রাজশাহীর বিন্দুর মোড়,সারিসারি ভাজিভুজির দোকান।সেই সব দোকানে সিঙ্গাড়া, সমুচা, পিয়াজু, চপকে আড়াল করে লোভাতুর জিহ্বায় লালা ঝরিয়ে দিতে প্রস্তুত যে খাবারটি তার নাম চড়ুই ভাজি।চড়ুইয়ের রোষ্ট।দাম মাত্র চল্লিশ টাকা।মাত্র চল্লিশটাকা উপার্জনের নিমিত্তে এভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের জীববৈচিত্রের অন্যতম আকর্ষন চড়ুই নিধন চলছে।এভাবেই লোভাতুরদের কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রাণী।টিকে আছে কেবল সেই সব প্রাণী যা এখনো বাঙ্গালীরা খাদ্য তালিকায় যোগ করতে পারেনি।এমন দিন আসতে হয়তো বেশি দেরি নেই যেদিন বাঙ্গালীরা মাছরাঙ্গা থেকে শুরু করে জাতীয় পাখি দোয়েল হয়ে কাকও সাবাড় করে দেবে।একদা কবিতায় পড়ছি
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই
কুড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই।
আমি থাকি মহা সুখে অট্রালিকার পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে”।
এখন আর চড়ুই কোন বাবুই পাখিকে ডেকে ওরকম করে কথা বলতে পারেনা।বাবুই পাখি এখন কেবল আমাদের ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়।বাবুই পাখির ঘর ভেঙেছে সেই বহুকাল আগে। সে আর শিল্পের বড়াই করার মত অবকাশ পায়নি।আমাদের লোলুপ দৃষ্টির রোশানল থেকে বাঁচতে পারেনি তালগাছে অসাধারণ নৈপুন্যে বাসা বাঁধা পাখিটি।আমরা যে যেখানে পেয়েছি বাবুই পাখি ধরে খেয়েছি কিংবা বাজারে বিক্রি করে অন্যের খাবার তালিকায় যোগ করে দিয়েছি।এখনো এদেশে অগণিত তালগাছ আছে কিন্তু সেই গাছের পাতায় পাতায় আজ আর কোন বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়না।একই সাথে মহা সুখে থাকা চড়ুই পাখির সুখও বেশিদিন থাকেনি।শুধু যে রাজশাহীর বিন্দুর মোড়ে চড়ুই পাখি রোষ্ট করে বিক্রি হচ্ছে তাই নয়, হয়তো আমাদের অজানা আরো কত জায়গায় জীবন্ত চড়ুই পাখি বিক্রি হচ্ছে এবং সেটা কারো না কারো বাড়িতে গিয়ে ভুরি ভোজের জন্য কোরবানি হচ্ছে।বালিহাস,বক,শালিক,পানকৌড়ি এখন আর দেখা যায়না।এভাবে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যের এই সব অঙ্গগুলি।এভাবেই একদিন আমরা জীববৈচিত্রহীন এক মরুভূমিতে পরিণত হব।নানা সময় খবরে দেখতে পাই কোথাও কোথাও হরিণের মাংসও বিক্রি হয়।সুন্দরবনের মত অভয়ারন্যেও প্রাণীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে ভুগে বিলীন হয়ে গেছে অনেক পাখি।আমাদের নদী নালায় শত শত প্রজাতির মাছ ছিল এখন হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া বাকি গুলো ইতিহাসের পাতায় ঠাই নিয়েছে।যে গুলো আছে তাও সীমিত।যে কোন সময় সেই অংশও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নানা সময়ে নানা ভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু আমরা কেউ সেসব কথা আমলে নেইনি।প্রত্যেকটি প্রাণীর গুরুত্ব এ বিশ্বে সীমাহীন।ধরুন এই ঢাকা শহরে যদি একটাও কাক না থাকে তাহলে এই শহর আমরা যেভাবে নোংরা করি তা দুদিনেই আমাদের শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে।একটা বনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণিকুলের ভূমিকা অনন্য।পশু-পাখি, জীব-জন্তু ছাড়া কোন বনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায়না।প্রাণিকুলের সাথে বন-বনানির আত্মিক সম্পর্ক।লোভাতুরদের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে আমাদের ঐতিহ্য রয়েলবেঙ্গল টাইগারও এখন বিলীন হওয়ার পথে।সামান্য কয়টা বাঘই এখন বেঁচে আছে।আশ্চর্য হতে হয় এটা ভেবে যে সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের অংশে থাকলেও আমাদের অংশে বাঘের সংখ্যা ভারতীয় অংশের কিয়দাংশ মাত্র।পাচারকারিরা নানা ভাবে বাঘ শিকার করে জীবিত অথবা মৃত পাচার করে।
সরকার এবং পরিবেশবিদদের চোখের সামনে দেশের আনাচে কানাচে হরদম পশুপাখি বিক্রি হচ্ছে।কেউ সেসবে নজর দিচ্ছেনা।রাজধানীর কাটাবনেও রয়েছে অগণিত দোকান। যেখানে নানা রকম পশুপাখি বিক্রি হচ্ছে।এমন নয় যে সব পশু পাখিই পোল্ট্রি মুরগির মত চাষ করা।ওখানেওতো প্রাকৃতিক ভাবে জন্মনেয়া বিভিন্ন বন থেকে ধরে আনা পাখি থাকতে পারে।সে গুলো খতিয়ে দেখা উচিত।
মানব জাতিকে টিকে থাকতে হলে জীববৈচিত্রের দিকে অবশ্যই আন্তরিকভাবে নজর দিতে হবে।জীববৈচিত্রের উপর অনেকটা নির্ভর করে মানব জাতির সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে যেমন কোন কাজ হয়না তেমনি জীববৈচিত্র ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে সুন্দর সুনির্মল পরিবেশে বেঁচে থাকার কথা কল্পনাও করা যায়না।আমাদের দেশের আনাচে কানাচে যেভাবে বন্য প্রাণী ও পশুপাখি নিধন হচ্ছে তা সত্যিই আশংকাজনক।নীতিনির্ধারকদের উচিত এসব বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া।আর একটি চড়ুই পাখিও যেন ধরা না হয়,আর একটি বক,পানকৌড়িও যেন হারিয়ে না যায়, আর কোন হরিণ যেন মারা না পড়ে, সে বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।এসবের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের ভয়াবহ দিনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছে তবুও জীববৈচিত্র নষ্ট করেনি।একটা চড়ুই,শালিক,বক তারা ধরেনি।ভাতের অভাব হলে তাকে বলে হাভাত কিন্তু এখনতো ভাতের কোন অভাব নেই। এখন আছে সংস্কৃতি ও দেশের জীববৈচিত্রের প্রতি ভালবাসার অভাব।এই অভাবীদের কি নামে ডাকা হবে তা জানা নেই।আমরা আশা করবো রাজশাহীর বিন্দুর মোড়ে বিক্রি হওয়া চড়ুই পাখিটির মত আর যেন কোন পাখিকে এভাবে ধ্বংস করা না হয়।বেঁচে থাকুক জীববৈচিত্র,বেঁচে থাকুক প্রাণিকুল আর সবাই মিলে ওদের জন্য সুন্দর একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে আসুন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি।
২২ নভেম্বর ২০১৬,দৈনিক ইত্তেফাক।