অসহায় এক রাজার গল্প

0
20

ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের এভিনিউ ফোরে একটি চারতলা ভবনের পুরোটা জুড়ে রফিক সাহেবের অফিস দ্য আর এস গ্রুপ। সুন্দর সাজানো গোছানো। প্রথম দেখাতেই রুচিশীল মনের পরিচয় মেলে। অফিসের পরিবেশটা এতোই সুন্দর যে কর্মচারিরা বাড়িতে থাকার চেয়ে অফিসে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। রফিক সাহেব বসেন তৃতীয় তলায়। তিনি তার ডেস্কে বসেই বাইরের দৃশ্য দেখতে পান। পুরো অফিস কাঁচ দিয়ে ঘেরা। পাশেই গুলশান লেক। লেকের পাড় ঘেসে পথচারিদের জন্য সুন্দর বাঁধানো রাস্তা। সারাদিন ওই পথে অসংখ্য পথচারি চলাফেরা করে। কেউ কেউ শরীর ঠিক রাখতে হাটাহাটি করে আর কেউ অফিসে যাওয়া আসার পথ হিসেবে ব্যবহার করে। রাস্তার দুই ধারে নানা ধরনের গাছ। লেকের পানিতে ছোট ছোট নৌকা চলাচল করে। কিছুদিন হলো স্পিডবোর্ড চলাচল করছে। রফিক সাহেব আকাশ দেখতে পছন্দ করেন। এই অভ্যাসটা তার কখনোই ছিল না। কিন্তু তিনি সেটা এখন অভ্যাসে পরিণত করেছেন একজনের ভালোবাসা থেকে। সেই একজন হলো তার মেয়ে। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে রফিক সাহেবের সুখের সংসার। বড় ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরি করছেন। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য তার মেয়ে। পড়ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। মেয়েটি তার খুব আদুরে। মেয়ে না যেন তার নিজের মা সে। আদুরে গলায় বাবাকে সে মায়ের মতই শাসন করে। বাবাকে আদর করে বলে ব্যাটা রফিক। সে যখন বাবাকে এভাবে ডাকে তখন রফিক সাহেবের মনে হয় তার মা  বুঝি তার সামনেই আছে। অথচ তিনি তার মাকে হারিয়েছেন বহু বছর আগে। মেয়েটি তার মায়ের স্বভাব না পেলেও তার মধ্যে তিনি মাকে খুঁজে পেয়েছেন।

রফিক সাহেবের মাকে খুব মনে পড়ে। যখনই মায়ের কথা মনে পড়ে তখনই তিনি মেয়ের সাথে গল্প করেন। মেয়েটি যে তার মায়ের স্থান দখল করে আছে। কী সুন্দর করে তাকে ব্যাটা রফিক বলে ডাকে। আদর করে, শাসন করে। মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই আকাশ দেখতে পছন্দ করে। কে জানে হয়তো মনের মধ্যে ওই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল তার। আকাশে উড়ে যাওয়া ডানা মেলা পাখির মত সেও মুক্ত আকাশে উড়তে চায়। মেয়ের সাথে সাথে তিনিও আকাশ দেখতে দেখতে আকাশের প্রতি মুগ্ধতা জন্মেছে। আর তাই তিনি গুলশান লেকের ধারে অফিস নিয়েছেন যেন পাশে কোনা আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা এসে তার আকাশ দেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। রফিক সাহেবের অফিসে একজন এইচআর ম্যানেজার নিয়োগ দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মোতাবেক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। পদ সংখ্যা মাত্র এক কিন্তু আবেদন জমা পড়লো কয়েক হাজার। সেই সব আবেদনপত্র থেকে বাছাই করে সেরা ও যোগ্য মানুষটিকে বেছে নেওয়া দূরুহ কাজ ছিল। এ কাজে তিনি তার অফিস টিমের বাইরে তার মেয়েকেও ইনভলভ করলেন। মেয়েটির তখন ভ্যাকেশন চলছিল। রফিক সাহেব বললেন আমার অফিসে একজন এইচআর ম্যানেজার নিয়োগ দিতে চাই। এপ্লিকেশন জমা পড়েছে কয়েক হাজার। তুমি কি সেখান থেকে শর্ট লিস্ট করতে আমাকে হেল্প করতে পারবে?

বাবার কথা শুনে রিফাহ বেশ আগ্রহী হলো। তবে সে শুরুতেই বলে নিল বাবা আমি কিন্তু এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ। তবে আমি তোমাকে অবশ্যই হেল্প করতে পারবো। তার আগে আমাকে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আমি সেই আলোকে তোমার জন্য শর্ট লিস্ট তৈরি করবো। রিফাহ বাবার কাছে জানতে চাইলেন পড়াশোনা,অভিজ্ঞতা,ছেলে বা মেয়ে, সাবজেক্ট এই সব ক্রাইটেরিয়া সম্পর্কে বলো। রফিক সাহেব মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি বললেন ছেলে বা মেয়ে যে যোগ্য হবে তাকেই নেওয়া হবে। এই দিক থেকে তার কোনো আপত্তি নেই। অন্যান্য ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ভালো সিজিপিএধারী তরুণ কাউকে পেলে ভালো। এছাড়া যদি এই ক্রাইটেরিয়ার পাশাপাশি তরুন না হয়ে মধ্য বয়সীও হয় এবং অন্য কোথাও জবের এক্সপেরিয়েন্স থাকে তাহলে আরও ভালো। তাছাড়া শুধু অফিসের কাজ নয় বরং দেখতে চাই প্রার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিস কেমন ছিল। সারাজীবন পড়াশোনাই করেছে নাকি আরও কিছু করেছে। বাবার কথা মত অসংখ্য সিভি থেকে বাছাই করে রিফাহ তার বাবাকে ৫০ জনের সিভি আলাদা করে দিল এবং বললো বাবা এই সিভিগুলো তোমার টিমকে দিতে পারো এবং তারা চাইলে এখান থেকে আরও শর্টলিস্ট তৈরি করতে পারবে। তাহলে ইন্টারভিউ নিতে সুবিধা হবে।

মেয়ের কথা মত বাছাইকৃত সিভিগুলো তিনি তার টিমকে দিলেন এবং যদি আরও শর্ট করা প্রয়োজন হয় তবে তা করতে বললেন। টিম সেগুলো থেকে বাছাই করে ১৫ জনকে রাখলেন। এই ১৫ জন সব দিক থেকে এগিয়ে। নির্ধারিত প্রার্থীদেরকে ফোনে ইন্টারভিউয়ের ডেট জানিয়ে দেওয়া হলো। রফিক সাহেব তার মেয়েকে বললেন সে চাইলে ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকতে পারে। তাহলে সে যে সব সিভি বাছাই করেছিল সেই সব প্রার্থীরা আসলে কতটা যোগ্য তা বুঝতে পারবে। ভবিষ্যতের জন্য একটা অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। কিন্তু রিফাহ তাতে রাজি হয়নি। তাছাড়া তার ক্লাসও শুরু হয়ে যাবে। অন্যদিকে রফিক সাহেব জানেন তার ছেলেকে বলে কোনো লাভ নেই। কেননা ছেলেটার ছুটি নেই।

মার্চের ২১ তারিখে ইন্টারভিউ ডেট। সেদিন সকাল সকাল অফিসে চলে আসলেন। প্রার্থীদের কেউ কেউ তারও আসার আগেই উপস্থিত হয়ে গেছে। এটি তাকে বেশ মুগ্ধ করলো। সময়জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরী। আজকালকার ছেলে মেয়েদের সময়জ্ঞান খুবই কম। ১০টায় আসতে বললে তারা আসে বারটায়। একে একে ১৪ জন প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিলেন। চমৎকার সব প্রার্থী বাছাই করেছে তার মেয়ে। মেয়েটি যদি এই বোর্ডে উপস্থিত থাকতো তবে খুশি হতো। যখনই যার ইন্টারভিউ নিয়েছেন মনে হয়েছে একেই নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু লোক লাগবে মাত্র একজন তাই পছন্দ হলেও সবাইকে নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রার্থীরাও অবাক হয়ে দেখেছে অন্য সব অফিসের ইন্টারভিউয়ের সাথে দ্য আর এস গ্রুপের ইন্টারভিউ সম্পূর্ণ আলাদা। রফিক সাহেব গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে প্রার্থীদের প্রশ্ন করেছেন। তাদের ভিতরটা দেখতে চেয়েছেন। যেমন একজনকে প্রশ্ন করলেন আপনি কি সুখী? আরেকজনকে প্রশ্ন করলেন আপনি কি সফল? অন্যান্য প্রশ্নে যাওয়ার আগে প্রত্যেক প্রার্থীকে এই ধরনের কিছু প্রশ্ন করে তার মনের মধ্যে ঢুকতে চেষ্টা করলেন।

একে একে ১৪ জনের ইন্টারভিউ শেষ হলে শেষ প্রার্থীর ডাক পড়লো। প্রার্থী যখন রুমে ঢুকলেন তখন রফিক সাহেব কফির পেয়ালাতে চুমুক দিচ্ছেন। তার কফি খেতে ভালো লাগে। তারই মত তার কন্যাও কফি পছন্দ করেন। টেবিলে একটা ফটো ফ্রেমে পরিবারের সবার ছবি আছে। মেয়েটি যখন ক্যাডেট কলেজ পড়তো তখনকার এক প্যারেন্টস ডেতে এই ছবিটা তোলা। ছবিটা তার খুবই পছন্দ। সে কারণেই অফিসের টেবিলের এক দিকে রেখে দিয়েছেন। ছবির দিকে তাকালেই তার মনে হয় এইতো ওরা আমার সাথেই আছে। শেষ প্রার্থী একজন মেয়ে। বয়স ৩৮ বা ৩৯ হবে। কালো বোরখা পরা তবে মুখ খোলা। ভেতরে আসার অনুমতি চেয়ে সালাম দিতেই রফিক সাহেব তাকে আসতে বললেন এবং সামনে রাখা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। অন্যান্য প্রার্থীদের মতই তাকেও চা বা কফি কি খাবে জানতে চাইলেন। ভদ্রমহিলা বললেন এখন চা বা কফি খেতে চান না। ইন্টারভিউ বোর্ডে আরও চারজন কর্মকর্তা ছিলেন যাদের একজন মেয়ে। তবে প্রশ্ন যা করার প্রায় সবটাই রফিক সাহেবই করলেন। শেষ প্রার্থীর নাম সাদিয়া আক্তার। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। সিজিপিএ ৩.৮ । এমবিএতে মেজর ছিল এইচআরএম। এর আগে নেসলে বাংলাদেশ এবং বেঙ্গল গ্রুপে এইচআরে কাজ করেছেন। বিয়ের পর সংসার ও সন্তান সন্ততি নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় চাকরি আর কন্টিনিউ করা হয়নি। স্বামী সরকারি চাকরিজীবী বিধায় দেশের নানা প্রান্তে পোস্টিং নিয়ে যেতে হয়। রফিক সাহেবের হাতে তার সিভি ও কভার লেটার। সেখানেই টুকিটাকি নানা তথ্য মেয়েটি দিয়ে রেখেছে। অন্য প্রার্থীদের সিভির সাথে কভার লেটার ছিল না। নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসলেন সাদিয়া আক্তার। সাথে করে আনা সার্টিফিকেট ও অভিজ্ঞতার অন্যান্য ডকুমেন্ট সহ ফাইলটি এগিয়ে দিলেন। রফিক সাহেব তাকে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন সেটা সাদিয়া আশাও করেনি। রফিক সাহেব জানতে চাইলেন আপনি এই চাকরিতে বেতন কত টাকা আশা করছেন? সাদিয়া আক্তার একটু সময় নিলেন। ভাবলেন তিনিতো দীর্ঘদিন সার্ভিস গ্যাপে আছেন। এই সময়ে টানা চাকরি করলে তার বেতন হয়তো লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘদিন চাকরি করেননি তাই অতো বেশি চাওয়া ঠিক হবে না। তিনি কয়েক মুহুর্ত ভেবে নিয়ে বললেন আমি মূলত আপনার প্রতিষ্ঠানের বেতন স্কেল অনুযায়ি পেলেই খুশি। তবে আপনি যেহেতু আমার মতামত জানতে চেয়েছেন তাই আমার চাওয়া ৭৫ হাজার টাকা।

রফিক সাহেব অবশ্য চমকালেন না। কারণ মেয়েটি যা বেতন আশা করছে তার প্রতিষ্ঠানে এইচআর ম্যানেজারের বেতন অনেকটা সেরকমই। তিনি বুঝলেন মেয়েটি এখানে আসার আগেই বেশ স্টাডি করে নিয়েছে দ্য আর এস গ্রুপ সম্পর্কে। ফলে শুরুতেই সে প্রতিষ্ঠানের বেতন কাঠামো অনুযায়ি বেতন পেলেই খুশি হবে জানিয়ে তারপর নিজের চাহিদার কথা বলেছে। দুটোর মধ্যে বেশ ব্যালেন্স রেখেছে। স্কুল কলেজ জীবনের গল্প করার পর রফিক সাহেব জানতে চাইলেন বই পড়া ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও মেয়েরা নানা বিষয়ে খেলাধুলাও করে থাকে। যেমন জোবেরা রহমান লিনু টেবিলটেনিস খেলে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে। আপনি কি কোনো খেলাধুলা পছন্দ করেন? মেয়েটি বললো স্যর আমি দাবা খেলা খুব পছন্দ করি। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় দাবা চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিয়েছি। যদিও বিজয়ী হতে পারিনি কখনো। মেয়েটির সরল জবাব বোর্ডের সবাইকে মুগ্ধ করলো। ইন্টারভিউতে মূলত প্রার্থীরা চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক মিথ্যা কথাও বলে। মেয়েটি চাইলে বলতেই পারতো সে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নশীপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

রফিক সাহেব মেয়েটির সত্যবাদীতায় মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন দাবা একটি বুদ্ধির খেলা। যার বুদ্ধি ও চিন্তার ব্যাপ্তি বেশি সে ততো সুবিধা করতে পারে। যেহেতু আপনি দাবা খেলতে পছন্দ করেন তাই এখন বলুন দাবার কোন গুটিটি আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সাদিয়া এই প্রশ্নটি শুনেও একটু অবাক হলো। নিজে দীর্ঘদিন দাবা খেললেও কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি যে কোনো একটি নির্দিষ্ট গুটি প্রিয় হতে পারে। সাদিয়া আক্তার নামের শেষ প্রার্থী কয়েক সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলেন  আমার মন্ত্রী পছন্দ। রফিক সাহেবও জানেন দাবার কোর্টে মন্ত্রীর পাওয়ার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তিনি প্রার্থীর যুক্তি বুঝার জন্য বললেন আমারতো মনে হয় ঘোড়ার চাল সবচেয়ে অনন্য। রফিক সাহেবের সাথে প্রার্থীও একমত হয়ে বললেন হ্যাঁ ঘোড়ার চাল অনন্য কিন্তু মন্ত্রীর মধ্যে সব গুনাগুণ আছে এবং সে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। সে তীর্যক ভাবে যেমন চলতে পারে তেমনি সরাসরিও চলতে পারে। যখন প্রয়োজন হয় সে রাজার ঢাল হয়ে দাড়ায়। তাছাড়াও বলা চলে সেই সেনা প্রধান। সাদিয়া আক্তারের কথা শুনে রফিক সাহেব আরও একবার মুগ্ধ হলেন। তিনি জানতে চাইলেন সাদিয়া আপনি তাহলে রাজাকে কিভাবে দেখছেন? যেহেতু মন্ত্রীকে অনেক ক্ষমতাশালী বললেন।

এই প্রশ্নে অবশ্য সাদিয়া আক্তারকে ভাবতে হলো না। তিনি বললেন দাবা খেলায় আমার কাছে রাজাই সবচেয় দুর্বল মনে হয়। সে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না। কারণ সে মাত্র একঘর পযর্ন্ত সরতে পারে। ফলে তাকে মন্ত্রী ও অন্যান্যদের উপর নির্ভর করতে হয়। রফিক সাহেব এবার মোক্ষম একটি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি জানতে চাইলেন মনে করুন আমাদের জীবনটা একটা দাবার কোর্ট। এই কোর্টে অনেক গুলো গুটি আছে যাদের শক্তি ও ক্ষমতা আলাদা। আপনি নিজে যদি এই কোর্টের একটি গুটি হয়ে থাকেন তবে নিজেকে কোন গুটি হিসেবে দেখেন? রফিক সাহেব লক্ষ্য করলেন এই প্রশ্ন শুনে সাদিয়া নামের প্রার্থীর চোখটা ছলছল করে উঠলো। কন্ঠটা কিছুটা কেঁপে উঠলো। তারপর বললো আমি নিজেকে রাজা হিসেবে দেখি।

রফিক সাহেব অবাক হলেন। যে মানুষ রাজাকে কোর্টের সবচেয়ে দুর্বল মনে করে সেই মানুষ কিভাবে নিজেকে রাজা দাবী করে? তিনি আগ্রহ নিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে  মেয়েটি তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করলো। বাস্তব জীবনে তিনি একজন রাজার মতই ছিলেন। দুর্বল,এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য তার পাশে সব সময় একজন শক্তিশালী মন্ত্রী ছিল। সেই মন্ত্রী আর কেউ না তার স্বামী। যে তাকে সব সময় রক্ষা করতেন। কিন্তু এক রোড এক্সিডেন্টে তার জীবনটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। তার স্বামী মারা গেছে। আর সে কারণেই এই চাকরিটা তার দরকার। তাকে যে রক্ষা করার মত আর কেউ নেই। বরং রাজা হয়েও তাকেই এখন সন্তান পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। ভয় পেলেতো চলবে না। যখন আপনি একটি নৌকার যাত্রী হিসেবে নদী পার হবেন তখন আপনার কোনো চিন্তা থাকবে না কারণ নৌকাটিতে একজন মাঝি আছে যে আপনাকে নিরাপদে অন্যপারে নিয়ে যাবে। কিন্তু কোনো কারণে যদি সেই নাবিক পড়ে যায় বা না থাকে তখন আপনাকে বাঁচতে হলে নিজেই হাল ধরতে হবে। যদিও আপনি আগে কখনো হাল ধরেননি। সাদিয়া বলতেই থাকে আর বোর্ডের সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে। তারপর আরও কিছু বিষয়ে আলাপ হওয়ার পর ইন্টারভিউ পর্ব শেষ হয়। প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হয় ফলাফল হলে সবাইকে জানানো হবে।

ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে দুপুর পেরিয়ে যায়। রফিক সাহেব নামাজ ও দুপুরের খাবার খাওয়ার আগেই মেয়েকে ফোন করেন। ওপাশ থেকে রিফাহ ফোন রিসিভ করে বাবার কন্ঠ শুনেই কিছুটা অনুমান করতে পারে। সে বাবা কিছু বলার আগেই বলে ওঠে বাবা আমি বোধহয় অনুমান করতে পারছি তুমি ইন্টারভিউ থেকে কাকে সিলেক্ট করেছ বা করতে চাইছো। মেয়ের এমন কথা শুনে রফিক সাহেব বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন ঠিক আছে বল দেখি কাকে নিতে চাইছি। আর তুই এতোটা  নিশ্চিত কিভাবে যে তোর প্রেডিকশন ঠিক হবে? তাছাড়া তোর বাছাই করা ৫০ জনের তালিকা ছোট করে ১৫ জন করা হয়েছিল। এমনওতো হতে পারে যে তোর অনুমান করা প্রার্থী আগেই বাদ হয়ে গেছে।

বাবার কথায় যুক্তি আছে। রিফাহ তাই বললো বাবা তোমার কথায় যুক্তি আছে। তবে যদি সেই বাছাই করা তালিকার মধ্যে আমার অনুমান করা প্রার্থীর সিভি থেকে যায় তাহলে তারই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রফিক সাহেব বললেন তাহলে বলতো তার নাম কী? রিফাহ বললো সাদিয়া আক্তার! বাড়ি রাজশাহীর জেলার পবা উপজেলাতে। তবে স্বামী সন্তান সহ সে রাজশাহী শহরের শ্রীরামপুর রাজপাড়া রেলওয়ে কলোনীতে। রফিক সাহেব তার হাতে থাকা সাদিয়া আক্তারের সিভি চেক করে দেখলো বর্তমান ঠিকানা এবং স্থায়ী ঠিকানা সবটাই মেয়ের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে। রফিক সাহেব জানতে চাইলেন কিভাবে তুই এটা বুঝলি? বাবার এই কথার উত্তর দেওয়ার আগে রিফাহ বললো বাবা তুমি ওনার সিভিটা হাতে নিয়ে দেখো পেছনে আমি আমার সিগনেচার দিয়ে কিছু লিখেছি। মেয়ের কথা মত রফিক সাহেব পাতা উল্টে দেখলেন সত্যি সত্যিই সেখানে রিফাহ সিগনেচার সহ একটি নোট দিয়েছে। প্রিয় বাবা যদি কোনো ভাবে আমার এই লেখাটা তোমার চোখে পড়ে তবে তুমি অবশ্যই তাকে নিয়োগ দিতে চেষ্টা করো। যদি সে অন্য প্রার্থীদের চেয়ে একটু কম যোগ্য হয় তবুও। কী আশ্চর্য এই লেখাটা তার চোখে পড়েনি। অবশ্য সিভির উল্টো পিঠতো তার দেখার কথা না। সুতরাং চোখেও পড়ার কথা না। এবার রফিক সাহেব জানতে চাইলেন তুই কেন এবং কি কারণে তার সিভিতেই এরকম একটা কথা লিখে রেখেছিলি? যদিও তুই না বললে ওটা আমার চোখেও পড়তো না।

রিফাহ তখন বললো বাবা ওনার সিভি দেখার সাথে সাথেই আমি ওনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আমার রুম মেট জুই আলিয়ানা নামে একটি ছোট্ট মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতো। একদিন জুঁই আর আমি নভো থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম। দেখার পর জুঁই বললো এখানেই রেলওয়ে কলোনীতে আমি প্রাইভেট পড়াই। চল আজ আমার সাথে। আমি বললাম আমি গিয়ে কি করবো? সে নাছোড় বান্দা। আমাকে সাথে যেতেই হলো। আলিয়ানাই মূলত সাদিয়া আক্তারের মেয়ে। সেদিন গিয়ে পুরো এক ঘন্টা ওনাদের সাথে গল্প করে এসেছিলাম। তারপর মাঝে মাঝেই আমাকে যেতে বলতো যদিও আর যাওয়া হয়নি। ওনার স্বামী যেদিন একসিডেন্ট করে মারা যান সেদিন  আমরা ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরছিলাম। আমার সাথে জুঁইও ছিল। হঠাৎ ওর ফোন এলো। ফোন রিসিভ করতেই জুঁইয়ের চোখে পানি চলে আসলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাড়িতে কারো কোনো সমস্যা কি না। পরে জানতে পারলাম আলিয়ানার বাবা এক্সিডেন্ট করে মারাগেছে। আমাদের হাসপাতালেই নিয়ে আসা হয়েছিল।আমি আর জুঁই সংবাদ পেয়ে হোস্টেলে না গিয়ে সোজা হাসপাতালে গিয়েছিলাম । সারাটা সময় ওনাকে দেখেছি এবং চেহারা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

তারপর যখন সিভি বাছাই করার জন্য আমাকে প্রস্তাব দিলে তখন সিভি দেখতে দেখতে ওনার সিভিতে চোখ আটকে গেলো। সিভিতে যেহেতু ছবি ছিল তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। ওনার অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল চাকরিটা ওনারই বেশি দরকার। ওনার সিভির পিছনে রেকমেন্ড করার পর ভেবেছিলাম তোমাকে ফোনে বলবো কিন্তু রুটিন ক্লাসের চাপে সব ভুলে গেছি।

রফিক সাহেব মেয়ের কাছ থেকে সব শুনে তাকে বললেন তোর রেকমেন্ড ছাড়াই সে তার নিজ যোগ্যতায় ইন্টারভিউ বোর্ডকে সন্তুষ্ট করেই চাকরিটা পাচ্ছে। যদিও অফিসিয়ালি জানানো হয়নি কিন্তু তোর সাথে কথা বলে বিষয়টা একেবারে ফাইনাল করে নিলাম। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছিল দেখে রিফাহ তখনই বাবার সাথে কথা শেষ করলো। মেয়ের সাথে কথা বলে রফিক সাহেবও নিশ্চিন্ত হলেন। বাবা মেয়ের ভাবনার কত মিল। অবশ্য বাবা মেয়ে না বলে উল্টো  মা ছেলেও বলা যেতে পারে। রিফাহতো বাবাকে ব্যাটা রফিক বলেই ডাকে মাঝে মাঝে। মনে হয় যেন নিজের মা তার ছেলেকে ডাকছে।

সেদিন ক্লাস শেষ করে জুঁই আর রিফাহ হোস্টেলে ফিরছিল। রিফাহ জুঁইকে বললো জানিস আমি সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার পেয়েছি। তোকে আমি এখন একটা ভবিষ্যৎবাণী করবো দেখবি সেটা সত্যি হবে। তবে সমস্যা হলো আমার বলা কথাটাতে একটা গুড নিউজ থাকবে আর একটা ব্যাড নিউজ থাকবে। আর ব্যাড নিউজটা তোর জন্য। তাই তোর কথা ভেবে খানিকটা খারাপও লাগছে। জুঁই আবার প্রেম করে জিসান নামে একটা ছেলের সাথে।বুয়েটে পড়ে ছেলেটা। ব্যাড নিউজের কথা শুনে জুইয়ের মনে প্রথমেই জিসানের ভাবনা আসলো। তার মুখটা চুপসে গেল। তারপরও সেটা আড়াল করে জুঁই হেসে হেসে বললো তুই ডাক্তারী পড়া বাদ দিয়ে কবে থেকে অ্যাস্ট্রোলজি চর্চা শুরু করলি? তাহলে কি ফোনে ইদানিং যে অদৃশ্য ভূতের সাথে চ্যাট করিস এগুলো তার আছর নাকিরে? জুঁইয়ের কথায় রিফাহ নিজেও হেসে উঠলো। তারপর বললো এই সপ্তাহের মধ্যেই তোর টিউশন চলে যাবে। জুইয়ের ওই একটাই টিউশনী । সেটা চলে গেলে ওর বেশ কষ্টই হবে। অবশ্য কয়েকটা পরিবার ওকে বলে রেখেছে ফ্রি হলে যেন তাদের বাচ্চাকে পড়ায়। মেডিকেলে এতো পড়ার চাপে একটার বেশি দুটো পড়ানো সম্ভব হয় না বলে সে কখনো কাউকে কথা দেয়নি। আলিয়ানার টিউশনীটা চলে গেলে তার টিউশনী পেতে বেশি বেগ পেতে হবে না। কিন্তু কথা হলো আলিয়ানার টিউশনীটা যাওয়ার মত তো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তখন সে রিফার কাছে জানতে চাইলো কিভাবে টিউশনী যাবে শুনি? তখন রিফাহ বললো কারণ এক সপ্তাহের মধ্যেই আলিয়ানার আম্মুর চাকরি হবে আর তার পোস্টিং হবে গুলশান। জুই ভাবলো রিফাহ ইয়ার্কি করতেছে। কিন্তু রুমে ফেরার পর সত্যি সত্যিই জুইয়ের কাছে ফোন আসলো। আলিয়ানার আম্মু জানালো তার নতুন চাকরি হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই পরিবার সহ তাকে ঢাকায় শিফট করতে হবে। শুনে একই সাথে জুই বেশ চমকে উঠলো। রিফাহ তখন ফোনের দিকে তাকিয়ে কোনো এক ভূতের সাথে চ্যাট করছে আর মিটমিট করে হাসছে। নিজের বিছানায় বসে জুই তার বন্ধু ও রুমমেট রিফাহর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছে রিফাহ কিভাবে জানলো আলিয়ানার আম্মুর চাকরি হবে? কিছুক্ষণের মধ্যেই রিফাহ টের পেলো তার কাঁধে জুই হাত দিয়ে তাকে ধাক্কাচ্ছে। ওর দিকে মুখ ফেরাতেই জুই তার হাতটা রিফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো দেখতো জিসানের সাথে আমার বিয়েটা হবে কি না? রিফাহ তখন দুষ্টুমীর ছলে ওর হাতটা ভালোভাবে দেখে বললো নারে তোর জিসানের সাথে বিয়ে হবে না। সেদিন সারা রাত জুইয়ের ঘুম হলো না। কতবার জিসান ওকে ফোন করলো কিন্তু ও ফোন রিসিভই করলো না। মেসেজের উত্তরও দিলো না। জুইয়ের বিশ্বাস রিফাহ যেহেতু বলেছে ঠিকই বলেছে। কারণ রিফাহ সব সময়ই সঠিক।

৮ জুলাই ২০২৫