একবার মিরপুর ১০ নাম্বার থেকে বাসে করে কচুক্ষেত যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন পিছন থেকে বললো এক্সমিউজমি ভাইয়া। আমি তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে। আমি তার কথায় মোটেও অবাক হইনি। সে নিজ থেকে বললো ভাইয়া আমি এফজিসিসির এক্স ক্যাডেট। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়ছি। এর পর পথ চলতে চলতে বেশ কথা হলো। কচুক্ষেত নেমে তাকে বললাম কী খাবে বলো। দুজনের কেউ কিন্তু কাউকে চিনি না। আগে কোন দিন দেখাও হয়নি। সে বললো ভাইয়া কিছু লাগবে না। আমি বললাম তা কি হয়। এর পর কচুক্ষেতেই একটি রেস্টুরেন্টে তাকে খাওয়ালাম। এক ঘন্টা গল্প করলাম নানা বিষয় নিয়ে।
আমার জানা মতে ক্যাডেট কলেজ ছাড়া আর কোন কমিউনিটি নেই যেখানে এরকম ঘটনা ঘটা সম্ভব। অচেনা একটা ছেলের সাথে নিজ থেকে পরিচিত হওয়া,গল্প করা,রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমি কখনো দেখিনি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের লোগো বা নাম ওয়ালা পোষাক পরিহিত কাউকে দেখে সেই প্রতিষ্ঠানেরই অন্য কেউ যে তাকে চেনে না এভাবে এগিয়ে গিয়ে কথা বলে,গল্প করে,এতোটা আন্তরিকতা দেখায়। ক্যাডেট টিশার্ট, হুডি পরা দেখলেই এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে ভাই কোন কলেজ? কত তম ইনটেক? কখনো কখনো রাস্তায় চলতে গিয়ে দেখা যায় কোন গাড়ির পিছনে গ্লাসে এক্স ক্যাডেট অন বোর্ড লেখা। সেটা দেখেও আপ্লুত হয়।ক্যাডেটরাই কেবল যত সিনিয়র হোক, বড় পদে হোক ভাই বলে সম্মোধন করে।একজন সদ্য এক্স ক্যাডেটের সাথে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্ণর ফজলে কবিরের সাথে দেখা হয় তখনো তাকে ভাই ডাকে,যে পজিশনেই থাকুক অনায়াসে তাকে ভাই ডাকা যায়। চলতে পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কতজনকেইতো দেখি কোন দিন জানতেও চাই না তুমি কোন ডিপার্টমেন্ট কিংবা আমাকেও কেউ বলেনি ভাই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
বয়স ৮০ পেরিয়ে যাওয়ার পরও এক্স ক্যাডেটদের ক্লাস সেভেনের প্রথম দিনের কথাও মনে পড়ে,নভিসেসের কথাও মনে পড়ে,ফেয়ারওয়েল ডিনারের কি খেয়েছিল,লাইটসআউটের পর কবে কি করেছল,প্রতিটি প্যারেন্টস ডে,ইভিনিংপ্রেপ,ভ্যাকেশান,এক্সকারশান এমনকি প্রতিটি মুহুর্ত তাদের মনে থাকে। অ্যাপুলেটের এক একটি দাগ যেন তাদের কাছে স্বর্ণ দিয়ে মোড়া এক একটি অধ্যায়। একজন বিখ্যাত এক্স ক্যাডেট তাঁর একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন কলেজের সিনিয়র এক ভাইকে যিনি কিনা কলেজে থাকতে সেই ক্যাডেটকে দিয়ে সু পলিশ করিয়েছিলেন। বহু বছর পরও সেসব তারা ভুলে যায়নি। সেই বড় ভাই অনেক দূরের দেশে থাকেন। যখন জানতে পারলেন তাকেই বই উৎসর্গ করা হয়েছে তিনি অবাক হলেন এবং জানতে চাইলেন তোকে দিয়ে সু পলিশ করিয়েছি সেই তুই কী মনে করে আমাকেই বই উৎসর্গ করলি? বিখ্যাত সেই এক্সক্যাডেট মিষ্টি হাসি হেসে বললেন ভাই শুধু কি সু পলিশ করিয়েছেন? কিছুকি শেখান নি?
ক্যাডেট, এক্স ক্যাডেটদের পরিচয় দেওয়ার জন্য নাম লাগে না,কী করছে সেটা জানা লাগে না মাত্র বললেই হয় ভাই/আপা আমি অমুক কলেজের এক্স ক্যাডেট। কখনো কখনো ক্যাডেট নাম্বার আর ইনটেক নাম্বারেই তার পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট হয়।
আরও একটা ঘটনার কথা বলি, ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজেও কেন্দ্র পড়েছে। এক এক্স ক্যাডেট তার ছাত্রকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেছে। কলেজের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি ওখানে দাড়ানোর ব্যবস্থা নেই। পাশেই আর্মি অফিসারদের বাসভবন। তারই একটিতে সে ঢুকে গেলো। তার মনে হলো এখানে নিশ্চই কোন না কোন এক্স ক্যাডেট ভাই অফিসার হিসেবে আছেন যদিও ওখানে আগে কখনো যায়নি এবং কাউকে চেনে না। তিন তলায় উঠে একটা দরজায় নক দিতেই একজন বেরিয়ে আসলেন এবং জানতে চাইলেন কী বিষয়? ছেলেটি বললো ভাই আপনি কি এক্স ক্যাডেট? এর পর আর কিছু বলতে হলো না তাকে ওই অফিসার ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং নিজ হাতে কফি বানিয়ে খাওয়ালেন অনেক গল্প করলেন। এটা হলো এক্স ক্যাডেটীয় গল্প।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অ্যালামনাই এসোসিয়েশানের গেটটুগেদার হচ্ছে নির্ধারিত চাঁদার বিনিময়ে। এক শিক্ষার্থী কোন কারণে চাঁদা দিতে পারেনি কিন্তু ঘটনাক্রমে সেদিন টিএসসিতে উপস্থিত ছিলো। সেই গেটটুগেদারে তার ব্যাচমেটরাও ছিলো। হাই হ্যালো করেই তাকে বিদায় নিতে হলো। কেউ বললোও না তুমি থাকো! না সিনিয়র ভাইয়েরা না তার ব্যাচমেটরা। কিন্তু ক্যাডেট কমিউনিটিতে কখনোই এরকম ঘটে না। অরকা,মেকা,ওকাস,জেক্সকা,একক সহ সব এসোসিয়েশান এখনো প্রতিটি সদস্যকে এবং একে অন্যকে খুব আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করে,ভালোবাসে।
“এ এমন প্রেম একবার যারা পড়েছে এমন প্রেমে
ভুলতে পারেনি যতক্ষণ তার শ্বাস না গিয়েছে থেমে।”
–জাজাফী
১৯/১১/২০