ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল ঈদুল আযহা।আমাদের কাছে যেটি কুরবানীর ঈদ বলে বেশি পরিচিত।কোন কোন এলাকায় এটিকে বকরি ঈদও বলা হয়ে থাকে।মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আঃ এর উপর পরীক্ষা স্বরুপ আল্লাহ কোরবানির বিধান আরোপ করেছিলেন যা পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি অত্যন্ত ফজিলতপুর্ন ইবাদত হিসেবে গন্য হয়েছে।কুরবানী আমাদের শিক্ষা দেয় ত্যাগের,নিরহংকারী হওয়ার,অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের এবং সবর্পরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিজেকে সপে দেওয়ার।কুরবানীর মাধ্যমে সমাজে বৈষম্যের অবসান ঘটে এবং সবার মাঝে খুশির ঐকতান বেজে ওঠে।যারা আর্থিক ভাবে সচ্ছল তারা সারা বছরই ভালো খাবার খেতে পারে,ভালো পোশাক পরতে পারে।কুরবানির সময় সমাজের আপামর জনসাধারণ সবাই ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়,ধনী গরীবের মধ্যে একটি ভালোবাসার সেতু তৈরি হয়।এটিই মুলত কুরবানির সব থেকে বড় শিক্ষা।ধনীর কুরবানির গোশতের একটি অংশ গরীবের জন্য বরাদ্দ থাকে ফলে কুরবানির অছিলায় গরীবের ঘরেও আনন্দের বান ডাকে।ধনীরা এই দিন আসেপাশের গরীব মিসকিনদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে ভালো খাবার খেতে দেয়,কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থও বিতরণ করা হয়।
মুসলিম বিশ্বে ঈদের দিনের মত আনন্দের আর কোন মুহুর্ত নেই।বছরে দুটো ঈদের মধ্যে কুরবানির ঈদ অন্যতম।নানা কারণে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহন করে।এমনকি রমজানের ঈদের চেয়েও তাই কুরবানির ঈদকে সবাই বড় ঈদ বলে মনে করে।বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর কাছেও এই দিনটি অত্যন্ত প্রিয়। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।আব্দুল্লাহ ইবনে কুত রা. থেকে বর্ণিত যে, প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ্র নিকট দিন সমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন । কুরআনে সুরা হাজ্জ এ আল্লাহ বলেছেন “কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া ।এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছে; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে ।
কুরবানির মাধ্যমে আমরা অনেক বিষয় শিখতে পারি।আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তার মধ্যে অন্যতম।এই দিনের রয়েছে গুরুত্বপুর্ন ইতিহাস।মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আঃ স্বপ্নে দেখেন আল্লাহ তাকে তাঁর সব থেকে প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে বলেছেন।তিনি প্রথমে দুম্বা তার পর উঠ কুরবানি করার পরও যখন একই স্বপ্ন আবার দেখলেন তখন তিনি ভেবে দেখলেন তাঁর সব থেকে প্রিয় নিজ পুত্র ইসমাইল।তিনি তখন পুত্রকে কুরবানি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।আল্লাহ সেদিন নিজ কুদরতে ইসমাইলের পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।সেই থেকেই কুরবানী ইব্রাহীমি সুন্নত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।কুরবানি সবার উপর ওয়াজিব নয় বরং বিশেষ কিছু শর্ত মিলে গেলে কুরবানী ওয়াজিব হয়।
কুরবানির দিনের রীতিনীতিঃ
- কুরবানির পশু নিজে জবাই করা উচিত। জবাই করা সম্ভব না হলে অন্তত সামনে উপস্থিত থাকা উচিত।এমনকি রাসূল সাঃ হযরত ফাতেমা রাঃ কে বলেছিলেন কুরবানির সময় উপস্থিত থাকতে।
- কুরবানির সময় উপস্থিত যাদের হাতেই ছুরি থাকবে তাদের বিসমিল্লাহ বলতে হবে।সেই সাথে ছুরিটি হতে হবে ধারালো।
- কুরবানির গোস্ত নিজেরা খাওয়া যাবে,বিতরণ করা যাবে এবং ভবিষ্যতের জন্য জমা করা যাবে।তবে কুরবানি যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম তাই গরীবদের মধ্যে গোস্ত বিতরণ করা অতি উত্তম।
- কুরবানি দাতা নিজে জবাই না করে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করলে তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত।কুরবানির গোস্ত ওইদিনই খাওয়া শুরু করা সুন্নত।
- জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা গেলে শরীরের কোন চুল,নখ না কাটা উত্তম এবং কুরবানি করার পর কাটা সুন্নাত।
- যদি কারো কুরবানি করার সামর্থ না থাকে তবে সে জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা গেলে শরীরের চুল,নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে এবং কুরবানিরদিন এগুলো কেটে পরিস্কার করবে এটাই তার জন্য কুরবানি হিসেবে গণ্য হবে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
- ৯ জিলহজ্জ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ই জিলহজ্জ আসর পযর্ন্ত সকল প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের উপর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব।
- কুরবানির গোস্ত তিনভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখা এবং বাকি দুই ভাগের একভাগ গরীবদের আরেকভাগ প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের মাঝে বন্টন করা মুস্তাহাব।তবে কারো পরিবারে লোক সংখ্যা বেশি হলে সবটুকু তারা নিজেরা খেতে পারবে।
কুরবানির পবিত্রতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী নতুবা কুরবানি কবুল হবে না।গোস্ত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করা যাবে না,হারাম উপার্জনের টাকায় কুরবানির পশু কেনা যাবে না।আল্লাহ খুশি হবেন আবার গোস্তও খাওয়া হবে এমন চিন্তা করে কুরবানি করা যাবে না।লোক দেখানোর জন্য অনেক দাম দিয়ে কিংবা বড় গরু কিনে কুরবানি দেওয়া যাবে না।যত টাকা দিয়ে গরু কেনা হয়েছে তা দিয়ে কত কেজি গোশত হয়েছে সেটার হিসাব করা যাবে না।পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে “ আর তোমাদের ধন সম্পত্তিতে রয়েছে অভাবী ও বঞ্চিতদের অধিকার” সুতরাং কুরবানির পবিত্রতা রক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানি করার নিয়ত করাউচিত এবং সমাজের বঞ্চিতদের মধ্যে কুরবানির গোশতের অংশ বিতরণের পাশাপাশি যতটুকু সম্ভব অসহায়দের মধ্যে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।
৮ জুলাই ২০১৯
দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকাতে প্রকাশিত।