Tuesday, March 19, 2024
Homeউপন্যাসরঙ্গীন ফানুস, পর্ব-২

রঙ্গীন ফানুস, পর্ব-২

     কবির স্যারের মুখে সেই প্রথম ক্যাডেট কলেজের নাম শুনি আমি।কিন্তু সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলনা।কোন দিন ভুল করেও কবির স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়নি ক্যাডেট কলেজ আসলে কি?যতদুর মনে পড়ে এর পর তিনি কোন দিন ক্যাডেট কলেজের নামটাও নিয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে।আর আমার মনে হয় তাকে যদি ওটা নিয়ে প্রশ্ন করতাম তবে দেখা যেত তিনি ওই ক্যাডেট কলেজ শব্দটা ছাড়া আর কিছুই জানেন না।ভুগোল আর ইতিহাসের ওপর স্যারের অন্যরকম দখল ছিল।সেই বয়সেই তিনি আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির কথা বলতেন।আমার মাথাতে সেসব ঢুকতো না।আমি যেসব পরীক্ষায় আসবেনা সেসবে কান দিতাম না।এখন বুঝি সেই সব বিষয়গুলি যদি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম তবে কতইনা ভাল হতো।কবির স্যারের সাথে আমার দেখা হয়নি অনেক অনেক বছর।বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় কিন্তু আমরা ব্যক্তি জীবনে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে অনেক কাছের মানুষেরও খোঁজ রাখতে পারিনা।বাবার মুখে একটা কথা শুনেছিলাম ‘চোখের আড়াল না মনের আড়াল’। সত্যিই এক জীবনে কেউ যখন চোখের আড়াল হয়ে যায় সে যেন মনের আড়ালেই হারিয়ে যায়। কালেভদ্রে হয়তো কারো সাথে দেখা হয়।বাকিরা অজ্ঞাতেই আজীবনের মত হারিয়ে যায়।একদিন হয়তো খবর পাই অমুক নেই।একদিন হয়তো তারাও শুনবে আমি নেই।

২.

সারা বছরে হয়তো একবার আমাদের জন্য নতুন কাপড় কেনা হতো।সেই নতুন কাপড় কেনার জন্যও কখনো শহরে যেতে হতো না।গ্রাম থেকে বের হলেই বিনোদপুর বাজার।কিংবা রাড়িখালি বাজার পার হলেই নবগঙ্গা নদী পেরিয়ে শত্রুজিৎপুর বাজার।আমাদের কাপড় যা কেনা হতো কিংবা বানানো হতো তার সবই ওখান থেকে।কথায় বলে মোল্লার দৌড় মসজিদ পযর্ন্ত আমাদের অবস্থা অনেকটা তাই।আমাদের দৌড় ছিল ওই বিনোদপুর বাজার নয়তো সবোর্চ্চ শত্রুজিৎপুর বাজার।এমনকি কেউ অসুস্থ্য হলে যখন শহরের সদর হাসপাতালে ভর্তি হতো তখনো আমাদের মত ছোটদের সেখানে যাওয়া হতো না।ছোটরা হলো নানা অকাজের কাজী।

ছোটদের নিলেই নানা তালবাহানা শুরু করবে ভেবেই বড়রা আমাদেরকে সব সময় বাড়িতেই রেখে যেত।আর তাদের হাতে ছিল আমাদেরকে বশ করার কঠিন এক অস্ত্র আর তা হলো চানাচুর।পাঁচ টাকা দিলেই এক প্যাকেট বড় সাইজের চানাচুরের প্যাকেট পাওয়া যেত।আমাদের সবারই প্রিয় ছিল এই চানাচুর।

বড়রা বলতো বাড়িতে থাকো তাহলে আসার সময় তোমাদের জন্য চানাচুর নিয়ে আসবো। আমরা সেই চানাচুরের লোভে বাড়িতেই থেকে যেতাম। কখনো আর শহরে যাওয়া হতনা।আবার দেখা যেত কখনো কখনো বাড়িতে রেখে যাওয়ার শর্তে চানাচুরের পরিবর্তে পুরো পাচ টাকাই হাতে ধরিয়ে দিত। যেদিন টাকা ধরিয়ে দিত সেদিন মনে হতো দুনিয়াতে সব থেকে বড়লোক হলাম আমি।আমাদের কাছে তখন পাচ টাকা মানে বিলগেটসের সমান টাকা।যদিও বিলগেটসের নাম গ্রামের একজনও জানতো না।এখন সেই সব কথা মনে পড়লে নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই।

যখন সেই পাচ টাকা হাতে দিয়ে দেওয়া হতো তখন আমাদের মনের মধ্যে যে পাখিটা বাস করতো সে তার রঙীন ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিত।সেদিন আর পড়ালেখা হতো না। বড়রা সেটা জানতো তার পরও সাথে করে শহরে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা এটা করতো।তারা মনে করতো ছেলে পেলেকে শহরে নিয়ে যাওয়ার যে ঝামেলা তার চেয়ে একদিন পড়ালেখা না করে যদি হইহই করে ঘুরে বেড়ায় তবুও শান্তি।গ্রামে শিক্ষিত মানুষের হার খুবই কম ছিল।পুরো গ্রামে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম  এ তথ্যটিই বলে দেয় গ্রামের অবস্থা কি ছিল।আর আমার স্কুল লাইফের সময়টা তাহলে কিরকম ছিল সেটা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে।এখন গ্রামে প্রতি ঘরে ঘরেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়ে পাওয়া যাবে কিন্তু তখনকার কথা ছিল সম্পুর্ন আলাদা।

     হাতে পাওয়া পাঁচটাকা নিয়ে আমাদের আনন্দের সীমা ছিলনা।পরিকল্পনা করতাম এই টাকা দিয়ে কি কি করবো।কখনোই মনে হতো না যে এখান থেকে একটাকা দুই টাকা জমিয়ে রাখবো।সবার আগে অবধারিত ভাবেই মার্বেল কেনার জন্য বাজেট করতাম দুই টাকা। তখন দুই টাকায় ৩০টার বেশি মার্বেল পাওয়া যেত।আমার বেশ মনে পড়ে মার্বেল ছিল আমাদের সব থেকে প্রিয় বিষয়।

      বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালিন সময়ে একদিন বিকেলে এক পিচ্চির সাথে বসে আছি তাদের ঘরে।সেদিন তার মা তাকে এবং আমাকে কিছু পিঠা খেতে দিলেন।পিচ্চিটার বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয় বছর।সে প্লেট থেকে একটা পিঠা হাতে নিয়ে আমাকে বললো জানো এই পিঠাটা না আমার প্রিয় পিঠা। আমি বললাম কতটা প্রিয়? সে বললো অনেক প্রিয়।তার পর পিঠা নিয়ে তার সাথে অর্ধেক এমফিল আর অর্ধেক পিএইচডি থিসিস করে ফেললাম।সে আমাকে জানালো সেই পিঠাটা নাকি তার কাছে তার বাবা মায়ের চেয়েও প্রিয়! আমি বললাম কি বলছো তুমি? তোমার বাবা মার চেয়েও তুমি এই পিঠাকে বেশি ভালবাসো? সে বললো অবশ্যই ভালবাসি। আমার বেশ অবাক লাগলো। সামান্য পিঠা কারো কাছে এতো প্রিয় হতে পারে? আমি বললাম আচ্ছা মনে করো তোমাকে এক প্লেট পিঠা দিয়ে বলা হলো এই পিঠা নিয়ে তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাও তাহলে কি করবা? সে আগের মতই উত্তর দিলো: এই পিঠা আমাকে এক প্লেট দিয়ে যদি বলে এই বাসা থেকে চলে যেতে তাও আমি যেতে রাজি আছি কিন্তু এই পিঠাই আমার সব থেকে প্রিয়!

সেই পিচ্চিটার মতই আমাদের কাছে মনে হতো মাবের্ল খেলতে দেওয়ার অনুমতির বিনীময়ে এক ওয়াক্ত না খেয়ে থাকতে বললে তাও আমার রাজি হয়ে যেতাম।এই খেলাটা এতো জনপ্রিয় ছিল যে মনে হতো এটাই বাংলাদেশের জাতীয় খেলা।নাহ তখন কিন্তু জাতীয় খেলা বিষয়ে কোন ধারনা ছিলনা কিন্তু মনে হতো সব থেকে বেশি জনপ্রিয় খেলাই হলো মাবের্ল খেলা।জাতীয় বিষয়গুলোর মধ্যে আমরা শুধু জানতাম জাতীয় পাখির নাম, ফুলের নাম, মাছের নাম এবং জাতীয় কবির নামটা জানতাম। এর বাইরে আর যত জাতীয় বিষয় আছে তার কিছুই আমাদের জানা ছিলনা।শুধু আমাদের কেন, পুরো এলাকার কারো জানা ছিল বলে মনে হয়না।মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের স্কুলেরই কারো ওসব জানা ছিলনা তখন।একবিংশ শতাব্দীতে এসে যে স্কুলে এখনো পত্রিকা পৌছায়না সেই স্কুলে এতো বছর আগে কেউ ওই সব বিষয় জানবে তা প্রায় ভাবাই যায় না।ঠিক এই কারনের ক্যাডেট কলেজ বিষয়েও কারো কোন ধারণা ছিলনা। কবির স্যার ওই শব্দটা উচ্চারণ না করলে হয়তো কোন দিন ওই বয়সে ওরকম একটা অজপাড়াগায়ে বসে ক্যাডেট কলেজ বলে যে কিছু একটা আছে তাই জানা হতো না।আমাদের সবার মাঝে মাবের্ল খেলা নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল তা বোধহয় বর্তমানে উসাইন বোল্টের একশো মিটার দৌড়ের সময় যেমন উত্তেজনা হয় তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিলনা।আমরা মাবের্ল খেলার জন্য এহেন কাজ নেই যা করিনি।স্কুল ছুটি হওয়ার পর অধিকাংশ দিন আমরা বাড়ি না ফিরে কোথায় কোথায় চলে যেতাম মাবের্ল খেলতে।ফিরতাম রাত হলে। তবে বড়দের চোখের পড়লেই দাবড়ানি খেতে হতো। কেউ এই খেলাটা পছন্দ করতো না।শেষে উপায় না দেখে আমরা অপকর্মে লিপ্ত হতাম। দেখিয়ে দিতাম আমাদের দস্যিপনা।আর আমাদের সেই দস্যিপনা টের পাওয়া যেত যখন লোকেরা পাট কাটতে যেত। দেখা যেত কোন কোন জমির ভিতরে একটা বিশাল এলাকা জুড়ে একটাও পাটগাছ নেই।সেখানকার মাটিও বেশ পরিপাটি করা যেন প্রতিদিন কেউ সেখানে লেপন দিয়েছে।গ্রামের কাচা ঘরগুলোতে মহিলারা লেপন দিয়ে পরিপাটি করে রাখে।আমরা যখন কোথাও মাবের্ল খেলার যায়গা পেতাম না তখন একবার ইকবাল এই বিটকেলে বুদ্ধি বের করলো।পাটক্ষেতের চারপাশে অগণিত পাট থাকায় ভিতরে কোন একটা অংশ যদি ওভাবে কেটে সেখানে খেলার ব্যবস্থা হয় তাহলে কারো সাধ্যি নেই আমাদেরকে ধরার।সে কারণেই বিভিন্ন পাটক্ষেতের মাঝে আমরা মাবের্ল খেলার কোট তৈরি করতাম। যখন সেখানে সুবিধা হতো সেখানেই খেলতাম।

পর্ব-১ এখানে

পর্ব-৩ এখানে

2794 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Most Popular