কেউ কেউ কথা রাখে

0
680
ঈদের পর দুটো বই পড়েছি। দুটোই একই লেখকের লেখা। তৃতীয় আরেকটি বই পড়তে শুরু করেছি মাত্র । সেই বইটির নাম “বিএনপির সময় অসময়” লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। ঈদের পরের সপ্তাহে যে দুটি বই পড়েছি তার মধ্যে প্রথম বইটা অবশ্য পড়তে শুরু করেছিলাম ঈদের ঠিক আগে আগে। তবে তখন পুরোটা পড়ে শেষ করতে পারিনি। পড়ার ক্ষেত্রে আমি খুবই ধীরগতি সম্পন্ন।প্রতিটি শব্দ মনে মনে হলেও উচ্চারণ না করে আমি পড়তে পারি না। ফলে একটি বই শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। আবার অনেক সময় একই সময়ে একাধিক বইও পড়তে শুরু করি। একটা বিশ পৃষ্ঠা পড়লাম তো আরেকটার দশ পৃষ্ঠা পড়লাম এমনও হয়। কারো কারো হয়তো মনে আছে আমি ঈদের আগে একদিন স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম “এই মুহূর্তে আমি যে বইটি পড়ছি তার নাম কেউ বলতে পারলে তাকে সেই বইটি উপহার দেবো। এমনকি যতজন বলতে পারবে সবাইকে উপহার দেবো”। আমি সত্যি সত্যিই উপহার দিতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমি খুবই খুশি হয়েছি যে আমার সেই পোস্টে অনেক অনেক বন্ধু মন্তব্য করে বইয়ের নাম বলেছে। তবে কেউ সঠিক নামটি অনুমান করতে পারেনি। আসলে অনুমান করা সম্ভবও না। এটি কাকতালীয় ভাবে হয়তো মিলে যেতে পারে। লক্ষ কোটি বইয়ের মধ্যে আমি কোনটা পড়ছি সেটা কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন বই সম্পর্কে কোনো রকম হিন্টস দেওয়া হয়নি। মজার বিষয় হলো সঠিক নামটি উদ্ধার করতে কেউ কেউ আমার ইনবক্সে প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছে। সেগুলোর মাধ্যমে উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছে। যেমন এক বন্ধু জানতে চাইলেন আমার প্রিয় লেখক কে, প্রিয় বই কী? এরকম নানা বিষয়ে। তো আমি যে বইটি পড়ছিলাম সেটির সাথে আমার প্রিয় লেখকের কোনো সম্পর্ক নেই। পরে বাধ্যহয়ে দু একটা হিন্টস দিয়েছিলাম। যেমন বইটির লেখক জীবিত এবং আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকায় থাকা মানুষ।

সেই স্ট্যাটাসের নিচে মন্তব্যের ঘরে যারা মন্তব্য করেছিলেন তাদের বলা অধিকাংশ বই আমি অনেক আগেই পড়েছি আর দু একটা বই এখনো পড়া হয়নি। তবে কয়েকজন বন্ধু খুব কাছাকাছি উত্তর দিয়েছিলেন। মানে আমি যে লেখকের বই পড়ছিলাম সেই লেখকেরই একই ঘরানার বইয়ের নাম বলেছিলেন। আরেকটু হলেই মিলে যেতে পারতো। আজ ভাবলাম সে বিষয়ে সবাইকে জানিয়ে দিই। আমি যখন ওই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম তখন পড়ছিলাম ‍দুই বাংলার জনপ্রিয়তম থ্রিলার লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা “ কেউ কেউ কথা রাখে” বইটি। তাঁর লেখা অন্য যে বইটি দুদিন আগেই পড়েছি সেটির নাম “জাল”। প্রথমে জাল বইটি পড়ে শেষ করেছি তারপর ”কেউ কেউ কথা রাখে” বইটি ধরেছি। আর তখনই ওই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম।

জাল নামক বইটিতে লেখক একজন তরুণ জনপ্রিয় ব্যারিস্টার আর একজন অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দাকে উপজীব্য করে দারুন এক গল্প ফেঁদেছেন। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের শব্দচয়ন,সহজবোধ্য ভাষার ব্যবহার আর গল্পের ধারাবাহিকতা সমানভাবে রক্ষার যে দক্ষতা তিনি তাঁর বইগুলোতে দেখিয়েছেন সেটাই পাঠককে তাঁর গল্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। জাল নামক রহস্য উপন্যাসটিতে আমি দেখতে পেলাম তরুণ ব্যরিস্টার তাঁর এক ক্লায়েন্টের সাথে একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করতে যান।তারপর একটা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রিয় ব্যরিস্টার নিজেই হয়ে ওঠেন আসামী বা সন্দেহভাজন। আবার যে খুন হয় তিনি তাঁর পরিচিতজন এবং খুন হয় ব্যরিস্টারের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে। কিন্তু ব্যরিস্টার জানান তিনি খুন করেননি বরং খুন করেছে অন্য একজন। এ নিয়ে রহস্য দানাবাঁধতে থাকে। চমৎকার ভাবে গল্প এগোতে থাকে। ডিবির অবসরপ্রাপ্ত এক তুখোড় গোয়েন্দা এই ইনভেস্টিগেশনে তাকে সহায়তা করে। জাল গল্পটিতে সবচেয়ে বেমানান লেগেছে ওই গোয়েন্দাকে। তাকে যেভাবে দেখানো হয়েছে তাতে তাঁর বয়স অন্তত ৬৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে হলে ভালো হতো বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁর কথা,আচরণ,হাবভাব কোনো ভাবেই তাঁর বয়সের সাথে মানানসই মনে হয়নি। সবচেয়ে মজার ছিল এই তুখোড় গোয়েন্দার মোবাইল চুরি যাওয়ার রহস্য উন্মোচন করতে না পারার বিষয়টি। লেখক ওই অংশটিকে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্প শেষ করার আগেই অবশ্য সেই রহস্যের সমাধানও করে দিয়েছেন। পাঠক হিসেবে সমাধানটি আমার পছন্দ হয়েছে। তবে অন্য অনেক লেখক আছেন যারা ওরকম পরিস্থিতিতে ওটুকুর সমাধান না করে বরং দ্বিতীয় কিস্তি লেখার জন্য রেখে দিতেন এবং গোয়েন্দা চরিত্রটিকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন গল্প লিখতেন। জাল নামক থ্রিলার বইটি আমাকে মুগ্ধ করেছে।

লেখকের অন্য যে বইটি পড়লাম সেটির নাম “ কেউ কেউ কথা রাখে”। এই বইটি নিয়েই আমি সেই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। বইয়ের নাম শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে সুনীলের বিখ্যাত কবিতা “ কেউ কথা রাখেনি”। এই বইটি পড়ার শুরুতে চোখে পড়বে ভূমিকা। ভূমিকা পড়লেই পাঠকের মনের মধ্যে দারুণ আগ্রহ জন্মাবে বইটি পড়ার জন্য। জাল বইটির তুলনায় এই বইটি অনেক বেশি ভালো লেগেছে কারণ বইটিতে নানা ভাবে এদেশের রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ের নানা বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে। খুনের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে দুজন পুলিশ অফিসার যারা কর্মসূত্রে সিনিয়র জুনিয়র হলেও তাদের মধ্যে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ছিল ভিন্নরকম। তাদের আলাপচারিতার মাধ্যমে বাকশাল,বঙ্গবন্ধু সহ সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি,অস্থিরতা সব ফুটে উঠেছে। “কেউ কেউ কথা রাখে” বইটির ভূমিকা পড়ে আমার মনে হয়েছে সত্য কোনো ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা একটি চমৎকার গল্প। পুরো গল্প পড়তে গিয়েও সেটা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে লেখকের জীবনে ,লেখকের চোখের সামনে ঘটা কোনো দৃশ্যকে পুজি করে গল্প লিখেছেন তিনি। তবে সে ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে গেছে পুরোনো সময়ে। নিজের সময়ের চেয়ে অনেক আগের সময়কে ব্যাকগ্রাউন্ড করে গল্প ফেঁদেছেন।

বইটিতে  দেখা যায় এক ব্যাংকারের বিয়ের কয়েক মাসের ব্যবধানে তার স্ত্রী নিজ বাসায় খুন হয়। তিনি অফিস থেকে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। রহস্য দানা বাঁধে। যার স্ত্রী খুন হয়েছে তিনি নিজেই সাসপেক্ট হিসেবে পুলিশের চোখে চোখে থাকেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তার সহযোগী রহস্য সমাধানকল্পে ইনভেস্টিগেশন জারি রাখেন। যে মেয়েটি খুন হয় তার গ্রুপ ছবি দেখতে গিয়ে একাধিক ছবিতে সন্দেহজনক একজনকে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে বখাটে আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পালিত একজন মানুষ। তদন্ত কাজে পুলিশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটির এক বান্ধবী যার সাথে আবার তদন্তসুত্রে বন্ধুত্ব তৈরি হয় পুলিশ অফিসারের সহযোগির। যার মুখ দিয়ে লেখক গল্পটি বলেছেন। এই উপন্যাস যে পুলিশ অফিসারের মুখ দিয়ে বলা হয়েছে গল্পেও তিনি একজন লেখক। আর এ কারণে গল্পটি আরও আকৃষ্ট করেছে আমাকে। উপন্যাসে সেই সময়ের যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা আসলে আজও বদলায়নি। আজও যারা ক্ষমতাবান তারা তাদের ক্ষমতাবলে দুর্বলদের পিষে মারছে। উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই নানা প্রমান সহ সৎ পুলিশ অফিসার আসামীকে গ্রেফতার করলেও সে জামিন পেয়ে যায় এবং আরও বেপরোয়া আচরণ করতে থাকে।হুমকি দিতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা খুন হয়ে যায়।

রহস্য রোমাঞ্চকর বর্ননার পাশাপাশি লেখক গল্পের পরতে পরতে প্রেম,বিরহ,মান অভিমান পর্ব দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে যাকে পুলিশ প্রাইম সাসপেক্ট হিসেবে গ্রেফতার করেছে সেই রাজনৈতিক ক্ষমতার ছাঁয়ায় থাকা ছেলেটি হয়তো নির্দোষ। উল্টো খুন হওয়া মেয়েটির স্বামীই খুনী। কিন্তু যখন সেই মানুষটিকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কবরস্থানে গিয়ে স্ত্রীর কবরের পাশে বসে কাঁদতে দেখা যায় তখন আর সেই সন্দেহ চলে না। গল্প নানা দিয়ে নানা সময়ে নানা ভাবে বাঁক নিয়েছে।রহস্যের সামাধান হয়েগেছে মনে হলেও আবার তা ভিন্ন ভাবে মোড় নিয়েছে। এভাবে একের পর এক বাঁক তৈরি করে লেখক তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। এই ঘটনার বহু বছর পর লেখক যখন অবসরে তখন তিনি পুরো ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। যেহেতু খুনের মামলায় আসামীর কোনো সাজা হয়নি ফলে খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটির কথা কেউ আর মনেও রাখবে না। নানা বিষয় ভেবেচিন্তে লেখক একটি বই লিখতে চেয়েছেন। এমনকি আবার নতুন করে কেসটি রিওপেন করা যায় কি না তা নিয়ে কথাও বলেছেন। লেখকের মনের মধ্যে পুরোনো দিনের প্রেম জমে উঠেছে। উকি দিয়েছে। কিন্তু সর্বপরি তিনি তার লেখাটাকে শেষ করতে চেয়েছেন। আর সেই সময়ে দেখা গেছে খুনের আসামী হিসেবে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল,যাকে আদালত জামিন দিয়ে দিয়েছে সেই লোকটির কোনো খবর কেউ জানে না। তাকে খুঁজে বের করতে পারলে অনেক কিছু জানা যেতো। অন্যদিকে খুন হওয়া মেয়েটির ব্যাংকার স্বামীর খোঁজও তেমন কেউ জানে না। রহস্য ক্রমাগত  ঘণীভূত হতে থাকে। কিন্তু গল্পের মাঝে আরেক গল্প থাকায় সেই গল্পের নায়ক তথা লেখক দমবার পাত্র নয়। নানা ভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ব্যাংকার ভদ্রলোক দূরবর্তী এক অঞ্চলে থাকে। সেখানকার এক ব্র্যাঞ্চে কাজ করছে।

যে মানুষটি স্ত্রীর শোকে কাতর। রোজ তার কবরের পাশে গিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন সেই মানুষটি প্রিয় স্ত্রীর কথা ভুলে গিয়ে তবেকি নতুন সংসার পেতেছেন এবং অতীত ভুলে থাকতে দূরে গিয়ে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন। লেখকের মনে আগ্রহ তৈরি হয়। আর সেই আগ্রহ থেকে তিনি যখন লোকটির কাছে পৌছান তখন দেখতে পান নির্জন এক গ্রামে নির্জন এক বাড়িতে তার বসবাস। আসেপাশে ঝোপ জঙ্গল। এবং পুরো বাড়িতে তিনি একা। দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। তার কাছে খুনির বিষয়ে জানতে চাইলে সে জানায় তাকে আর খুঁজে লাভ নেই। তাকে আর পাওয়া যাবে না। তিনি নিজেও আর ওসব নিয়ে ভাবতে চান না। এমনকি তিনি চান না তার মৃত স্ত্রীর জীবনের গল্প বই আকারে প্রকাশ হোক। কিন্তু লেখক নাছোড়বান্দা। তিনি চেয়েছেন বইটি প্রকাশ করতে। প্রয়োজন হলে নাম চরিত্র বদলে হলেও প্রকাশ করবেন।

এভাবেই গল্প এগোতে থাকে এবং এক সময় লেখক বুঝতে পারেন কেন খুন হওয়া মেয়েটির স্বামী চান না বইটি প্রকাশ হোক। আর কেনইবা খুনীকে আর খুঁজে লাভ হবে না। শেষ অংশটি পুরো গল্পকে আরও রোমাঞ্চকর করে  তুলেছে। বইটি পাঠকমাত্রই আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে বলে মনে হয়েছে। আমার মত যারা খুব অল্পতেই খুশি হয়,মুগ্ধহওয়ার অশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে তাদের কাছে “ কেউ কেউ কথা রাখে” বইটি সুপাঠ্য হবে বলে আমি মনে করি। আর বইটি পড়লেই জানতে পারবেন কেন বইটির নাম “ কেউ কেউ কথা রাখে” রাখা হয়েছে।

১১ জুলাই ২০২৩