতে পারে।
- পর্যাপ্ত যানবাহনের অভাব: টানেলের টোল আদায়ের প্রধান উৎস যানবাহন। কিন্তু টানেল দিয়ে প্রত্যাশিত সংখ্যক যানবাহন চলাচল না করায় রাজস্ব কম হচ্ছে।
- পরিকল্পনার ঘাটতি: চট্টগ্রামে বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে টানেলের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
সম্ভাবনার দিকগুলো:
- অঞ্চলীয় সংযোগ উন্নয়ন: টানেলটি চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমানোর পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করেছে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে সহায়ক।
- পর্যটন উন্নয়ন: টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এতে ভবিষ্যতে পর্যটক বৃদ্ধি রাজস্ব আয় বাড়াবে।
- বহুমুখী ব্যবহার: ভবিষ্যতে টানেলটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরের উন্নয়ন, এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও কার্যকর করতে সহায়ক হতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কর্ণফুলী টানেলের সফলতা অনেকটাই নির্ভর করছে এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার ওপর। কিছু প্রস্তাবনা নিম্নরূপ:
- টোল ব্যবস্থাপনা উন্নত করা: টোল আদায়ের প্রক্রিয়া আরও ডিজিটাল এবং স্বচ্ছ করতে হবে। এছাড়া টোল হার পুনর্বিবেচনা করে যানবাহন মালিকদের আকর্ষণ করা যেতে পারে।
- যোগাযোগ উন্নয়ন: টানেলের উভয় প্রান্তে সড়ক অবকাঠামো উন্নত করা জরুরি। এই যোগাযোগ উন্নয়ন টানেলের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হবে।
- বিনিয়োগ আকর্ষণ: টানেলকেন্দ্রিক শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।
- পর্যটন প্রচারণা: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন স্থাপনার সঙ্গে টানেলকে একীভূত করে প্রচারণা চালানো হলে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার
কর্ণফুলী টানেল বর্তমানে একটি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করলেও এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও এখন এটি বোঝা মনে হচ্ছে, তবে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে টানেলটি ভবিষ্যতে লাভজনক প্রমাণিত হতে পারে। সরকারের উচিত পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে টানেলটিকে একটি সফল প্রকল্পে পরিণত করা।