মাছে ভাতে যেমন বাঙ্গালী, তেমনি অতিথি পরায়ন হিসেবেও বাঙ্গালীর সুনাম আছে।ইতিহাস বেশ পুরোনো।ইবনে বতুতা কিংবা তারও আগে যারা এই বাংলায় এসেছেন তারা এদেশের মানুষের অতিথিপরায়নতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।সেই ধারাবাহিকতা এই আধুনিক কালে হয়তো কিছুটা ফিঁকে হয়ে গেছে তবে একেবারে বিলীন হয়নি।তাইতো ভ্যালেরি টেইলরদের মত অগণিত খ্যাতিমান মানুষ এই দেশের মাটি ও মানুষের ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এদেশেই স্থায়ী ভাবে থেকে গেছেন।
এমন স্মৃতি আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই আছে যে, কোথাও গিয়েছি কিংবা নিজের বাড়িতেই মেহমান এসেছে।খেতে বসার পর দেখা গেল পরিবারের অন্যদের সাথে অতিথিকে খাওয়ানোর পর খাবারের আর কিছু বাকি নেই।পরিবারের নারীরা তখন হাসিমুখেই অভূক্ত থেকেছে।নিজের পাতের মাছের টুকরাটি অনায়াসে অতিথির পাতে তুলে দিয়েছে।স্মৃতি গুলি সবার কাছেই মুগ্ধকর।
তবে শুধু মাত্র পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধরাই যে অতিথি তাই নয়।আধুনিক বিশ্বে অতিথি কথাটির ব্যপকতা বিশাল।এর পরিমন্ডল নিজ পরিবার ছেড়ে গোটা দেশের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে।আজকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যে বিদেশীরা ঘুরতে এসেছে তারাও আমাদের অতিথি।যারা সিলেটের চা বাগান কিংবা জাফলং এর সৌন্দর্য দেখতে এসেছে তারাও আমাদের অতিথি।
চলন বিল কিংবা আড়িয়াল বিল থেকে শুরু করে হাকালুকি হাওড়ের অবাধ জলে ভেসে থাকা দুর কোন দেশ থেকে আসা পানকৌড়িটিও কিন্তু আমাদের অতিথি।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয় গুলি অতিথি পাখির অভয়াশ্রম বলেই পরিচিত।সাইবেরিয়া থেকে উড়ে উড়ে যে পাখিটি আমাদের দেশে এসেছে সে আমাদের পরম অতিথি।তার সেবা করা আমাদের কর্তব্য।
কিন্তু যে বিদেশী অতিথিরা আমাদের পযর্টন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে আসছে আমরা তাদের কতটা আতিথেয়তা দেখাতে পারছি?অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী দেখলেই তুলনামূলক ভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছি।সার্বিক ভাবে তারা হয়তো নিরাপদেই আছে কিন্তু মানসিক ভাবে তারা কতটা প্রশান্তি পাচ্ছে তা আমাদের দেখার বিষয়।ভিন দেশী একটা মানুষ এদেশের সৌন্দর্য দেখতে এসেছে আমাদের উচিত তাদেরকে যথা সাধ্য সহযোগিতা করা,ভালবাসা দেখানো।এতে করে সেই মানুষ গুলি নিজ দেশে ফিরে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ভালবাসা ও আতিথেয়তার কথা বাকিদের বলবে এবং তারাও এই দেশ ঘুরতে আসার আগ্রহ পাবে।ফলে দেশের সম্মান বাড়ার পাশাপাশি পযর্টন শিল্প থেকে জাতীয় আয় বাড়বে।কিন্তু আমরা অনেক সময় লোভাতুর হয়ে পযর্টকদের থেকে খাদ্য সামগ্রি থেকে শুরু করে রিক্সা,হোটেল,যানবাহন সব কিছুতেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছি।এতে করে আমাদের সম্মান কমছে বই বাড়ছেনা।তারা হয়তো প্রাথমিক ভাবে বুঝতে পারছেনা যে আমরা তাদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছি কিন্তু একসময় ঠিকই তারা বুঝতে পারছে যে তাদেরকে আমরা ঠকিয়েছি।এর ফলে এই দেশের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে।
একই ভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ যে সব জলাশয়ে অতিথি পাখির আগমন হচ্ছে আমরা সেখানে আমাদের সেই সব অতিথিদের নানা ভাবে ভোগাচ্ছি। উড়ন্ত পাখির ছবি তোলার আশায় শান্ত জলে অবাধ সাতারে মেতে থাকা পাখির দিকে অনেক সময় আমরা ঢিল ছুড়ে তাদের আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছি যা মোটেই উচিত নয়।এতে করে কখনো কখনো পাখি হতাহত হচ্ছে পাশাপাশি তাদের মধ্যে ভয়ের জন্ম হচ্ছে।সুদুর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা একটা অতিথি পাখিকে ঢিল ছুড়লে তার ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক।
অতিথি পাখিকে আপনার পরিবারের সাথে তুলনা করুন।মনে করুন দাম্মাম শহরে আপনি অবস্থান করছেন।কেউ যদি আপনার দিকে ঢিল ছুড়ে মারে তাহলে আপনার কেমন লাগবে একবার চিন্তা করে দেখুন।নিশ্চই ভাল লাগবেনা।তেমনি ভাবে সাইবেরিয়া বা অন্য কোথাও থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখিরও খারাপ লাগে।
শীত কাল আসলে পাখি শিকারীদের লোভ আরো বেড়ে যায়।তারা নির্বিচারে অতিথি পাখি শিকার করে বিক্রি করে আমাদেরই মত কারো না কারো কাছে।এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।অতিথি পরমাত্মীয় তাই তাকে ভালবাসতে হবে, সম্মান দেখাতে হবে, আগলে রাখতে হবে।
আমরা যদি ক্রমাগত ভাবে আমাদের ঐতিহ্য ভুলে যেতে থাকি তবে একদিন এই দেশে আর কোন পযর্টক আসবেনা,আর কোন অতিথি পাখি আমাদের আকাশে ডানা মেলবে না,ভেসে বেড়াবেনা কোন পানকৌড়ি,বক,বেলে হাঁস।আমরা চাইবো যে যেখানে যে অবস্থানে আছি আমাদের অতিথিদের যথাযথ সম্মান দেখাবো।আর একটা অতিথি পাখিকেও যেন কোন শিকারীর শিকারে পরিণত না হতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।যারা অতিথি পাখি দেখার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোথাও যাবে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন ভুলেও কেউ অতিথি পাখিকে ঢিল না ছুড়ি।
পযর্টন এলাকাগুলোর সব শ্রেনীর মানুষদের প্রতি অনুরোধ থাকবে যেন কোন পযর্টককে কোন ভাবেই ঠকানো না হয়।
তলোয়ারের জোরে যা জয় করা যায়না তা হৃদয় দিয়ে জয় করা যায়।তাই আমাদের পুবর্পুরুষেরা যেমন অতিথি পরায়ণ ছিলেন তেমনি আমাদেরও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা উচিত।যেন গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে এদেশে ছুটে আসে।এ দেশ হয়ে ওঠে সবার জন্য আদর্শ ও অনুপ্রেরণার একমাত্র দৃষ্টান্ত।
২০ ডিসেম্বর ২০১৬,দৈনিক ইত্তেফাক।