আজ আমরা অভাবে জর্জরিত এক জাতি।অভাব যেন আমাদের নিত্যদিনের সাথী।আমাদের টাকা পয়সার অভাব,বাড়ি গাড়ির অভাব,প্রেম ভালবাসার অভাব,ক্ষমতার অভাব,চক্ষুলজ্জার অভাব,নীতি ও আদর্শেরও অভাব।আমাদের বড়ই অভাব।শুধু মানুষের অভাব নেই। কবি বলেছিলেন “অভাব শুধু নাই মানুষের/চাই কত মন চাই কত সের”। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে সব কিছুর সাথে মানুষেরও অভাব প্রবল হয়েছে।সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের পৃষ্টপোষকতায় রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের গা ঘেসে দাড়ানো আজমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দশ দিন ব্যাপী বই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।বই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নুর।সেদিন উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং আরো অনেকে।সেই উদ্বোধনের সময় যা মানুষ এসেছিল তার পর মেলা প্রাঙ্গণ খা খা করছে।
৮৬টি স্টলে সজ্জিত এই মেলার পুরো মাঠ কাপের্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যেন পাঠকের পায়ে ধুলো না লাগে।কিন্তু হায় ধুলোর কপালে যেমন পাঠকের পায়ের ছোয়া লেখা নেই তেমনি কাপের্টের কপালেও পাঠকের পায়ের ছোয়া লাগার ভাগ্য লেখা ছিলনা বোধহয়।একুশে বই মেলার পর এতো বড় পরিসরে আর কোথাও বই মেলা হতে দেখিনি আমি।উত্তরা বিশাল একটি এরিয়া এবং সেখানে সাধারন মানুষের পাশাপাশি এলিট শ্রেনীর মানুষেরও বসবাস। দেশ সেরা রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের পাশাপাশি আরো অনেক নামি দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে।তার পরও বই মেলা পুরো ফাঁকা।এমন অনেক প্রকাশনী আছে যাদের এই চার পাঁচ দিনেও দশটা বই বিক্রি হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।পাঠক না আসলে বই বিক্রি হবে কি করে।মানুষ জানেই না যে এতো বড় একটা মেলা হচ্ছে। জানবে কি করে? কোন পত্রিকায় কোন টিভিতে বই মেলার কোন খবর ছাপা হয়নি।শুনেছি অনেক পত্রিকা টিভি প্রেস ব্রিফিং না দিলে নিউজ কাভার করেনা।তাহলে আমাদের মত সাধারণদের প্রশ্ন ভারত থেকে যে হাতিটি ছুটে এসেছিল এবং আমরা যাকে বঙ্গবাহাদুর উপাধী দিয়েছিলাম তার খবর কিভাবে পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনে প্রচার হলো।সেই হাতিটিকি তবে প্রেস ব্রিফিং করেছিল।
কদিন আগে একটা হনুমান ছুটে আসলো ভারত থেকে সেটা নিয়েও বেশ হইচই হলো নিউজ হলো,ফলোআপ নিউজও হলো।কিন্তু একটা বিশাল পরিসরের সুন্দর বই মেলার কোন নিউজই ছাপা হলো না কোথাও।পাশেই রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ২২ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পযর্ন্ত রাজউক ন্যাশনালস অনুষ্ঠিত হলো যেখানে টেলিভিশন চ্যানেল যেমন ছিল তেমনি রেডিও এবং পত্রিকাও ছিল।বই মেলা শুরু হয়েছে সেটারও আগে এবং সেটা এখনো চলছে।অথচ তারা সেটা আমলেই নেয়নি।
বইয়ের প্রতিকি তাহলে অরুচি ধরে গেছে?না হলে এরকম হবে কেন?মনে পড়ে গেল সেই গল্পটি।এক শিক্ষক শ্রেনী কক্ষে তার ছাত্রদের বললেন মনে করো তোমাদেরকে কেউ এক ব্যাগ বই আর এক ব্যাগ টাকার মধ্য থেকে যে কোনটি বেছে নিতে বললো ।তোমরা কোনটা নেবে?এক ছাত্র উঠে দাড়িয়ে বললো স্যার আমি হলে টাকাটাই নেব।স্যার তখন বললেন তুমি বোকা,আমি হলে বইগুলোই নিতাম।ছাত্রটি তখন বললো স্যার আপনিতো বই ই নিবেন।যার যেটার অভাব সেতো সেটাই নেবে।
আমাদের মনে হয় জ্ঞানের কোন অভাব আর নেই।তাই বই কেনা,বই পড়ার প্রতি আমাদের আর কোন আগ্রহ নেই।জানুয়ারির শুরুতেই আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলা শুরু হবে।দেখা যাবে টিকেট কেটে আমরাই মেলাতে ঢুকছি কত কিছু কিনছি কিংবা কিছু না হলেও ঘুরে বেড়াচ্ছি।অথচ বই মেলাতে ফ্রিতেও কেউ ঢুকছিনা।আর্মি স্টেডিয়ামে মাঝে মাঝেই নানা ধরনের ফেস্ট হয়।টিকেট কাটতে গেলে দেখা যায় টিকেট শেষ।চড়া দামেও তখন টিকেট পাওয়া যায়না।অথচ এতো সুন্দর জ্ঞানের আধার সাজিয়ে বসে থাকা মেলাটিতে আমাদের যাওয়ার সুযোগই হয়না।কেউ কেউ বলছেন উত্তরা ব্যাকওয়ার্ড জায়গাতে মেলা হচ্ছে।আমরা অবাক হই এটা শুনে।যেখানে রাজউক কলেজের মত প্রতিষ্ঠান রয়েছে,যেখানে দেশের সব সেরা সেরা ইংরেজী মাধ্যম স্কুল গুলোর প্রধান শাখা রয়েছে,বিমানবন্দর,রেলস্টেশান রয়েছে সেখানে যদি যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ ও ব্যাকওয়ার্ড মনে হয় তবে এই ঢাকা শহরে আর কোনটা ব্যাকওয়ার্ড নয় তা নতুন করে জানতে হবে।ট্রেনে করে ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং আসার জন্য উত্তরার কোন বিকল্প নেই।বিমান বন্দর সেটাও উত্তরাতে।এবং ঢাকার সব থেকে নিরিবিলি এলাকা উত্তরা।তাহলে পাঠকের উপস্থিতি কম কেন?কারণ পাঠক সেই গল্পটা জানে।
এক ভদ্র মহিলা তার স্বামীর জন্মদিনে স্বামীকে কিছু উপহার দিতে চান।তিনি গেলেন সুপার মার্কেটে।যে মার্কেটে প্রায় সবই পাওয়া যায়।তিনি দোকানীকে বললেন আমি আমার স্বামীর জন্মদিনে উপহার দিতে চাই।কি দিলে ভাল হয় বলুনতো।দোকানী একটা পারফিউম ধরিয়ে দিয়ে বললেন এটা নিতে পারেন।মহিলা বললেন না না পারফিউম সেতো ওর একটা আছে।দোকানী তখন একটা শেভিং ক্রিম দিলেন।মহিলা আবার বললেন না না ওটাতো ওর একটা আছেই। এভাবে দোকানী ভদ্র মহিলাকে যাই দিচ্ছেন সেটাই তিনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন কারণ তা নাকি একটা আছেই।
দোকানদার তখন একটা বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন এটা নিতে পারেন,উপহার হিসেবে বই খুবই ভাল।ভদ্র মহিলা বললেন না না বই? বইও তো একটা আছে!
সম্ভবত আমাদের সবার একই দশা হয়েছে।কোন কালে নিজে একটা বই কিনেছি কিংবা উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছি তাই আর আমাদের কোন বই লাগবে না।কিংবা স্কুলের সেই ছাত্রটির ভাষায় যার যা অভাব সেতো তাই নিবে। আমাদের জ্ঞানের অভাব নেই বলেই জ্ঞানের আধার বই আর আমাদের চাইনা।আর নিউজ মিডিয়া গুলো? হা এই সামান্য সংবাদ প্রচার করে তাদের কোন লাভ হবেনা।তার চেয়ে বরং কোন মডেল কিংবা আলোচিত ব্যক্তির কিছু একটা ছাপলে দর্শক খাবে বেশি।কথায় আছেনা তেলো মাথায় তেল দেয়,আমাদের হয়েছে তাই।
৬ জানুয়ারি ২০১৭,দৈনিক ইত্তেফাক।