ক্যাডেট জুনায়েদকে প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল সে আসলে চাকমা।কিন্তু আমি কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ভেবেছি পরে সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করবো যে দোস্ত তুইকি চাকমা?কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আরে আমিতো গাধার চেয়েও বড় গাধা।ওর নামতো জুনায়েদ।চাকমারাতো মুসলমান নয়।একমাত্র উপজাতি পাঙন হলো মুসলমান।তাই মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে নিলাম।তবে আমি সরিয়ে নিলে কি হবে বদের হাড্ডি গুলো মানে আমার অন্য বন্ধুরা ঠিকই মনে রেখেছে।
নতুন পরিচয়েতো কাউকে কিছু বলা যায় না। সবে মাত্র পিসিসিতে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছি।আগে সবার সাথে পরিচয় হোক।আমরা যখন ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই তখন কলেজের সিপি ছিলেন আতিক ভাই।আতিক ভাই সম্পর্কেতো দূরে থাকুক আমার যে গাইড ভাই তার সম্পর্কেও কিছু জানিনা। আমাদের প্রথম কাজ হবে সব কিছু মনে রাখা,সবাইকে চেনা।মনে রাখতে হবে কলেজে আমাদের চেয়ে জুনিয়র কেউ নেই এমনকি একটা থালা বাসনও আমাদের চেয়ে জুনিয়র নেই।
কদিন যেতে না যেতেই প্রায় অনেক কিছু আয়ত্বে চলে আসলো।তবে একই ভাবে ক্লাসে বন্ধু আর শত্রুও তৈরি হয়ে গেল।টুগেদার উই স্ট্যান্ড যেমন বলি তেমনি এলোন এন্ড এপার্টও বলি। যে কথাটা আমি জুনায়েদকে বলবো বলবো করে বলা হয়নি সেই কথাটাই একদিন ইভিনিং প্রেপ শেষে বলে ফেললো সজল।কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হলো জুনায়েদের সাথে এবং তখনি মুখ ফসকে বলে ফেললো তুইতো একটা চাকমা।
সজলের মুখে চাকমা শব্দটা শুনে ক্ষেপে গেল জুনায়েদ।সে বললো আমি চাকমা হলে তুইও চাকমা,তোর চৌদ্দগোষ্টি চাকমা,তোর দাদা নানা মামা সবাই চাকমা। এই ক্লাসের সবাই চাকমা,এই কলেজের সবাই চাকমা এমনকি সিপি আতিক ভাইও চাকমা।সজল সম্ভবত এরকম একটা সুযোগই খুজতেছিল।সে কথা না বাড়িয়ে আতিক ভাইয়ের কাছে নালিশ দিল ক্যাডেট জুনায়েদ আপনাকে চাকমা বলেছে।আতিক ভাই ভাল ছিল কিন্তু তা বলে ক্লাস সেভেনের কেউ তাকে চাকমা বলবে তা তো তিনি মেনে নিতে পারেন না।তিনি ডেকে পাঠালেন জুনায়েদকে।সেই সন্ধ্যায় বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে দাড়াতে হলো পুরো ক্লাস সেভেনকে।এক জুনায়েদেরে জন্য এবার সবাইকে শাস্তি পেতে হবে।কিন্তু কেউ জানেনা কথাটা সিপির কানে দিল কে?কে সেই বিশ্বাস ঘাতক। (পরে জানলাম ওটা ছিল সজল)।
আতিক ভাই ডেকেছে মানেই সর্বনাশ।তার ব্যাচের অন্যরাও তখন চলে এসেছে।তারা যখন জানতে পারলো কলেজের সবাইকে জুনায়েদ চাকমা বলেছে তখন তারাও ক্ষেপে গেল।তবে আতিক ভাই খুবই ভাল মানুষ। তিনি শান্ত অথচ গম্ভীর ভাবে জুনায়েদকে প্রশ্ন করলেন তুমি আমাকে চাকমা বলেছ?জুনায়েদ ভয়ে কোন উত্তর দিলনা।তিনি তখন ধমকে উঠলেন।সত্যি বলো নইলো সোজা প্রিন্সিপালের কাছে পাঠিয়ে দেব এবং কালকেই তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
জুনায়েদ ছিল খুবই জেদী এবং মেধাবীও বটে।সে যে কত কিছু জানে তা না দেখলে বোঝা যাবেনা।সে শান্ত ভাবে বললো জ্বি ভাই আমি চাকমা বলেছি।সবাইকে চাকমা বলেছি।আতিক ভাই ভাবতেই পারেনি তার মুখের উপর আবার ও চাকমা বলবে।বাকিরা তখন আরো ক্ষেপে উঠেছে।আতিক ভাই জানতে চাইলেন তুমি কেন সবাইকে চাকমা বললে?আমরাতো কেউ চাকমা নই।এই কলেজেরই কেউ চাকমা নয়।আমরা ভাবলাম জুনায়েদ হয়তো সজলের নাম বলবে যে সেই প্রথম তাকে চাকমা বলেছে তাই রাগের মাথায় সেও বলেছে।কিন্তু জুনায়েদ সব চেপে গেল আর সজলও বেচে গেল শাস্তির হাত থেকে। জুনায়েদ বললো ভাই চাকমা শব্দের অর্থ মানুষ।সুতরাং এই কলেজের সবাই যদি মানুষ না হয় তবে কেউ চাকমা নয় এবং আমাকে শাস্তি দিন।
আমরা কেউ জানতাম না যে সত্যি সত্যিই চাকমা মানে মানুষ।এমনকি আতিক ভাইও জানতেন না।আতিক ভাই তখন মেসবাহকে বললেন বাংলা অভিধানটা নিয়ে আসতে।মেসবাহ ছুটে গিয়ে বাংলা অভিধান নিয়ে আসার পর দেখা গেল সত্যি সত্যিই চাকমা মানে মানুষ।তার মানে কলেজের সবাইকে চাকমা বললেও তেমন কোন ভুল কিছু বলেনি জুনায়েদ।
আতিক ভাই ওকে কোন শাস্তি দিলেন না।বরং বললেন তোমার থেকে গোটা কলেজ নতুন একটা শব্দ শিখলো।আশা করি তুমি কলেজকে অনেক কিছু দিতে পারবে। এর পর থেকে আমরা ওকে চাকমা বলে ডাকলেও সে কিছু মনে করতো না।মানুষকে তো মানুষ বলে ডাকাই যায়। প্রিয়তমাকে যদি জান বলে ডাকা যায় তবে মানুষকে চাকমা বলা যেতেই পারে।
ফেয়ারওয়েলের দিন তাই আতিক ভাই জুনায়েদকে ডেকে বলেছিলেন “তোমার কি মনে হয় আমিকি ঠিকমত চাকমা হতে পেরেছি? বলেই তিনি মুচকি হাসি দিলেন। তার মন থেকেও নিশ্চই জুনায়েদ বা চাকমার আবিস্কারক হারিয়ে যায়নি।
#জাজাফী
১৪ জানুয়ারি ২০১৭