Tuesday, April 30, 2024
Homeপ্রবন্ধআপনার সাফল্য ও ব্যার্থতা সব আপনারই হাতে

আপনার সাফল্য ও ব্যার্থতা সব আপনারই হাতে

নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে বেরিয়েছি। এখন কি আর যে সে চাকরি করতে পারি? যে সে কাজ করতে পারি? এমন ভাবনা আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর। আমার এই লেখাটি যদি আপনি পড়ে থাকেন তবে নিজের সাথে একবার মিলিয়ে নিতে পারেন যে আপনিও ওই দলের কি না।ধরুন একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা এমন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো একটি সাবজেক্টে প্রথম শ্রেণী বা হাই সিজিপিএ নিয়ে পাশ করলো। তার পর আমরা দেখতে পাই সে বা তারা বেছে বেছে চাকরির আবেদন করে। অনেক সময় পছন্দমত চাকরি হয় না ফলে হতাশ হয়। আবার একটু চেষ্টা করলেই যে চাকরি সে অনায়াসেই পেতে পারতো সে কিন্তু সেগুলো হেলায় ঠেলে ফেলে। এমনকি তাকে যদি বলা হয় তুমি ওই চাকরিতে আবেদন করো বা করোনি কেন? সে তখন চোখ কপালে তুলে বলে আরে তুমি পাগল হয়েছ? ওই চাকরি করবো আমি? এতো দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সিজিপিএ নিয়ে পাশ করে বেরিয়ে এরকম একটি চাকরি করলে মানসম্মান থাকবে? এর চেয়ে বেকার থাকবো তাও ভালো।

 

আমি নিশ্চিত এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায়। নিজেকে এতোটাই যোগ্য মনে করে যে যে কোনো কাজ সে করবে এমনটি ভাবতেই পারে না। ফলে পছন্দমত কাজ বা চাকরি না পেলে হতাশার পরিমান বাড়তে থাকে এবং এর ফলে অনেক সময় তুখোড় মেধাবী আর আত্মবিশ্বাসী হয়েও আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিগত কয়েক বছরে এর হার বেড়েছে অনেক বেশি। আপনি যদি এমন ধারণা নিয়ে বসে থাকেন যে আপনার মত এমন ভালো সাবজেক্ট,ভালো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভালো রেজাল্ট নিয়ে যে কোনো কাজ করা আপনার জন্য লজ্জাজনক বা অপমান জনক তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনি ঢের পিছিয়ে আছেন।অন্তত চিন্তার জায়গা থেকে আপনি অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন তারা কোনো কাজকেই ছোটো চোখে দেখে না।

আজ আপনাদের আমি তেমনই একজন মানুষের কথা বলতে চাই। জীবনের নানা সময়ে ঘাতপ্রতিঘাত আর অবহেলা সহ্য করেও তিনি কখনো হার মানেননি। আর তার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা শুনলে আমি নিশ্চিত আপনি চোখ কপালে তুলবেন। তখন নিজের সাথে মিলিয়ে নিতে পারবেন আপনি তার চেয়েও উচ্চডিগ্রিধারী কি না কিংবা তার তুলনায় আপনি অধিক যোগ্য কি না। একই সাথে আপনি নিজেকে তার সাথে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনার এখন কোন কাজ করা উচিত কিংবা বসে থাকা উচিত। আপনি একবার কল্পনা করুনতো ধানমন্ডিতে কোনো একটি ফাস্টফুডের দোকানে বন্ধুদের সাথে খেতে বসেছেন যিনি খাবার সার্ভ করলেন তিনি  একজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী! হয়তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে পিএইচডি ডিগ্রীধারী কেন ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করবে! আপনি নিজে হলেও হয়তো এ কাজ করতেন না। এই মানুষটির নাম ইট্যাং ঝ্যাং। ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া ঝ্যাং এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাংহাই শহরে। ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে পিথাগোরাসের সূত্র প্রমান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যে বয়েসে আমরা সাধারণত  পাটিগণিতের সাধারণ অংকগুলো শিখি সেখানে তিনি জিওমেট্টির কঠিন বিষয়গুলো অনায়াসে সলভ করেন। এ যেন আরেক রামানুজন।

কিন্তু হঠাৎ তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। চীনে শুরু হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তার রেশ অনেকটাই এসে আঘাত করলো ঝ্যাং এর জীবনে। ফলে সাংহাইতে টিকতে না পেরে তাকে তার মায়ের সাথে চলে যেতে হলো অজপাড়াগায়ে। যেখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধার কিছুই ছিলো না। এমনকি ছিলো না পড়ালেখা করার মত তেমন স্কুল। অগত্যা বেচেথাকার তাগিতে তিনি মায়ের সাথে কাজে লেগে পড়লেন। পড়াশোনায় যে ছেলেটি এতো মেধাবী ছিল যে উচ্চতর ক্লাসের জিওমেট্টি অনায়াসে সলভ করতে পারতেন সেই মেধাবী ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পুরোপুরি পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।সারাদিন মায়ের সাথে হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে কোনো মত বেচে থাকার চেষ্টা করলেন। এবং টানা দশ বছর তিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করেছেন। দশ বছর শিক্ষার আলো বঞ্চিত! ইতপূর্বে বর্ণিত পিএইচডি শব্দটি নিশ্চই এখন আপনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আর ভাবছেন যে মানুষ বাল্য কালে শিক্ষা শুরুর পর হঠাৎ করে দশ বছর পুরোপুরি পড়াশোনার সুযোগ বঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি কিভাবে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন! হ্যা বিস্ময়কর বটে। পড়াশোনার সুযোগ বঞ্চিত হলেও তার মনের মধ্যে বড় হওয়ার যে স্বপ্ন ছিলো তিনি তা কোনো দিন ত্যাগ করেননি। নিজের মত করে ভাবতেন,নানা ভাবে সমস্যার সমাধান করতেন এবং এভাবেই তিনি নিজের পড়াশোনার পরিধি এগিয়ে নিতে থাকেন।

এই কঠিন সময় পার করে তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন  অতঃপর সাফল্যের সাথে ১৯৮২ সালে বিএসসি এবং ১৯৮৪ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তার বয়স তখন ২৭ বছর! আপনি ভেবে দেখেছেন ১০ বছর সব রকমের একাডেমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে  বঞ্চিত মানুষটি আমাদের দেশের ছেলে মেয়েদের কাছাকাছি বয়সে (সেশন জটে অনেকের ২৭ বছরও লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করতে এমন নজির আছে বাংলাদেশে) বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছেন। তার পর ১৯৮৫ সালে পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে ১৯৯১ সালে সাফল্যের সাথে পিএইচডি অর্জন করেন। বাল্যকাল থেকে অসম্ভব কঠিন বাস্তবতা পার করে আসা ঝ্যাং মনে মনে ভাবলেন এবার তার দুঃখের দিন শেষ। এখন যেহেতু পিএইচডি ডিগ্রি হাতে পেয়েছেন ফলে নিশ্চই ভালো একটা মোটা বেতনের চাকরি জুটে যাবে। এই লেখাটি যদি আপনি এ পযর্ন্ত পড়ে থাকেন তবে আপনার মনেও একই ধারণা জন্মাতে পারে। কিন্তু ঝ্যাং নিজেও কল্পনা করতে পারেননি যে তার দুঃখের দিন এতো সহজে তাকে ছেড়ে যাবে না। দুঃখ যেন তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল তাই তাকে ছেড়ে কোনো ভাবেই যেতে চাইছিলো না।

ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট সহ বিএসসি,এমএসসির পাশাপাশি পিএইচডি ডিগ্রি থাকার পরও দিনের পর দিন চেষ্টা করেও একটি চাকরি জোগাড় করতে পারেননি ঝ্যাং।প্রথম দিকে তিনি অপেক্ষাকৃত ভালো মানের চাকরির চেষ্টা করেছেন যেখানে ভালো বেতন পাওয়া যাবে। সেখান থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে শেষে চিন্তা করেছেন যে কোনো চাকরি হলেই তিনি তা করবেন। এই ভাবনা নিয়ে কত শত প্রতিষ্ঠানে সিভি দিয়েছেন,ভাইভা দিয়েছেন কিন্তু কেউ তার মেধার মূল্যায়ন করেনি, কেউ তাকে হায়ার করেনি। ঝ্যাং বিশ্বের অগণিত তরুণের জন্য আদর্শ স্থাপন করেছেন। তিনি  এতো অবহেলা সহ্য করেও হতাশ হননি, হাল ছেড়ে দেননি। এমনকি তিনি খোদ তার সুপারভাইজারের কাছ থেকেও চাকরি বিষয়ে কোনো রকম সহযোগিতা পাননি। আপনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবতে পারেন কেন তার পিএইচডি সুপারভাইজার তাকে রেকোমেন্ড করেননি? এখানে রয়েছে মজার এক গল্প। ঝ্যাং তার পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন ঠিকই তবে তার পিএইচডি গবেষণাপত্রে তার সুপারভাইজারের গবেষণা কাজের বেশ কিছু ভুল ধরা পড়েছিল। ফলে তার গবেষক লজ্জায় পড়েছিলেন এবং রাগে ক্ষোভে ঝ্যাংকে কোনো রকম রেকমেন্ড করেন নি।

মাসের পর মাস শত শত প্রতিষ্ঠানে সিভি দিয়ে, ইন্টারভিউ দিয়েও যখন ঝ্যাং একটা চাকরি পেলেন না তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে কিছু একটা করতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। তিনি সে সময়ে নিউইয়র্কে ছিলেন। সেখানকার একটি রুস্টেুরেন্টের মালামাল খালাসের শ্রমিক হিসেবে তিনি কাজ শুরু করলেন! পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন মানুষ সে কি না মালামাল খালাসের শ্রমিক! রূপকথার গল্পেরমত শোনাচ্ছে বিষয়টি তাই না? কিন্তু এটাই বাস্তবতা। যারা বাস্তবতা বুঝতে পারে তারা এসবে পরোয়া করে না। ডিগ্রি মানুষের গায়ে লেখা থাকে না ফলে তিনি যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী সেটা তিনি না বললে কারো বুঝার কথা নয়। আর ছোটবেলা থেকেই যেহেতু শ্রমিক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাই এ কাজ করতে গিয়ে তাকে মোটেও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। আরদশজন শ্রমিকের মতই তিনি অনায়াসে মালামাল খালাসের কাজ করতে পেরেছেন। এর কিছুদিন পর তিনি কেন্টাকির মোটেলে এবং সাবওয়ে স্যান্ডউইচের দোকানেও কাজকরেছেন। আপনি শুনলে আরও একবার বিস্মিত হবেন যে তাকে এই ধরনের কাজ করতে হয়েছে পরবর্তী আট বছর। আট বছর পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। ভাগ্যক্রমে তার সাথে এক বিকেলে স্যান্ডউইচের দোকানে দেখা হয়েছিল স্বনামধন্য অধ্যাপক মিস্টার আপেলের সাথে। ঝ্যাং এর কথাবার্তা এবং ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করেছিল এবং তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা মনে হওয়ায় তিনি জানতে চেয়েছিলেন ঝ্যাং আসলে কতটুকু পড়াশোনা জানে। যদি সম্ভব হয় তবে তিনি তাকে এর চেয়েও ভালো কোনো কাজ জুটিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন। এটা নির্ভর করছে ঝ্যাং কতটুকু পড়াশোনা জানে তার উপর। মিস্টার আপেল কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি যে তাকে যে মানুষটি স্যান্ডউইচ সার্ভ করছে তার পড়াশোনার দৌড় কত বেশি। ঝ্যাং যখন তাকে জানালেন আমার পিএইচডি ডিগ্রি আছে! তখন অধ্যাপক আপেল কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলেন। তার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে তাকে অভিবাদন করলেন এবং নিজের একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে অফিসে দেখা করতে বললেন। ফলে অচিরেই ঝ্যাং এর কষ্টের জীবনের ইতি ঘটলো। অধ্যাপক আপেলের সহযোগিতায় তিনি নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে চাকরি পেলেন। তখন ঝ্যাং এর বয়স ৪৪ বছর! মানে ভেবে দেখেছেন সাফল্য আসতে কখনো কখনো ৪৪ বছর বা তারও বেশি সময় আপনাকে অপেক্ষা করতে হতে পারে।

 

ঝ্যাং এর জীবনের এই সব দিক আপনি ভালোভাবে অবলোকন করলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন জীবনের কোনো অবস্থাতেই হতাশ হতে নেই, হাল ছেড়ে দিতে নেই।নিজেই নিজেকে বলুন হাল ছেড়োনা বন্ধু। এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের বাংলা গানের কিংবদন্তী শিল্প কবির সুমনের উদাহরণ টানতে পারি। আপনি কি জানেন যে এই বিখ্যাত শিল্পী তার সঙ্গীত জীবন শুরুই করেছিলেন বয়স চল্লিশ পার হওয়ার পর! অনেকেই মনে করেন ছোটবেলা থেকে গানের তালিম না নিলে,চেষ্টা অব্যাহত না রাখলে শিল্পী হওয়া যায় না। সব যুক্তি ভুল প্রমান করে দিয়ে কবির সুমন শুধু শিল্পী হয়েই দেখাননি বরং হয়েছেন গানের মায়েস্ত্রো।ঠিক যেমন ঝ্যাং তার জীবনে চুয়াল্লিশটি বছর পার করে একটি ভালো চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন । আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়,একাডেমিক পরীক্ষায় ভালো না করতে পারলে আত্মহনন করে, বিসিএস  না পেলে বা অন্যান্য চাকরি না পেলেও আত্মহত্যা করে। তারা তাদের ভাবনাকে একই সমান্তরাল ধারায় বয়ে চলে ফলে ভিন্ন ভাবে ভাবলে যে তার ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারতো তা সে কখনো চিন্তা করে না। শুধু মাত্র নির্দিষ্ট কিছু চাকরির অপেক্ষায় বছরের পর বছর পার করে দেয় এবং শেষ পযর্ন্ত সেটা না পেলে নিজের জীবন বৃথা মনে করে।

পৃথিবীতে কোনো কিছুর জন্যই আত্মহনন কাম্য নয়। আপনি যা পাননি তার কথা ভুলে যান বরং আপনার জন্য আরও যা অপেক্ষা করছে সেগুলো গ্রহণ করুন। জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে। খোদ পিএইচডি ডিগ্রি থাকার পর যদি ঝ্যাং স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ করতে পারেন,মাল খালাসের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারেন তবে আপনার করতে অসুবিধা কোথায়? যখন পেটে ভাত থাকবে না, পরনে কাপড় থাকবে না তখন কি কেউ আপনাকে ওগুলোর যোগান দিবে? যদি না দিয়ে থাকে তবে আপনি কিছু একটা কাজ করলে সেই সব লোক কী বললো না বললো তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? পৃথিবীতে কে কি ভাবলো সেটা চিন্তা করে আপনি বসে থাকা মানে নিজেই নিজের ক্ষতি করা,নিজেকে পিছিয়ে রাখা। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন আলবার্ট আইনস্টাইন। আপনি শুনলে আরও একবার অবাক হবেন যে খোদ আইনস্টাইন নিজেই তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর যোগ্য চাকরি পাননি! আপনি তাহলে কেন হতাশ হচ্ছেন?

আমাদের আজকের আলোচনার নায়ক ঝ্যাং এর গল্প কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলেন তার পর মন দিলেন অধ্যাপনায়। ছোটবেলায় লেগে থাকার যে গুণটি তিনি অর্জন করেছিলেন তাতে একটুও মরিচা ধরেনি। কিন্তু এতো কিছুর পরও সাফল্য যেন তার হাতে ধরা দিতেই চাইছিল না। তবে যার জন্ম হয়েছে হার না মানার এক দৃঢ়চেতা মন নিয়ে তিনি কি আর এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতে পারেন। ঝ্যাং ও তাই হাল ছাড়েন নি। এর পর দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেছে। অবশেষে 2013 সালে তিনি পেলেন অসাধারণ এক সাফল্য। বছরের পর বছর ধরে লেগে থাকার ফল হিসেবে তিনি এমন একটি নাম্বারথিওরি তত্ত্ব প্রমাণ করেন যা অনেকদিন থেকে অমিমাংসিত ছিল। (থিওরিটি হলো, p,p+d উভয়ই মৌলিক সংখ্যা এরকম অসীম সংখ্যক জোড়া রয়েছে, যেখানে d< 70,000,000। d এর মান দুই হলে তা হয়ে যায় নামকরা টুইন প্রাইম কনজেকচার। আপনি ভাবতেও পারবেন না এ জন্য ঝ্যাং কত বছর চেষ্টা করেছেন! গুনে গুনে 15 বছর। এই পনের বছরে তার একবারও প্রমোশন হয়নি! আমরা হলে কী করতাম? ভাবতাম ধুর এতো খাটাখাটনি করেও প্রমোশন হচ্ছে না, যাহ চাকরিই করবো না! কিন্তু ঝ্যাং তা করেন নি। তিনি লেগে থেকেছেন এবং সত্যি সত্যিই এক সময় সাফল্য তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে এক লাফে প্রভাষক থেকে তিনি হয়ে গেলেন পূর্ণ অধ্যাপক! আর এই সময়ে ঝ্যাং এর সামনে একের পর এক সুযোগ আসতে থাকলো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে অফার দেওয়া হলো।এবার তিনি বুঝেশুনে সেরাটাকেই বেছে নিলেন।

নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায় শেষ করে তিনি যোগ দিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান্টা বারবারাতে! নাম্বার থিওরি তত্ত্ব প্রমানের পর শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক হওয়াই নয় বরং একে একে অনেকগুলো পুরস্কারও পেয়েগেলেন। যার মধ্যে  কোল প্রাইজ, ক্যাম আর্থার অ্যাওয়ার্ড,রলফ শক প্রাইজ,ফ্রাঙ্ক নেলসন কোল প্রাইজ অন্যতম। এছাড়াও তাকে একাডেমী সিনিকা ফেলোশিপ দেওয়া হলো যা অত্যন্ত সম্মানজনক। পরবর্তী বছরে তিনি ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথেমেটিশিয়ান এ আমন্ত্রিত বক্তা হওয়ার দুর্লভ সম্মাননা লাভ করেন।

একবার ভেবে দেখুন সেই যে দশ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে তাকে বাধ্য হয়ে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছিল, তিনি যদি সেটাই করতেন তবে বিখ্যাত এই ম্যাথেমেটিশিয়ানকে বিশ্ব পেতো না। তিনিও পেতেন না এতো এতো সাফল্য,খ্যাতি,গৌরব। ঝ্যাং এর জীবন থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আমরা যারা খুব অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ি তারা একটি বার ঝ্যাং এর জীবনের দিকে তাকাই। নিশ্চই আমাদের সামনে এমন এক দরজা দেখতে পাবো যে দরজা দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে। সেই আলোর পথে শুধু হাটতে হবে। এই রাস্তা চলে গেছে সাফল্যের ফুলে দুইদিক সজ্জিত করে। একদিন যে ছেলেটি অর্থকষ্টে পড়ে মায়ের সাথে দিনমজুরের কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন,সুপারভাইজার কর্তৃক অবহেলিত হয়েছেন,পিএইচডি ডিগ্রি থাকার পরও চাকরি পাননি, রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন,দিনের পর দিন অর্থাভাবে রাস্তায় রাস্তায় রাত পার করেছেন সেই মানুষটির ছিল নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস। তিনি তার জ্ঞানকে অহংকার হিসেবে দেখেননি বরং থেকেছেন বিনয়ী এবং নিজের উপর আস্থাশীল। ফলে তিনি টুইন প্রাইম কনজেকচার সমস্যার সমাধান করেছেন। আপনি কি ভেবে দেখেছেন যদি অর্থবিত্ত থাকলেই সব হতো তাহলে এই সমস্যার সামাধান বহু আগেই অনেকে করে ফেলতেন।

খুব অল্প কিছু না পাওয়া,অল্প কিছু ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে বা মেনে নিতে না পেরে আমাদের সমাজে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। একবার আত্মহনন করলে তারতো করে দেখানোর মত আর কিছু থাকে না। সুতরাং তাদের উচিত এই গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও একবার জেগে ওঠা। আরও একবার নিজের মনে গেয়ে ওঠা  ” গিভ মি সাম সানশাইন, গিভ মি সাম রেইন, গিভ মি আনাদার চান্স টু গ্রো আপ অন্সএগেন” । হ্যা আপনি চাইলেই আরেকটা চান্স পেতেই পারেন। সুযোগ আপনার হাতে অগনিত। আপনি শুধু লেগে থাকুন। দেখবেন ঝ্যাং এর মত আপনার হাতেও সাফল্য ধরা দিবে। কবির সুমনের মত আপনিও চাইলে শিল্পী হতে পারেন। বয়স কোনো বিষয় না, শিক্ষা গ্যাপ কোনো বিষয় না, গ্রেড কোনো বিষয় না, সাবজেক্ট কোনো বিষয় না। শুধু কাজকে ভালোবাসুন। পাছে লোকে কিছু বলে এই কথাটিকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিন। লোকে কী বললো না বললো তাতে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না। আপনার সাফল্য, ব্যার্থতা সব আপনারই হাতে। একবার না পারিলে দেখো শতবার বলে যে কথাটি কবি বলেছেন আপনি তার কতটা অনুসরণ করেছেন? একবার দুবার বা দশবার ব্যর্থ হওয়া মানে এই নয় যে আপনি সফল হবেন না। আপনিতো শত বার চেষ্টা করেননি। আপনি ভিন্ন ভাবে চেষ্টা করুন এবং নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। নিজেকে বলুন আপনি পারবেন। আপনি সেই সব যোদ্ধাদের একজন যারা কখনো হার স্বীকার করতে রাজি নয় বরং জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত লেগে থাকতে চায়। ঠিক যেমন আমাদের এই গল্পের মহানায়ক উইট্যাং ঝ্যাং।

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

লেখাঃ জাজাফী

গ্রো আপ অন্সএগেন-৩

উইট্যাং ঝ্যাং (Yitang Zhang)

 

 

Most Popular