বয়ে চলা নদীর মত জীবনটাও নানা অলিগলি পেরিয়ে কবে কোথায় কোন মোহনায় গিয়ে মেশে তা কেউ জানে না।তাইতো কথায় বলে নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। যদিও এটি কথার কথা কিন্তু কথাটি পুরোপুরি সত্য। একটি মাটির পাতিল যত্ন করে রেখে দিলে তা যুগের পর যুগ সেভাবেই থেকে যাবে। কিন্তু রক্ত মাংসের শরীরে গড়া মানুষকে যতই যত্ন করে রাখি না কেন,যতই ভালোবেসে আগলে রাখি না কেন তার মধ্যে রয়েছে প্রাণ পাখি। কখন সে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেবে কেউ আমরা জানি না।প্রতিনিয়ত চোখের সামনে যাদের দেখি তারাই একদিন হুট করে চিরকালের মত হারিয়ে যায়। আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি না আজ যার সাথে গল্প করেছি কাল হয়তো সে থাকবে না নয়তো আমি থাকবো না, নয়তো আমরা কেউ থাকবো না।
এবারের ঈদ ছিল আমার জন্য আনন্দ বেদনার। বেদনা বলতে যা বুঝায় যদিও এটা সেরকম কিছু না। এবারের ঈদে বাড়িতে গিয়ে কয়েকজন স্বজনকে দেখতে পাইনি। তারা পৃথিবীর আলোবাতাসে আর নিঃশ্বাস নেয় না। তাদের শরীরের ঘ্রাণ এখন আর পাওয়া যায় না। যে জমিন থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল আজ তারা সেই জমিনের নিচে শুয়ে আছে। মিশে গেছে তাদের শরীরের মাংস হাড় অস্তিমজ্জা সব। এই তালিকায় ছিলেন আমার মেজ চাচি,দুই চাচা আর এক বন্ধু এবং এক বন্ধুর বাবা। তাদের সাথে ছিল আমার আত্মার সম্পর্ক। আমার দুই চাচার মধ্যে একজনের কথা রাস্তায় যেতে যেতে মনে পড়লো। তার বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বেশ কিছু দইয়ের পাতিল পড়ে আছে। আমার সাথে তার শেষ স্মৃতি দই নিয়ে। ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। ডাক্তার বলেছিলেন সময় ফুরিয়ে গেছে। শেষ বার যখন ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন জানতে চেয়েছিলাম তিনি কী খেতে পছন্দ করেন। চাচা বলেছিলেন তিনি তেমন কিছুই খেতে পারেন না। শুধু দুই আর চিড়া খেতে পারেন। আমি তার জন্য শহর থেকে দই কিনে এনে দিয়েছিলাম। তিনি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলেন।
তারপর আবার আমি ফিরে আসি সমুদ্র সৈকতের শহরে। একদিন খবর পাই সেই চাচা আর নেই। ইচ্ছে থাকলেও তাই তার শেষ যাত্রায় শরীক হতে পারিনি। আমার যে চাচি মারা গিয়েছেন এইতো কিছুদিন আগে। তার মৃত্যুর সময়ও যেতে পারিনি। আমি এই চাচির মৃত্যু নিয়ে খুব ভয় পেতাম। কারণ অনেক আগে থেকেই তিনি চাইতেন তিনি মারা গেলে আমি যেন তার জানাজা নামাজের ইমাম হই! আমি নিজেকে অতটা যোগ্য মনে করতাম না কখনোই। তাই প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করতাম চাচি যেন অনেক অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকেন। আমি যদি আরও মুত্তাকি হতে পারি এবং তখন যদি চাচি ইন্তেকাল করেন তবে হয়তো আমি তার জানাজায় ইমামতি করতে পারবো। আল্লাহ তার জন্য যে সময় নির্ধারণ করেছিলেন তিনি সেই সময়েই তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। তার ছোট সন্তান আরও কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছিলেন। এখন নিশ্চই আল্লাহ চাইলে মা ছেলের সাক্ষাত ঘটেছে। আমি চাচির জানাজাতে উপস্থিত হতে পারিনি।দূরত্ব আমাকে আরও বেশি অপারগ করে দিয়েছে।
আমার যে বন্ধু আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। গ্রামের বাড়িতে দুই তলা বিল্ডিং করেছে। একটি প্রিমিও গাড়ি কিনেছে। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই হাসিখুশি মানুষটিও কয়েক মাস আগে বিদায় নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে তার হার্টের অপারেশন করা হয়েছিল।এবার ঈদে গিয়ে তাকেও মিস করেছি। মিস করেছি আমার বন্ধু আওরঙ্গজেবের বাবাকে। যিনি ফরিদপুর মেডিকেলের ডক্টর ছিলেন। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ ছিলেন। আমার বাবার অসুস্থতার সময়ে তিনি অনেক সহযোগিতা করেছেন। সবকিছু ছেড়ে তিনি বাবার পাশে থেকেছেন। তার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিল সেই স্মৃতিও আর মনে নেই।
এবারের ঈদ ছিল আমার জন্য আনন্দ বেদনার এক মহাকাব্য। শুরুটা হয়েছিল অবশ্য আনন্দের সাথে এবং শেষটাও মোটামুটি আনন্দের সাথেই হয়েছে। আমি সব সময় ভালো কাজের সাথে যুক্ত থাকতে চেষ্টা করি। সব সময় পারি না। এবার কিছু মহৎপ্রাণ মানুষের সংস্পর্শে এসে ভালোকাজের পরিমান বেড়েছে। এবারের ঈদ তাই আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা ঈদও বলা যেতে পারে। ঈদের আগে পবিত্র রমজান মাসে অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ কিংবা ৭০ জনেরও অধিক শিশু কিশোর কিশোরীর হাতে ঈদের জামা তুলে দেওয়া আর ৪২টি পরিবারকে ঈদের বাজার করে দেওয়ার যে সুযোগ আমি পেয়েছিলাম তা আমার ঈদকে সত্যিকারের আনন্দে রুপ দিয়েছে।
এই ঈদে আমি তিনজনের কাছ থেকে মোট ১১ হাজার টাকা ঈদ সালামী পেয়েছিলাম। সেটাও আমার আনন্দকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার একই সাথে আমি আমার ভাই বোন বন্ধুদেরকে ঈদ সালামী দিতে পেরেছি সেটাও কম আনন্দের নয়।এর বাইরে ১১ জনের হাতে যাকাতের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দিতে পেরেও ভালো লাগছে।আমার হারানো মোবাইলটা ফেরত পাওয়ার জন্য থানায় জিডি করেছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফোনটা ফিরে পেলে এক বন্ধুকে উপহার দেবো। আমি কথা রেখেছি। ফোন ফিরে পেয়ে সেই বন্ধুকে উপহার দিয়েছি। সে খুবই খুশি হয়েছে।
ঈদ যাত্রার শুরুতেই ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল। এবার ১১ দিনের ছুটি ছিল আমার। অনেক কিছু করবো বলে ভেবেছিলাম। তবে প্রচন্ড গরমের কারণে তেমন কিছুই করতে পারিনি। গ্রামের বাড়িতে একটা কম্পিউটার থাকার পরও সাথে করে ল্যাপটপটা নিয়ে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল ১০/১২ বছর আগে যে লেখাগুলো ২৫/৩০ হাজার শব্দ লিখে ফেলে রেখেছিলাম তার দু একটা নিয়ে বসবো। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়নি। যদিও আমি সব সময় গুগল ডকে লিখি। ফলে ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে যে কোনো কম্পিউটার থেকেই লেখা সম্ভব হয়। কষ্ট করে ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়াই বৃথা হয়েছে।
যখন কক্সবাজার থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিল তখন আমার জন্য সুবিধা ছিল। এখন আবার তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কানেক্টিং ফ্লাইট ধরলে সময়ও লাগে অনেক আবার টাকাও খরচ হয় দ্বিগুন। তাই সময় বেশি লাগার পাশাপাশি টাকাও বেশি খরচ হবে ভেবে বাসেই যাত্রা করি। কিন্তু এবার ডাইরেক্ট বাসও পাইনি। প্রথমে ঢাকা পযর্ন্ত গিয়ে পরে আবার বাস বদল করেছি। আমি সাধারণত কক্সবাজার থেকে ঢাকা পযর্ন্ত এনা পরিবহনের বাসে যাওয়া আসা করি। এবারও বাসা থেকে একটা অটোতে করে এনা পরিবহনের ঝাউতলা কাউন্টারে গিয়ে বসি। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করার পর নির্ধারিত সময় বাস আসলে উঠে বসি। বাস ছড়ে দেয়। কলাতলিতে গিয়ে আবার অপেক্ষা। সেই সময়ে আইসক্রিম খাবো বলে নিচে নামি। আইসক্রিম না পেয়ে কোক কিনি। বাসে ফিরতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি ট্রাউজারের পকেটে মোবাইলটা নেই!
আমার মনে হলো হয়তো বাসের সিটে পড়েছে। কিন্তু গিয়ে পেলাম না। ফোন করলে এক লোক রিসিভ করলো। সে তখন কালুরদোকান! আমার ওই মোবাইলের চেয়ে সিমটা সাথে থাকা জরুরী। কিন্তু ভাগ্যের লিখন খন্ডানোর উপায় নেই। ভেবেছিলাম ঢাকায় পৌছেই সিম তুলে নেবো কিন্তু সেই সুযোগ পাইনি। পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ বাড়িতে পৌছালাম। মাগরিবের নামাজ পড়ে তারপর সিম তুলে নিলাম।
ঈদে কোথাও ঘুরতে যাইনি। আমাদের বাড়ি একদম গ্রামে। খুব একটা উন্নতির ছোঁয়া পায়নি এমন গ্রাম।একদিন শহরে গেলাম। গিয়ে মনে হলো পুরো শহর মৃত। দোকানপাট বন্ধ। লোকজন নেই। মনে হয় সবাই এ শহর ছেড়ে কোথাও পালিয়ে গেছে। শহরে গিয়ে যাদের সাথে আমি ঘুরতাম তারাও কেউ নেই। তারা কে কোথায় কী নিয়ে ব্যস্ত আছে জানি না।এবার ঈদে আমাদের বাড়িতে প্রচুর গ্যাঞ্জাম হয়েছে। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারিলেগেছে। অশান্তি ছিল চরমে। আমি মাঝখানে পড়ে গিয়ে আমার অবস্থাও কাহিল। ভিলেজ পলিটিক্স দেখে আমি প্রচন্ড বিরক্ত। দুইদিনের জীবনে মানুষের এতো লোভ এতো ক্ষোভ এতো চাহিদা কেন আমি জানি না। এতো রেশারেশি।
এগারদিনের ছুটির মধ্যে ১৯ তারিখ সারাদিন বাড়িতে যাওয়ার জন্য পথে পথে কেটেছে! তারপর ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ২৭ তারিখ পুরোটা দিন গেছে! তারপর কক্সবাজার ফেরার জন্য ২৮ তারিখটা গেছে। ছুটির তিন চারদিন এভাবেই পথে পথে কাটে।
আমার এবার নাটোর যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বিভাদের বাসায়। ভেবেছিলাম ওদের বাসায় যাবো। আমাকে দাওয়াত করেছিল। আগে কখনো যাইনি। কিন্তু প্রচন্ড গরমের কারণে আর বাড়িতে গ্যাঞ্জামের কারণে মনটাই বিষিয়ে উঠেছিল। ফলে কোথাও আর যাওয়া হয়নি। বিভাদের বাড়িতেও না।
দীর্ঘ ভ্রমণ আমাকে কখনো ক্লান্ত করে না। এবারও ক্লান্ত করেনি। কিন্তু ঢাকায় ফেরার পর বন্ধুর সাথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে পেটের বারটা বেজেছে।প্রচন্ড বমি আর ডিসেন্ট্রি! যদিও শরীর ক্লান্ত ছিল না। কিন্তু খুব বিরক্ত হয়েছি। ঈদের আগে রোহানকে বলেছিলাম ঢাকায় ফিরলে তোমার সাথে দেখা করবো বা তোমাদের বাসায় আসবো। একদিন তোমার সাথে থাকবো। কিন্তু শরীরটা খারাপ হয়ে সব বিগড়ে গেছে। পরে ধানমিন্ডতে আমার বন্ধু শাহীনের বাসায় উঠেছিলাম। রাতে ফেসবুকে ঢুকে দেখি রোহানের নানা মারা গেছেন! ওইদিন আমার ওর সাথেই থাকার কথা ছিল। বিকেলে টিকেট কাটতে কলাবাগান গেলাম। যাওয়ার পথে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম আমি ধানমন্ডিতে আছি। এটা চোখে পড়ায় উত্তরা থেকে এক ভাই ফোন দিয়ে বললেন তিনি আসতে চান দেখা করতে। আমি বললাম সময়তো কম। তিনি জানালেন বাইকে আসবেন। বেশি সময় লাগবে না।
সীমান্ত স্কয়ারে তার সাথে দেখা করলাম। এতো কষ্ট করে এতো দূর থেকে এসেছেন। এক ঘন্টা মত আড্ডা দিয়ে বন্ধুর বাসায় ফিরে গেলাম। এশার নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে রিকশা নিয়ে বাস কাউন্টারে গেলাম। শরীর ভালো থাকলে আজ সারাদিন ঢাকায় থাকতে পারতাম। তবে সেটা আর হয়নি।
এবার ঈদে বাড়িতে গিয়ে শুধুমাত্র একটি বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়া ছাড়া কোনো মুভি দেখিনি,নাটক দেখিনি, কোথাও ঘুরতে যাইনি। সারাদিন ঘরের মধ্যেই শুয়ে বসে কাটিয়েছি। এবার ঈদে কেউ আমাকে মোবাইলে ঈদ মুবারক লিখে মেসেজ দেয়নি। আমিও দেইনি। আমি দেইনি বলেইকি কেউ দেয়নি কি না জানি না। তবে ফেসবুকে কয়েকজনের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে। যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় তা খুবই সীমিত।
সবচেয়ে খারাপ লেগেছে গত ১৬ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে কন্টিনেন্টাল কুরিয়ারে আরুশী আর ইররামের জন্য ছোট্ট একটি ঈদ উপহার পাঠিয়েছিলাম।আজও তা ওদের কাছে পৌছেনি। ওরা থাকে ঢাকার লালবাগে! ভাবছি আজ একবার আরুশীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে চেষ্টা করবো ওরা পেলো কি না। না পেলে ভোক্তা অধিকারে কুরিয়ারের নামে মামলা করবো। এই মামলা কি আমলযোগ্য হবে কি না আমার জানা নেই।