লুই আলথুসের (Louis Althusser) মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, যার লেখা “Ideology and Ideological State Apparatuses” প্রবন্ধটি মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বে একটি অনন্য মাত্রা যোগ করে। এটি তার গ্রন্থ “On the Reproduction of Capitalism”–এর অংশ। এই লেখায় আলথুসার বিশ্লেষণ করেন রাষ্ট্র কীভাবে তার শাসনক্ষমতা বজায় রাখতে জনগণকে ভাবাদর্শের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কীভাবে শ্রেণিসংগ্রামের ভিত্তিতে সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে।
মূল তত্ত্ব ও ধারণা
১. আইডিওলজি (ভাবাদর্শ):
আলথুসেরের মতে, আইডিওলজি এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তির চিন্তা ও চেতনার গঠন করে। এটি সমাজের মধ্যে ব্যক্তি এবং তাদের স্থান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে। তবে আইডিওলজি শুধু প্রতারণামূলক নয়; এটি ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কের মধ্যে অর্থও তৈরি করে।
২. রাষ্ট্রযন্ত্র (State Apparatus):
আলথুসের রাষ্ট্রকে দুটি যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন:
- দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatuses, RSA): পুলিশের শক্তি, সামরিক বাহিনী, আদালত, এবং কারাগারের মতো যন্ত্র, যেগুলো সরাসরি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা বজায় রাখে।
- ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatuses, ISA): শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, পরিবার, সংস্কৃতি ইত্যাদি, যেগুলো মানুষকে “স্বাভাবিক” আচরণের মধ্যে রাখতে চিন্তা ও চেতনাকে প্রভাবিত করে।
৩. আইডিওলজির ইন্টারপেলেশন:
আলথুসার বলেন, আইডিওলজি মানুষের চিন্তাকে এমনভাবে “ইন্টারপেলেট” (ডাকে) বা সম্বোধন করে যে, তারা নিজেকে স্বাধীন ব্যক্তি মনে করলেও আসলে তারা শাসকশ্রেণির সেবায় নিয়োজিত।
৪. শ্রেণিসংগ্রাম:
আলথুসারের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র হলো শ্রেণি সংগ্রামের ক্ষেত্র। শাসকশ্রেণি তাদের শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য আইডিওলজি ও বলপ্রয়োগ উভয়েরই ব্যবহার করে।
আলথুসারের বইয়ের প্রভাব ও গুরুত্ব
১. মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বে নতুন মাত্রা:
আলথুসার মার্কসের তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে রাষ্ট্র ও আইডিওলজির সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বের মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে শুধু দমনমূলক হিসেবে দেখলেও আলথুসার দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র “ভাবাদর্শিক” মাধ্যমেও শাসন করে।
২. শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভূমিকা:
আলথুসার দেখান যে, শিক্ষা একটি প্রধান আইডিওলজিক্যাল যন্ত্র, যা শাসকশ্রেণির মূল্যবোধ এবং চিন্তাকে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এটি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, “যা আছে, তাই স্বাভাবিক।”
৩. স্বাধীনতার প্রশ্ন:
আলথুসারের তত্ত্ব চ্যালেঞ্জ করে যে, মানুষ আসলে কতটা স্বাধীন। তার মতে, আমাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত মূলত আইডিওলজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
১. তত্ত্বের গভীরতা ও জটিলতা:
আলথুসারের লেখার ভাষা জটিল এবং বোঝা কিছুটা কঠিন, তবে এটি গভীরভাবে সমাজের কাঠামো এবং ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।
২. সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা:
আলথুসারের তত্ত্ব এখনো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আধুনিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিভাবে জনগণকে প্রভাবিত করা হয়, তা আলথুসারের আইডিওলজির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়।
৩. সমালোচনা:
- আলথুসারের তত্ত্বে মানুষের চেতনার স্বাধীনতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, যা কিছু সমালোচকের মতে অতিরিক্ত নির্ধারণবাদী (deterministic)।
- তিনি শ্রেণিসংগ্রামের গুরুত্বের কথা বললেও, এতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সক্রিয় ভূমিকার বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা নেই।
“রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ” সমাজের গভীর কাঠামো বোঝার একটি চমৎকার তাত্ত্বিক গ্রন্থ। এটি দেখায় কিভাবে রাষ্ট্র শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং ভাবাদর্শের মাধ্যমে তার শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। বইটি পড়ার পর রাষ্ট্র, সমাজ, এবং আমাদের চেতনার নির্মাণ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
তবে, এটি বুঝতে সময় ও মনোযোগ প্রয়োজন। যারা সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, এবং মার্কসবাদী চিন্তার গভীরে যেতে চান, তাদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য।