একজন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেন

ওল্ড ট্রাফোর্ডের দেয়ালগুলো আজও রাতে ফিসফিস করে বলে  এখানে একসময় রাজত্ব করতেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেন। রক্ত দিয়ে লেখা এক কিংবদন্তি।

0
90

চলুন গল্পে গল্পে ফিরে যাই পুরোনো দিনে। ১৯৯০ সালের জানুয়ারির আকাশে কুয়াশার ঘন আবরণ। শীতের এক সন্ধ্যা। নটিংহ্যাম ফরেস্টের স্টেডিয়াম সেদিন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। গ্যালারি জ্বলে উঠেছিল আশঙ্কা আর অপেক্ষায়। যেন হাজার হাজার চোখের সামনে লেখা হতে চলেছে একটি রক্তাক্ত রায়। অ্যালেক্স ফার্গুসেন তখনো স্যার উপাধী পাননি। সেটি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক বছর। সেই সময়ে তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ। সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথার ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি জানেন, আজ হারলে সব শেষ। শুধু একটি ম্যাচ নয়, তার স্বপ্ন, তার যুদ্ধ, তার আত্মার লড়াই  সব শেষ। কেননা বার বার পরাজিত হতে হতে এমন হয়ে গিয়েছিল যে তাকে ছাটাই করার আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পেছনের গ্যালারিতে ইউনাইটেড সমর্থকরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। কিন্তু তাদের চিৎকারে ভেসে আসে এক অদৃশ্য আতঙ্ক। “Fergie Out! Fergie Out!”

এই আওয়াজ যেন পেরেক ঠুকে দিচ্ছিল তার সাহসে। মাঠের মধ্যে নটিংহ্যাম ফরেস্ট আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তীব্র বেগে। ফার্গুসেনের ইউনাইটেড কোনো ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিরোধ করছে। মাঠের বাতাস ভারী, যেন শ্বাস নেওয়াও কঠিন। প্রতিটি পাসে, প্রতিটি দৌঁড়ে, সময় যেন তামার মত ভারী হয়ে পড়ে। তারপর… এক মুহূর্তের বিদ্যুৎঝলক। একটি স্মরণীয় পাস… একটি নিঃশ্বাস আটকে রাখা দৌড়…। মার্ক রবিন্স — তরুণ, অনেকটাই অচেনা। বল পেয়ে ছুটলেন। সমস্ত গ্যালারি দাঁড়িয়ে পড়লো, সময় থমকে গেল। তার পায়ের স্পর্শে বলটি নটিংহ্যামের গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে জালে ঢুকে গেল। গোল! একটি নিস্তব্ধ বিস্ফোরণ। গ্যালারিতে যেন একসঙ্গে বয়ে গেলো বিস্ময়ের ঢেউ। কিছু সমর্থক চিৎকার করে কাঁদছিল, কিছু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ফার্গুসেনের ঠোঁট নড়লো না, হাত তুললেন না। শুধু চোখের কোণে একটা অদৃশ্য অশ্রুবিন্দু চকচক করে উঠলো। ভেতরে ভেতরে তিনি যেন নিজেই নিজেকে বললেন, “আমি বেঁচে গেছি।”

কিন্তু যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। বল নিয়ন্ত্রণে রাখতে, প্রতিটি মিনিটে প্রতিপক্ষের ধাক্কা সামলাতে
দলকে মরিয়া হয়ে লড়তে হলো। সময়ের প্রতিটি কাটা যেন বুকে ছুরি চালাচ্ছিলো। শেষ বাঁশি বাজলো। ১-০ গোলের জয়। ছোট্ট এক সংখ্যা, কিন্তু ফার্গুসেনের জীবনে একটি মহাকাব্য। সেই রাতে, নটিংহ্যামের ঠান্ডা বাতাসে অদেখা অশ্রু ঝরেছিল, আকাশের তারাগুলো ফিসফিস করে বলেছিল, “ইতিহাস বেঁচে গেছে।” সেই গোল, সেই রাত আজও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতিটি হৃদয়ে রক্তের মতো বয়ে চলে। আজও ফুটবল জানে,কখনো কখনো, একটি মাত্র মুহূর্তই বদলে দিতে পারে কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যত।

জীবন যখন মৃত্যুর কিনারে দাঁড়িয়ে, তখনই সে সবচেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নটিংহ্যামে সেই অলৌকিক রাত্রির পরও যুদ্ধ শেষ হয়নি। কেবলতো শুরু। ম্যাচের পরের দিনগুলোয় ফার্গুসেনের চেহারায় ছিল এক অদ্ভুত পরিবর্তন। চোখ দুটোয় জ্বলে উঠেছিল বাঁচার এক অদম্য আগুন। দলকে তিনি চুপিসারে নতুন করে গড়তে শুরু করলেন, মনের ভেতর প্রতিটি খেলোয়াড়ের ওপর আঁকা হলো অদৃশ্য এক যুদ্ধচিত্র।

তারপর এলো সেই দিন । ১৯৯০ সালের FA Cup ফাইনাল। ওয়েম্বলির ঐতিহাসিক ময়দান। আকাশ ধূসর। মৃদু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে টানটান এক অজানা স্নায়ুযুদ্ধ। গ্যালারির সাদা-লাল পতাকাগুলো বাতাসে লাফাচ্ছে,হাজার হাজার কণ্ঠস্বর মিশছে এক বিশাল সমুদ্রে। কখনো আনন্দের ফোয়ারা, কখনো আশঙ্কার নিঃশ্বাস। তাদের প্রতিপক্ষ সেদিন  ক্রিস্টাল প্যালেস। অবজ্ঞা করা সহজ, কিন্তু আজ তারা এসেছে খুনের নেশায়। প্রথম সাইরেন বাজলো। খেলা শুরু। ক্রিস্টাল প্যালেস যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউনাইটেডের ওপর। গোলের পর গোল। প্রত্যাঘাতের পর প্রত্যাঘাত। ফার্গুসেন দাঁড়িয়ে, চোখ দুটো তীক্ষ্ণ, এক মুহূর্তের জন্যও না কাঁপা। তার মন যেন প্রতিটি পাস, প্রতিটি ফাউল, প্রতিটি দৌড়ে মিশে গেছে।

প্রথমার্ধ শেষ। স্কোর সমান। গ্যালারির ভেতর চাপা উত্তেজনা। সমর্থকদের মুখে চুপচাপ প্রার্থনা। ওয়েম্বলির বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে। সময় গড়িয়ে দ্বিতীয়ার্ধ চলে এলো। হঠাৎ করেই ক্রিস্টাল প্যালেস এগিয়ে যায়। হাজার হাজার গলা থেকে বেরিয়ে আসে বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস। ফার্গুসেনের মনে আবারো বেজে ওঠে সেই পুরোনো ভয়।”সব হারিয়ে যাবে?” কিন্তু ভয়ই যদি হয় শেষ কথা, তবে বীরত্বের দাম কোথায়? তিনি বেঞ্চ থেকে ডেকে আনলেন মার্ক হিউজেস, ব্রায়ান রবসনকে। তার দুই সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই উত্তাল সময়ে ইউনাইটেডও ফিরিয়ে দিল এক সমান শক্তির আঘাত। স্কোর সমান হলো। সময় শেষ। ম্যাচ গেল রিপ্লেতে। ফার্গুসেন এবার তার হৃদয়ের মাটি কেটে তৈরি করলেন নতুন রণকৌশল। দলে আনলেন এক সাহসী পরিবর্তন। লেস সিলি গোলরক্ষক হিসেবে বদলি নামালেন।ডিফেন্সের প্রাণপণে লড়াই। ওয়েম্বলির আকাশ সেদিন একেবারে উজ্জ্বল নীল। সূর্যের সোনালি আলো যেন ঘোষণা দিচ্ছিল নতুন আশার।

মাঠে তখন কেবল একটি কথা লেখা”জয় চাই”। লি মার্টিন। যিনি সচরাচর গোলের ধারেকাছেও আসেন না। তিনি এগিয়ে গেলেন, পায়ের ছোঁয়ায় বলকে উড়িয়ে দিলেন আকাশে। নিমেষে বল ঢুকে গেল প্রতিপক্ষের জালে! ১-০। সমস্ত গ্যালারি কেঁপে উঠলো। আনন্দে, চোখে জল, মুখে উল্লাস। ফার্গুসেন দাঁড়িয়ে, দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের দিকে তাকালেন। এ যেন শুধু একটি গোল নয়, এটি তার নিজের পুনর্জন্মের ডাক। শেষ বাঁশি বাজল। ইউনাইটেডের ছেলেরা ছোটে, লাফায়, কান্না করে। কেউ মাঠে পড়ে থাকে, কেউ গ্যালারির দিকে হাত তোলে। স্যার অ্যালেক্স ধীরে ধীরে মাঠের কেন্দ্রে আসেন। মাথা নিচু, ঠোঁটের কোণে এক ধীর অম্লান হাসি। যেন বলছেন: “আমি পড়ে যাইনি। আমি রক্ত দিয়ে আমার গল্প লিখেছি।”

যারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে, ভাগ্য তাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়। আর ইউনাইটেডের ইতিহাসে অমর হয়ে যান একজন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেন। যিনি পরাজয়ের কিনার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গড়েছিলেন ফুটবলের সবচেয়ে মহাকাব্যিক সাম্রাজ্য। ওয়েম্বলির সেই রাতে যখন শেষ বাঁশি বেজে উঠেছিল, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেন একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সব উল্লাসের মাঝখানে তার চোখের মধ্যে তখনো চলছিল এক নীরব ঝড়। অনেকের জন্য হয়তো সেই জয় ছিল এক ট্রফি। কিন্তু ফার্গুসেনের জন্য? এ ছিল কেবল শুরু। এক বিশাল যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি।

সময়ের ধুলো ঝেড়ে নতুন ইতিহাস রচনার অভিযান শুরু হলো। ওল্ড ট্রাফোর্ডের করিডোরগুলোয় সেই সময় এক অদৃশ্য উত্তেজনা ভাসছিল। চেয়ারম্যানের রুম থেকে ড্রেসিং রুম পর্যন্ত,সবার মনে এক প্রশ্ন:”এই মানুষটা কি আমাদের আবার গৌরবের দিন ফিরিয়ে আনতে পারবে?” ফার্গুসেন জানতেন, মেরামত নয়, দরকার পুরোপুরি নতুন করে নির্মাণ।


তিনি একে একে সাবধানী কৌশলে পুরনো, ক্লান্ত সৈনিকদের বিদায় দিলেন। যারা আর যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিতে পারতো না, তাদের চোখে সম্মান রেখেই মুক্তি দিলেন। গোটা ইউনাইটেডের শরীরে তখন নতুন শিরা-উপশিরা জোড়া লাগানো হচ্ছিল। আলো-আঁধারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিল এক বিপ্লবের পদধ্বনি।

তারপর শুরু হলো স্বর্ণযুগের ছেলে খোঁজার যাত্রা। নরম সকালবেলায়, ভিজে ঘাসের মধ্যে, কুয়াশার চাদরে মোড়া প্রশিক্ষণ মাঠে এক ঝাঁক তরুণ ছেলেরা দৌড়াচ্ছিল প্রাণপণে। তাদের চোখে ছিল স্বপ্নের দীপ্তি, পায়ে ছিল বিদ্যুৎ। সেই দলে ছিল রায়ান গিগস। যেন বাতাসের সন্তান, ডানায় ভর করে উড়ে যান মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ডেভিড বেকহাম যার ডান পায়ে ছিল যাদুর ছোঁয়া, নিখুঁত ক্রস, অব্যর্থ ফ্রি-কিক। পল স্কোলস মাঠের নিরব জাদুকর, যিনি নিঃশব্দে বদলে দিতেন খেলার গতিপথ। গ্যারি ও ফিল নেভিল দুই ভাই, যেন রক্তের সম্পর্ক দিয়ে বাঁধা দুটো নির্ভরতার দুর্গ। নিকি বাট পাথরের মত কঠিন, যুদ্ধক্ষেত্রের এক অমোঘ সৈনিক। ফার্গুসেন তাদের গড়ছিলেন নিজের হাতের ছাঁচে। প্রতিদিন, প্রতিটি অনুশীলনে, তিনি তাদের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছিলেন লড়াইয়ের নেশা, পরাজয়ের ঘৃণা, আর জয়ের ক্ষুধা।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যুবকরা একে একে ঘোষণা দিলো নিজেদের আগমন। তারা কোনো সাধারণ প্রজন্ম ছিল না। তারা ছিল “Class of ’92″। ইতিহাসের পাতায় জ্বলন্ত সোনালী অক্ষরে লেখা এক নাম। পেছনে ফার্গুসেন দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। গভীর চোখে, নীরব ঠোঁটে  যেন একজন কৃষক দেখছে কীভাবে তার হাতে বোনা বীজ ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসছে রাজকীয় ফসল।

রাজত্ব শুরু হলো। ১৯৯৩ সালে অপেক্ষার অবসান হলো। ২৬ বছরের খরা ভেঙে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইংলিশ লিগে চ্যাম্পিয়ন হলো। ওল্ড ট্রাফোর্ডের আকাশ ফেটে গেল উল্লাসে। লাল পতাকাগুলো সেদিন কেবল কাপড়ে নয়, প্রতিটি হৃদয়ের ভেতরেও উড়ছিল। ফার্গুসেন দাঁড়িয়ে ছিলেন দলবল নিয়ে, কিন্তু তার চোখে ছিল এক মৃদু, অদৃশ্য বিষণ্ণতা
কারণ তিনি জানতেন, এটি শেষ নয়; এটি কেবল শুরু। পরের বছরগুলোয় তিনি একের পর এক শিরোপা জিতলেন  প্রিমিয়ার লিগ, FA Cup, লিগ কাপ, এবং অবশেষে ১৯৯৯ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে গড়লেন “ট্রেবল” এক সাথে তিনটি বড় ট্রফি। এমন কীর্তি যা তখন পর্যন্ত ইংলিশ ফুটবলে ছিল স্বপ্নেরও অতীত। এবং এভাবেই একজন স্কটিশ যুবক, যিনি চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন,যিনি এক রাতে তার ক্যারিয়ার বাঁচিয়েছিলেন এক তরুণের পায়ে ভর করে,তিনি গড়ে তুললেন এক কিংবদন্তী সাম্রাজ্য। যার শীর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি পরিণত হলেন ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কোচ। ওল্ড ট্রাফোর্ডের দেয়ালগুলো আজও রাতে ফিসফিস করে বলে  এখানে একসময় রাজত্ব করতেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসেন। রক্ত দিয়ে লেখা এক কিংবদন্তি।

লেখা: জাজাফী (গল্পকার)

www.zazafee.com