Friday, March 29, 2024
Homeউপন্যাসরঙ্গীন ফানুস, পর্ব-১

রঙ্গীন ফানুস, পর্ব-১

(ক্যাডেট কলেজ লাইফ নিয়ে নতুন উপন্যাস)

১.

রাজশাহী যাচ্ছি।ঝিনাইদাহ মোড় পেরিয়ে গাড়িটা সবেগে ছুটে চলেছে রাজশাহীর পথে।এই প্রথম রাজশাহী যাচ্ছি।কিছু দূর যেতেই হাতের ডান পাশে চির সবুজ এক চত্বর আমার চোখ জুড়িয়ে দেয়।সবেগে ছুটে চলা বাসের জানালা দিয়ে কতটুকুইবা দেখা যায় সেই চত্বর।রাস্তার ধারে গেটের উপরে নাম লেখা ছিল।চলন্ত বাস থেকে সেই নামটাও পড়তে পারিনি।যতটা দেখেছি ভিতরে অবিরাম সবুজের লীলাভূমি।শান বাধা গ্রাউন্ডে দাগ টানা।দূরে একটা কি দুটো বড় মাঠ,ফুটবল গ্রাউন্ড এবং আরো কিছু কিছু।সেই সময়ে ওসবই আমার জীবনে প্রথম দেখা। ফলে চোখে সেই সবুজ মায়াবী প্রান্তরটির ছবি আজীবনের মত ফ্রেম বন্দী হয়ে গেল।বাউন্ডারি ঘেরা সেই প্রান্তরে সেই আঙিনায় না জানি কতই রহস্য লুকিয়ে আছে ভেবে ভেবে শিহরিত হই।মনে হয় বাস থামিয়ে ছুটে যাই সেই প্রান্তরে।

     আমার কেবলই মনে হয় মাটির পৃথিবীতে এতো সুন্দর কোন জায়গা হতে পারে?এটা কি কোন স্বপ্নলোক।পাশে বসা বাবাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা ওই বাউন্ডারি ঘেরা সবুজ প্রান্তরটাতে কি আছে?বাবা হয়তো আগেই খেয়াল করেছিলেন আমি অপলোক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।তাই বাবাও হয়তো দেখেছিলেন ওই স্বপ্নভূবনটিকে।তিনি আমার কাধে হাত রেখে বললেন ওটা ক্যাডেট কলেজ।বাবার মুখে ক্যাডেট কলেজ শব্দটা শুনে মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগে কবির স্যারের মুখে প্রথম এই শব্দটা শুনেছিলাম।যতক্ষণ বাসটা ছুটে আঙিনার সীমানা পার না হলো ততোক্ষণ আমার ছোট্ট স্বপ্নাতুর চোখ দুটো সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। বাবা বোধ হয় সেদিনই টের পেয়েছিলেন। আমার চোখের স্বপ্নটা তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

যখন বাসটা সেই সবুজ সোনালী ভুবন পেরিয়ে গেছে তখন আমার চোখ ভেজা।বেদনা নয় বরং ওরকম সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পেরে আনন্দে চোখ ভিজে গেছে।বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠেছিলেন।ভেবেছিলেন আমি বোধহয় বাড়ির জন্য, গ্রামের জন্য মন খারাপ করছি।বাবা জানতে চাইলেন আমার চাখে পানি কেন? জানতে চাইলেন গ্রামের জন্য, গ্রামের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করছি কিনা।

আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে, গ্রামের কথা এবং গ্রামের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে।বাবা আমার চোখের জল মুছে দিলেন।আমি বাবার বুকে মাথা রেখে বললাম বাবা আমার চোখের এই জল গ্রামের বন্ধুদের জন্য নয়, গ্রামের স্কুলের জন্য নয়, এমনকি গ্রামের জন্যও নয়। বাবা তখন সপ্রসন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।এতো ছোট বয়সে আমার আরো কিছুর জন্য দরদ থাকতে পারে বাবা তা কল্পনা করতে পারছিলেন না।

তিনি সস্নেহে জানতে চাইলেন কেন তবে আমার চোখে জল। কিছুক্ষণ আগে অপলোক চোখে তাকিয়ে দেখা সবুজ চত্বরের কথা বাবাকে বললাম। বললাম বাবা ওরকম স্বপ্নময় একটা ভুবন দেখতে পেয়ে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেছে।বাবা ওখানে কি আমি কখনো যেতে পারবো? ওখানে কারা থাকে বাবা? তারাকি দেশের রাজা? রাজা না হলে ওই যায়গাটা ওতো সুন্দর কেন? বাবা আমাকে আরো জোরে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আমার স্বপ্নটা সম্ভবত তখন বাবার বুকে লেপটে গেল।আমি বাবার কাছে আরো কতকি প্রশ্ন করলাম কিন্তু বাবা কিছুই বলতে পারলেন না।বাবার আসলে ওই সবুজ চির স্বপ্নময় ভুবনের কিছুই জানা ছিলনা তেমন।

বাবার ছিল পুলিশের চাকরি।বড় কোন পোষ্ট ছিলনা সেটা।সাধারণ কনস্টেবল ছিল আমার বাবা।দেশের নানা প্রান্তে বাবার বদলী হলেও কখনো কোন দিন সেসব জায়গায় যাওয়া হয়নি আমাদের।সামান্য বেতনের চাকরি ছিল বলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়নি কখনো।এই যে রাজশাহী যাচ্ছি সেটা বড় ভাগ্যের ব্যাপার।বাবা কনস্টেবল থেকে হাবিলদার হয়েছেন।নতুন করে বদলী হয়েছেন রাজশাহীতে।সেখানে বাবা সরকারী কোয়াটার নামে একটা জিনিস পেয়েছেন।

কোয়াটার কি তা জানা ছিলনা আমার কিংবা আমার মা ও ভাইবোনদের।বাবার মুখে জানতে পারি কোয়াটার হলো বাড়ি।মানে একটু ভদ্রতা করে বাড়িকে কোয়াটার বলা হয়।আমাদের রাজশাহী যাওয়া উদ্দেশ্য হলো সেই সরকারী বাড়িতে থাকা।জানি আমার মধ্যে এক রকম স্বপ্ন তৈরি হতে শুরু করে। সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগে ঝিনাইদাহ মোড় থেকে একটু এগিয়ে হাতের ডান পাশে দেখা চির সবুজ সোনালী প্রান্তর।যে প্রান্তরের খোঁজ এর আগে কখনো পাইনি,কোন দিন স্বপ্নেও দেখিনি সেটা। শুধু একবার নামটা শুনেছিলাম কবির স্যারের মুখে।আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি।তিনি শুধু মুখে বলেছিলেন ক্যাডেট কলেজ শব্দটি।

গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই আমি শহর সম্পর্কে কোন ধারনাই রাখিনা।গ্রাম্য না বলে সরাসরি গেয়ো বলা যেতে পারে। কারণ আমি যে গ্রামে জন্ম নিয়েছি সেই গ্রাম আসলে গ্রাম নয় যেন তার থেকেও অনুন্নত কিছু। যেটাকে এক কথায় গেয়ো বলা যেতে পারে।অনেকটা পিছিয়ে পড়া মানুষকে যেমন অন্যরা অবহেলা করে ক্ষ্যাত বলে ডাকে ঠিক সেভাবে আমার গ্রামকে এবং গ্রামের মানুষকে গেয়ো বললে খুব বেশি গায়ে লাগবে বলে মনে হয় না।বিশ্ব তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির পথে আর আমার গ্রাম সেই উন্নয়নের ধারার বিপরীতে অবস্থান করছে।

অনেকটা স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালানো মাঝির সেই অংকের মত।বিপরীতে গেলে একই সাথে স্রোত এবং নৌকার গতিবেগের তারতম্য লক্ষ্যনীয়।পঞ্চাশ বছর আগেও আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলনা,রাস্তা পাকা ছিলনা এই পঞ্চাশ বছর পরও বিদ্যুৎ আসেনি,রাস্তা পাকা হয়নি। সুতরাং সেরকম একটা গ্রামকে এবং গ্রামের মানুষকে গেয়ো বললে খুব বেশি গায়ে লাগার প্রশ্নই ওঠেনা।

     সেরকম একটা অজপাড়া গায়ে বেড়ে ওঠায় শহর সম্পর্কে ধারনা না থাকাটাই স্বাভাবিক।আনোয়ার ভাই লটারীতে একটা টেলিভিশন জিতেছিলেন।সেটাই ছিল গ্রামের প্রথম টেলিভিশন। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই মিলে সেই টেলিভিশন দেখতাম। টেলিভিশনে তখন সব থেকে বেশি জনপ্রিয় ছিল আলিফ লায়লা নামে একটা সিরিজ।সেই টেলিভিশনে যা দেখা হতো সেটাই আমাদের জন্য সব।বাড়ির পাশেই ছিল আমাদের স্কুল।ঘন্টা বাজতেই হাতে বই খাতা নিয়ে ভো দৌড় দিতাম আমরা।

হয়তো অধিকাংশ দিন গায়ে শার্টও থাকতো না। শার্ট হাতে নিয়েই দৌড়াতাম।পথে যেতে যেতে কখনো পরা হতো শার্টটা আবার কখনো স্কুলে গিয়ে গায়ে দিতাম।শিক্ষকেরা সবাই ছিল পরিচিত,এলাকার মানুষ বলে কেউ কাউকে কিছু বলতো না।আমরা যে স্কুলে যাচ্ছি এতেই যেন তাদের আত্মতুষ্টি।আবার এমনও দিন যেত যে ভো দৌড় দিয়েছি, বই খাতা ঠিকই নিয়েছি কিন্তু শার্ট নিতে ভুলে গেছি। গায়ে যে স্যান্ডো গোঞ্জি পরা ছিল হয়তো সেটা পরেই চলে গেছি স্কুলে।

কোন কোন দিন মা পিছন থেকে ডেকে শার্ট ধরিয়ে দিতেন। আর যেদিন মা আশেপাশে থাকতোনা সেদিন হয়তো ভুল হয়েই যেত।স্কুলে গিয়ে দেখা যেত আহহারে শার্টটাইতো আনা হয়নি।ফিরে গিয়ে শার্ট আনতে হবে ভেবে স্কুল থেকে বের হতে চাইলে কবির স্যার কোন ভাবেই বের হতে দিতেন না।তার মতে আমরা যদি একবার স্কুল থেকে বেরিয়ে যাই তবে সেদিনের মত আমরা আর স্কুলে ফিরবো কিনা সন্দেহ আছে।তাই তিনি আমাদের বের হতে দিতেন না। সত্যি বলতে স্কুলে যেতে আমাদের খুব ভাল লাগতো কিন্তু কোন ভাবে যদি স্কুল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেতাম তাহলে আর ফিরে যেতেও ইচ্ছে করতো না।

আমাদের কবির স্যার খুবই ভাল মানুষ ছিলেন।আমাদের মতে তার ছিল অনেক জ্ঞান।ফিলোসফি দেখাতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। তার ভাষ্য ছিল এটাতো শহরের নামিদামি স্কুল নয় কিংবা ক্যাডেট কলেজও নয় যে পোষাক বড় বিষয় হয়ে দাড়াবে।এখানে এই পাড়াগায়ের অখ্যাত এই স্কুলে পড়ালেখার জন্য বই, খাতা, কলমই যথেষ্ট। সাথে ছাত্র ছাত্রী আর শিক্ষক থাকলেই হলো। ছাত্রদের গায়ে শার্ট থাকলো না  স্যান্ডোগেঞ্জি থাকলো সেটা দেখার কিছু নেই।তোমাদের কে কতটা পড়ালেখা শিখে কি হবে সেটাতো আমরা আগে থেকেই অনুমান করতে পারি।

তাই অত কিছু নিয়ে ভাবাভাবি লাগবেনা। কবির স্যারের কথাটা খুব মনে পড়ে।এখণ মনে হয় গ্রামের সেই সময়ে স্কুলের স্যারেরা তাদের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে খুব বেশি স্বপ্ন দেখতেন না। তারা মনে করতেন কোন মত পাশ করে তাদেরই মত কোথাও কোন স্কুলে দপ্তরি নয়তো কেরানী নয়তো সবোর্চ্চ তাদের মত মাষ্টারী করবো আমরা।ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কবি সাহিত্যিক আর্মি অফিসার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিজ্ঞানী বা দার্শনিক সহ আরো যে হাজার রকমের পেশায় যাওয়ার হাতছানী থাকে তা যেন কারো স্বপ্নতেও ছিলনা। …চলছে…

পর্ব-২ পড়ুন এখানে

123 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Most Popular