লেখক: ব্যারিস্টার সৈয়দ আফতাব আহমেদ
“জাজাফী” বাংলার সাহিত্যাকাশে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব, যে তার লেখনীতে সমাজের প্রথা, নিপীড়ন, রাজনীতি ও জীবনের গভীরতম দার্শনিক ভাবনাকে উপস্থাপন করেন। তার লেখাগুলোর মধ্যে উঠে আসে মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, অসহায়ের প্রতি সমবেদনা এবং আত্মানুসন্ধানের তীব্র প্রেরণা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই গোপনচারী লেখক কবিতা, প্রবন্ধ, এবং গল্পের মধ্যে দিয়ে চিন্তা ও সংবেদনের এক অভিনব ধারা তৈরি করেছেন যা শুধু সাহিত্য নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রেও অনন্য।
জাজাফীর কাজের মধ্য দিয়ে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে জীবন এবং সমাজের প্রতি গভীর বোধ। তার কবিতায় যেমন “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব রয়েছে, তেমনি বিদ্রোহী সুর ও স্রোতের প্রতীক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের সুরও প্রতিধ্বনিত হয়। জাজাফীর কাব্যিক ভাষা, জীবনের ভাঙচুর এবং আদর্শের টানাপোড়েন বর্ণনা করতে গিয়ে ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো মুক্তচেতা কবিদের অনুরূপ ভাবধারায় ভাস্বর হয়ে ওঠে।
তাকে সমাজের একান্ত অসংগতিপূর্ণ এবং নিপীড়নমূলক বাস্তবতার বিরুদ্ধে উচ্চকিত হতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, “The Social Contract” গ্রন্থে জ্যাঁ জ্যাক রুসো যে সমাজের আদিম স্বাধীনতার কথা বলেছেন এবং “On Liberty” তে জন স্টুয়ার্ট মিল যে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছেন, জাজাফীর রচনায় তাদের প্রভাব বিদ্যমান। সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি তুলে ধরেন ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সামাজিক প্রভাবের দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক প্রথা ভাঙার পথে বাধাগুলির বিবরণ।
জাজাফীর রচনায় একটি বড় অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছেন জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিটশে। “Thus Spoke Zarathustra” এর মতো মহাকাব্যিক দার্শনিক গ্রন্থে যে জীবনকে নিজের মতো করে জীবনের চর্চা করা এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে মুক্ত হতে বলেছে, জাজাফীর রচনাতেও এই আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্ম-প্রশ্নের ঝোঁক বারবার উঠে এসেছে। যেমন নিটশে বলেছেন, “He who has a why to live can bear almost any how,” জাজাফীও তাঁর লেখায় জীবনের মানে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, মানুষের জীবন লক্ষ্যহীন এবং অর্থহীন থাকতে পারে না, এবং তা পূর্ণতা পায় ব্যক্তির একান্ত সাধনা ও চেতনার দ্বারা।
তার লেখার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের নিপীড়নমূলক রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা। এমিল ডুর্খাইমের “The Division of Labor in Society” বা কার্ল মার্কসের “Das Kapital” এর মতো গ্রন্থে যে শ্রেণী বৈষম্য ও অর্থনৈতিক শোষণের কথা বলা হয়েছে, জাজাফীও তার রচনায় সেই ধারণাকে তুলে ধরেন। বিশেষত দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তিনি তা গভীরভাবে অনুভব করেন এবং সামাজিক বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রয়োজনে লেখনীতে আক্রমণাত্মক হতে দ্বিধা করেন না।
জাজাফীর সাহিত্যে “আন্তর্জাতিক রাজনীতি”র প্রভাব এবং গ্লোবালাইজেশনের নানা দিকও লক্ষ্য করা যায়। কেনেথ ওয়াল্টজের “Theory of International Politics” এবং হ্যান্স জে. মরগানথাউয়ের “Politics Among Nations” গ্রন্থের চিন্তাগুলি তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। লেখকের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বার্থের সংঘাত এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের অন্বেষা মানুষের জীবনকে আরও জটিল ও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এসব প্রভাবের কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলি তার লেখায় বড় ভূমিকা পালন করে।
জাজাফীর লেখনীতে মাঝে মাঝে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ছোঁয়াও দেখা যায়। ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের “The Interpretation of Cultures” এবং ব্রোনিস্লাভ মালিনোভস্কির “Argonauts of the Western Pacific” এর মতো নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থে ব্যক্তিত্বের সমাজ-নির্ধারিত স্বরূপ এবং সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যাগুলি জাজাফীর লেখায় প্রায়ই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের সংস্কৃতি, তার পরিচয় এবং ব্যক্তিত্বকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করে এবং সমাজের প্রতিটি প্রথা ও নিয়ম মানব মনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
তার রচনায় ইতিহাসের প্রভাবও সুস্পষ্ট, এবং বিশেষ করে হাওয়ার্ড জিনের “A People’s History of the United States” বা এরিক হবসবামের “The Age of Extremes” এর মতো গ্রন্থের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তিনি মনে করেন, সমাজে প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছায় ইতিহাসকে পুনর্গঠন করে এবং প্রকৃত ইতিহাসের ধারণা থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখে। ইতিহাসের অমোঘ শক্তি এবং তার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সমাজের ন্যায়বিচার ও সাম্যের ধারণা তার লেখার অনুষঙ্গ।
জাজাফীর এই দার্শনিক ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার মিশ্রণ তার লেখাগুলিকে শুধু শিল্পময়ই করেনি, বরং তা সমাজের বিবেককে জাগ্রত করে। যেমন মার্কিন কবি ল্যাংস্টন হিউজেস তার “Let America Be America Again” কবিতায় নিপীড়িতের পক্ষ নিয়ে উচ্চকিত হয়েছেন, তেমনি জাজাফী বাংলার মাটি ও মানুষের অব্যক্ত অনুভূতিকে প্রকাশ করতে তাঁর লেখায় বেছে নিয়েছেন শিল্পিত এক কণ্ঠস্বর।
তবে এই কণ্ঠস্বর কখনোই সরাসরি উচ্চারিত হয় না। বরং জাজাফীর লেখাগুলি তার পাঠকদের আত্মজিজ্ঞাসার পথে ঠেলে দেয়, যেখানে তারা নিজেদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাধ্য হয়।