জুলাই-২০১৭ তে ৯৬ বছরে পা দিয়েছে দেশের সব থেকে প্রবীণ এবং প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আমাদের রয়েছে অনেক ইতিহাস। যে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মাত্র একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকেনি পাশাপাশি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের অংশ।আমাদের ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপুর্ন দুটি অধ্যায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অতুলনীয়।বিশ্ববিদ্যালয় এক কালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাতি পেয়েছিল।কিন্তু এখন অনেকেই মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অতীতের ঔজ্বল্য হারিয়ে ফেলেছে।আমরা বিশ্বের অপারপার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চোখ মেললে দেখতে পাই সেরা একশোতো দূরের কথা পাঁচশো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করলেও আমাদের ঐতিহ্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাইনা।এক কালে পাওয়া গেলেও এখন নানা কারণে সেই তালিকায় আর ঠাই হয়না আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের।তার মানে স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমে গেছে বলেই বর্হিবিশ্বে এর ভাবমুর্তিও কমে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ আশা প্রকাশ করেছেন আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উঠে আসবে বিশ্বের সেরা ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়।কিন্তু বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে কোন ভাবেই আমরা এরকম আশা প্রকাশ করার সাহস পাইনা।বিগত বছর গুলোতে আমরা দেখেছি একের পর এক নতুন বিভাগ চালু হয়েছে এবং প্রতিবছরই সেই সব বিভাগে ছাত্র ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে।আগের তুলনায় প্রতিটি বিভাগে ছাত্র ছাত্রীদের রেজাল্ট ভাল হচ্ছে,সিজিপিএর দিকে তাকালে দেখতে পাই অধিকাংশ বিভাগের এক বৃহদাংশ শিক্ষার্থীর সিজিপিএ ৩ এর উপরে এবং সেটা ৩.৯ এর ঘরে গিয়ে পৌছেছে।অন্যদিকে শ্রমবাজারের দিকে তাকালে আমরা দেখছি সেই সব মেধাবী ভাল ফলাফলধারীদের অনেকেই বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রধানত যে সব নতুন বিভাগ চালু হয়েছে দেশে তার অধিকাংশরই নির্দিষ্ট কোন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি।ফলে ভাল ফলাফল নিয়ে পাশ করার পরও চাকরিদাতাদের কাছে তারা অবহেলিত হচ্ছে।যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করা হয় তখন কেবল মাত্র ভাল ফলাফল আর শিক্ষার দিকেই নজর দেওয়া হয়না বরং পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পাশ করে কে কতটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে কিংবা স্বাবলম্বি হয়েছে সেসবও দেখা হয়। এ কারণেই বিগত বছর গুলিতে দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় এগিয়ে আছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আগের তুলনায় কমেছে এটা আমরা মুখে না বললেও আমাদের সামনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।আমরা দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগ নিয়মিত সময়ের বাইরে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে।সান্ধ্যকালীন ওই সব কোর্সে যাদের ভর্তি করা হচ্ছে তাদের ভর্তি যোগ্যতা নিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই সন্দেহ আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ওই সব শিক্ষার্থীদের ফলাফলও জরিপের আওতাভুক্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবির্ক মানসুচক নিম্নগামী হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন সিনেট অধিবেশনের বাজেট বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বলে প্রথম আলো সহ বেশ কিছু নামিদামী পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স খোলা হয়েছে। কামাল উদ্দিনের মতে, এসব কোর্সে কখনো কখনো ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করার অভিযোগ রয়েছে। সিনেট সভায় তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এই কোর্সের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল ও অর্থ লাভের আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। এর মাধ্যমে একশ্রেণির শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন। তিনি এই শ্রেণির শিক্ষকদের ‘শিক্ষক দোকানদার’ বলেও মন্তব্য করেন।
শিক্ষা যখন পন্যের মত বেচাকেনা শুরু হয় আর বিশ্ববিদ্যালয় যখন সেই বেচাকেনার বাজার হয়ে ওঠে তখন সেখানে শিক্ষার মান নিম্নগামী হবে এটাই স্বাভাবিক।আমরা কদিন আগেই পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি দেশের ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন উপাচাযর্হীন অবস্থায় চলছে।দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবোর্চ্চ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয়।এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ই নানা অনিয়মের জালে জড়িয়ে পড়ে আর শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণে যুক্ত হয় তাহলে শিক্ষার মান থাকে কি করে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড কিন্তু আমরা নানা ভাবে সেই মেরুদন্ডই ভেঙ্গেদিচ্ছি।এখন আমাদের দেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী প্রতিবছর এমআইটি,কেমব্রিজ,অক্সফোর্ড থেকে শুরু করে ক্যালটেক এবং স্ট্যানফোর্ডে পড়তে যাচ্ছে।এদিক থেকে বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা চলে আমাদের ছেলে মেয়েরা আগের তুলনায় মেধাবী হয়েছে।বিশ বছর আগে এমআইটি,অক্সফোর্ড বা হাবার্ডে আমাদের দেশের শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার আর আজকের দিনে সেখানে প্রায় প্রতিটি কোর্সেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে বিশ্বের নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে ভাল করলেও আমাদের এদেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান নিম্নগামী হওয়ায় আগের তুলনায় বর্হিবিশ্বের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছুটা অনিহা প্রকাশ করছে।
বর্হিবিশ্বের ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষার গুণগত মান বিচারে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কোন কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখছে।সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ সুবিধা এবং তুলনামুলক খরচ কম হওয়ার পরও সেখানে ভর্তির বদলে অনেকে গাজীপুরের আইইউটিতে ভর্তি হচ্ছে যদিও সেটা পনের থেকে বিশ লাখ টাকার ব্যাপার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য বলেছেন ‘বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অবস্থাতেই বাণিজ্যকেন্দ্র নয়। এটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।’ কিন্তু তারই অধীনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগই সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে অনেকটা বাণিজ্যিকিকরণে লিপ্ত হয়েছে যা কোষাধক্ষ্যের বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে এবং সেই একই বক্তব্যকে অন্য অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন।
সান্ধ্যকালীন কোর্স বিশ্বের আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে তবে সময়ের পার্থক্য ছাড়া সেখানে শিক্ষার মানের তেমন কোন পার্থক্য না থাকায় সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববতীয় দেশ ভারতের দুটি খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সান্ধ্য কোর্সের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। আইআইটি মুম্বাইয়ে কর্মরত পেশাজীবীদের জন্য এম. টেক. স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেখানে নিয়মিত এম. টেক. কোর্সটিও সান্ধ্যকালীন। অন্যদিকে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কিছু ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। সেখানে সান্ধ্যকালীন কোনো স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো কোনো কোর্স চালু করলে দোষের কিছু হবে না। তবে তা করতে হবে নিয়মিত কোর্সের কোনো প্রকার বিঘ্ন না ঘটিয়ে। ভর্তিসহ মূল্যায়ন একই মানের রাখাও সংগত। আর বিবেচনায় রাখা সংগত, একই শিক্ষক বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়লে তাঁর শিক্ষাদানের মান ক্রমান্বয়ে উঁচু হওয়ার সুযোগ কম।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যনতুন বিভাগ খোলার পরিবর্তে পুবর্বতী বিভাগগুলিকে যুগোপোযোগি শিক্ষার আওতায় আনা অধিক জরুরী।বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অধিকতর গবেষণাক্ষেত্র তৈরি করতে হবে পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও কেবল মাত্র সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষায় ভাল সিজিপিএ পাওয়ার বদলে নিজেকে সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।শিক্ষকদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো খানিকটা সময় দিয়ে এর মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখা।সাদা দল-নীল দল নানা মত অভিমতে না জাড়িয়ে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত শিক্ষাই একমাত্র ব্রতী হিসেবে মেনে নিয়ে কাজ করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পরিবেশগত মানোন্নয়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র।তখন হয়তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সেরাদের তালিকায় আসায় আর কোন বাধা থাকবে না।
–জাজাফী
৩ জুলাই ২০১৭
উত্তরা,ঢাকা-১২৩০