আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে তখন ক্লাস টেনের এক ফলোয়ার যার নাম আব্দুল আলীম সে কবিতা লিখতো এবং বিভিন্ন ছোটখাট পত্রিকায় তা ছাপা হতো। ওর কবিতা ছিলো খুব কঠিন। মানে সম্ভবত ডিকশনারীতে থাকা সবচেয়ে কঠিন শব্দগুলো বেছে বেছে নিয়ে তারপর কবিতা লিখতো। আমি একদিন ডেকে বললাম তুই কী ছাতামাথা লিখিস কিছুই বুঝতে পারি না ওর চেয়েতো আমিই ভালো লিখতে পারি। কথাটা বলেছি ঠিকই কিন্তু জীবনে কোনদিন কবিতা লিখিনি।
সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। বললো ভাই তাহলে লিখে দেখাইয়েনতো। ভাবলাম ঠিক আছে তবে মনে মনে বিপদ আসছে টের পেলাম। এর চেয়ে ভাই ক্রসকান্ট্রি অনেক সোজা,হার্ডল রেস জেতাও সহজ। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেলো তখন চুপিচুপি লিখতে শুরু করলাম। অনেকবার লেখার পর যা দাড়ালো তা কবিতা হলো কিনা জানিনা তবে নিজের কাছে বেশ লাগলো। পরদিন আলীমকে ডেকে পাঠালাম। ও আসার পর ওর হাতে কবিতাটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম দেখ কেমন লিখেছি? সে পড়ে বললো ভাই ভালো লিখেছেন,আপনি পারবেন।
আমি বেশ খুশি হলাম তবে বুঝলাম সিনিয়রের লেখা খারাপ বলার সাহস নেই বলেই সে ভালো বলেছে। সেই থেকে শুরু। মনে হতো কবি হবো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কবিতা সংখ্যা সেঞ্চুরী পুর্ণ হলো। আমি সেগুলোর নাম দিলাম অকবিতা।কিছু ভক্তও তৈরি হলো আমার। তারা আমাকে সামনে পেলেই জোর করে কবিতা লিখে দিতে বলতো। অনেকটা রাজদরবারে থাকা কবিদের মত সেই কবিতা বা অকবিতাগুলোর সবই হতো যার সামনে বসে লিখছি তাকে নিয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে যেতাম আর সেখানেও আমার ক্ষুদে পাঠক তৈরি হতে লাগলো। আমি ভাবলাম বেশ বেশ কবিই হবো। লেখাপড়ায় ঢিল দেওয়া শুরু হলো। ভ্যাকেশান এলেই ছুট। পড়াশোনা খুব কমই হতো লেখার পোকা মাথায় ঘুরে বেড়াতো।
তার পর একদিন কবিতা লেখার ভূত মাথা থেকে সরে গেলো। ভাবলাম ধুর কবিতা লিখে কী হবে তার চেয়ে গল্প লিখি। আমি কি আর জানতাম শব্দের পর শব্দ জোড়া দিলেই গল্প হয় না। শেষে আগের মতই নাম দিলাম অগল্প।আশ্চর্য ব্যাপার হলো গল্পগুলো নামিদামী পত্রিকাতেও ছাপা হতে লাগলো। তবে পত্রিকায় কলাম পড়তে পড়তে মনে হলো ধুর গল্প লিখে কি হবে তার চেয়ে কলাম লিখি। বুদ্ধিজীবী হতে হলে কলাম লিখতে হবে।
শুরু হলো কলাম লেখা। এটাও চললো বেশ বছর তিনেক। পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতে থাকলো। একবার পত্রিকা থেকে বললো জাজাফী তোমার ছবি দিতে হবে কলামের সাথে ছবি ছাপাতে চাই। আমি বললাম থাক আমার কলাম ছাপানোর দরকার নেই তবু ছবি দেবো না! তিনি কি মনে করলেন জানিনা তবে আমি অহংকার প্রকাশ করিনি তা তিনি বুঝেছেন। শেষে ছবি ছাড়াই আবার ছাপাতে শুরু করলেন। কিন্তু বেশিদিন গেলো না আগ্রহে ভাটা পড়লো।
ভাবলাম ছোটদের সাথে এতো মিশি,তারা আমায় বন্ধু মনে করে এমনকি অনেকেই বন্ধু বলেও ডাকে তাই ছোটদেরবন্ধু নামে একটি ওয়েবসাইট করলাম। প্রথমে এটাসেটা যা খুশি দিতাম পরে ভাবলাম ছোটদের নানা বিষয় ওখানে তুলে ধরি। একাকি বেশ কিছুদিন চালানোর পর টিমে সদস্য বাড়লো এখন তারাই কাজ করছে লিখছে সম্পাদনা করছে। এর পর মাথায় ভুত চাপলো ভাবলাম আরো একটা কিছু করা উচিত যেটাতে শুধু ছোটরা নয় বরং বড়রাও থাকবে সেই চিন্তা থেকে Teenagers নামে একটা ওয়েবসাইট করলাম ইংরেজীতে।
এ দুটোই এখন চলছে বেশ। এখন লেখালেখি সব লাঠে উঠেছে। টিমের সবার সাথে দিন রাত ফেসবুক মেসেঞ্জারে এই দুটো সাইট নিয়ে পড়ে আছি। কাজ হচ্ছে খুব কম তবে আড্ডা হচ্ছে বেশ। আর আমার সেই ছোট্ট বন্ধুর পরিধি এখন আরো বেড়েছে। টিভি খুললেই যে বাচ্চাদের দেখতাম এখন তারা আমার সাথে গল্প করে কথা বলে কখনো কখনো আমাকে নানা নামে সম্মোধন করে। বেশ মজায় দিন কাটে। আর ফেসবুকে মাঝে মাঝে এটা ওটা পোষ্ট করি ( যদি দুই চারটা লাইক পড়ে, লাইক কমেন্ট দেখতে বেশ ভালো লাগে!!) এটাও কতদিন চলবে তা জানিনা। হয়তো নতুন কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। যেমন কবি হতে চাইতাম,লেখক হতে চাইতাম,ব্যবসায়ী হতে চাইতাম,কলামিস্ট হতে চাইতাম সব এক এক করে সরে যাচ্ছে।
আমার কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই,বোধকরি কখনোই ছিলো না। আমার বন্ধুরা,পরিচিতজনেরা সবাই কোন না কোন পরিকল্পনা করে বেড়ে উঠেছে এবং জীবনযাপন করছে। এই করোনার দুর্যোগের দিনে তাদের পরিবার আছে,প্রিয়জন আছে কিন্তু তাদের নাকি কিচ্ছু ভালো লাগছে না মানে বন্দী কারাগার মনে হচ্ছে। আমার তা মনে হচ্ছে না। আমি আগেও এভাবেই ঘরে কম্পিউটারের সামনে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতাম এখনো দেই। পরিবর্তনের ভিতর এই যে মাঝে মাঝে শুক্রবারে ধানমন্ডিতে গিয়ে কিছু রেস্টুরেন্টে খেতাম এখন তা যাওয়া হয় না।
যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মত শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি সব সময় তৈরি আছে। আমি যেখানেই থাকি যে পরিস্থিতিতেই থাকিনা কেন নিজের মত করে তা সাজিয়ে উপভোগ্য করে তুলি। বিশ্ববিদ্যালয় হল মসজিদে মাথার নিচে ডায়েরি দিয়ে রাতের পর রাত ঘুমানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে,নদী সাতরে পার হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে,একাধারে ২৫ কিলোমিটার হাটার অভিজ্ঞতা আমার আছে,২৪ ঘন্টায় একবার খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
আমি জানি কোন কিছুতেই আমি পারফেক্ট নই তবুও আমি কম বেশি সব শিখেছি।আমি ছবি আঁকতে পারি,গল্প কবিতা লিখতে পারি,গান লিখতে পারি,সাইকেল চালাতে পারি,ভ্যান রিকশা চালাতে পারি,একতলা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে অসংখ্য বার লাফিয়ে নামার অভিজ্ঞতা আছে(এখন হয়তো পারবো না)মুভি দেখতে খুব ভালো লাগে,বিজ্ঞাপন দেখতে ভালো লাগে,বই পড়তে ভালো লাগে,গান শুনতে ভালো লাগে,কুরআন তিলাওয়াত শুনতে ভালো লাগে। রান্না করতে পারি,সংসারের সব কাজ পারি,বাদরামিও করতে পারি।আমার কখনো বোরিং লাগে না। জীবনটাকে আমি একটি বেডরুমের মত করে ফেলেছি যার ইন্টেরিয়র ডিজাইন আমি নিজের মনের মত করেছি যেন ভালো না লাগার কিছু না থাকে।
ভালো ঘর,ভালো কাপড়,ভালো খাবার এসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।যখন যেখানে যেটুকু পাই তাতেই আমি মানিয়ে নেই,খুশি থাকি। বাকি জীবন এভাবেই কাটবে হাসি আনন্দে।
— জাজাফী
১৮ এপ্রিল ২০২০