Tuesday, April 30, 2024
Homeপ্রবন্ধতাদের সম্মান ও খ্যাতি আইফেল টাওয়ারের মতই উঁচু

তাদের সম্মান ও খ্যাতি আইফেল টাওয়ারের মতই উঁচু

চলুন পৃথিবীর দিকে তাকাই।অগণিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই অসংখ্য স্থাপনা,আশ্চর্য হই সেসব দেখে। যদি পৃথিবীর সেরা দশটি আকর্ষণীয় স্থানের কথা বলতে বলি তবে আপনি নিশ্চই মিশরের পিরামিড,আগ্রার তাজমহল,চীনের মহাপ্রাচির বা নায়াগ্রার জলপ্রপাতের কথা বলবেন।আমার বিশ্বাস সেই তালিকায় আরও একটি স্থানের নাম থাকবে।প্যারিস! হ্যাঁ নাম বলার সাথে সাথে আমাদের অনেকেরই নিশ্চই অব্যক্ত একটি ইচ্ছে মনের মধ্যে জেগে ওঠে, ইস! যদি প্যারিসে যেতে পারতাম। যেহেতু প্যারিস প্রসঙ্গ আসলো তাহলে মনে করে দেখুন প্যারিস গিয়ে আপনি কী কী দেখতে চাইবেন। আমি যা ভাবছি আপনিও নিশ্চই তাই ভাবছেন। পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা আইফেল টাওয়ার।

প্যারিস মানেই সবার আগে আইফেল টাওয়ারের ছবি ভেসে উঠবে সবার চোখে। এর পর ল্যুভর মিউজিয়াম সহ অন্যান্য বিষয় নজরে আসবে। আপনি হয়তো মনে মনে এরই মধ্যে এই লেখাটি পড়তে পড়তে কল্পনা করেছেন আপনি আইফেল টাওয়ারের পাশে বিস্তৃত সবুজ ঘাসের উপর দাড়িয়ে আইফেল টাওয়ারকে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে স্মৃতির পাতা সমৃদ্ধ করেছেন পাশাপাশি আপনার ফেসবুক,ইন্সটাগ্রামে সেগুলো আপলোড দিয়ে বন্ধুদের জানাচ্ছেন ওহে প্রিয় বন্ধুবর দেখো আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছে পৃথিবী সেরা একটি স্থানে দাড়িয়ে ছবি তোলার,মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার। আপনি কি জানেন আজকে আইফেল টাওয়ার যেখানে দাড়িয়ে পৃথিবীবাসির চোখ ছানাবড়া করে রেখেছে সেটি ওখানে থাকার কথাই ছিল না! হয়তো তথ্যটি জানেন অথবা জানেন না। আইফেল টাওয়ারের স্থপতি গুস্তাভ আইফেল তার ডিজাইন এবং পরিকল্পনার কথা প্রথমে ফুটবলের স্বর্গরাজ্য স্পেনের বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। আশা করেছিলেন সেটা তারা গ্রহণ করবেন এবং এই স্থাপনাটি বার্সেলোনাতে স্থাপিত হবে। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে তার প্রস্তাব তারা নাকোচ করেছিল। তারা বলেছিল লোহালক্কড়ের এই জঞ্জাল দিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রকে বিকৃত করতে চাই না!

আমার মনে হয় এই তথ্যটি জেনে আপনি হাসছেন এবং বিস্মিত হচ্ছেন এই ভেবে যে তারা কতইনা বোকামি করেছে, কতইনা ভুল করেছে। আপনার ধারণা সঠিক। এখন স্পেন নিশ্চই আফসোস করে সেদিন গুস্তাভ আইফেলের প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে কতইনা ভালো হতো। শুধু মাত্র আইফেল টাওয়ারের প্রতি মুগ্ধতা দেখিয়ে প্রতিবছর যে পরিমান পর্যটক প্যারিস ভ্রমন করে তা থেকে ফ্রান্সের যে রেভিনিউ আসে সেটা বিস্ময়কর। এমন একটি সুযোগ তারা কতটা অবহেলায় হেলায় ঠেলে ফেলেছে। গুস্তাভ আইফেল যখন স্পেনের কাছ থেকে তার প্রস্তাবে সাড়া পেলেন না তিনি কিন্তু হাতশ হননি। তিনি এর পর ফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছে।ফ্রান্স সরকার খুব ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। তারপর বাকিটা ইতিহাস। এখন কাউকেই এ নিয়ে বলার অবকাশ রাখে না।

আইফেল টাওয়ার যেমন গর্বের সাথে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে তেমনি সেই টাওয়ারের গায়ে পৃথিবী বিখ্যাত এমন কিছু মানুষের নাম খোদাই করা আছে যাদের নিয়ে পৃথিবীবাসি গর্ব করে। তাদের সম্মান,খ্যাতিও আইফেল টাওয়ারের মতই উচু। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন অগাস্টিন লুইস কসি। পৃথিবীর সবাই সব মানুষের নাম জানে না। হতে পারে কসির নামও আপনি প্রথম বারের মত শুনছেন অথবা আগে থেকেই তার সম্পর্কে জানেন। অগাস্টিন লুইস কসি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ। গণিত কথাটি শুনলেই আমাদের মধ্যে একপ্রকার ভয় কাজ করে কিন্তু মজার বিষয় হলো গণিত ছাড়া আমরা একটি দিন,একটি ঘন্টাও পার করতে পারিনা। প্রতিটি কাজে কর্মে আমাদের নানা ভাবে গণিতের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। হিসেব নিকেষ করতে হয়। যাকে আমাদের এতোটা প্রয়োজন দেখুন আমরা তাকে কতইনা ভয় পাই। অথচ উল্টোটা হওয়ার দরকার ছিল। যেমন মোবাইল আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিষ হয়েছে বলে সব সময় সাথে রাখি তেমনি গণিত বিষয়টিও ভালোবাসার স্থান দখল করার দরকার ছিল।

যাই হোক এই লেখাটি গণিতের প্রতি আপনার বা আমার ভালোবাসা তৈরির লক্ষ্যে রচিত নয় বরং আমরা অল্পবিস্তর কসি সম্পর্কে জানবো। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন অগাস্টিন লুইস কসি নামে এক বিশ্ববিখ্যাত  গণিতবিদ সম্পর্কে জেনে আমাদের লাভ কী? আমার মনে হয় লেখাটি পড়লে নিজেই বুঝতে পারবেন লাভ আছে কি নেই। তবে এটাতো সত্যি আমরা জীবনে সব কিছু লাভের জন্য করি না। আমরা যখন সিনেমা দেখি,গান শুনি, কবিতা আবৃত্তি শুনি কিংবা আকাশে ঘুড়ি উড়ানো দেখি এগুলোর জন্য আমরা কিন্তু কখনো ভাবি না যে এগুলো করে লাভ কী? যাই হোক তবে কসির এই গল্প থেকে আপনি নিশ্চই এমন কিছু জানতে পারবেন যা আপনার জীবন পরিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে যদি আপনি তা কাজে লাগান।

আমাদের দেশে অগণিত শিশু কিশোর,তরুণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সেটা আপনিও নিশ্চই জানেন। অভাবে জর্জরিত পরিবারগুলির সাথে কথা বললে তারা আক্ষেপ করে বলেন লেখাপড়া করানোর মত সামর্থ তাদের নেই। তাই তারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন না। আবার অনেকে মাধ্যমিকের গন্ডি পার হওয়ার পর ঝরে পড়েন তাদেরও একই সমস্যা। আমার ধারণা অগাস্টিন লুইস কসির সমস্যা ছিল তার চেয়েও অধিক। আপনি আপনার জীবনের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে নিন। আপনিকি আপনার জীবনে দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়েছেন? কিংবা কোনো মতে এক বেলা খাবার খেয়ে কাটিয়েছেন? আপনিকি রাস্তায়,ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন,ছেড়া কাপড়ে দিনের পর দিন পার করেছেন? যদি এই প্রশ্নের সবগুলোর উত্তর হ্যা হয় তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনি এই লেখাটি পড়ছেন মানে হলো আপনাকে অন্তত এতোটা কঠিন সময় পার করতে হয়নি। আর যদি পার করতে হয়েও থাকে তবে এই লেখাটি যখন পড়ছেন তখন আপনি আপনার কর্মনিষ্ঠার গুনে সফল ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছেন। আপনি নিজেই হয়ে উঠেছেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানুষ। অগাস্টিন লুইস কসির জীবন ছিল এমনই ভাগ্যবিড়ম্বিত যে সারাদিনের কাজের জন্য তিনি মাত্র আধাপাউন্ড পাউরুটি পেতেন। কখনো কখনো তার চেয়েও কম পেতেন।আর যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো তবে মাঝে মাঝে তিনি কয়েক টুকরো বিস্কুটও পেতেন। কিন্তু সেই বিস্কুট এতোটাই শক্ত যে দাত দিয়ে কামড় দিয়ে ভাঙা যেত না বরং পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হতো। তার পর যখন তা কিছুটা নরম হতো তখন খেতে হতো।

আমাদের ছেলে মেয়েরা সকালে রান্না করা তরকারি দুপুরে দিলে খেতে চায় না, মুখ ঝামটা মেরে যেদিকে মন চায় চলে যায়। তাদের জন্য অগাস্টিন লুইস কসির জীবন দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। সারাদিন না খেয়ে কাজ করার পরও তিনি কখনো হতাশ হননি,হাল ছেড়ে দেননি। তিনি একটি স্বপ্নকে বুকে লালন করতেন,গণিত নিয়ে খেলা করতেন,গণিত ভালোবাসতেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমরা যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিই এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই সেখানে কসি তার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য সারাদিনের ক্লান্তিকর কাজের শেষে বসতেন গণিত নিয়ে। তার এই সাধনাই তাকে বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।তিনি কোনো পরিস্থিতিতেই তার গবেষণাকর্ম থামাননি। আপনি শুনলে চোখ কপালে তুলবেন যে কসি প্রায় আটশোটির মত মৌলিক গবেষণা পেপার প্রকাশ করেছিলেন।তার জীবনের দিকে তাকালে বার বার এটাই মনে হয় যে চেষ্টা করলে যে কোনো পরিবেশ থেকেই সফল হওয়া যায়। ধনসম্পদে পরিপূর্ণ থাকলেই যদি কেউ বিখ্যাত পন্ডিত,সাধক,বিজ্ঞানী হতে পারতেন তবে কসিদের মত কারো নাম আমরা জানতেও পারতাম না। নজরুলে মত কেউ কবি হতেন না।

অগাস্টিন লুইস কসির নামে আছে ষোলটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও তত্ত্ব। এতো ধারণা ও তত্ত্ব পৃথিবীর আর কোনো গণিতবিদের নামে নেই। তার সাধনা তাকে এতোটা মর্যাদা ও সাফল্য দান করেছিল যে আইফেল টাওয়ারের গায়ে খোদাই করা পৃথিবী বিখ্যাত বাহাত্তরজন মানুষের নামের যে ক্ষুদ্র তালিকাটি আছে সেখানে অগাস্টিন লুইস কসির নামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। সুতরাং ছোটো কিছু না পাওয়া,ছোটো কিছু ব্যর্থতার দায় নিয়ে হতাশ হওয়ার দরকার নেই,জীবন বিলিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। আপনার আমার সমস্যা হয়তো আমাদের কাছে বড় মনে হচ্ছে কিন্তু চারদিকে তাকালে দেখতে পাবেন অগণিত মানুষ আছে যাদের জীবনে এতো বিশাল সমস্যা আছে যার তুলনায় আমাদের সমস্যাগুলো একটি বালুকণার সমান। তাদের সমস্যার সামনে আমাদের সমস্যা,না পাওয়ার ব্যর্থতা রেখে দিলে তা হবে সাহারা মরুভূমিতে একটি আংটি রাখলে যতটুকু হয় ততোটুকু।

 

পাত্রে ছিদ্র রেখে পানি ঢাললে তা বেরিয়ে যাবেই। আপনি পানি ঢালার পরিমান যতই বৃদ্ধিকরুন না কেন এক সময় সব পানিই বেরিয়ে যাবে। পানি ঢালা বৃদ্ধি না করে যদি ছিদ্র বন্ধ করতে পারেন তবে এক আজলা পানি রাখলেও তা দিনের পর দিন থেকে যাবে। জীবনে সবারই কোনো না কোনো সমস্যা থাকে। সেগুলোকে বড় করে না দেখে,হতাশ না হয়ে বরং সেগুলো সমাধানের পথ খুজে নিতে চেষ্টা করুন।ঠিক যেমনটি অগাস্টিন লুইস কসি করতেন। আপনি হয়তো আপনার সমস্যাটিকে এক দিক থেকে দেখেছেন বলে কূলকিনারা করতে পারছেন না, সমাধান খুজে পাচ্ছেন না ফলে হতাশার মাত্রা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনার সমস্যাটিকে একটি রুটি হিসেবে কল্পনা করুন যে রুটির এক দিক উপরে যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন আরেক দিক উনুনে রাখা তাওয়ার উপর পড়ে আছে। ওটাকে উল্টো করে দেখুন। নতুন দিগন্ত দেখতে পাবেন। আপনার সমস্যার সমাধান হয়তো যে পাশটি আপনি দেখছেন না সে পাশেই বিদ্যমান। শুধু তাওয়ায় রাখা সমস্যা নামক রুটিটি উল্টে দেখুন।

বিকেলে যখন সূর্য আস্তে আস্তে ঢুবে যায় তখন ক্রমাগত অন্ধকারে তলিয়ে যায় গোটা বিশ্ব। আপনি সেটা দেখে হতাশ হবেন না যে হায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে দেখুন। একসময় রাত পার হবে এবং আবার সূর্য উঠবে তার পূর্ণ আলো নিয়ে।যদি অন্ধকার দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে জীবনকে ছুটি দিয়ে দেন তবে পরবর্তী সকালে নতুন সূর্য দেখার যে সুযোগ আপনার সামনে ছিল তা থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন। এ জন্য কাউকে দায়ী করতে পারবেন না কারণ আপনার প্রতিটি সুযোগ ও সম্ভাবনা আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন। আজকে আমার আপনার ঘরে যে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে তার আবিস্কারক টমাস আলভা এডিসন। বলা হয়ে থাকে তিনি নয়শত নিরানব্বই বার ব্যর্থ হয়ে হাজারতম বারে সফল হয়েছিলেন। তিনি যদি এক দুবার চেষ্টা করেই হতাশ হতেন,চেষ্টা ছেড়ে দিতেন তবে বৈদ্যুতিক বাতি আবিস্কৃত হতো না। তিনি বলতেন আমিতো ব্যর্থ হইনি বরং আমি নয়শত নিরানব্বই ভাবে চেষ্টা করে দেখেছি বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিস্কার করা যায় কি না। আপনি নয়শত নিরানব্বই ভাবে না হোক অন্তত নয়বার চেষ্টা করে দেখেছেন? সফলতা,সমস্যার সমাধান আপনার নাগালেই। শুধু আপনাকে রুবিকস কিউবটাকে ঘুরিয়ে দেখতে হবে ম্যাচিং কালারটা ঠিক কোন সাইডে আছে। তার পর দেখবেন নিমিষেই তা মিলে গেছে।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

অগাস্টিন লুইস কসি

লেখাঃ জাজাফী

 

Most Popular