Thursday, November 21, 2024
Homeউপন্যাসনা মানুষি জীবন

না মানুষি জীবন

পার্ট-১ (দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত)

দমকা হাওয়ায় হারিকেনের আলোটা কিছুক্ষন আগেই নিভে গেছে। ওটা আর জ্বালাতে ইচ্ছে করছেনা। রাত যদিও খুব একটা হয়নি তার পরও জেগে থাকতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা। টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টির ফোটা আছড়ে পড়ছে। নুপুরের শব্দের চেয়েও সেটা বেশি মিষ্টি মনে হচ্ছে। একা একা রাত জেগে থেকে আর কি হবে। বাবা মা কেউ বাড়িতে নেই। পরীর দিঘির মেলা দেখতে বড়দিকে সাথে নিয়ে বাবা মা ছোট পিসিদের বাড়িতে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে তারা আজ ফিরবেনা। ওরা বাড়িতে থাকলে আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকতে হতো। পড়ি বা না পড়ি হারিকেন জ্বালিয়ে গুনগুন করলেই মা মনে করতো আমি বিদ্যাসাগর হচ্ছি। আদতে আমিতো লবডঙ্কা। পাটখড়ির বেড়ার নিচ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরের ভিতরে ঢুকছে। চারদিকে ঘন অন্ধকার। অজ পাড়াগায়ে বিদ্যুতের আলো এসে পৌছেনি। ভোটের সময় নেতারা কত আশার বাণী শুনিয়ে গেছে তার কোন ঠিক নেই কিন্তু ভোট পার হলেই তারা হারিয়ে গেছে। আমরা জানি তারা আবার কোন একদিন ভোট চাইতে আমাদের দুয়ারে ভিখারীর বেশে দাড়াবে। তারা আগের সব কিছু ভুলে যাবে। আমরাও তাদেরকে ক্ষমা করে তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আবার তাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করবো। সাত পুরুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটা। রমা কাকি সে দিক থেকে আলাদা। সে কাউকে ভোট দেয় না। নিতাই বাবু তাকে আশা দিয়েছিল ভোটে জিতলে আমাদের গ্রামের জন্য একটা টিউব অয়েল দিবেন, যেন সবাই সেই টিউব অয়েল থেকে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারি।

নিতাই বাবুকে আমরা ভোট দিয়ে পাশ করিয়েছিলাম কিন্তু তিনি কথা রাখেন নি। তার পর যারাই এসে ভোট চেয়েছে আর আশার বাণী শুনিয়েছে রমা কাকি কারো কোন কথা বিশ্বাস করেনি। সে আর মিথ্যা কথায় প্রতারিত হতে চায়না। আমাদের গ্রামের অন্যরা সবাই ঠিকই প্রতারিত হয়। পরিমল কাকার বড় ছেলেটা ঢাকায় থাকে। আসার সময় সে একটা টেলিভিশন কিনে নিয়ে এসেছিল। বিদ্যুত না থাকার কারণে তা আর দেখা হতো না কারো। কিন্তু টেলিভিশনটা ওভাবে ফেলে রেখে লাভ কি। তাই শেষে পরিমল কাকা একটা ব্যাটারি কিনে আনলেন। সেই টেলিভিশনে বিরেন শিকদারকেও দেখা যায় হাসি মুখে মুরগির রান খাচ্ছে, কোক খাচ্ছে। সেটা দেখে আমাদের হাহুতাশ হয়তো বাড়েনা কিন্তু রমা কাকির শরীর জ্বলে যায়। সে খেকিয়ে উঠে বলে, দেখ কইছিলাম না এরা নেমক হারাম। ভোটের সময় এসে হাতে পায়ে ধরে ভোট চায় আর ভোট ফুরালে লাপাত্তা। পাশ করার পরের পাঁচ বছর তাদেরকে শুধু টিভিতেই দেখা যায়। সে জন্যই আমি দুমুখো সাপকে বিশ্বাস করিনা। রমা কাকির কথায় যুক্তি আছে। এসএসসিতে লেটার মার্ক সহ পাশ করেছিল সে। কিন্তু গরীব ঘরে জন্ম নিয়ে  ওটুকু যে শিখতে পেরেছে এটাই ভাগ্য। পড়ালেখা আর হয়ে ওঠেনি তার।

 

বিকেল থেকেই আকাশে প্রচন্ড মেঘ জমেছিল। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই আকাশ কাপিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। কতক্ষণ চলবে তার কোন ঠিক নেই। বৃষ্টির সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে বইছে দমকা হাওয়া। বড়দি বাড়িতে থাকলে বৃষ্টির দিনে ওর মুখ থেকে ভেসে আসতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

”নীল নব ঘনে আষাঢ় গগণে তিল ঠাই আর নাহিরে

ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে”

 

থেকে থেকে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। সেই আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে চমকে উঠছে গোয়ালের গরুটা। তার সাথে হয়তো চমকে উঠছে তার বাছুরটাও। সে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। ছোট বেলায় যখন বিদুৎ চমকাতো আমিও মায়ের আঁচলের তলে মুখ লুকাতাম।  আজ মাকে বেশি করে মনে পড়ছে। সারাদিন মা এতো বকে তার পরও আশ্চর্য ভাবে এখন মাকেই বেশি মনে পড়ছে। মাত্র একটি দিনের জন্যইতো মা পিসিদের বাড়িতে গেছে। আমাকে মা বকাবকি করে, আমারও খারাপ লাগে। অজ পাড়াগায়ে জন্ম নিয়ে যে বয়সে আমার কিছু একটা করার কথা, সংসারের হাল ধরার কথা সেই বয়সে আমি বাবার ঘাড়ে ভুতের মত চেপে বসে আছি। বড়দির বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। আমাদের যে অবস্থা তাতে ভাল ঘরে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে। দু’টো মাত্র ঘর আমাদের বাড়িতে। একটা ছনের চালার রান্ন ঘর আর একটা টিনের। টিনের ঘরটা যে কিরকম টিনের সেটা টের পাওয়া যায় বৃষ্টি শুরু হলে। মা আর বড়দির ছোটাছুটি শুরু হয়। এখানে সেখানে থালা বাসন পেতে রাখতে হয়। বাবা কষ্ট করে একটা পড়ার টেবিল কিনে দিয়েছিল। সেই ছোট্ট টেবিলটার ওপর আমার আর বড়দির বই খাতা সাজানো আছে। বৃষ্টি এলে সেই বই খাতার উপরে তিন চারটা থালা বাটি ভর করে। সাধারণ ভাবে কেউ কিছু বুঝতে পারবেনা কিন্তু চোখটা টিনের চালে নিয়ে গেলে টের পাওয়া যাবে সেই চালে অসংখ্য ছিদ্র। বৃষ্টি আসলেই সেই ছিদ্র দিয়ে অবিরাম ভাবে জল ঢুকে পড়ে। সেই জল যেন আমাদের বই, খাতা, বিছানা ভিজিয়ে না দেয় তার চেষ্টাতে ব্যস্ত থাকে আমার মা আর বড়দি।

হঠাৎ মনে পড়ে আজ তো কারো ছোটাছুটি নেই। আজ তো তাহলে বৃষ্টি মনের আনন্দে সব ভিজিয়ে দিতে পারবে। একবার মনে হলো ভিজুক না একটু। পরে ভাবলাম মা আমাকে কত ভালবাসে,দিদিও ভালবাসে খুব। একদিনের জন্য এই বাড়িটা আমার হাতে সপে দিয়ে গেছে তারা। সেই দায়িত্বটুকু যদি পালন করতে না পারি তবে আমার ওপর থেকে তাদের সব বিশ্বাস উঠে যাবে। আমি দ্রুত উঠে পড়ি বিছানা ছেড়ে। খুঁজে খুঁজে দুই তিনটা বাটি, থালা, বাসন জোগাড় করি। বাবার বালিশের নিচেয় একটা দুই ব্যাটারির টর্চ লাইট ছিল সেটাও খুঁজে পাই। সেটা জ্বালিয়ে প্রথমে টেবিলের কাছে যাই। সকালে বাবা মা  আর দিদি বেরিয়ে যাওয়ার পর আর আমার ঘরে যাওয়া হয়নি। ঘুমানোর সময় আমি আজ বাবা মায়ের বিছানাতেই ঠাই নিয়েছিলাম। আমার ঘরে থাকার মত তেমন কিছু নেই যা চোরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু মায়ের কিছু শাড়ী আর দিদির জন্য কেনা রুপোর গয়না আছে দুই জোড়া যেটা মায়ের ঘরে। সে জন্যই মায়ের ঘরে থাকা। আমার ঘরের দরজাতে একটা ছোট্ট তালা দেওয়া আছে। সেটা খুলে ভিতরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে থালাবাটি গুলো দিতে গিয়ে চমকে উঠি। মা কিংবা দিদি যাওয়ার আগেই যায়গায় যায়গায় থালা বাটি পেতে রেখে গেছে। তাদের দায়িত¦ বোধ আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি নিশ্চিত জানি বাকি সব জায়গাতেও তারা একই ভাবে পাতিল বসিয়ে গেছে যেন বৃষ্টির জল ভিজিয়ে একাকার করে দিতে না পারে। আমি যে অকর্মা এবং অলস সেটা আমার মা কিংবা দিদি বেশ ভালই অনুভব করে। আমি নিশ্চিন্ত মনে ফিরে এলাম বাবা মার ঘরে। বাইরে গোয়ালের দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখলাম গরুটা আর তার বাছুরটা দাড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে তারা ডেকে উঠছে। বেশ কিছুদিন হলো গরুটা তিন সের দুধ দিচ্ছে। সপ্তাহে হয়তো একদিন আমরা একচুমুক করে দুধ পান করি। বাকিটা বিক্রি করে দেই বাজারে। দিদির বিয়ের কথা চিন্তা করে আমারও খেতে ইচ্ছে করেনা।

দিদির বিয়েতে কত খরচ হবে কিন্তু আমি জানিনা বাবা একলা কিভাবে সেই খরচ সামলাবেন। বাবারতো আয় বলতে তেমন কিছুই নেই। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দেই। বাইরে বৃষ্টির অবিরাম ঝরে পড়া আর টিনের চালে রিমঝিম শব্দ কানে এসে বাজছে। দক্ষিণের জানালাটা খুলতেই চোখে পড়ে পুকুরটা। পুকুরটা আমাদের না। পরিমল কাকার এই পুকুরটাতে সারা বছর পানি থাকে। গ্রীস্মকালে গায়ের সবাই এখানেই গোসল করে। কিন্তু বছরের বাকি সময়টাতে এখানে খুব একটা কেউ আসেনা। জানালাটা বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করি। আসে পাশে কোন বাড়ি নেই। সব থেকে কাছের বাড়িটাও বেশ দুরে। বাবা কেন যে একলা এই নির্জন জায়গাতে বাড়ি করেছিল তা জানিনা। প্রতিদিন সবার আগে আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যা নামে, আর সবার পরে আমাদের বাড়িতে সুর্যের আলো আসে। এ যেন আলো অন্ধকারে যাই। ভুতুড়ে মনে হয় যায়গাটাকে। তবে থাকতে থাকতে নির্জনতাকে কিভাবে কিভাবে যেন সবাই ভালবেসে ফেলেছি। দিদিও দেখি কখনো আর হাহুতাশ করে না। আমি কোন দিন এই বাড়িতে একাকী একটা রাত কাটিয়েছি বলে মনে পড়ে না।

 

পার্ট-২

 

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বৃষ্টির শব্দের প্রথমে বুঝতে পারিনি তবে কিছুক্ষন কান খাড়া করে রাখার পর বুঝতে পারলাম দরজায় শব্দ হচ্ছে। রাত কয়টা বাজে অনুমান করতে পারছিনা। ঘড়ি না থাকার এই এক সমস্যা। যেখানে দু বেলা খাবার জন্য চুলায় আগুন জ্বলে না সেখানে ঘড়ি থাকাটাতো রীতিমত বিলাসীতা। আমি হাতড়ে হাতড়ে বাবার টর্চ লাইটটা খুঁজে বের করি। কত কাল আগে লাইটে ব্যাটারি লাগানো হয়েছিল তা বোধ হয় বাবা নিজেও জানেনা। লাইটের আলো কমে গেছে। এখন সেটা টিমটিম করে জ¦লছে। মনে হয় একটা জোনাক পোকা ধরে লাইটের মাথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে সেই আলো দিচ্ছে। টর্চ লাইটা বাবা কেনেনি। একটা টর্চ লাইট কেনার সামর্থ আমার বাবার নেই বললেই চলে। কোন এক সন্ধ্যা রাতে গঞ্জ থেকে বাড়ি ফেরার পথে কালুকান্দির মাঠে হাটার সময় কিছু একটার সাথে বাবা হোঁচট খেয়েছিল। অন্ধকার ছিল বেশ। একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে গিয়ে দেখে একটা টর্চ লাইট। বাবা সেদিন টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে সেটা জ¦ালিয়ে আসে পাশে কেউ আছে কিনা দেখতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাউকেই পাওয়া যায়নি। বাবা মিথ্যা বলেছিল কিনা জানিনা। কেউ যদি নাই থাকবে তবে ওখানে একটা টর্চ লাইট কেন থাকবে। কে ফেলে রেখে যাবে একটা টর্চ লাইট। বড় দিদি বলেছিল বাবা কোন কালে হয়তো এমন কোন পুন্য করেছিল যার জন্য পুরস্কার হিসেবে এই টর্চ লাইটটা পেয়েছে। আমি দিদির কথার কোন প্রতিবাদ করিনি। সম্ভবত সেই যে টর্চ লাইট পেয়েছিল ব্যাটারি সহ তার পর বাবা হয়তো কোন দিন লাইটে ব্যাটারি লাগায়নি।

লাইটটা জ্বালানোও হতো খুব কম। টিমটিমে আলো জ্বেলে দরজার কাছে যেতে না যেতেই আবার দরজায় করাঘাত পড়লো। বুঝলাম আমি ভুল শুনিনি। নিশ্চই বাইরে কেউ এসেছে। কে হতে পারে তা বুঝতে পারছিনা। বাবা নিশ্চই নয়। কারণ সে তো মা এবং দিদির সাথে পিসিদের বাড়িতে গেছে। আজ ফেরারও কথা নয়। আবার মনে হলো বাবাই হয়তো ফিরে এসেছে। পিসিদের বাড়িতে থাকার মত ঘরওতো সেই আমাদেরই মত। তাছাড়া আমাকে একা রেখে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা হওয়ায় মা’ই হয়তো বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করতে যাব তখন আবার দরজায় করাঘাত হলো। এবার কথাও শুনতে পেলাম। কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি গলা খাকারি দিয়ে বললাম কে? আমার কথা শুনে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, নিখিলেশ দরজা খোলো, আমি সুষমা। কন্ঠ শুনে চিনতে পারলাম। কিন্তু সুষমা দি এতো রাতে, এই বৃষ্টির মাধ্যে কেন এসেছে? তাছাড়া আমিতো সব সময় সুষমাদি বলেই তাকে ডাকি। সে  পরিচয় দেবার সময় সুষমাদি না বলে শুধু সুষমা বললো কেন?

 

খুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখনো অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। এ বৃষ্টি যেন পণ করেছে সে আর থামবেই না। বৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে সারা গ্রাম ভাসিয়ে দেবে। আকাশের কি খুবই মন খারাপ? তার এই কান্না কি তবে থামবে না। টিনের ঘর হলেও আমাদের ঘরের বারান্দার ছাউনি ছনের। ছনের ছাউনি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় সেটা গড়িয়ে মেঝেতে পানি পড়ছে। সেই ভেজা বারান্দায় পড়ে আছে একটা অর্ধ ছেড়া কলাপাতা। যে কলাপাতা মাথায় দিয়ে সুষমাদি এসেছে আমাদের বাড়িতে। একটা ছাতা কেনার মত সমর্থ এ গায়ের দু একজন ছাড়া কারোরই নেই। সবার ভরসা ওই কলাপাতা, নয়তো বড় কচু পাতা। বৃষ্টির মওসুমটা আমরা এক প্রকার ভিজে ভিজেই কাটিয়ে দেই। আগে জ্বর বাঁধতো খুব, এখন সব সয়ে গেছে। সুষমাদির ফেলে রাখা অর্ধ ছেড়া কলাপাতা থেকে চোখ সরিয়ে সুষমাদির দিকে চোখ ফেরাই। তার হাতে একটা হারিকেন মিটমিট করে জ¦লছে। হারিকেনে সম্ভবত তেল ফুরিয়ে এসেছে। তবে কি সুষমাদি হারিকেনের জন্য তেল নিতে এসেছে? ঘরে তেল আছে কি না তাওতো জানা নেই। এ সংসারের কোন জিনিষটা কোথায় রাখা থাকে তাও আমার জানা নেই। দিদি আর মাই সব সামলে রাখে। খাবার সময় হলেই কেবল আমাকে পাওয়া যায়। এখন যদি সুষমাদি হারিকেনের জন্য তেল চায় তবে সেটা খুঁজে পেতেই আমার রাত পেরিয়ে যাবে।

 

সুষমাদির হাতে ধরে রাখা হারিকেনের মৃদু আলোয় তার মুখটা খুব মায়াবি মনে হচ্ছে। পরনের শাড়িটা ভিজে একাকার হয়ে গেছে। শরীরের সাথে লেপটে আছে অর্ধ ছেড়া মলিন শাড়িটা। বাইরের তুমুল বৃষ্টি। সামান্য কলাপাতা তাকে সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পারেনি। সুষমাদির খালি পা,ভেজা শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে মেঝেতে। মাটির মেঝে ভিজে কাদা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি থেকে সুষমাদিদের বাড়ি বেশ খানিকটা দুর। মাঝের পথটুকুতে আর কোন বাড়ি নেই। জন শুন্য এ পাশটাতে কেবল  আমরাই থাকি। হারিকেনের তেল নিতেই যদি সুষমাদি আসবে তাহলে এই রাতে কেন আসতে হবে। রাতটাতো এমনিতেই কাটিয়ে দেওয়া যেত। সকালেই তেল নিয়ে যেতে পারতো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসায় সে কাপছে। আলো অন্ধকারের মিশেলেও সেই কাপুনিটা টের পাওয়া যাচ্ছে। আমি বললাম সুষমাদি এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসলে যে! মা,দিদি কেউতো বাড়িতে নেই। বাবাও গেছে তাদের সাথে পরীর দিঘির মেলা দেখতে। সুষমাদির কাপুনি বেড়েই চলছে। কাপাকাপা গলায় বললো, কাকিমা যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয়েছিল। বলেছে আজ নাকি ফিরবেনা।

 

হঠাৎ করে ঝড়ো বাতাস এসে সুষমাদির হাতে ধরে থাকা হারিকেনটি নিভিয়ে দিল। সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকে উঠলে সুষমাদিকে কেমন যেন ঘোর লাগা মনে হলো। সুষমাদির বয়স যখন পনের বছর তখন তার বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরে একটা ফুটফুটে মেয়েও জন্ম নিল। মেয়েটির নাম সুকন্যা। সুকন্যার কপালে বোধ হয় সুখ লেখা ছিলনা। সুকন্যার বাবার ভাই বোন কেউ ছিলনা। পরিবারে কেউ না থাকলেও সুষমাদি সুখের কোন অভাব বোধ করেনি। সুকন্যাকে নিয়ে সুষমাদি আর তার স্বামীর ছিল সুখের সংসার। এক সকালে গঞ্জ থেকে ফেরার পর কি এক অসুখে পড়লো সে। বেশ কিছুদিন ভুগে মারা গেল। সুষমাদির কপালের সিদুর মুছে গেল সতের বছর বয়স হতে না হতেই। সুকন্যার বয়স তখন দেড় বছর। সুষমাদি মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসলো বাবার ঘরে। বাবা ছাড়া সুষমাদির আর কেউ ছিলনা। জ্ঞাতি গোষ্ঠিও কেউ ছিলনা। বাবার কাছে শুনেছি তারা নাকি দুর কোন গা থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছিল। তাই তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠি না থাকাই স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে মিশতে মিশতে আমরাই তাদের আত্মীয়র মত হয়ে উঠেছিলাম।

 

সুষমাদির স্বামী মারা যাবার পর সে যখন বাপের বাড়ি চলে আসলো, তার বাবা তখন এক প্রকার বিছানায়। দীর্ঘ দিন তিনি হাপানি রোগে কাতরাচ্ছেন। মাঝ রাত হবে হয়তো। ঘড়ি নেই তাই বুঝতে পারছিনা ঠিক কত রাত হয়েছে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি আর আকাশে মেঘের কান ফাটানো শব্দ ছাড়া কোথাও কিছু চোখে পড়ছেনা। এই বৃষ্টি ভেজা ঘোর অন্ধকার রাতে বাড়িতে আমি একা। আমার সামনে খোলা চুল,খালি পা,ভেজা শরীরে দাড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে সুষমাদি। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। সুষমাদি হঠাৎ সেই অন্ধকারে হাতড়ে আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললো নিখিলেস আমাকে বাঁচা। আমি বুঝতেই পারিনি কি হচ্ছে এবং কি হতে চলেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সুষমাদির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আরো জোরে চেপে ধরলো। আমি মনকে প্রবোধ দিয়ে সুষমাদিকে শান্ত হয়ে সব খুলে বলতে বললাম। সুষমাদি আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো আমার একমাত্র মেয়ে সুকন্যা বোধ হয় আর বাঁচবেনা। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে ওর। সুষমাদি জানালো সন্ধ্যা থেকে খুব জ¦র, সাথে প্রচন্ড বমি করতে করতে মেয়েটা একেবারে বিছানা ধরেছে। প্রচন্ড এই বৃষ্টির রাতে মেয়েটাকে  নিয়ে কি করবে সে ভেবে পায়নি তাই আমার কাছে এসেছে। আমি জানি আমিও নিরুপায়। এই মধ্য রাতে প্রচন্ড বৃষ্টিতে সব ভেসে যাচ্ছে। এর মাঝে আমার আর করার কিইবা থাকে। আমি সুষমাদিকে শান্তনা দিলাম। বললাম আমাকে কি করতে হবে বলো। সে আমাকে তার সাথে বাড়িতে যেতে বললো। বাবা মা আমাকে আমাদের বাড়িটা দেখে রাখতে বলে গেছে এখন এই বাড়ি ফেলে ঘোর অন্ধকার বৃষ্টি বিঘিœত এই রাতে কিভাবে আমি যাই ভেবে পাইনা।

 

সুষমাদিকে বারান্দায় রেখে আমি ঘরের ভিতরে যাই। বৃষ্টির শব্দে এতো কাছ থেকেও যেন একজন আরেকজনের কথা ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিনা। আশে পাশে কোথাও কোন বাড়ি নেই, কোন মানুষ নেই। আমাদের বাড়িটা যেন কোন এক নিঝুম দ্বীপে। সুষমাদিকে বললাম, তুমি দাড়াও আমি ঘরে তালা মেরে আসি। অন্ধকারে মিটমিট করে জ¦লা টর্চ লাইটের আলোয় চাবি খুঁজলাম। চাবি হাতে নিয়ে ফিরতেই কার যেন গরম নিঃশ্বাস আমার কাধে এসে পড়লো। আমি চমকে চর্ট ফেলতেই ভেসে উঠলো সুষমাদির মুখ। সে মুখে বড় মায়া, যেন সেই মায়া কাটিয়ে কেউ চোখ ফেরাতে পারবেনা। আমি বললাম, সুষমাদি তুমি এখানে কখন এলে? সে বললো বাইরে অন্ধকারে ভীষণ ভয় করছিল, তাই তুমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আমিও ঢুকেছি। আমি সুষমাদিকে নিয়ে ঘর থেকে বারান্দায় নেমে এলাম। ঘরের দরজায় তালাটা ভাল করে আটকে দিলাম। বারান্দার এক কোনায় একটা মাথল ছিল কিন্তু সেটা আর খুঁজে পেলাম না। বাবা এই মাথলটা নিজে বানিয়েছিলেন। রোদ  বৃষ্টিতে ওই মাথলটাই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু দরকারের সময় তা পাওয়া গেলনা। এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই যেতে হবে। বেরোনোর আগে সুষমাদির হারিকেনটা আবার জ্বালিয়ে নিলাম। জানিনা কতক্ষণ সেটা জ্বলবে। বাইরে যে দমকা বাতাস তাতে মুহুর্তেই হারিকেন নিভে যাবে এটা নিশ্চিত।

 

মাথায় একটা গামছা পেচিয়ে সুষমাদির সাথে তার বাড়ির দিকে রওনা হলাম। পিছনে পড়ে থাকলো আমাদের বাড়িটি। যে বাড়িতে আজই প্রথম  আমি একাকি রাত কাটাতে চলেছিলাম। গ্রামের শেষ মাথায় আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির আগের বাড়িটাই সুষমাদিদের। সেই বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দুরত্ব অনেক। মাঝখানে জন মানুষের বসবাসের চিহ্ন নেই। সে জন্যই রাস্তাও সেভাবে তৈরি হয়নি। রিলিফের টাকায় রাস্তা হওয়ার কথা ছিল, তার পরিবর্তে সেই রিলিফের টাকায় মেম্বারের বাড়িতে উঠেছে পাকা দালান। আমাদের কথা আর কে ভাবে! সুষমাদি আমার পাশে পাশে হাটছে। এতো কাছাকাছি অবস্থানে আমি কোন দিন কারো সাথে হাটি নি। না বাবা মার সাথে, না অন্য কারো সাথে। সুষমাদির ভেজা শরীর আমার শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়ার মত অবস্থা। আমি সে সবে গা করছিনা। মনের মধ্যে একটাই চিন্তা সুষমাদির একমাত্র কন্যা সুকন্যা এখন কেমন আছে। যে পরিমান বৃষ্টি হচ্ছে তাতে মাথার উপর ছাতা থাকলেও ভেজা থেকে শরীর বাঁচানো যেত না। সেখানে সুষমাদি এক হাতে হারিকেন অন্য হাতে কলাপাতা ধরে রেখেছে মাথার উপর। সেই কলাপাতা বাতাসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। আমরা দুজনই সমানে ভিজছি। বৃষ্টিতে ভিজে আমার গেঞ্জি শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। পরনের লুঙ্গিটা পায়ের সাথে ভিজে জড়িয়ে গেছে, তাই হাটতে অসুবিধা হচ্ছে।  অন্ধকারে না তাকালেও বোঝা যায় সুষমাদিরও হাটতে অসুবিধা হচ্ছে। আমার পায়ে প্লাস্টিকের জুতো। সুষমাদি খালি পায়ে হাটছে। দুজনের পায়ের নিচ থেকে ছলাৎ শব্দে কাদা পানি ছিটকে সরে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছি। শরীরটা হালকা কাপতে শুরু করেছে। সুষমাদিও কাপছে, তবে সেটা ভয়ে না বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় তা বুঝতে পারছিনা। আগের বারের মত দমকা হাওয়ায় হারিকেন নিভে যায়নি বলে সেই আলোতে পথ কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছি। মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

 

 

পার্ট–৩

অবিরাম বর্ষন আর মেঘের বিকট গর্জনের সাথে সমানে চলছে বিদুৎ চমক। ওরা যেন একে অন্যের সাথে শক্তির পরীক্ষায় নেমেছে। এই দুর্যোগ ঘন রাতে কোথাও কেউ জেগে নেই। আকাশে মেঘ দেখলেই সবাই যে যার ঘরে ফিরে যায়। তা না হলে হয়তো এই রাতেও এক দুজনকে দেখা যেত গঞ্জ থেকে ফিরছে। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুম কমে যায়। সুখেন বাবুরও ঘুম কমে গেছে। মালোপাড়ার শেষ মাথায় সুখেন বাবুর বাড়ি। তিনি আমাদের গায়ের একমাত্র ডাক্তার। কোন বিশেষজ্ঞ কেউ নন, তবে অবহেলিত এই তল্লাটে তিনিই সবার কাছে বিশেষজ্ঞর চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের বিপদে আপদে তাকে সব সময় পাশে পাওয়া যায়। চিকিৎসার জন্য তিনি কোন ফি নেন না কখনো। ওষুধের টাকাও সবাই সময় মত দিতে পারে এমন রেকর্ড নেই। এসব বোঝা যায় তার বাড়ির দিকে তাকালেই। আর দশজন মানুষের ঘরের সাথে তার ঘরের কোন পার্থক্য চোখে পড়েনা। ডাক্তার বলে যে তার আলিশান বাড়ি থাকবে, কিংবা ভাল খাবে, পরবে তা কিন্তু নয়। তিনি সারা জীবন মানুষের কল্যানে নিজেকে বিলিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে ক্ষুদ্র এ জীবনে মানুষকে ভালবাসা ছাড়া আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে। সবাইকে তিনি সমান চোখে দেখেন। তার এই সারল্য সবাইকে মুগ্ধ করে। যে যখন পারছে বাকিতে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছে, আবার করো হাতে কিছু অতিরিক্ত টাকা থাকলে ডাক্তারকে দিয়ে যাচ্ছে যেন ওষুধ কিনে রাখতে পারে। উঠোনে দাড়িয়ে গলা খাকারি দিই। সুখী দাদু বলে আর ডাকা লাগেনা, তিনিই বলে ওঠেন কে? আমি বলি আমি নিখিলেশ।

 

ছোট্ট একটা গ্রাম আমাদের। সবাই সবাইকে চেনে। নাম বলতেই তাই তার চিনতে অসুবিধা হয়না। তার বয়স হয়েছে ঢের, আশি নব্বইয়ের বেশি। চোখে তাই বলে কম দেখেন এমন না। কানাই লাল স্যার যেখানে মোটা পাওয়ারের চশমা পরেন সুখেন বাবু সেখানে চশমা ছাড়াই দিব্বি দেখতে পান। বড়রা তাকে সুখেন বাবু বলেই ডাকে। সবাই মনে করে তার মত সুখী আর কেউ নেই। তিনি নিজেও সেটা স্বীকার করেন। আর আমরা ছোটরা তাকে সুখী দাদু বলে ডাকি। ছেলেপুলে কেউ নেই তার। তিনি একাই থাকেন বাড়িতে। ধীরেনের মা রোজ রান্না করে দিয়ে যায়, তাই তিনি খান। অনেক বছর হলো সুখেন বাবুর স্ত্রীও মারা গেছে। কেউ নেই বললেও আসলে ডাক্তার দাদুর সবাই আছে। আমার মত রক্তের সম্পর্কহীন তার অগণিত নাতি নাতনি আছে, গ্রামের বড়রা সবাই তাকে বাবার সম্মানে রাখে। কেউ বাড়িতে ভাল কিছু রান্না করলেই ডাক্তার দাদুর জন্য দিয়ে যায়। হারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আমাকে ভিতরে ডাকলেন। এতো রাতে কেন এসেছি জানতে চাইলেন। দাদুর হাতে ঘড়ি আছে। সেটা থেকেই জানতে পারলাম রাত তখন পৌনে দুইটা। আমি দাদুকে স্ব-বিস্তারে খুলে বললাম। সুকন্যার জ¦র এবং বমির কথাও বললাম। দাদু দিনের বেলা হলে হয়তো আমার সাথে ভ্যানে করে হলেও যেতে পারতো কিন্তু এই দুযোর্গ পুর্ন রাতে যেখানে আমার মত মানুষেরই চলাফেরা কঠিন সেখানে দাদুর ঘর থেকে বেরোনোই অসম্ভব। দাদু কয়েকটা ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে কিভাবে খাওয়াতে হবে তার নিয়ম বলে দিলেন। কালকে যেন আমি এসে বলে যাই সুকন্যার কি অবস্থা সেটাও মনে করিয়ে দিলেন। আমি ওষুধ নিয়ে সুষমাদির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

 

রাতে সুষমাদি যখন আমাকে ডাকতে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে, তখন তার সাথে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি সুকন্যার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক বার বমি করে সে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। শরীরে যেন কোন শক্তির লেশ মাত্র নেই। সারা শরীর জ¦রে পুড়ে যাচ্ছে। ওর বিছানার পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাই। এই দুর্যোগ ঘন রাতে ছোট্ট অসুস্থ মেয়েটির জন্য কিইবা করার আছে আমার। সুষমাদি আমার পাশে বসে কাপা কাপা হাতে আমার বাহু চেপে ধরে বললো, নিখিলেশ এই মধ্য রাতে তুমিই আমার একমাত্র অবলম্বন। আমি তাকে অভয় দিলাম, সুকন্যার কিচ্ছু হবেনা। সে খুঁজে পেতে একটা গামছা দিল আমাকে। আমি গামছা দিয়ে মাথাটা না মুছেই বেরিয়ে গেলাম সুখেন বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমার ফেরার অপেক্ষায় হয়তো ঠায় দাড়িয়ে রইলো কন্যার সুস্থ্যতার আশা বুকে নিয়ে সুষমাদি।

 

ডাক্তার দাদু একটা পলিথিনে মুড়ে দিয়েছেন ওষুধ গুলো যেন ভিজে না যায়। আমি ফিরতে ফিরতে ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেছে। মনের মধ্যে শঙ্কা, সুকন্যা ঠিক আছেতো! দরজায় কড়া নাড়তেই সুষমাদি দরজা খুলে দিল। আমি তার হাতে ওষুধ গুলো দিয়ে সুকন্যাকে খাইয়ে দিতে বললাম। ওষুধ খাওয়ানোর পর সে গামছা এনে আমার মাথা মুছে দিল। আমার শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে। সে গেঞ্জিটা খুলে শরীর মুছে দিতে চাইলে আমি না করলাম। শেষে আমি নিজেই মুছে নিলাম। রান্না ঘর, শোবার ঘর করতে করতে সেও ততক্ষণে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে পরনের শাড়ি। আমি সেদিকে না তাকিয়ে সুকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এক ফাঁকে সুষমাদিকে বললাম, তুমিতো ভিজে একাকার হয়ে আছ। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে নিজেই অসুখে পড়বে, তখন তোমাকে দেখবে কে? সে এতো কষ্টের মধ্যেও ঠোটে হাসির রেখা টেনে বললো, কেন তুমিতো আছোই! আমি বললাম ঠাট্টা রেখে মাথা মুছে শাড়ী পাল্টে নাও। এর পর কতক্ষণ কেটেছে জানিনা। এক সময় অনেকটা স্বাভাবিকের মত সুকন্যা ঘুমিয়ে গেল। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ¦র কমে এসেছে। রাত হয়তো পোহাতে চলেছে, আর থাকা ঠিক হবেনা ভেবে সুষমাদিকে বললাম এখন আমি যাই, সকাল হয়ে এলো। সে বললো, এইটুকুতো সময়, থেকেই যাও। আমি নানা বিষয় চিন্তা করে বাড়ির পথে হাটতে শুরু করলাম। পিছন ফিরে তাকালে বিদ্যুৎ চমকানো আলোতে হয়তো দেখতে পেতাম আমার চলে যাবার পথে তাকিয়ে আছে সুষমাদি। হয়তো সেটার পরিবর্তে দেখতাম দরজাটা বন্ধ করে ফেলেছে কারো অপেক্ষায় দাড়িয়ে না থেকে।

 

 

পার্ট-৪

 

ভোর হতে বেশি বাকি নেই। বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমে এসেছে। বাইরে ফর্সা হতে শুরু করেছে। চোখে ঘুম নেই, ক্লান্তিও নেই। এই সামান্য সময়ের জন্য আর ঘুমাতেও ইচ্ছে করছেনা। সুষমাদির মেয়েটার জ¦র কিছুটা কমেছে। বাড়িতে কেউ নেই ভেবে সুষমাদিকে বলে চলে এসেছি। মেয়েটার জন্য খুব মায়া হচ্ছিল। সুকন্যা ছাড়া সুষমাদি বেঁচে থাকার মত কোন আশা দেখতে পায়না। বাবা হাপানিতে ভুগছে। যে কোন দিন তার ডাক এসে যাবে, তখন সুষমাদি একা হয়ে যাবে। মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। আমি যখন সুকন্যাকে রেখে বাড়িতে ফিরে আসছি তখন সুষমাদি বলেছিল, তোমাকে এগিয়ে দেই। আমি নিষেধ করেছি। সে অসুস্থ বাবা এবং কন্যাকে রেখে এই বৃষ্টির দিনে আমাকে এগিয়ে দিতে আসুক সেটা আমিও চাইনি। তাছাড়া সে এগিয়ে দেওয়া না দেওয়া একই কথা। এমন তো নয় সে ছাতা নিয়ে আসবে আমি যেন না ভিজি। আমাকে ভিজতে ভিজতেই বাড়িতে আসতে হয়েছে। সে যদি এগিয়ে দিতে আসতো তবে তাকেও ভিজতে ভিজতেই আসতে হতো। আবার এই গহিন রাতে এতোটা পথ তাকে একাএকা ফিরে যেতে হতো। তার চেয়ে আমি একা চলে এসেছি এই ভাল। বারান্দায় গামছা ঝোলানো ছিল। সেটা দিয়ে ভাল করে মাথা মুছে সারা শরীর মুছেছি। ভিজে একাকার হয়ে যাওয়ায় লুঙ্গি পাল্টে আরেকটা পরতে হয়েছে। পাশ ফিরে শুতেই বার বার একটু আগের স্মৃতি মনে পড়ছে। সুষমাদির বাড়িতে যাওয়ার পর ঘরে ঢুকে সুষমাদিই প্রথম গামছা দিয়ে আমার মাথা মুছে দিয়েছে। আমি নিজেই মুছতে পারতাম কিন্তু সে জোর করে মাথা মুছে দিয়েছে। গা থেকে গেঞ্জি খুলে শরীরটাও মুছে দিতে চেয়েছিল আমি নিজে শরীর মুছেছি। কিন্তু সেই যে মাথা মুছে দিয়েছিল সেই স্মৃতিটুকুই আমার চোখে ভেসে উঠছে। বৃষ্টি শুধু যে আমাকে ভিজিয়েছিল তাতো নয়। সুষমাদিকেও সমানে ভিজিয়েছে। এই বৃষ্টির কোন মায়াদয়া নেই। বৃষ্টিতে ভেজার পর বেশিক্ষণ ওভাবে থাকলে নিশ্চিত কোন রোগ বাধিয়ে বসবে। আমি তাকে বললাম তুমিও মাথা মুছে নাও। আমি ততোক্ষণে সুকন্যার পাশে বসে দেখি কি অবস্থা।

 

আমাদের বাড়িতে দুটো ঘর থাকলেও সুষমাদির বাড়িতে একটাই ঘর। উঠোনের একপাশে একটা ছাপড়া উঠিয়ে রান্নার কাজ চালিয়ে নেয়। একমাত্র ঘরে দুটো রুম। একরুমে তার হাপানিতে কাতর বাবা থাকে অন্যটিতে সুকন্যাকে নিয়ে সে থাকে। আমি যখন সুকন্যার শিয়রের পাশে বসেছি সুষমাদি তখন গামছা দিয়ে ভেজা চুল মুছে নিচ্ছে। তার ঘরের কোন বারান্দা নেই যে আমি গিয়ে সেখানে দাড়াব আর সেই ফাঁকে সুষমাদি ভেজা শাড়ি পাল্টে নেবে। আমারতো মনে হয় পাল্টে নেবার মত শাড়িও তার আছে কিনা সন্দেহ। আমার ঘুম আসছেনা। বৃষ্টির দিনে সকালে পাখিরাও ডেকে ওঠেনা। সুর্যই যেখানে লুকিয়ে থাকে সেখানে পাখিরা কেন ডেকে উঠবে। ভোরের অপেক্ষায় আমার চোখ দুটো জেগে আছে। দুই চোখের পাতা এক করলেই সুষমাদির ঘরের ছবি ভেসে উঠছে। কি মনে করে যেন সুষমাদি আমাকে ডাক দিয়ে বললো নিখিলেশ গামছাটা দিয়ে আমার পিঠটা একটু মুছে দাওতো। আমিও কোন কিছু না ভেবে বাড়িয়ে দেওয়া গামছাটি নিয়ে তার ভেজা পিঠ আলতো করে মুছে দিলাম। সে হাত দিয়ে তার শাড়ীর আঁচল সরিয়ে রেখেছিল। খোলা পিঠ আলো আধারিতে কেমন যেন লাগছিল। কেন যেন সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। অথচ তখন কোন কিছুই মনে হয়নি। তার খোলা চুল,বস্ত্রহীন পিঠ কোন কিছুর প্রতি তখন নজর পড়েনি। এক মনে শুধু সুকন্যা নামের ছোট্ট মেয়েটির অসুখের কথা মাথায় ছিল। আর এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কতনা কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে যখন গামছা দিয়ে পিঠ মুছে দিচ্ছিলাম তখন তার মধ্যে কেমন যেন কাপুনি ছিল। মুখে এক ধরনের শব্দও ছিল তার। আমি আর ওসব ভাবতে পারিনা। শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায়। বলাইয়ের কথা মনে পড়ে। বলাই হলে কি হতো সেটা কল্পনা করতেই রক্ত হিম হয়ে আসে। মনে মনে ভাবতে থাকি সকালে উঠে কি কি কাজ করার আছে। সব কিছুর মাঝে একটা কথা ঠিকই ভেবে রাখি আর তা হলো সুকন্যাকে একবার গিয়ে দেখে আসা। ছোট্ট রোগাগ্রস্থ মেয়েটিকে রাতে যে অবস্থায় রেখে এসেছি তাতে দিনে একবার না গেলেই নয়। সুস্থ্য থাকতে ছোট্ট মেয়েটি আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকতো। আমার সাথে তার যেন জনম জনমের সম্পর্ক। সে যেন আমার আত্মার আত্মীয়। আমার সাথেই তার সব খুনসুটি। সে আমাকে দেখলে যেন দুনিয়া ভুলে যায়। বাপ মরা মেয়েটার প্রতি তাই আমারও স্নেহ উথলে ওঠে। কলেজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরি তখন একবার হলেও সুকন্যাকে দেখে আসি। ছোট্ট মেয়েটি হয়তো তার অসুস্থ নানার পাশে বসে থাকে নিশ্চুপ হয়ে।

 

বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কতক্ষন পেরিয়েছে জানি না। গোয়ালে বাছুরটা সমানে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে। নিশ্চই তার বেশ ক্ষুধা লেগেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। আড়মোড় ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখি বেশ বেলা হয়ে গেছে। আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি নেই। সারাদিন হয়তো রোদের দেখা পাওয়া যাবেনা তবে বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা খুব কম। ভাবছি বাবা মা এবং দিদি কি আজকে ফিরে আসবে? ফিরে না আসলে আমাকে না খেয়েই কাটাতে হবে। অবশ্য ঘরে নাড়ু চিড়ে আছে তা দিয়ে দিন পার করে দেওয়া যাবে। গোয়াল ঘরের দরজা খুলে গাভীটাকে বাইরে এনে খুটার সাথে বাঁধলাম। চাড়িতে জাওন দেওয়া দরকার কিন্তু কোন দিন ওসব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নেই। জীবনের রুঢ় বাস্তবতা টের পেতে শুরু করলাম। খুঁজে পেতে গোয়াল ঘরের এক কোণে কিছু খুদ এবং কুড়ো পেলাম। সেটা চাড়িতে পানির সাথে গুলিয়ে দিলাম। কিন্তু ওইটুকু খাবারে আর কিইবা হবে। পালা থেকে কিছু খড় নিয়ে এসে ছোট ছোট করে কাটলাম। সেগুলোও কুড়োর সাথে মিশিয়ে দিলাম। গাভীটা বেশ আরাম করে খেতে শুরু করলো। বাছুরটাও হাম্মা হাম্বা ডাক বন্ধ করে মায়ের বুকে মুখ লাগিয়ে আয়েশ করে দুধ খেতে শুরু করলো। আমি জানি জীবনে প্রথম বারের মত হলেও আমাকে নিষ্ঠুর হতে হবে। একটু খাওয়ার পরই জোর করে বাছুরটাকে সরিয়ে নিতে হবে। তার পর অপটু হাতে দুধ দোয়াতে হবে। ওর মায়ের দুধ ও খাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু ওর মায়ের দুধের ওপর আমাদেরও জীবন জীবিকা নির্ভর করে অনেকাংশে। ওকে ছেড়ে দিয়ে রাখলে সবটুকু দুধ সে নিমিষে শেষ করে ফেলবে। তাই কিছুক্ষণ পাশে দাড়িয়ে থেকে ওর খাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এর পর জোর করে সরিয়ে নিলাম। যে কাজটা কোন দিন করি নি আজ আমাকে সেটাই করতে হবে। দুধ দোয়াতে হবে।

 

মা যখন দুধ দোয়াতো বেশ কয়েক বার কাছে দাড়িয়ে সেটা দেখেছি। আশা করি চেষ্টা করলে পারবো। বাছুরটাকে একটা খুটির সাথে বেধে রেখে দুধ দোয়ানোর পাতিলটা নিয়ে আসলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম মা সেই সময় কি কি করতো। তার পর ভাল করে ওলানে পালানোর পর যখন দুধ দোয়াতে শুর করবো বলে হাত দিয়েছি তখন অনুভব করলাম কার যেন একটা হাত আমার কাধের উপর এসে পড়েছে। চমকে উঠলাম সাথে সাথে। এ সময় এই সকালে কারো তো আসার কথা নয়। বাবা মা ফিরে আসলেও তাদের সময় লাগবে। পরীর দিঘিতো অনেক দুর। পিছন ফিরে ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম। সুষমাদি দাড়িয়ে আছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, সুষমাদি তুমি এখানে, এই সময়ে? তার মুখে তেমন কোন চিন্তার বলি রেখা দেখিনি তখন। তার একমাত্র কন্যা যে গত রাতেও ভীষণ অসুস্থ ছিল সেরকম কোন চিন্তাও তার চেহারায় খুঁজে পাইনি। সুষমাদি একটু হেসে দিয়ে বললো, কাল তুমি আমার মেয়ের জন্য যা করেছ তার ঋণ কোন দিন শোধ হবেনা। মেয়েটা এখন বেশ ভাল আছে। ভাবলাম রাতে একা একা ভিজতে ভিজতে চলে এলে তোমার আবার জ¦রটর বাঁধলো কিনা দেখেই যাই। সেই সাথে মেয়েটার সুস্থ্যতার খবরটাও দিয়ে যাই। আমার মুখ থেকে শুধু ও শব্দটি বেরিয়ে আসলো। আমাকে সরিয়ে দিয়ে সুষমাদি নিজেই দুধ দোয়াতে শুরু করলো। মুখে যেন তার কথার ফুলঝুরি। তোমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা। তবে রাতে তুমি আমাকে যেভাবে বিপদের সময় পাশে থেকে সাহস দিয়েছ তাইবা কয় জন পারে।

 

সুষমাদির যেন কোন তাড়া নেই। সে তার মত করে দুধ দোয়াচ্ছে। আমি বললাম দুধতো আমিই দেয়াতে পারতাম। তুমি আমার কাছে দিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমি একাই পারবো। ওদিকে সুকন্যাকে একা রেখে এসেছ। সে আমার কথা শুনলো না। বললো ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। রাতে বেশি ঘুম হয়নি বলে ও এখন ঘুমাচ্ছে। সকালে উঠে আমি রান্নাও করে রেখে এসেছি। ভাবলাম তোমাকে রান্না করে দেবে কে তাই তোমাকে বলতে আসলাম আমাদের সাথে খেয়ো। আমি কোন কথা বললাম না। সুষমাদি দুধের পাতিলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়াল। তাকে বেশ নির্ভার লাগছে। রাতে ও বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর আমার মাথায় আকাশ সমান এলোমেলো চিন্তা ছিল এখন তা আর নেই। আমি চাইছি কেউ আসার আগেই সুষমাদি বাড়িতে ফিরে যাক। হয়তো বিধাতা আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। সুষমাদি নিজ থেকে আমাদের উঠোনটা ঝাড়ু দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার সময় বললেন, তুমি গোসল করে সোজা আমাদের বাড়ি চলে আসো। এক সাথে খাব। আমি সুষমাদির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে না থেকে ঘরে ফিরে গেলাম। রাস্তায় কেউ যদি দেখে সুষমাদি আমাদের বাড়ির দিক থেকে সাত সকালে যাচ্ছে তাহলে কথা শুনতে হবে। আমার হাতে অনেক কাজ। দুধ নষ্ট হয়ে যাবে তাই ঘরে তালা লাগিয়ে রাড়িখালি বাজারের দিকে রওনা দিলাম। সমস্যা একটাই,আমি বাজারে থাকা কালিন সময়ে যদি বাবা মা ফিরে আসে তবে ঘরে ঢুকতে পারবে না। চাবিতো থাকবে আমার কাছে।কিন্তু দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি সাথে সাথেই রওনা হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম সুষমাদির বাড়িতে সকালে খেতে যাওয়ার কথা।

 

 

পার্ট–৫

 

বাজারে যাওয়ার পথে হঠাৎ মনে পড়লো আমি তো দুধের দাম দর কিছুই জানিনা। তাহলে কিভাবে বিক্রি করবো। ষোল বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরও আমি কোন দিন কিছু বিক্রি করতে বাজারে গিয়েছি বলে মনে পড়েনা। সাত পাঁচ ভাবছি আর হাটছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যাওয়ার পথে বলাইকে সাথে করে নিয়ে যাই। কিন্তু বলাইয়ের সাথে আমার কথা বলা বন্ধ। সে আমার ভাল বন্ধু ছিল কিন্তু তার সাথে আমি ইচ্ছে করেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। তাহলে একমাত্র উপায় হলো মহিতোষ জেঠু। বাজারে গিয়ে তার থেকে জেনে নিতে হবে দুধের বর্তমান দাম কত। দুধ দোয়ানোর পর মেপে দেখেছি তিন সের দুধ হয়েছে। যা বিক্রি হবে তার থেকে কিছু টাকা দিয়ে বাজার করতে হবে যেন বাবা মা দিদি ফিরে আসার পর রান্না বসাতে পারে। এমনিতেই আমার নাম হয়ে গেছে অলস অকম্মা। একটি মাত্র দিন বাবা মা আমার হাতে ছোট্ট সংসারটা রেখে গেছে সেটাই যদি গুছিয়ে সামলে রাখতে না পারি তবে সম্মানের ছিটেফোটাও থাকবেনা। অবশ্য বাবা মা কিংবা দিদির সামনে আমার সম্মান অসম্মানের কিছু নেই। আমি অলস হলেও তারা আমাকে ভালবাসবে আমি কর্মঠ হলেও তারা আমাকে ভালবাসবে। রাজপরিবারে জন্ম নিলে আমি না জানি কোন হালে চলাফেরা করতাম।

 

বাজারের পথে দুধের ঢালুন নিয়ে হাটছি আর লজ্জায় যেন লাল হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ দেখে ফেললেই আমার সম্মানের বারটা বাজবে। কিন্তু আমি এও জানি যে যত জনই দেখুক কেউ একটু অবাকও হবে না। এখানে, এই গায়ে, এই মাঝি পাড়া থেকে শুরু করে ওদিকের মালোপাড়া পার হয়ে চৌধুরী পাড়া থেকে শুরু করে পুরো গ্রাম চক্কর দিলেও কেউ কিছু মনে করবেনা। খেটে খাওয়া মানুষ সবাই। তার পরও কেন যেন সংকোচ বোধ করছিলাম। কানাই লাল স্যারের বাড়ি বাজারে যাওয়ার পথেই পড়ে। স্যার যদি দেখে আমি দুধ বিক্রি করতে যাচ্ছি তবে আর যাই হোক মহা খুশি হবেন। তিনি ধরেই রেখেছেন যে আমাকে দিয়ে কেউ কোন দিন কিছু করাতে পারবে না। ভুল করে নাকি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের পরিবর্তে আমার জন্ম হয়েছিল এই দরিদ্র পরিবারে। সত্যি সত্যি আমি যখন কানাই লাল স্যারের বাড়ির কাছাকাছি এসেছি তখন দেখি বাড়ি থেকে কানাই লাল স্যার বের হয়েছেন বাজারে যাবেন বলে। তার চোখে মোটা কাচের চশমা। চশমার ওপাশে দুটো কোটরাগত চোখ। কিন্তু সেই চোখ আশ্চর্য নির্লিপ্ত মায়া ভরা। কোনো দিন স্যার আমাকে বকেন নি। সব সময় আদর করেছেন ভালবেসেছেন। দরিদ্র পরিবারে আমাদের সবার জন্ম হলেও স্যার আমাদের বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। কোন কিছুকে নেগেটিভলি নিতেন না। আমাকে দেখে তিনি থামতে বললেন। প্রথমে চোখ থেকে চশমাটা খুলে পরনের ধুতিতে কয়েকবার মুছে নিলেন। তার পর চশমাটাকে যায়গা মত বসিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন আরে নিখিলেশ নাকি। কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য! তোমার হাতে দুধের ঢালুন দেখছি। এর চেয়ে ভাল খবর আর কি হতে পারে যে, নিখিলেশ শেষমেশ কিছু একটা বিক্রি করতে বাজারে যাচ্ছে।

আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম। তিনি কইগো বলে তার স্ত্রীকে ডাকলেন। আমার হাত ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। আমার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। স্যার আমাকে উঠোনে একটা টুলের উপর বসতে বললেন। পাশেই আরেকটা টুল নিয়ে নিজেও বসলেন। আমি আতি উতি করছি ছুটে বের হওয়ার জন্য। কানাই লাল স্যার অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। তিনি বুঝলেন কেন আমি আতিউতি করছি। তিনি কাকিমাকে ডাকলেন। কাকিমা কাছে আসতেই আমি প্রনাম করলাম। কাকিমার সাথে আমার মাঝে মাঝে কলেজে যাওয়া আসার পথে কথা হয়। স্যার আগ বাড়িয়ে বললেন দেখ সুর্য আজ কোন দিকে উঠেছে। আমাদের নিখিলেশ দুধ বিক্রি করতে বাজারে যাচ্ছে। যাও ওকে ঘর থেকে দুটো নাড়ু চিড়ে এনে দাও। আমি জানি এখন খাওয়ার সময় নয় তার পরও স্যার যেভাবে ধরেছেন না খেয়ে বের হতে পারবো না। কাকিমা নাড়ু চিড়ে নিয়ে আসার পর আমাকে খেতেই হলো। এক ফাঁকে স্যার বললেন আমিও বাজারে যাচ্ছিলাম দুধ কিনবো বলে।তোমার ঢালুনে কতটুকু আছে? আমি জানালাম তিন সের। কানাই লাল স্যার কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললেন আমার যদিও অত লাগবেনা তার পরও আমাদের নিখিলেশ প্রথম কিছু একটা বিক্রি করতে যাচ্ছে সেই উপলক্ষে তিন সের দুধই আমি কিনে নিলাম। স্যারের কথা শুনে আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তত দুধ নিয়ে বাজারেতো যেতে হচ্ছেনা। স্যার আমাকে অভয় দিয়ে বললেন তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমাকে বাড়িতে পেয়ে ঠকাবো না। তুমিতো বাজারে যাবাই তো আমার সাথেই চলো। সেখানে কি দরে বিক্রি হয় সেটা দেখেই তোমাকে দাম মিটিয়ে দেব।

 

মনে মনে স্যারকে প্রনাম করলাম। মনে হচ্ছিল স্যারের পা ধরে প্রনাম করি। নাড়ু চিড়ে মুখে দিয়ে জল পান করে স্যারের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। বাজারে কিছু কিনতে গেলে আগে দোকানীই দাম চায়। সেখানে কম বেশি করে কেনা যায়। কিন্তু নিজেই যদি কিছু বিক্রি করতে যাই তবেতো আমাকেই আগে দাম চাইতে হবে। আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না দুধের সের কত করে চাবো। কারো কাছে জিজ্ঞেস করার কথাও ভাবতে পারছিলাম না কারণ সবাই ভাবতো কলেজে পড়ুয়া ছেলে দুধের সের কত তাও জানেনা। স্যারের কল্যানে সব লজ্জা থেকেই বেঁচে গেলাম। এমন কি বলাইকেও আর সাথে নেওয়ার চিন্তা করতে হল না। বাজারে গিয়ে স্যারই নিজে দুধের সেদিনের দর জেনে নিয়ে আমাকে টাকা দিয়ে দিলেন। টাকা নিয়ে স্যারকে প্রনাম জানিয়ে চাল,তেল,লবন,মরিচ আর শবজি কিনে বাড়ির পথে রওনা হলাম। বাজার থেকে বের হওয়ার পর মনে হলো যাওয়ার পথেই তো সুষমাদির বাড়ি। অসুস্থ্য সুকন্যাকে রাতে ওই অবস্থায় রেখে আসার পর এখন কি অবস্থায় আছে তা জানিনা। বাচ্চাটার জন্য এক টাকার সন্দেশ কিনে নিয়ে গেলে সে খুশি হবে। আবার ফিরে গিয়ে মহিতোষ জেঠুর দোকান থেকে এক টাকার সন্দেশ কিনে নিলাম। এতোক্ষণে বাবা মা দিদি নিশ্চই ফিরে এসেছে। তারা যেভাবে আমার কাছে বাড়ি রেখে গিয়েছিল এসে দেখবে কোন কিছুই সেভাবে নেই। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কানাই লাল স্যারের বাড়ির কাছে আসার পর মনে পড়লো দুধের ঢালুনটা নিয়ে যেতে হবে।

আমি আবার স্যারের বাড়ির ভিতরে গিয়ে কাকিমা বলে ডাক দিলাম। কাকিমা সম্ভবত রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিল। আমার ডাক শুনতে পেলো কিনা জানিনা, তবে ঘর থেকে উকি দিল চৌদ্দ পনের বছরের এক বালিকা। তার চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নিল। মেয়েটিকে তো আমি আগে কখনো দেখি নি। মুহুর্তের মধ্যেই ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম আমি। আমি আবার কাকিমা বলে ডাক দিলাম কিন্তু আমার চোখ ছিল বারান্দায় লাজুক চোখে ঠায় দাড়িয়ে থাকা বালিকাটির দিকে। এবার কাকিমা আমার ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। ও নিখিলেশ! বলে তিনি রান্না ঘর থেকে ঢালুনটা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন। আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তার চোখও তখন বারান্দাতে নিবদ্ধ হল। আমাকে বললেন আমার মেয়ের ননদ। একটু আগেই এসেছে। এবার ম্যাট্টিক পরীক্ষা দিয়েছে। অঞ্জলী নাম ওর। তার পর কাকিমা আমার দিকে দেখিয়ে বলল এ হলো আমাদের নিখিলেশ, খুব ভাল ছেলে,কলেজে পড়ে। আমি মনে মনে ভাবলাম মেঘ না চাইতেই জল। আমিতো কিছুই জানতে চাইনি, কিন্তু কাকিমা আমার মনে কথা পড়ে ফেলে সব বলে দিয়েছে। সেই সাথে আমার প্রশংসাও করেছে।

 

মনে হচ্ছিল বাড়ি ফিরে গিয়ে আর লাভ কি! এখানেই থেকে যাই। এ আকাশের অসীম ছায়াতলে রোদ বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে দাড়িয়ে থাকি কারো জন্য অনন্ত অপেক্ষায়। কাকিমা আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি বাড়ি যা,তোর মা আর দিদিকে দেখলাম বাড়ির দিকে যেতে। আমি সম্বিত ফিরে তাকিয়ে দেখি বারান্দাটা খাঁ খাঁ শুন্য। একটু আগেও ওখানে যে কেউ একজন ঠায় দাড়িয়ে ছিল তা আর মনেই হচ্ছেনা। চপল পায়ে সে হেটে চলে গেছে। যাওয়ার আগে রেখে গেছে স্নিগ্ধ পদচিহ্ন। আমি যতই পা চালাই পা যেন আর চলতেই চায়না। বার বার পিছনে ফিরে তাকাই কারো মুখ দেখার আশায়, কিন্তু আমাকে হতাশই হতে হয়। শেষ বার যখন তাকিয়েছি তখন কানাই লাল স্যারের ঘরের জানালায় অবিরাম হাসি মুখ। হাসি মুখে আনন্দ। সব মায়া কাটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই। উঠোনে পা রাখতেই মনে পড়ে সুকন্যার কথা। বাচ্চাটাকে সারা দিনে একবারও দেখতে যাওয়া হয়নি। বাজার থেকে আসার সময় মহিতোষ জেঠুর দোকান থেকে আনা এক টাকার সন্দেশও পড়ে আছে পকেটে। আমাকে বাজার নিয়ে ফিরতে দেখে মায়ের মুখে ভুবোন ভোলানো হাসি। দিদিকেও খুব খুশি দেখাচ্ছে। বাবা সম্ভবত ফেরেনি। তকে আশেপাশে কোথাও দেখছিনা।

আমার এক হাতে বাজারের ব্যাগ। কাছে যেতেই মা আমার মুখে, শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করলেন। বললেন আহ আমার মানিক চান এক দিনেই দেখ কেমন শুকিয়ে গেছে। ঠিক মত ঘুম হয়নি একা একা তাই নারে। আমি বলি মা সুকন্যার খুব অসুখ। রাতে একবার গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। তার পর সুখেন বাবুর কাছ থেকে ওর জন্য ওষুধ এনে দিয়েছি। এখন সম্ভবত একটু ভাল আছে। আমার কথা শুনে মায়ের মুখটা যেন আরো উজ্জল হয়ে উঠলো। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো আমার ছেলেটা কত ভাল কাজ করেছে। কে বলেছে আমার ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না? সে হলো সোনার টুকরো ছেলে। আমি মায়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিদির হাতে বাজারের ব্যাগটা দিয়ে দুধ বিক্রির বাকি টাকা মায়ের হাতে দিলাম। সেখান থেকে মা আমাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। আমি সেটা না নিয়ে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম মা রেখে দাও পরে অনেক কাজে লাগবে। আনন্দে সম্ভবত মায়ের চোখে জল চলে আসলো। আমি সেই জল গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা না করে মাকে বললাম সুকন্যার জন্য একটু সন্দেশ এনেছিলাম সেটা দিয়ে আসি আর ওকে দেখে আসি।

 

সুষমাদির বাড়ির উঠনে পা রাখতেই টের পেলাম সুকন্যা বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। সে মায়ের সাথে আধো আধো বুলিতে কথা বলছে। আমি গলা খাকারি দিয়ে সুকন্যার নাম ধরে ডাক দিলাম। শুনতে পেলাম সে বলছে মামা এসেছে। শব্দটা সে হয়তো পুরোটা উচ্চারণ করতে পারেনি কিন্তু আমার কানে সেটা পুরাটাই শোনা গেছে। ঘরে ঢুকে সুকন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাতে সন্দেশ দুটো ধরিয়ে দিতেই তার মুখটা খুশিতে ভরে উঠলো। শরীরটা এখনো বেশ ক্লান্ত। ওইটুকু শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। বমি আর জ¦রে সে কাহিল ছিল। সুষমাদির কন্ঠে তখন অভিমানের সুর। তোমাকে বললাম গোসল সেরে আমাদের বাড়ি আসো এক সাথে খাবো কিন্তু তোমার টিকিটিরও দেখা পেলাম না। আমি সুষমাদিকে সবিস্তার জানালাম। শুধু বাদ রাখলাম কানাই লাল স্যারের ঘরের জানালায় দেখা অবিরাম হাসিমুখের কথা। কথা বলতে বলতে সুষমাদি ভাত বেড়ে আমার সামনে রাখলো। আমি না করার পরও সে জোর করলো আমাকে খেতেই হবে। শেষমেশ খেয়ে আবার বেরিয়ে গেলাম। রাতে যখন বাড়িতে ফিরলাম বাবা তখনো ফিরে আসেনি। রাতে বাবা যখন ফিরবে তখন মা নিশ্চই বাবাকে তার ছেলের প্রশংসায় ভাসিয়ে দিবে।

 

 

পার্ট-৬

বলাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে নিষেধ করেছি ও যেন ভুলেও কোন দিন আমাদের বাড়িতে আর না আসে। ও আসলে আমাদের বাড়িতে আসতো অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথম প্রথম গা করতাম না কিন্তু একসময় বিরক্তি চরমে উঠলে সরাসরি নিষেধ করে দিলাম। একদিন মা জিজ্ঞেস করলো হ্যারে বলাই দেখি খুব ঘন ঘন তোর কাছে আসে ব্যাপার কি? কি নিয়ে এতো কথা বলিস তোরা? আমি মাকে কি করে বলি। শেষে বলাইকে সরাসরি বললাম তুই আর আজ থেকে আমার বন্ধু না। আমার সাথে কথা বলবিনা, আমাদের বাড়িতেও আর আসবিনা। আমার কথা শুনে বলাইয়ের মন খারাপ হয়েছিল কিনা জানিনা কিংবা রাগ করেছিল কিনা তাও জানিনা। তবে তার পর থেকে সে আমাদের বাড়িতে আর আসেনি। আমি আর বলাই বিনোদপুর কলেজে একসাথেই পড়ি। কলেজে আমি নিয়মিত যাই বা না যাই বলাই ঠিকই নিয়মিত কলেজে যায়। পড়াশোনায় সে আমার থেকে খুব একটা ভাল ছিলনা কোন কালেও তবে সে কলেজে নিয়মিত যায় অন্য কারণে। বলাইয়ের সাথে কথা বলতে আমার কেমন যেন ঘেন্না হয়। ভাল কিছু তার মুখে কোন দিন আসে না। একদিন সে ব্যাগ থেকে দেখি একটা বই বের করেছে। বইয়ের কভারে অরুচিকর ছবি দেওয়া। সে সেই বইটা ক্লাসের অন্যদের দেখিয়ে কত রকম হাসি ঠাট্টা করেছে। রনজু রসিয়ে রসিয়ে বলেছে কিরে এতোদিন শুনেছি মানুষ বীজ গণিতের সুত্র মুখস্থ করে আর তুই শেষ পযর্ন্ত কামসুত্র মুখস্থ করছিস। এটা শুনে অন্যরা তখন সেকি হাসাহাসি।

 

আমার গা গুলিয়ে আসে। আমি সেই থেকেই ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। কিন্তু সে আমার বাড়ি অব্দি এসেছে। কানের কাছে বার বার ফুস মন্তর দিয়েছে। সে ওই বইটার চ্যাপ্টার গুলো প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছে। কতই বা বয়স হবে ওর বা আমার। ষোলতে পড়েছি আমরা। একদিন বিকেলে আমি বসে আছি আমার ঘরে। জানালা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। সেই সময় কোথা থেকে যেন বলাই এসে হাজির। আমার টেবিলের বসে হুট করে জানালাটা খুলে দিতেই বাইরের স্নিগ্ধ বাতাস ঢুকে গেল। একটু আগে যে ঘরটা অন্ধকার ছিল সেটা আলোকিত হলো। বলাই আমার দিকে না তাকিয়ে সোজা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো আহ কী অপরুপ দৃশ্য!। এমন দৃশ্য জনম জনম ধরে দেখে গেলেও সাধ মেটেনা। আমি অবাক হয়ে ভাবি এই জানালা দিয়ে আমিতো রোজ তাকিতে থাকি, কই আমার কাছেতো সেরকম কিছু মনে হয়না। জানালাটা খুললেই পুকুর সেই পুকুরে হয়তো স্বচ্ছ নীল জল আছে, হয়তো ভাল করে তাকালে সেই জলের নিচেয় ভেসে বেড়ানো শোল, গজারের ঝাক দেখা যাবে। হয়তো ফুস করে ভেসে উঠতে দেখা যাবে একটা টাকি মাছ তাকে ধিরে থাকবে তার হাজার খানেক ছানাপোনা। কিংবা দেখা যাবে দুটো হাস সমানে সাতার কাটছে। বিকেলের আলো টুকু আছড়ে পড়বে পুকুরের জলে আর সেটা চিকচিক করবে। এই দৃশ্য দেখে দেখে আমিতো ক্লান্ত। একবার দেখার পর আর দেখতে ইচ্ছে হয়না।

আমি বলি প্রথম দেখছিস তো তাই ওরকম মনে হচ্ছে। দু’দিন দেখলেই দেখবি সব ঘোলাটে হয়ে গেছে। ফোড়ন কেটে বলাই বললো তাহলে তুই নিশ্চই রোজ দেখিস! একদিনও বলিসনি এটা। আমি অবাক হয়ে ভাবি এটা বলার কি আছে। জানালা খুললেইতো রোজ ওই একই দৃশ্য চোখে পড়ে। আমি পাশ ফিরে শুই। ওর সাথে কথা বলতেই আর ইচ্ছে হয়না। কিছুক্ষণ পর বলাই নিজেই উঠে আসে। জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আমার বিছানার পাশে এসে বসে। মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলে দোস্ত তোর এই জানালা খুললে যে সৌন্দর্য দেখা যায় তা স্বর্গের সৌন্দর্য থেকে কোন অংশে কম নয়! আমি হাসি আর বলি, আমি কি করে জানবো স্বর্গের সৌন্দর্য কেমন হয়। আমিতো আগে কখনো সেখানে যাইনি। বলাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে, দোস্ত আমি যদি এই সৌন্দর্য রোজ দেখতে পেতাম! তার পরদিন থেকে বলাই রোজ আসতে শুরুকরলো। একই সময়ে আসে, কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, তার পর চলে যায়। কোন কোন দিন বলে, আজকে বাইরেটা ধুসর বর্ণহীন! আমি বাইরে তাকিয়ে দেখি আর দশটা দিনের সাথে কোন পার্থক্য নেই। তার পরও বলাইয়ের চোখে তা ধুসর বর্ণহীন লাগে কেন জানি না। সেই একই রকম অন্য একটা দিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকার সময় তার যেন চোখের পলকই পড়েনা। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে, আহ! বিরক্ত করিস না। এই সৌন্দর্য দেখার সময় বিরক্ত করা ঠিক না। এটাতো আর সুর্য নয় যে, রোজ উঠবে আর দেখবো। তাছাড়া সুর্যের মধ্যে সৌন্দর্য বলেও কিছু নেই।

 

আমার বেশ অবাক লাগে। কিছুটা সন্দেহ হয়। কি এমন দৃশ্য দেখে বলাই! যা আমি দেখি না,যা আমাকে আকৃষ্ঠ করে না। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াই। বলাই যে দিকে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে দৃষ্টি ফেলি। যত দুর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। পুকুরের জলে তখন দু’টো হাস অবিরাম সাতার কাটছে। এর বাইরেতো আর কিছুই চোখে পড়ে না। আমি ফোড়ন কেটে বলি দেখলামতো তোর অবিরাম সৌন্দর্য। আমাকেতো মুগ্ধ করতে পারলোনা। এই বলে আমি জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। কি একটা কাজে মা ডাক দিতেই বলাইকে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম সুষমাদি ভেজা কাপড়ে আমাদের উঠোন পেরিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমার চোখটা সাথে সাথে আমার রুমের দরজায় গিয়ে স্থির হলো। সেখানে ঠায় দাড়িয়ে আছে বলাই। বলাইয়ের চোখ তখন সুষমাদির চলে যাওয়া পথের  দিকে নিবদ্ধ। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। রোজ সুষমাদি যখন গোসল করে জানালা খুলে বলাই সুষমাদির দিকেই তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিতে কাম ছাড়া আর কিছু থাকেনা। মা আবার ডাক দিতেই আমি ছুটে যাই। মা আমাকে ডেকে বলাইয়ের কথাই বলে। জানতে চায় রোজ বলাই এই সময়টাতে কেন আসে। কি বলতে চায় সে। আমি কিছু বলতে পারি না। একটু আগে দেখা ঘটনাটা আমাকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে বলাই কেন আসে। কিন্তু সেটাতো মাকে বলা সম্ভব নয়। আমি ঘুরিয়ে বলি, মা ওর কিছু পড়া আমাকে দেখিয়ে দিতে বলে। মা খুশি হয়। মনে মনে নিশ্চই ভাবে আর যাই হোক ছেলেটা আমার বিদ্যাসাগর হচ্ছে!

 

একবার মনে হলো সুষমাদিকে বলি এই পুকুরে গোসল করতে না আসতে। আবার মনে হলো পুকুরটাতো আমাদের না। কেন তবে সুষমাদিকে নিষেধ করবো। তাছাড়া এখানে গোসল না করলে সুষমাদি কোথায় গোসল করবে। আসে পাশেতো আর কোন পুকুর নেই। তাকে যেতে হবে মালো পাড়াতে মুখুজ্জদের পুকুরে। সেখানে এক সাথে কত  ছেলে বুড়ো গোসল করে তার ঠিক নেই। তাদের কারো কারো বাকা চাহনি সুষমাদিকে কুরে কুরে খাবে। তার থেকে বরং ভাল হয় বলাইকেই আসতে নিষেধ করলে। পরদিন কলেজে গিয়ে বলাইকে নিষেধ করি তুই আর আমাদের বাড়িতে আসবি না। মা নিষেধ করেছে তুই যেন আমাদের বাড়িতে না যাস। আমি মুখের উপর একটা মিথ্যে কথা বলে দিই। এছাড়া আর করার কিছু ছিল না আমার। আমার মা যে বলাইকে যেতে নিষেধ করতে পারে এটা বলাইও বিশ্বাস করতো না। তার পরও সে আর কোন কথা বাড়ায়নি। তাই বলে সে আসা থামিয়ে দেয়নি। সে বরং সুষমাদিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দিত আমাকে ডাকার জন্য। আমার ইচ্ছে করতো না ওর সাথে দেখা করতে। তার পরও যেতাম। বলাইয়ের চোখ সারাক্ষণ সুষমাদির উঠোনে নিবদ্ধ থাকতো।

একদিন সুষমাদি উঠোনে বসে কি যেন করছিল। তার পরনে ছিল একটা ছেড়া শাড়ী। সেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে শরীরটা কোন মত ঢাকতে পারলেও পিঠ খালিই থেকে যায়। যেখানে পেট পুরে দু’বেলা খাবারের জন্য চুলোই জ¦লেনা সেখানে এর বেশি আর কিইবা করতে পারতো সুষমাদি। বলাইয়ের কামুক চোখে সেই দৃশ্য মধুর লাগে। সে দৃষ্টি যেন ফেরাতেই পারে না। বিষয়টা আমার চোখ এড়ায়নি। আমি জোর করে ওকে সরিয়ে নিয়ে যাই। এখন আমার হাতে একটাই মাত্র পথ খোলা আর তা হলো লজ্জার মাথা খেয়ে বলাইয়ের বাবাকে সব খুলে বলা। বলাই কথায় কথায় অনেক বার সুষমাদির শরীর টেনে এনেছে আমি কিছু বলিনি। আমি কিছু বলতে গেলে সেটা আরো বেশি ঘোলা করে ফেলবে ভেবেই বলি নি। কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার মোটেও সহ্য হতো না। সুষমাদির বয়স আর কত হবে আঠারতে পড়েছে সবে মাত্র। বিয়ের তিন বছরের মাথায় তার স্বামী মারা যায়। বাবাও না থাকার মত অবস্থা। চোখে কম দেখে, কানেও শোনে না বলা চলে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে শেষ বিদায়ের প্রহর গোনে। বাড়ীর পাশের জমিটুকুতে শাকসবজি আবাদ করে নিজেদের খাওয়ার কাজ চালিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যায়, যা দিয়ে সংসার চলে না। তাই সুষমাদি মাঝে মাঝে এখানে সেখানে এর ওর বাড়িতে সাংসারিক কাজ করে কিছু কিছু আয় করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই সামান্য আয় দিয়ে তিনজনের সংসার আর কতইবা চলে। তার ওপর ঘরে একজন অসুস্থ্য রোগী।

যে বয়সে স্বামী সোহাগে থাকার কথা, সেই বয়সে সংসারের ঘানি টানতেই তার দিন পার হয়। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে কাজ করতে হয়। মানুষের লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে বেঁচে থাকাও দুরুহ ব্যাপার। রমা কাকি কয়েক বার বলেছে আরেকটা বিয়ের কথা, কিন্তু সুষমাদি কানে তোলেনি। শেষমেশ রমা কাকিও বলা ছেড়ে দিয়েছে। সে এক কথার মানুষ। ভাল কথা বলার পর যদি কেউ না শোনে তবে রমাকাকি আর সেধে তাকে বলতে যায় না। তার ভাষায় নিজের খেয়ে পরে বনের মোষ তাড়িয়ে লাভ কি। কিন্তু দিন সব সময় একরকম যায়না। আকাশের রঙ যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তেমনি মানুষের জীবনের রঙও বদলায়। মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ পাশাপাশি অবস্থান করে। তবে কারো কারো জীবনে সম্ভবত দুটোর যে কোন একটার উপস্থিতিই চোখে পড়ে। এ গায়ের মানুষের মনে সুখ কতটা আছে তা কেউ বলতে পারবে না। সবাই সুখে থাকার অভিনয় করে চলেছে নিরন্তর। সুখে থাকার অভিনয়ের মধ্যেই যেন সব সুখ লুকিয়ে আছে। এক সকালে সবাইকে মুক্তি দিয়ে সুষমাদির বাবা বিদায় নিলে তার দুই কুলে আর কেউ রইলো না। ঘরে সামর্থহীন বাবা ছিল তাতেই তার ভরসার একটা জায়গা ছিল। নেকড়ে গুলো ভিড়তে সাহস পেতো না। চিতায় ওঠার সাথে সাথে তাই তার চিন্তা আরো বেড়ে গেল। সেই চিন্তাটা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা। শশ্মান থেকে আমরা যখন ফিরে এসেছি সে তখন পা ছড়িয়ে বসে ছিল। তার একমাত্র মেয়ে সুকন্যা মায়ের পাশে নির্বাক চোখে মাকে দেখছিল। আকাশে এক ঝাক বুনো পায়রা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চারদিক খা খা শুন্যতা যেন গ্রাস করে নিতে শুরু করলো। দুর থেকে ভেসে আসতে লাগলো ডাহুকের সকরুন সুরে ডাক।

 

পার্ট-৭

আমাদের দুধের গাভীটাকে অবশেষে বিক্রি করে দিতে হলো। এ ছাড়া বাবার হাতে আর কোন উপায় ছিলনা। দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে। যৌতুকের কোন বিষয় নেই তার পরও বর পক্ষকে আপ্যায়নের জন্য খরচতো কম নয়। তারা বলেছে ত্রিশজন আসবে। যেখানে তিনজনের পেট পুরে খাবার জোগাড় করার সামর্থই আমাদের নেই সেখানে ত্রিশজন নতুন মেহমানকে খাওয়ানোর ক্ষমতা বাবা কোথায় পাবে। শেষে কোন উপায়ান্ত না দেখে আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস দুধেল গাভীটাকেই বিক্রি করে দিতে হলো। মা নিজ হাতে গরুটিকে যন্ত করে গোসল করিয়ে দিলো। দিদি তখন পাশেই দাড়িয়ে ছিল। টাকা পয়সার অভাবে দিদির বিয়েটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেকবার বিয়ের কথা উঠলেও দিদি সংসারের নানা চিন্তা করে অমত করেছে। সেই করতে করতে বয়স আঠার হয়ে গেছে। গরীব ঘরে চৌদ্দ পনের বছর বয়সী মেয়েই বোঝা সেখানে আঠারোতো ঢের বেশি। বাবা মা তাই আর দেরি করতে রাজি হয়নি। ভাল সম্মন্ধ দেখে দিদির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। গরুটাকে গোসল করানোর সময় মায়ের চোখে জল ছিল,দিদির চোখেও জল চিকচিক করছিল। এতো আদরের ছিল গাভীটা যে, তার জন্য সবার মনেই মায়া জন্মে গেছে। সে যে শুধু দুধ দিতো তাই নয়, সে দুধ দিয়ে এ পরিবারের চারজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতো।

 

আমি যখন গরুটার রশি ধরে হাটের দিকে হাটতে শুরু করেছি দিদি আর মা বেশ কিছুদুর হাটতে হাটতে আমাদের পিছু পিছু আসলো। শত্রুজিৎপুর হাটে যাওয়ার পর আমাদের খুব বেশি দেরি করতে হয়নি। নারানপুরের আব্দুল করিম শেখ আমাদের গরুটিকে কিনে নিয়ে গেল। সম্ভবত গরুটিরও আমাদের প্রতি মায় পড়ে গিয়েছিল। সে বার কয়েক হাম্বা হাম্বা করে ডাক দিল। যেন বলতে চাইলো এভাবে আমাকে পর করে দিলে। কিংবা হতে পারে সে তার একমাত্র বাছুরটিকে ছেড়ে যাচ্ছে বলে তার কষ্ট হচ্ছে। মানুষ বড়ই নিষ্ঠুর হয়ে তার চোখে ধরা পড়ছে। মা এবং সন্তানকে আলাদা করে দেওয়ায় নিশ্চই তার মনে অনেক ক্ষোভ। আমার চেয়েও সম্ভবত বাবার মনে দুঃখটা বেশি। গরু বিক্রি করতে আসার সময় শেষ বারের মত ঢালুনে করে দুধটুকুও নিয়ে এসেছিলাম। দুধ বিক্রির পর বাবা ঢালুনটা আর বাড়িতে নিলেন না। বুঝলাম বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। দিদির জন্য লাল বেনারসি শাড়ী কেনা হলো। পায়ে দেওয়ার জন্য আলতা কেনা হলো। এক গোছা রেশমী চুড়িও কেনা হলো। বর পক্ষ বলেছে তারা হাতের চুড়ি আর গলার হার দেবে। আমাদের গরীবের সংসারে সবটাই বিলাস দ্রব্য। বাবা দিদির জন্য একটা নাকফুল বানাতে দিয়েছিলেন সেটা নিলেন। বরের জন্য একটা আঙটিও কেনা হলো। সব মিলিয়ে সাধের গাভীটি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তার অর্ধেকটাই শেষ হয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে খরচের কোন সীমা পরিসীমা নেই। লিস্ট ধরে ধরে বাকি সব কেনা হলো। বিয়ের আগের দিন রাত পযর্ন্ত সুষমাদি নিজে সাথে থেকে সব কিছু করলেন। দিদিকে সাজিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে মাকে নানা কাজে সহযোগিতা করলেন। তার মত ভাল মনের মানুষ এক জীবনে আমি খুব কম দেখেছি। তার চোখে বড়ই মায়া।মুখের হাসিতে কোন কৃপণতা নেই।

 

বিয়ের দিন সকালে দেখি বলাই এসে হাজির। তাকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করার পরও সে এসেছে। যেহেতু একমাত্র দিদির বিয়ে তাই আমি আর তাকে কিছু বলতে পারিনি। তার সাথে সাথে শাশ্বত,অনিমেশ নিমাই ওরাও এসেছে। যদিও আমি ওদের কাউকেই দাওয়াত দেইনি। সামান্য আয়োজনে ওদেরকে দাওয়াত দেওয়ার মত অবস্থা ছিলনা আমার। যা আয়োজন করেছি তা আগত মেহমানদেরকেই আপ্যায়ন করতে পারবো কিনা সেটা নিয়েই দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম। অনিমেষ আমাকে বাড়ির এক কোণায় ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, তুই আমাদের দাওয়াত করিসনি তার পরও চলে এসেছি বলে মন খারাপ করিস না। আমরা জানি দাওয়াত করার মত অবস্থায় তোদের নেই। আমরাও এখানে এসে খাওয়ার জন্য মনস্থির করে রাখি নি। আমরা ভাবলাম তোর এই কঠিন মুহুর্তে বন্ধু হয়ে যদি তোর পাশেই না থাকতে পারি তবে কিসের বন্ধুত্ব। তোকে পুরো অনুষ্ঠানে সাহায্য করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমি অনিমেষকে বুকে টেনে নেই। চোখে জল এসে যায়। বলাইয়ের উপর থেকে মুহুর্তেই রাগ নেমে যায়। সবাই মিলে দিদির বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানকে পরিপাটি করে তুলি। গেট সাজানো থেকে শুরু করে বরের বসার যায়গা সাজানো এবং বাকি সব কাজ আমরা আনন্দের সাথেই করতে থাকি। আমাদের ছুটোছুটি চলছে সমানে। কয়েকটা বাচ্চার সাথে দেখি সুকন্যা বসে কি যেন খাচ্ছে। ওর মাও নিশ্চই হয়তো কোন না কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। বর আসতেই হইচই পড়ে গেল। আমরা গেট ধরে দাড়িয়ে গেলাম। তবে বড়দের কথা মত আমরা বেশি উচ্চবাচ্য করলাম না। বরপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে আমাদেরকে খুশি করেই উঠোনে প্রবেশ করলো। খাওয়াদাওয়া শেষে বিয়ের যাবতীয় কাজ হয়ে গেলে এক সময় চোখের জলে ভাসিয়ে আমার একমাত্র দিদি শশুর বাড়ি চলে গেল। তার সাথে আমার যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাওয়া হলো না। আমার বদলে আমার ছোট পিসির ছেলে অনন্ত আর আমাদের এক ঠাকুর মা গেল। দিদি হাউমাউ করে কেঁদেছিল। সেটা দেখে আমার চোখেও  জল এসে গেল। উঠোনটা ফাঁকা পড়ে থাকবে। যে উঠোনে সারাদিন মান দিদি হেটে বেড়াতো। ছোট বেলায় এই উঠোনে দিদির সাথে দাড়িয়া বান্ধা খেলতাম,লুকোচুরি খেলতাম। কত শত খুনসুটি হতো। সে সব দেখতে দেখতে চোখের পলকে স্মৃতির খাতায় আটকে গেল। কোন দিন আর সেই সব মুহুর্ত ফিরে আসবেনা।

 

আকাশে মেঘ করলে কোন দিন দিদি দৌড়ে এসে আমার পড়ার টেবিলে উপরে থালা বাসন পেতে দেবেনা। কোন দিন মাথার চুলে বিলি কেটে দেবে না। বাছুরটা সকাল থেকে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছে। মায়ের অনুপস্থিতি তার বুকে যন্ত্রনার আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছে সেটা আমি অনুভব করতে পারছি দিদি চলে যাওয়ার পর থেকে। আপনজন কাছে না থাকার যন্ত্রনা যে কত কঠিন তা উপলব্ধি করছি। দিদিকে বিদায় দিয়ে খাওয়া নাওয়ার কথা ভুলে গেছি। বলাইরাও ফিরে গেছে। আমি আহাম্মকের মত তাদেরকে একটি বারের জন্যও খেয়ে যেতে বলি নি। মেহমানরা ত্রিশজন আসার কথা বলে ছিল কিন্তু তারা মাত্র বিশজন এসেছিল। খাবারের কোন কমতি ছিল না। অথচ আমার যে বন্ধুরা বিনা নিমন্ত্রনে এসে দিদির বিয়ের আয়োজনকে সুন্দর করে দিয়ে গেছে তাদেরকে খালি মুখে ফিরে যেতে দেখেও আমার মধ্যে কোন বোধ শক্তি কাজ করেনি। এখন আর কোন কিছুই ভাল লাগছে না। আশ্চর্য! আমার একমাত্র দিদির বিয়েতে সারাদিন সুষমাদির ছায়াটুকুও দেখলাম না। কিছুক্ষণ ঠায় দাড়িয়ে থেকে ঘরে চলে গেলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মনে হচ্ছিল রাজ্যের ক্লান্তি চোখে মুখে ভর করছে। সেই ক্লান্তি আসলে প্রিয়জন চলে যাওয়ার ক্লান্তি।

দিদিই ছিল আমার সব থেকে ভাল বন্ধু। সে কত দিন মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। সেই ঋণ আমি কোন কালেও শোধ করতে পারবো না। সাত পাঁচ ভাবছি,আমার চোখ বন্ধ। সেই বন্ধ চোখে স্বপ্নের মত ভেসে ভেসে আসছে অতীতের সব সুখ স্মৃতি। হাঠাৎ কারো পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকাতেই দেখি বাবা দাড়িয়ে আছেন। মুখটা বিষন্ন তবে নির্ভার। বিবাহযোগ্য কন্যাকে বিয়ে দিতে পেরে তিনি আজ অনেকটাই ভারমুক্ত হয়েছেন বলেই তাকে নির্ভার লাগছে। অন্যদিকে প্রাণপ্রিয় কন্যাকে বিদায় দিয়ে মনটাও বেশ ভারাক্রান্ত। আমার পাশে বসে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তার পর বললেন, তোর বন্ধুরা সবাই এতো খাটাখাটনি করলো শেষে না খেয়েই চলে গেল। যা গিয়ে ওদেরকে ডেকে নিয়ে আয়। অনেক খাবারতো বেচেই আছে। একসাথে দু’টো খাবি। তোরওতো খাওয়া হয়নি কিছু। সারাদিন ধকলতো কম যায়নি। আমারও বেশ খারাপ লাগলো। যারা আমার একমাত্র দিদির বিয়ের জন্য এতো কষ্ট করলো তাদেরকে অভুক্ত অবস্থায় চলে যেতে দেওয়া আমার উচিত হয়নি। বাবার কথা মত ওদেরকে ডেকে আনতে গেলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম ওরা কেউ আসবে না। প্রথমত দাওয়াত দেইনি, তার উপর চলে আসার সময়ও একবার মুখ ফুটে বলিনি তোরা খেয়ে যায়। কোন মুখে ওদের সামনে গিয়ে দাড়াবো বুঝতে পারছিলাম না। যাওয়ার পথে সুষমাদিকে দেখলাম রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। আমি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। তার উপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। আমার একমাত্র দিদির বিয়ের দিন তাকে একটি বারের জন্যও আমাদের বাড়িতে দেখি নি। অথচ তার থাকার কথা ছিল। সে আর আমার দিদিতো ভাল বান্ধবী ছিল। একসাথে হেসে খেলেই তারা বড় হয়েছিল।

 

সে আমার পথ আগলে দাড়াল। মুখে একরাশ হাসি টেনে বললো, নিখিলেশ তোমার দিদির রাজকপাল। তার স্বামীও দেখতে রাজপুত্রর মত। আর শুনেছি বংশও ভাল। আমি কোন কথা বললাম না। আমি কয়েকবার তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আমাকে যেতে দিল না। যেন আমার অভিমান ভাঙ্গাতে চায় সে। আমার মনের মধ্যে সীমাহিন ভাবনা। আমি তাকে হাত দিয়ে ঠেলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। একবারও পিছন ফিরে তাকালাম না। তাকালেই দেখতে পেতাম সে অপলোক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাগ নেই, কিন্তু অভিমান ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। পথে যেতে যেতে বার বার মনে হলো কেন সুষমাদি আমার পথ আগলে দাড়াল? কেন সে দিদির বিয়ের দিন আমাদের বাড়িতে গেল না। তার একমাত্র মেয়ে সুকন্যাকে দেখেছিলাম কিন্তু তাকে দেখি নি। প্রথমে ভেবেছিলাম সে কোন না কোন কাজে আছে তাই চোখে পড়ছেনা কিন্তু এখন মনে হলো আমাদেরতো রাজপ্রাসাদের মত আলিশান বাড়ি নয় যে সহজে চোখে পড়বে না। পরে মনে হলো বিয়ে বাড়িতে পরে যাবার মত তার কোন কাপড়ই ছিল না। মনটা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। হাটতে হাটতে আমি ততোক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছি। মনে হচ্ছিল এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে সুষমাদিকে বালি তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তুমি আসোনি বলে আমি তোমার উপর না জেনে না বুঝে অভিমান করেছিলাম বলে আমাকে ক্ষমা করো। কিন্তু আমার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ভাবলাম পরে এক সময় এটা নিয়ে তার সাথে কথা বলবো।

 

এখন আমার চারদিকে শুন্যতা। কানাই লাল স্যারের বাড়ির কাছে আসতেই চোখ দুটো আপনা থেকেই খোলা জানালায় নিবদ্ধ হয়। চোখ দুটো বার বার আমার সাথে প্রতারণা করছে। সে জানে ওই খোলা জানালায় কেউ তার জন্য পথ চেয়ে বসে নেই তার পরও সে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাবেই। একদিন এক মুহুর্তের জন্য ওই জানালায় অবিরাম হাসিমুখ দেখা গিয়েছিল কিন্তু সে যেন হ্যালীর ধুমকেতুর মত মিলিয়ে গেছে। তার পর আর কোন দিন তাকে দেখা যায়নি। অথচ এই পথ দিয়ে যতবার যাওয়া আসা করি আমার নিজের অজান্তেই চোখ দুটো কাকে যেন খুঁজে ফেরে সেই খোলা জানালায়। জানালাটার প্রতি আমার ক্ষোভ জমে গেছে। হয়তো কোন একদিন দা কুড়াল এনে জানালাটাকে খুন করে রেখে যাব। সে কোন সাহসে বার বার আমার সাথে প্রতারণা করবে,মরিচিকার মত সে আমার চোখ দুটোকে কেন টানবে। পোড়া চোখ যুক্তি শোনে না। কোন একদিন ওই জানালায় একচিলতে হাসি নিয়ে পুর্ন চন্দ্রের মত দেখা গিয়েছিল এক চন্দ্রমুখী। তার ছিল দীঘল কালো চুল,অপুর্ব সুন্দর মায়াকাড়া হরিণীর চোখ, আর হৃদয় খুন করা হাসি। যে হাসিটা এক নিমিষে খুন করতে পারে হাজারো নিখিলেশ, অনিমেশদের। তার পর সব স্মৃতির পাতায় আটকা পড়ে আছে। মনে অজান্তে যতবারই খোলা জানালায় দৃষ্টি পড়েছে কেবলই সেখানে শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাইনি। কোন এক বিকেলে অস্তমান সুর্যের সাথে সাথে সেও অস্ত নিয়েছে। সুর্যটা প্রতিদিন একই নিয়মে উদয় হলেও সেই হাসি মুখ আর কোন দিন খোলা জানালায় দেখা যায় নি। হয়তো আর কোন দিন দেখাও যাবে না।

 

 

পার্ট-৮

কোন অলক্ষনেই যে একটা কবিতা লিখতে গিয়েছিলাম জানিনা। কি একটা লিস্ট করবে বলে কলেজে একদিন অনিমেশ আমার কাছে একটা কাগজ চাইলো। আমি ঝন্টু স্যারের সাথে কথা বলছিলাম বলে ওকে বলেছিলাম আমার খাতা থেকে ছিড়ে নে। স্যারের সাথে কথা বলা শেষ করে যখন ক্লাস রুমে ফিরেছি দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। একসময় মুচকি হাসিটা হো হো শব্দে ফেটে পড়লো। আমি বুঝেই উঠতে পারিনি তারা কি নিয়ে হাসছে। তার পর অনিমেশ তার পিছনে লুকিয়ে রাখা খাতাটি বের করে শব্দ করে পড়তে শুরু করলো।

 

”তোমার খোলা চুল,স্নিগ্ধ হাসি/বড় মায়াকাড়া,বড় ভালবাসি/

খোলা জানালায় অবিরাম হাসি মুখ/সে মুখে তাকিয়ে খুঁজি জীবনের সব সুখ।।

 

আমার আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে ওরা আমার খাতাটা ঘেটে ঘেটে কবিতাটি পেয়েছে। তার পর ক্ষ্যাপানো শুরু করলো। বলাইয়ের আগের সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম দিদির বিয়ের দিন। কিন্তু সেদিন বলাই জন্মের মত আমার শত্রু হয়ে গেল। আমি ওকে ইতোর বলে গালি দিলাম। তাতে তার কিছুই গেল আসলো না। সে তার মত করে বলতে লাগলো। সে বার বার বলতে লাগলো

 

”সুষমাদি তোমার খোলা চুল,স্নিগ্ধ হাসি/বড় মায়া কাড়া,বড় ভালবাসি

খোলা জানালায় অবিরাম সুষমাদির হাসিমুখ/সে মুখে তাকিয়ে খুঁজি জীবনের সব সুখ”

 

রাগে আমার শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল বলাইকে খুন করে ফেলি। ক্লাসের সবাই আমাদের গায়ের ছিল না বলে তারা জানতো না সুষমাদি কে। আমি হাত থেকে কবিতাটি নিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলি। কাগজে লেখা কবিতা কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলা যায়, কিন্তু বুকের মধ্যে যে কবিতা লেখা ছিল তা কি আর ছিঁড়ে ফেলা যায় কখনো! আমার জানা ছিল না যে কবিতাটা আরো কোথাও লিখে রেখেছি। সেদিন রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি। পথে সুষমাদির সাথে দেখা হয়। রাগ দেখিয়ে বলি যত্তসব ভাল্লাগেনা কিছু আর। সে কি বুঝলো জানিনা, বাড়ি ফেরার পর আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। সে বেচারিরতো কোন দোষ নেই। নিজের বন্ধুদের আহাম্মকির কারণে শুধু শুধুতাকে রাগ দেখিয়ে এসেছি। দুপুরে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আড়মোড় ভেঙ্গে বিছানায় উঠে বসতেই দেখি  হাসি হাসি মুখ করে সুষমাদি টেবিলের উপর ঝুকে আছে। আমি আবারও চমকে উঠি। দরজা খোলাই ছিল। ঘর থেকেই দেখা যাচ্ছে মা রান্না করছে। রান্না ঘর থেকে আমার রুমটা বেশ ভাল ভাবেই দেখা যায়। আমি উঠে দেখি সুষমাদির হাতে আমার ডায়েরি। যে পাতাটা খোলা সেখানে সেই কবিতাটি! আশ্চর্য এ কবিতা ডায়েরিতে এলো কি করে! সুষমাদি মেট্রিক পাশ করেছিল সেকেন্ড ডিভিশানে। বিয়ের পর আর পড়ালেখা করা হয়নি। গরীব ঘরের ছেলে মেয়েদের বিয়ের পর আর পড়ালেখা হয়ে ওঠেনা। সে কবিতাটা আমার সামনেই শব্দ করে পড়ে শোনালো। আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম যখন সে আবৃত্তি করলো

 

”সুষমাদি তোমার খোলা চুল,স্নিগ্ধ হাসি/বড় মায়াকাড়া বড় ভালবাসি

খোলা জানালায় অবিরাম সুষমাদির হাসিমুখ/সে মুখে তাকিয়ে খুঁজি জীবনের সব সুখ”।

 

আমি তো এ কবিতা লিখি নি। কবিতার কোথাও সুষমাদির কথা লেখা ছিল না, তার নামও ছিল না। কিন্তু সে যে কবিতাটা আবৃত্তি করলো তাতে স্পষ্ট তার নাম আছে,তার খোলা চুলের কথা আছে। আমি ছোবল দিয়ে তার হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে কবিতাতে চোখ বুলালাম। নাহ সেখানে সুষমাদির নামতো নেই! তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাকা হাসি ঠোটে লেগে আছে। আমি তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম সুষমাদি এটা মোটেও ঠিক হলো না। আমাকে এভাবে ভড়কে দেওয়া উচিত হয়নি। সে কিছু বললো না।তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। কবিতার প্রশংসাও করলো আর বললো কবিতা লেখা ছেড়ে না দিতে। আমি অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করলাম যে আমিতো কবিতা লিখতেই শুরু করিনি তাহলে ছাড়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে।

 

দুপুরে খাইনি বলে পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা ছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে গোসল সেরে আসলাম। বার কয়েক এপাড় ওপাড় সাতার কাটার পর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগলো। গোসল সেরে কাপড় পাল্টে খেতে বসলাম। সুষমাদি তখনো আমাদের বাড়িতেই ছিল। তার বাবা মারা যাবার পর অধিকাংশ সময় কাজ না থাকলে সে আমাদের বাড়িতেই থাকে। মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটায়। আমি আমার মত করে এখানে ওখানে ঘুরি ফিরি। যেদিন সুষমাদির মুখে নিজের লেখা কবিতা শুনেছিলাম সেদিনই সন্ধ্যার একটু পর মায়ের কথা মত সুকন্যাকে ও বাড়িতে দিয়ে আসতে গেলাম। সুষমাদি যে কথাটি বললো তা শুনে আমি আরো একবার চমকে উঠলাম। নিখিলেশ তোমার ঘরের জানালা খুলতেই দেখি অবিরাম সৌন্দর্য। যেন পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য সেদিন সেই বিকেলে তোমার জানালা ঠিকরে ভিতরে প্রবেশ করছিল। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে ফিরে যাই বাড়িতে। আরো একবার সেই অন্ধকারে জানালা খুলে বাইরে তাকাই। আমার চোখে ঘন অন্ধকার ছাড়া কোথাও কোন সৌন্দর্য ধরা পড়েনা। মনে পড়ে যায় বলাইয়ের কথা। যার চোখ আটকে ছিল পুকুর ঘাটে অজানা কোন সৌন্দর্যের মোহে।

 

 

পার্ট-৯

বেশ কিছুদিন ধরে দিদিকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয়নি। কিভাবে বলবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। আবার না বলতে পারলেও খারাপ লাগছিল। কিছুদিন হলো দিদির বিয়ে হয়েছে। জামাইবাবু বেশ ভাল। দিদিকে আদরে আহ্লাদেই রাখে। আমার দিদিও অনেক ভাল। শিমুলিয়া গ্রামে যে কয়টা ঘর অবস্থা সম্পন্ন দিদিরা সেই ঘর গুলির মধ্যে অন্যতম। শুধু অবস্থা সম্পন্নই নয়, নামে যসেও তাদের খ্যাতি আছে। তৃতীয় বারের মত দিদি যখন শশুর বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আসলো তখন দিদিকে নিয়ে পুকুর ঘাটে হাটতে গেলাম। হাটতে হাটতে ছোট বেলার অনেক কথাই বললাম। তার পর আমতা আমতা করে দিদিকে বললাম, দিদি তোকে একটা কথা বলার ছিল। দিদি বললো, একটা কেন হাজারটা বল! তাতেতো দোষ নেই। কতদিন পর আসলাম বাড়িতে। তোর জমিয়ে রাখা সব কথা শুনবো বলেইতো আমি অস্থির হয়ে আছি। আমি দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললাম, দিদি আমার আর কোন কিছুই ভাল লাগে না। এই গা, এই গায়ের মানুষ এবং তাদের চালচলন ভাল লাগে না। তাদের চোখের দৃষ্টি আমার ভাল লাগে না, তাদের মুখের কথাও আমার ভাল লাগে না। দিদি আমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে আমার একটু কাছে এসে বললো কি হয়েছে খুলে বল। আমি বললাম দিদি তোরতো অনেক গুলো কাপড় তার থেকে একটা যদি সুষমাদিকে দিয়ে আসতি। ওটুকু বলেই আমি আর অপেক্ষা না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। হাটতে হাটতে নকখোলার বিলে চলে গেলাম।

 

নকখোলার বিলে অগণিত মাছরাঙ্গা পাখি আছে, আর আছে সাদা রঙের বক। নিজেল পানিতে তাকালেই দেখা যায় কই, ডাইনকানা আর টাকি মাছের সারি। একটা কলার ভেলায় চেপে মন যেদিকে যায় হাল বেয়ে চলে যেতে থাকি। মনে হয় জীবনানন্দ দাশের হাল ভেঙে যে নাবি হারায়েছে দিশা এর মত আমিও হারিয়ে যাই কোন সুদুরে। আমি জানি আমার কথা শুনে আকাশ পাতাল কিছু ভাববে না আমার দিদি। দারিদ্রতার যাতা কলে পিষ্ট হয়েইতো বড় হয়েছে দিদি। তার সাথেই বেড়ে ওঠা সুষমাদির অবস্থা দিদির চেয়ে ভাল আর কারো জানার কথাও নয়। আমি কথাটুকু বলেই তার সামনে থেকে সরে এসেছি লজ্জায়। যে কথাটা আমার বলার ছিল না সেটাই আমি তাকে বলে এসেছি। এ সমাজে এর দায় ছিল সকলের। টিভি খুললেই নিতাই রায়দের মুখ যেমন ভেসে আসে, তেমনি তার থেকে বেশি ভেসে আসে বীরেন শিকদারদের মুখ। যারা ভাগ্য বদলে দেবে বলে দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চেয়েছিল। কিন্তু বাঙ্গালীর ভাগ্য ফেরেনি। একটা মাছরাঙ্গাকে দেখলাম ফুস করে জলের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে আবার বেরিয়ে আসলো। তার মুখে তখন একটা বড় পুটি মাছ। একটা দোড়া সাপ একেবেকে পানির উপর দিয়ে সাতার কেটে চলে গেল। কয়েকটা বালিহাস সাতার কাটছে মনের আনন্দে। যতদুর চোখ যায় পানি আর পানি। এই বিলটা কত মানুষের রুজি রুটির ব্যবস্থা করে তার কোন হিসেব নেই। আবার এই বিল কত যে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

বিলে সারা বছর পানি থাকে। কোথাও কোমর পানি তো কোথাও ঠাই নেই। কলিম মাঝির ছোট ছেলে এই বিলের পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল বলে শোনা যায়। এর পরও কত মানুষের জীবন এই পানি কাদায় হারিয়ে গেছে তা জানা নেই। রাজা লক্ষনেশ্বর শায়েস্তাখার আমলে এই বিল খনন করেছিল বলে শুনেছি কিন্তু সত্যি না মিথ্যা জানা হয়নি। সুর্য ডুবে গেছে অনেক আগে। আকাশে সাদা মেঘের ভেলার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলেছে একঝাক বক। আস্তে আস্তে অন্ধকার চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। আমি ইচ্ছে করেই দেরি করছি। যেন দিদিকে বলে আসা বিষয়টা দিদির মাথা থেকে চলে যায়। আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে ভেলাটা তীরের দিকে বাইতে শুরু করি। দুর থেকে কে যেন নিখিলেশ নাম ধরে ডাক দেয়। আমি ফিরে তাকাই না। আমি জানি ওটা ভ্রম ছিল। একটু এগোতেই কারো কান্নার শব্দ পাই। কেউ যেন ইনিয়ে বানিয়ে কাঁদছে আর নিখিলেশ আমাকে নিয়ে যা বলে ডাকছে। আমি জানি আমার ফিরে তাকানো মানেই সর্বনাশ ডেকে আনা। ওই ফাঁদে পা দিয়ে নকখোলার বিলে কত তাজা প্রাণ নিমিশে স্মৃতি হয়ে গেছে তা কারো অজানা নয়। নক খোলার বিলের মাঝে মাঝে খুটিতে শতর্কবানী লেখা আছে। কেউ ডাকলে পিছন ফিরে তাকানো যাবেনা। বিগত দুই বছরে কেউ এই ভুলটা করে নি। তাই নকখোলার বিল কারো পরিবারে কান্নার কারণ হয়ে উঠেনি। পিছন থেকে যতই ডাক আসুক আমি ভুলেও সেই ডাকে সাড়া দেব না।

 

পিছনের সেই মায়াবি ডাক উপেক্ষা করে ভেলাটা তীরে নিয়ে আসি। যেখান থেকে ভেলাটা নিয়েছিলাম সেখানে রাখা হয়নি। ভেলার মালিক ভেলাটা যায়গা মত না পেয়ে মরিয়া হয়ে খুঁজবে আর গালিগালাজ করবে। তা করুক! আমিতো আর সেই গালি শুনছি না। ভেলাটাকে খুটায় বেঁধে রেখে হাটতে থাকি বাড়ির দিকে। আমার সাহসের কোন অভাব নেই, তার পরও পিছন ফিরে তাকাইনি একটি বারও। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনের উপর যেদিন বিতৃষ্ণা এসে যাবে সেদিন সন্ধ্যায় নকখোলার বিলে যাবো একাকী। তার পর যতদুর চোখ যায় ভেলা নিয়ে ভেসে বেড়াব। কেউ পিছন থেকে ডাকলে ফিরে তাকাবো। সেদিন কোন পিছুটান থাকবেনা আমার,সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে চলে গেলেও আমার জন্য কারো চোখে জল ঝরবেনা। বাবা মা দিদি ছাড়া কাঁদার মত এ ভুবনে আমার আর কেইবা আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা বেশ আনন্দের। বর্ষার দিন গায়ের রাস্তায় হাটুজল থাকে, আর গ্রীস্মের সময় সেখানে ধুলোর আস্তরণ চোখে পড়ে। কাদামাটি আর ধুলোর রাজ্যে আমাদের বসবাস। কখনো খেয়ে থাকি, কখনো না খেয়ে থাকি তাতে কিছু আসে যায়না, কিন্তু আমাদের নিত্যদিন ধুলোর সাথে মাখামাখি থাকেই। কত রাত হয়েছে বোঝা যাচ্ছেনা। ইচ্ছে করেই দেরি করে ফিরছি। এতোক্ষণে সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। সুষমাদির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তার ঘরে বাতি জ¦লছে। মনে হলো একবার দেখা করে যাই। যেহেতু বাতি জ¦লছে তার মানে সে জেগেই আছে। আমি দরজায় কড়া নাড়তেই কে কে বলে কথা বলে উঠলো সে। আমি নাম বলতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। তার মুখটা হাসিহাসি। আমার হাত ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল। বিছানায় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সুকন্যা। সে কেন ঘুমায়নি বুঝতে পারি নি। সে কি ভেবে রেখেছিল আমি আসবো। তার অমলিন হাসিমুখ,দীঘল কালো চুলের সৌন্দর্য পেরিয়ে আমার চোখ দুটো আটকে আছে পরনের নতুন শাড়ীটার দিকে। দিদি সত্যি সত্যিই তাকে একটা শাড়ী আর ব্লাউজ দিয়ে গেছে যা সুষমাদি পরে আছে। আমার যেন কি হয়ে গেছে আমি জানি না। সে ভাত বেড়ে দিলে আমি অপলোক তার দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করি। একবারও মনে হয়নি আমি কেন এই রাতে একাকী তার ঘরে বসে তার বেড়ে দেওয়া ভাত খাব। তার যেন খাওয়াতেই আনন্দ। খাওয়া শেষে মুখ হাত মুছবো বলে আমি যখন গামছা খুঁজছি সে তখন এগিয়ে দিল। মুখ মুছে ফেরত দিতে গিয়ে খেয়াল হলো সেটা গামছা ছিলনা,সেটা ছিল সুষমাদির পরনের শাড়ীর আঁচল। সেও হয়তো তা খেয়াল করেনি আগে। যখন টের পেল সে যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

 

আমি বেরিয়ে গেলাম বাড়ির পথে। মনে মনে দিদিকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। উঠনে পা রাখতেই টের পেলাম মা ঘুমায়নি। সে নিশ্চই এখনো না খেয়েই আছে। গলা খাকারি দিতেই মা দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। আমি আগে কখনো এরকম রাত করে বাড়ি ফিরিনি। সে আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে পাটি পেতে দিল,নিজ হাতে ভাত মেখে মুখে তুলে দিল। একটু আগেই আমি যে খেয়ে এসেছি তার পরও খাওয়ার অভিনয় করতে হলো। মাকে কষ্ট দিতে মন চাইছে না। আমি বললাম মা তুমিও খেয়ে নাও। মায়ের খাওয়া হয় খুব কমই। দিদি ঘুমিয়েছে কিনা জানতে চাই। ঘুমোতে যাবার আগে খোলা জানালা দিয়ে দেখি দিদির মুখটি। অবসম্ভব সারল্য ভরা সেই মুখটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে। আকাশ থেকে অবিরাম ঝরে পড়া জোছনা পুকুরের পানিতে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে রেখেছে। সেদিকে তাকিয়ে কত কিছু মনে পড়ছে। জীবনটা বড়ই বৈচিত্রময়।

 

 

পার্ট-১০

 

অনেক চেষ্টা করে শেষে চার লাইনের একটা কবিতা লিখতে পেরেছিলাম। কানাইলাল স্যারের বাড়িতে রেখে আসা ঢালুন আনতে গিয়ে যে চাঁদ মুখ দেখেছিলাম সেটা চোখে লেগে আছে। ফিরে আসার সময় খোলা জানালায় চন্দ্রমুখীর মত বাকা হাসি নিয়ে সে যে ইঙ্গিত দিয়েছিল তাতে প্রেম ছিল, সুখ ছিল, আর ছিল স্বপ্নের সিড়ি। সুকন্যার অসুখের খোঁজ নেওয়া,বাজার থেকে ওর জন্য আনা দুই টুকরা সন্দেশ, বাড়িতে বাবা মা দিদি ফিরে এছেসে সেই চিন্তা আর হাতে বাজারের ব্যাগের চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে কখন যেন তাই ক্ষনিকের জন্য উদয় হওয়া চাঁদ হাসি প্রাধান্য পায় আমার কাছে। দিদির হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে মাকে বলে সুকন্যার জন্য আনা দুই টুকরো সন্দেশ দিতে সুষমাদির বাড়িতে পার রাখি। মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে,সেখানে আর এক মুহুর্তও দাড়াতে ইচ্ছে করে না। সুকন্যার হাতে সন্দেশ দুটো ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করি মাথা শান্ত করার জন্য কিন্তু কোন কিছুই ভাবতে পারি না।

 

সন্ধ্যার অন্ধকার তখন চারদিক থেকে ধেয়ে এসেছে। হাটতে হাটতে কানাই লাল স্যারের বাড়ি অব্দি চলে যাই। ঠায় দাড়িয়ে থাকি রাস্তায়। আমার চোখ দুটো কি যেন খুঁজছে, কাকে যেন খুঁজে মরছে। দৃষ্টি আপনা আপনি চলে যায় কানাই লাল স্যারের ঘরের জানালায়। একটু আগে যে জানালায় অবিরাম হাসি মুখ ছিল, আর ছিল রহস্যময় চাহুনীর পাশাপাশি বাকা হাসি। এখন সেই জানালা বন্ধ। পাটকাঠির বেড়ার ফাঁক গলে ক্ষীণ আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসলেও সেই অমলিন হাসি মুখ আর দেখা হয়ে ওঠে না। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকি কোন অছিলা নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকা যায়। মনে পড়তেই ছুটে যাই বাড়িতে। টেবিল থেকে একটা বই আর খাতা নিয়ে আবার ছুটি হাসি মুখের খোঁজে। উপরে দেখাই পড়া বুঝতে যাচ্ছি। কানাই লাল স্যারের উঠোনে দাড়িয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলি স্যার বাড়িতে আছেন? স্যারের কোন উত্তর পাইনা। উত্তর আসে কাকিমার কাছ থেকে। স্যারের হাপানিটা হঠাৎ বেড়েছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তাই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। কাকিমা ঘরের ভিতরে যেতে বলায় স্যারের পাশে গিয়ে বসি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেই সে পরম আনন্দ পায়। আমার হাতে বই দেখে তার চোখটা উজ্জল হয়ে ওঠে। দীর্ঘ একটা নিঃশ^াস নিয়ে স্যার বলেন, তুই পড়তে এসেছিস আর দেখ আজই আমি অসুখে পড়েছি। অসুখটা তেমন কঠিন কিছু না। যে কোন সময় ঠিক হয়ে যাবে। তুই বরং কাল আসিস। মনে মনে বলি, ওহে নিখিলেশ তোমার অপেক্ষা বাড়লো আরো। চলে যাওয়ার কথা মুখ দিয়ে না বলা পযর্ন্ত নড়বো না বলে পণ করে বসে থাকি। এটা ওটা বলে স্যারের সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকি। উদ্দেশ্য একটাই যদি তব দেখা পাই হে প্রিয়ে। কিন্তু সে আর আসেনা। তার হাসির শব্দ শুনি,পাটকাঠির বেড়ার ফাঁক গলে অন্য রুম থেকে আলো এসে ঠিকরে পড়ছে সাথে বয়ে আনছে সেই হাসি,যে হাসিতে খুন হতে হয় অবিরাম। কিন্তু কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়,কাকিমা বললেন রাত অনেক হয়েছে এবার বাড়ি যা, কাল আসিস। নিরাসক্ত মুখে আমি উঠে দাড়াই। পা চলতে চায় না। মনে হয় জানালার পাশে গিয়ে দাড়াই। যদি একবার জানালা খুলে যায়, ভেসে ওঠে সেই মুখ।

 

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পথ কেটে এগিয়ে যেতে থাকি। পিছনে পড়ে থাকে কানাই লাল স্যারের বাড়ি,দো চালা টিনের ঘর, আর দক্ষিনের জানালা। বার কয়েক ফিরে তাকাই। কিন্তু সেখানে আমার হাহুতাশ ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। রাতে খাবারের পর চোখে আর ঘুম আসে না। কেবলই মনে পড়ে ক্ষণিক দেখা একটি মুখের ছবি। ঘুমোতে যাবার আগে ডায়েরির পাতায় জমে ওঠে চার লাইনের একটি কবিতা,আত্মপ্রকাশ ঘটে এক কবির। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠি। আমার টেবিলের সামনে যে টুলটা পাতা আছে সেখানে বসে আছেন কানাইলাল স্যার। আমি প্রনাম জানিয়ে কখন এসেছেন সেটা জানতে চাই। তার শরীর এখন কেমন সেটাও প্রশ্ন করতে ভুলি না। স্যার হাসি মুখে বলেন, তিনি ভাল আছেন এবং হাপানী আর নেই এখন। গত দিন বেশ হাটাহাটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে হাপানীটা বেড়েছিল। তাছাড়া কাল তুই বই নিয়ে আশা করে কিছু একটা পড়া বুঝতে গিয়েছিলি আমি তোকে দেকাতে পারিনি বলে খারাপ লাগছিল। তাই ভাবলাম যাই তোর পড়াটা দেখিয়ে দিয়ে আসি। আমি আমতা আমতা করতে থাকি। পড়ার নামে আমারতো চাঁদ মুখ দেখার শখ ছিল কিন্তু সব ভেস্তে গেল। হাতমুখ ধুয়ে এসে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্যারের কাছে একটা দুটো অধ্যায় বুঝে নেই। মন পড়ে থাকে কানাই লাল স্যারের দোচালা টিনের ঘরের দক্ষিণ জানালায়। ভাবতে থাকি এখণ তবে কি উপায় করা যায়। পড়া শেষে স্যার যখন বাড়ির পথে হাটতে শুরু করেছেন আমিও পাশে গিয়ে হাটি। বলি স্যার আপনি কষ্ট করে আসলেন আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। স্যার আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যেন এক জীবনে তিনি কোন দিন আমার মত কোন শিক্ষাগুরু ভক্ত ছাত্র দেখেন নি। স্যার ধীরে ধীরে পা চালান। আমার মনে হয় আমি যেন খরগোশ-কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতায় আছি। চলতে পথে কত শত কথা হয়, যার সবটাই হয় পড়াশোনা নিয়ে। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জেনে না জেনে সেগুলোর উত্তর দিতে থাকি আর ভাবি আর কত দুর। যখন চোখের সামনে আবছা ভাবে ভেসে ওঠে স্যারের দোচালা ঘর, তখন মনের মধ্যে ফাগুনের হাওয়া বইতে শুরু হয়। মুখে যেন হাসির ফোয়ারা বয়ে যায়। আর তো কিছুটা সময়, তার পর দিনের আলোতেই দেখা হবে চাঁদ মুখ। যে মুখের হাসির সামনে বিমলিন হয়ে যায় তিনশো তেত্রিশটা পুর্ন চন্দ্র আর নিরানব্বইটা সুর্য। স্যার কি বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনের কথাটা? অবশ্য না বুঝারও কোন কারণ ছিল না। আমার আতিউতি চাহুনী, আমার ছটফটানির মধ্যেইতো অনেক কিছু ছিল।

 

কোন একদিন হয়তো আমারই মত কানাই লাল স্যারও কারো না কারো জন্য এমনই ভাবে ছটফট করেছিলেন তা কে জানে। স্যারর উঠোনে পা রাখতেই কাকিমা জানালেন আরেকটু আগে আসতে পারতেন! মেয়েটা চলে গেল বাবার সাথে কথাও বলে যেতে পারলো না। ঠিক সেই সময় আমার মুখের দিকে তাকালে যে কেউ বলে দিতে পারতো আমি বুঝি সদ্য রাজ্যহীন কোন রাজা। বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিন ব্যথা অনুভব করলাম। যে চাঁদ দিগন্তের কাছে পুর্ন আভা নিয়ে সমুজ্জল ছিল সে আর নেই। যেন হ্যালির ধুমকেতুর মত দেখা দিয়ে আজীবনের মত হারিয়ে গেছে। এক জীবনে মানুষের ভাগ্যে দুবার হ্যালির ধুমকেতু দেখার সৌভাগ্য হয় না, আমারওকি তাই। উঠোনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, সেই সাথে বাড়িটাও। কেমন যেন শশ্মানের মত নির্জন মনে হচ্ছে অথচ আমার সামনে কাকিমা আছে কানাই লাল স্যারও আছেন। আমাকে একটা টুল দিয়ে কাকিমা বসতে বললেন। কিন্তু আমার আর বসে লাভ কি! যে জীবন ঘাস ফড়িংয়ের, শালিকের, দোয়েলের সে জীবন হয়নাকো দেখা। টুলটা সামনে শুন্যই পড়ে থাকে। টুলের ওপর রাখা সদ্য কাকিমার এনে দেয়া নাড়– চিড়ে আমাকে টানে না। যেন লাটাই থেকে সুতো ছিড়ে ঘুড়িটা দুর নীলিমায় হারিয়ে গেছে আর আমি শুন্য লাটাই হাতে বসে আছি। জীবনটা আনন্দের চেয়ে বেদনার রঙ দিয়েই বেশিটা সাজানো। যে সাজিয়েছে তার মনেওকি বেদনা ছিল? নাহ সে তো আনন্দ বেদনার বহু উর্ধে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা নাড়– মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দুই চোখে শুন্যতা নিয়ে যে দিকে তাকাই আমাকে নিরাশা গ্রাস করে নিতে থাকে। আকাশ, বাতাস, এই শান্ত নদীর স্বচ্ছ জল, হিজল, তলাম, লতাগুল্ম কোন কিছুই আর আমাকে টানে না। হঠাৎ মনে হয় নকখোলার বিল আমাকে ডাকছে,আমাকে সেখানেই ছুটে যেতে হবে। যেতে যেতে বুক পকেটে হাত রাখি। সেখানে চার ভাজ করা যে কাগজটি আছে তার মাঝে বহু যতœ করে চার লাইনের একটা কবিতা লেখা হয়েছিল। কবিতা কারো শোনা হয়ে ওঠার আগেই মরে গেল,সেই সাথে বুঝিবা কবিরও মৃত্যু হলো। বুক পকেট থেকে ভাজকরা কবিতাটি বের করে চোখের সামনে মেলে ধরি,ঘোলাটে হয়ে আসে চোখের সামনে মেলে ধরা কাগজটি। চোখে সম্ভবত কিছু একটা পড়েছিল তাই জল টলমল করে ওঠে। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জলটুকু মুছে ফেলি।

 

হাটতে হাটতে অজানার পথে বিরামহীন হেটে চলেছি। এ চলার যেন শেষ নেই। নকখোলার বিলের কথা বেশ মনে পড়ে যায়। সে যেন দুর থেকে আমাকে ডাকছে তার নীল ঘোলা জলে ভেলায় ভেসে যেতে। আমি হাটতে হাটতে বিলের ধারে চলে যাই। আগের দিন যেখান থেকে ভেলা নিয়েছিলাম আজ আর সেখানে কোন ভেলা বাঁধা নেই। ভেলার মালিক হয়তো সেদিন খুঁজে না পেয়ে অনেক গালিগালাজ করেছিল। একটু খুঁজে পেতেই একটা ভেলা চোখে পড়লো। খুটায় বাধা রশিটা খুলে ভাসিয়ে দিলাম ভেলা। আজ আর কোন পিছুটান নেই। যতদুর চোখ যায় ভেসে যাবো। কোন দিন যে হিজল তলায় কেউ যেতে সাহস করেনি আজ সেখানেও যেতে আমার কোন বাঁধা নেই। যে হাসির রেখা অজান্তেই মিলিয়ে গেছে, সে হাসি আর কোন দিন ফিরে আসবে কিনা জানি না। কোথাও কোন জন মানুষের চিহ্ন নেই। সবাই যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে। ভেলায় ভাসতে ভাসতে এক সময় হিজল তলা চলে যাই। যে হিজল গাছটি নিয়ে কত না গল্প আছে। কেউ কোন দিন হিজল তলায় ভুলেও যায়না। সেখান থেকে কারো ফিরে আসার কোন নজির নেই। আমি দিব্বি সেখানে এসে আমার ভেলাটা থামিয়েছি। আশ্চর্য রকম স্বচ্ছ সেই পানি। মনে হয় নিচে কোন মাটি নেই। কোন একটা কাচের পাতিলের মধ্যে স্বচ্ছ পানি রাখা আর আমি সেই পানিতে ভেলা ভাসিয়ে রেখেছি। পকেট থেকে ভাজ করা কবিতার কাগজটি বের করে ছেলে বেলার মত করে নৌকা বানাই। ভাসিয়ে দেই হিজল তলার সেই স্বচ্ছ জলে।

 

কাগজের নৌকাটি স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকে। আমি যতই পানিতে ঢেউ তুলে সেটা সরিয়ে দিতে চাই সে সরে না। যাকে দেওয়ার ছিল তাকেই দিতে পারিনি বলেই কিনা জানিনা কবিতাটি হিজল তলার জলও গ্রাহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। যাকে ভাসিয়ে দিয়েছি তাকে আর ফিরিয়ে লাভ নেই। অনাদি অনন্তকাল সে ভেসে থাক তার মত করে। কিংবা ভেসে যাক মন যেদিকে যায়। রাত হয়ে গেছে বেশ আগে। কোথাও কোন আলো নেই। কিছু জোনাকী মিটমিট করে জলছে সেই সাথে আকাশে জ¦লে আছে পুর্নচাদ তাকে ঘিরে আছে অগণিত তারা। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কেউ আমাকে ডাকছে না। আমি ভেলাটা ভাসিয়ে নিয়ে তীরের দিকে বাইতে থাকি কিন্তু তার পরও কেউ পিছু ডাকে না। যে মায়াবীনির ডাকে সাড়া দিয়ে চিরকালের মত স্মৃতি হয়ে গেছে অনেক মানুষ এই নকখোলার বিলে, সেই মায়াবীনিওকি তবে নিখিলেশকে ত্যাগ করেছে। নিখিলেশ কি তবে এতোটাই অচ্ছুৎ।

 

ভেলা তীরের দিকে বাইতে বাইতে কতবার যে পিছনে ফিরে তাকিয়েছি তার ঠিক নেই। যতদুর চোখ গেছে শুধু ঘোলা জল আর জ¦লে থাকা জোনাকী ছাড়া কিছু চোখে পড়েনি। কবিতার সেই কাগজের নৌকাটি হয়তো এখনো অবিরাম আমারই মত ভেসে আছে হিজল তলার স্বচ্ছ জলে। তীর খুঁজে পেতে ভেলা থেকে নেমে বাড়ির পথে হাটছি। আমার সাথে সাথে হেটে চলেছে আকাশের মস্ত চাঁদ। সে কি তবে আমাকে পাহারা দিচ্ছে? কার ভয়ে পাহারা দিতে হবে আমাকে?

 

 

পার্ট-১১

 

 

সকাল থেকে মাকে দেখিনি। কোথায় গেছে তা আমাকে বলে যায়নি। তার ঘরে তালা লাগানো। মাকে খুঁজতেই হোক আর এমনিই হোক আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। যখন সুষমাদির বাড়ির কাছাকাছি এসেছি তখন সানাইয়ের সুর আমার কানে এসে শুল হয়ে বিঁধলো। ও বাড়িতে সানাইয়ের সুর বাজা মানে একমাত্র সুষমাদিরই বিয়ের সানাই হবে এটা বুঝতে বাকি থাকে না। বাড়িতে দুটো মাত্র প্রাণ। তিন বছরের সুকন্যা আর সুষমাদি। তবেকি সুষমাদির বিয়ে হচ্ছে? কার সাথে হচ্ছে,কেন হচ্ছে? এতো দিন যে মানুষটি বিয়ে করেনি এখন কেন করতে হচ্ছে। বাবা মারা যাওয়ার পর দুনিয়াতে একমাত্র মেয়ে ছাড়া সুষমাদির আর কেউ ছিলনা। মেয়ে এবং নিজের বেঁচে থাকার জন্য তাকে কাজ করতে হতো। মানুষের দৃষ্টিতে সে রোজ খুন হতো। তার বাবা বেঁচে থাকতেও তার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু বৃদ্ধ বাবার কথা চিন্তা করে সে রাজি হয়নি। কাঁপাকাঁপা পায়ে সুষমাদির বাড়ির উঠোনে পা রাখি। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করি। এর মাঝে সাজুগুজু করে সুষমাদি বেরিয়ে আসে। তার পাশে আমার মাও ছিল। আমি হতবাক হয়ে যাই। বুঝতে বাকি থাকেনা কিছু। একবার সুষমাদি সম্ভবত আমার দিকে তাকিয়েছিল আড়চোখে। সে চোখের দৃষ্টি যেন আমাকে খুন করতে চায়। আমি বেরিয়ে যাই। আমি হাটছি দিগন্তের পথে। কোথায় যাচ্ছি তার ঠিক নেই। হয়তো এই যাওয়ার কোন শেষ নেই। হয়তো এই পথ চিরকালের মত অচেনা হতে চলেছে।

 

কানাই লাল স্যারের ঘরের যে জানালায় আমার চোখ কারো হাসিমুখ খুঁজে ফিরতো, সেই জানালাটাও হয়তো খোলাই ছিল। কিন্তু আমার পোড়া চোখ সেদিকে ভুলেও একবার তাকালো না। পথে যেতে যেতে কত জনের সাথে দেখা হলো। তারা হয়তো আমার চোখে বিষন্নতা দেখেছিল, দেখেছিল কোন এক গভীর শুণ্যতা। আমার হাত ধরে দু একজন থামিয়ে কুশলাদি জানতে চেয়েছিল, আমি বলেছি ভাল আছি। কিংবা ভাল থাকার অবিরাম অভিনয় করে চলেছি। হাটতে হাটতে নবগঙ্গা নদীর ধার ধরে কত দুর গিয়েছি জানি না। আমি এতোটা দূরে যেতে চাইছি যেখানে সানাইয়ের সুর নেই,মেহেদীর রঙ নেই, কাজল কালো হরিণী চোখে তাকিয়ে কেউ আমাকে খুন করবে না। অনেক আগেই আমি সেই দুরত্ব অতিক্রম করে এসেছি। কিন্তু পোড়া চোখের পাতায় ভেসে আসছে কপালে লাল টিপ, আলতা রাঙা পা, সাখা সিদুরের ছবি। কানে অবিরাম বেজে চলেছে সানাইয়ের সুর। একটা ছোট্ট মাটির ঢিলাকেও অসহ্য লাগছে। পথ থেকে সেই ঢিলাটা কুড়িয়ে ছুড়ে মারছি নবগঙ্গার জলে। জল ছিটকে পড়ছে চার দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আকাশে কোন মেঘ নেই, সে আকাশে উজ্জল সুর্য যেন সব টুকু তেজ ঢেলে দিয়ে আমাকে পোড়াতে চায়। যদি ঢিল ছুড়ে আকাশাকে ছোয়া যেত, তবে একটা ঢিল ছুড়ে আকাশের বুকটা ছিন্ন ভিন্ন করে দিতাম। কেন আজ তার চোখে জল নেই,কেন সে কান্নার বৃষ্টি হয়ে নেমে আসেনা আজ। এক নিখিলেশ কেন অবিরাম অভিমানে জ¦লতে থাকবে।

 

আজ বোধ হয় আমার সেই দিন। আজওকি তবে নকখোলার বিল আমাকে আশ্রয় দেবে না? সেও কি সবার মত আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সুষমাদির বাড়িতে যে সানাইয়ের সুর বাজছে সে বড়ই করুণ মনে হয় আমার কাছে। এর চেয়ে ভাল ছিল বধিরতা, তাহলে সেই সুর শুনতে হতো না কোন দিন। এর চেয়ে ভাল ছিল অন্ধ হওয়া, তাহলে দেখতে হতোনা সেই আলতা রাঙা পা,কপালের লাল টিপ, বেনারসীতে জড়ানো চির চেনা মুখখানি।

 

মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব, সেই সাথে দিদির কথাও। এই যে আমি হাটছি নকখোলার বিলের দিকে, এ আমার অনন্তের পথে হেটে যাওয়া। এই পথ কিছুক্ষনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে। হয়তো কোন দিন শোনা হবেনা দিদির আদুরে ডাক, মায়ের স্নেহ মাখা বুলি। বাবা গঞ্জ থেকে ফিরে এসে যখন নিখিলেশ বলে ডাক দিবে, তখন কেবল শুন্যতা ছাড়া আর কিছু ফিরে আসবে না। ঘরখানা আজীবনের মত শুন্য হয়ে পড়ে থাকবে। কিন্তু যে মায়াবীনির ডাক শুনতে আজ ছুটে চলেছি নকখোলার বিলের দিকে সে কি তবে সেদিনের মতই নিরব থাকবে, যেদিন আকাশে পুর্ন চাঁদ ছিল আর ছিল শত কোটি তারার মেলা। সেই জোছনার আলোয় চারদিক ছিল আলোকিত।

 

ভেলা নিয়ে হিজল তলা পেরিয়ে সপ্তসিন্ধু নামে যে যায়গাটি ছিল সেটিও পেরিয়ে এসেছি। আজও সেদিনের মত ভরা জোছনা চারদিক আলোকিত করে রেখেছে। বিলের জলে ভেলা ভাসানোর আগেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সানাইয়ের সুর থেমে গেছে সেই কবে, কিন্তু আমার কানে সেটা বেজে চলেছে অবিরাম। সে যেন আমাকে শোনাতেই ব্যস্ত। যে মুখ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা আমার সামনে ভেসে উঠতো গোচরে অগচরে সে এখন অতি দূর নক্ষত্রের পথে আজীবনের মত হারিয়ে গেছে। যাবার বেলায় তার সাথে কথা হয়নি,হয়তো আর কোন দিন সেই চিরচেনা কন্ঠটি শোনা হবেনা।

 

দ্বিতীয়বারের মত নকখোলার বিলের মায়াবীনি আমার সাথে ছলনা করলো। সারা রাত বিলের পানিতে ভেলা ভাসিয়ে বেড়ানোর পরও সে একটিবারের জন্যও আমাকে ডাকলো না। কেন ডাকলো না কে জানে! কেবলই মনে হতে লাগলো মানুষ যা বলেছিল সব ভুল ছিল, সব ছিল রটনা। এই ঘোলা জলের নকখোলার বিল, দুরে হিজল তলার স্বচ্ছ পানি, কারো সাথে প্রতারণা করেনি কখনো। মানুষ বিনা দোষে কলঙ্ক তিলক পরিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ।

 

কারো একজনের ধাক্কায় ঘুম ভাঙতেই ধড়ফড়িয়ে উঠি। ভেলার উপরই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভেলাটা ভাসতে ভাসতে তীরে এসে থেমে গেছে। কিন্তু বিলেতো কোন ¯্রােত নেই। আর যতদূর মনে পড়ে আমিতো বিলের মাঝামাঝিতেই ছিলাম যতক্ষন জেগে ছিলাম। কখন ঘুমিয়েছি, কিভাবে তীরে এসেছি তা জানা হয়নি। যে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে তাকে আমি চিনি না। সম্ভবত অন্য কোন গায়ের লোক সে। তবে সে ছিল ভেলাটির মালিক। তার কথাতে বুঝলাম সে যেখানে ভেলাটি রেখেছিল সেখানে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এসে পেয়ে গেছে। সারা রাত আমি ভেলাতে ভেসে কাটিয়ে দিয়েছি শুনে তার যেন বিস্ময়ের সীমা নেই। আমি জানি সে চারদিক রটিয়ে দেবে। এও জানি সে যেহেতু আমাকে চেনেনা তাই যাই বলে বেড়াক তাতে কারো কিছু আসে যায় না। হয়তো যুগের পর যুগ নকখোলার বিল নিয়ে মানুষের যে ভ্রান্ত ধারণাা ছিল সেটার মতই আরো নতুন কোন ভ্রান্ত ধারনার জন্ম নেবে।

 

বেলা হয়ে এসেছে। সারা রাত বাড়িতে ফিরিনি দেখে বাবা মা হয়তো চারদিকে খোঁজ নিয়েছে। যে বিল আমাকে ধরে রাখতে পারেনি, ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার, সে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার কোন মানে হয়না। আমি ফিরে যাই মায়ের কোলে, নিজ বাড়িতে। সুষমাদির বাড়ির কাছে যেতেই দেখতে পাই একদল লোক গরুর গাড়ি থামিয়ে বাড়িটি ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। জানতে পারি বিয়ের সাথে সাথে বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে গেছে সুষমাদি। কত সহজেই মায়ার ব্াধন মানুষ ছিন্ন করতে পারে তা ভেবে বিষন্ন হয়ে পড়ি। এ ভব সংসারে কেবল একজন নিখিলেশ মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাড়িতে ফেরার পর মা বাবা বুকে জড়িয়ে ধরে যে আদর করেছিল তাতে মনে হয়েছিল হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে তারা ফিরে পেয়েছে। বারান্দায় পাটি পেতে মায়ের পাশে বসে থাকি নিরবে। শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকি পথটার দিকে। যে পথে কোন দিন ফিরে আসবেনা ব্ধান ছিন্ন করে যে চলে গেছে ।

 

পার্ট-১২

বলাই নেই তিন বছর হতে চললো। এই তিনবছরে জীবনের রঙ পাল্টেছে বহুবার। সে চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে মনেরও আড়াল হতে চলেছে। বলাইয়ের সাথে আমার কত হাসি কান্নার স্মৃতি মিশে আছে। একসাথে স্কুল কলেজ যাওয়া, নকখোলার বিলে ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো, আরো কত কি। সেই বলাই এখন আর নেই। ভাগ্যের সন্ধানে সে তার বাপের শেষ সম্বল চাষের জমিটুকু বিক্রি করে মালদ্বীপ গেছে। তিন বছর হয়ে গেছে কিন্তু বলাইয়ের কোন খোঁজ পাইনি। প্রথম দিকে সে কিছু কিছু টাকা পাঠাতো তার পর তাও বন্ধ হয়ে গেছে। বলাইয়ের বাবা মা এক মাত্র ছেলের জন্য পাগল প্রায়। তাদের একটাই চাওয়া ছেলেটা ভালভাবে দেশে ফিরে আসুক। বলাইয়ের কি হয়েছে তা আমার জানা নেই। মাঝে মাঝে মনে হতো সে বুঝি ইচ্ছে করেই আড়াল হয়ে গেছে,ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেছে। যতই ঘৃনা করিনা কেন বিদেশ যাওয়ার সময় তার সাথে শেষ দেখাটা করতে ভুলিনি। আমি কিছু বলার আগে স্বভাব মত সে বলেছিল, এই দেশে, এই গায়ে থেকে আর কি হবে?যেখানে দু মুঠো ভাত জোটেনা,ঘুমানোর জন্য ঘর জোটেনা, সেখানে আর থাকতে চাই না। ওর অভিমানি কথায় মনটা ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু যে খোঁচা দিতে শিখেছে সে খোঁচা না দিয়ে কথা বলার মানুষ না। যেতে যেতেও সে জ¦ালিয়ে যায় তার অনলে। আক্ষেপ করে বলেছিল ”তোমার খোলা চুল,স্নিগ্ধ হাসি/বড় মায়া কাড়া,বড় ভালবাসি। আমি জানি সে মনে মনে সুষমাদিকে ভালবাসতো। সুষমাদির একাকীত্ব তাকে ভাবাতো এবং তার দৃষ্টি সারাক্ষণ সুষমাদিকে খুঁজতো। যেতে যেতে তাই তার কন্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়ে। যে বাতাসে আর কোন দিন সুষমার খোলা চুল উড়বে না,যে পুকুরে সে আর কোন দিন অবাধ সাতারে মেতে উঠবেনা,যে পথে কোন দিন সে হাটবেনা, সে বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে আমার কষ্ট হয়,সে পুকুরে সাতার কাটতে আমার বিষাদ লাগে,সেই পথে হেটে যেতে আমার ক্লান্তি লাগে।

 

বলাইয়ের মনে যে ভালবাসা জন্মেছিল তার কারণে সে কোন দিন সুষমাদিকে দিদি বলে ডাকেনি। তিন বছরের ছোট ছিল বলাই। সুষমাদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বলাইকে ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। কলেজে যেত না ঠিকমত। তার পর একদিন কোন ভুত ঘাড়ে চেপে বসলো, সে দেশান্তরি হবে। সেই যে সে দেশান্তরি হলো এখন আর তাকে খুঁজে পাইনা। নকখোলার বিলের পানিতে পানকৌড়ি ভেসে বেড়ায়,ভেলায় চড়ে কত বিকেল পার করে দেই, শুধু ভেলার অন্য প্রান্তে বলাই নেই। হয়তো কোন দিনও তাকে আর ভেলার অন্য প্রান্তে খুঁজে পাব না।

 

পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কানাই লাল স্যারের চেষ্টায় অম্বিকাপুর হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে গেলাম। দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে মানুষ কমে গেল, সেই সাথে খরচও কমলো কিছুটা। কিন্তু সারাদিন মায়ের কথা বলার মত মানুষের খুব অভাব ছিল। দিদি থাকতে মা সারাদিন দিদির সাথে গল্প করতো। দিদির বিয়ের পর কিছুদিন সুষমাদির সাথে গল্প হতো। এর পর আমি চাকরি পাওয়ায় সংসারে সুখ আসতে শুরু করেছে। বাবাকে পরিশ্রম কমিয়ে দিতে বলেছি। গোপিনাথপুর থেকে একটা ভাল সম্মন্ধ এসেছিল আমার জন্য। বাবা, মা, দিদি, জামাই বাবু সবাই মিলে কনে দেখে এসে জানাল তাদের বেশ পছন্দ মেয়েটিকে। আমি আর অমত করিনি বড়দের কথায়।

 

বিয়েতে বলাই ছাড়া আর সবাই ছিল। অনিমেষ ছিল,পঙ্কজ ছিল,নিমাই ছিল, শুধু বলাই ছিল না। তার থাকার কথাও না। সে তো দুর বিদেশে দেশান্তরি হয়েছে। বাসর রাতে বিছানায় ঘোমটা মাথায় যে আমার জন্য অপেক্ষায় ছিল তাকে প্রথম বার দেখেই চমকে উঠেছি।তার গলার স্বর আমার চেনা,তার হাসিটাও আমার চেনা। শরীর থেকে যে মিষ্টি সুবাশ ছড়িয়ে পড়ছিল সেটাও যেন আমার চেনা। ঘোমটার আড়ালে যেন অতি পরিচিত কারো মুখ লুকিয়ে রাখা। সেই মুখটা কার? জানালায় অবিরাম হাসি মুখের সেই আলো ছায়ার রানী নাকি অন্য কেউ যার অবাধ সাতারের মধ্যে কেউ কেউ খুঁজে পেতো পৃথিবীর তিন ভাগ সৌন্দর্য। ঘোমটা সরাতেই যেন তেত্রিশটা সুর্য একসাথে আমার চোখের সামনে আলো দিয়ে উঠলো। যেন নিরানব্বইটা পুর্ন চাঁদ একসাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু সেই আলোর ধারায় কার যেন ছায়া পড়েছে। তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল নাকি তোমার মন, বলে তার মুখটা উচু করে ধরলাম। সেই প্রথম কথা বলে উঠলো।

 

তার হাসিতে প্রেম ছিল,তার কথায় যাদু ছিল। সে আমাকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল এখনও বেশ মনে পড়ে। বিয়ের দেড় বছর পর সেটা মনে পড়তে বাধ্য করেছে আমাকে। সেদিনের মতই আরো একবার আমি চমকে উঠেছি। জীবনে না জানি আরো কতবার চমকাতে হবে আমাকে। আমি তাকে কোন নামে ডাকবো সেটা সে জানতে চেয়েছিল। তার নাম ছিল তমালিকা। আমি তাকে বলেছিলাম তোমাকে আমি তমালিকা বলেই ডাকবো। সে যখন বললো তার আরো একটা নাম আছে আমি সেটা ধরেও চাইলে ডাকতে পারি। আমি তখন সেই নামটা শোনার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। সে বলেছিল তার নাম সুষমা! ভীষণ রকম চমকে উঠেছিলাম সেদিন। বিষম খেলাম বেশ। একজনের সাথে আরেকজনের নাম মিলতেই পারে, তবে তার সেই চোখ, সেই নাক, সেই বাকা হাসিও যে মিলতে পারে তা ভাবিনি। কিংবা হয়তো আমার চোখ নিজের মত করে দৃশ্য সাজিয়ে নিয়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে সে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে বললো অমন চমকে উঠলে যে! আমার তখন কি আর বলার থাকতে পারে। যেন নকখোলার বিলে একাকী ভেলায় চড়ে ভেসে আছি আর পিছন থেকে মায়াবীনি সেই রাক্ষুসী আমাকে ডাকছে আর আমি নিরুত্তর ভেসে চলেছি কুলের দিকে।

 

দুজন দুজনাতে একাকার হয়ে কত কথা হয়েছিল সেদিন। ওর খুব কবিতার প্রেম ছিল। বিয়ের প্রথম রাতেই ও আমাকে কবিতা শুনিয়েছিল। সে তার প্রিয় কবিতার দুটো লাইন যখন শুনিয়েছিল তার পর থেকে কবিতা শুনতে আর ইচ্ছে হয়নি। সে আচমকা আমাকে চমকে দিয়ে আবৃত্তি করে উঠলো

“সুষমাদি তোমার খোলা চুল,স্নিগ্ধ হাসি/বড় মায়াকাড়া বড় ভালবাসি,

খোলা জানালায় অবিরাম সুষমাদির হাসিমুখ/সে মুখে তাকিয়ে খুঁজি জীবনের সব সুখ”।

 

জীবন বড়ই বৈচিত্রময়। কবিতা শুনে আমি চমকে উঠে কথা হারিয়ে ফেলি। তার মুখে তখন অবিরাম বাকা হাসি। বলতে পারিনা তোমার বাঁকা হাসিতেও প্রেম আছে। ঘোর লাগা কন্ঠে বলি, এ কবিতা কোথায় পেলে? সে হাসে, উত্তর দেয় না। পরদিন সকালে বেশ বেলা করে আমার ঘুম ভাঙে। আড়মোড় ভেঙে বিছানা ছাড়তে গিয়ে বালিশের নিচেয় কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাই। বের করে দেখি একটা ডায়েরি,আমার লেখা। খুলে দেখি তেমন কিছুই লেখা নেই সেটাতে। শুধু মাঝখানে একটা পৃষ্ঠাতে ওই কবিতার চরণদুটি। সেখানে সুষমাদির নাম লেখা নেই, কিন্তু তমালিকা কি করে নাম জুড়ে দিয়ে আবৃত্তি করেছিল তা জানা হয়না।

 

দেড় বছর পর আমাদের ঘর আলো করে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। বাবা, মা, দিদি সবাই অনেক খুশি। আমারও অনেক ভাললাগা ভালবাসার ফসল ছিল সে। আতুর ঘর থেকে বের হওয়ার পর যখন নাম রাখার সময় এলো সবাই তাদের পছন্দ মত নাম বলতে লাগলো। আমি তমালিকাকে বললাম কি নাম রাখবা মেয়ের? সে বাসর রাতের মত সেই বাকা হাসি হেসে জানাল মেয়টির মান রাখলাম সুকন্যা! আমি তখন ঠায় দাড়িয়ে নির্বাক চোখে একবার তমালিকার দিকে আর একবার তার কোলের শিশুকন্যার দিকে তাকিয়ে জীবনের রহস্য খুঁজতে লাগলাম। ক্রমাগত আমি রহস্যের অতল গভীরে হারিয়ে যেতে যেতেও কোন কুল কিনারা খুঁজে পেলাম না। তবে কি তমালিকার মধ্যে সুষমা ফিরে এসেছে? তবে কি সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির মধ্যে সুকন্যা ফিরে এসেছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে মেয়েটার নাম সুকন্যাই রাখা হলো। অনেক বছর পর হয়তো পরিচিত নামটা ফিরে এলো এই ঘরে, এই আঙিনায়।

 

 

 

সুষমা কোথায় আছে আমি জানিনা। শুনেছি সে তার স¦ামীর সাথে একমাত্র কন্যাকে নিয়ে কোলকাতা চলে গেছে। কিন্তু আমি জানি সে আছে এই আঙ্গীনাতে, আমার আশেপাশেই। বারান্দায় খেজুর পাতার পাটি পেতে এক মাত্র মেয়ে সুকন্যাকে যে দুধ খাওয়াচ্ছে হয়তো সেই সুষমা,হয়তো সে তমালিকা নয়। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কত অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি কিন্তু সদুত্তর পাই না। যে হাসি মুখ আমার অন্তরকে প্রশমিত করে সে তমালিকা কিংবা সুষমা হতে পারে কিন্তু সে সুষমাদি নয়।

 

=================সমাপ্ত====================================

 

সুচনা- ২৫ মে ২০১৬

দুপুর ২.৩০

শেষ

২৭ মে ২০১৬

বিকাল ৫.৫৫

 

 

জাজাফী

ইমেইলঃ [email protected]

Most Popular