বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের আনাচে কানাচে জালের মত বিছিয়ে আছে অসংখ্য নদী। কিন্তু আফসোস নদীগুলো মৃতপ্রায়। মা ছাড়া সন্তানের যেমন পরিচয় দেবার মত কিছু থাকেনা তেমনি নদীমাতৃক দেশ তকমা গায়ে লাগিয়ে নদীকে উপেক্ষা করে থাকা যায় না। কিন্তু আমরা থাকছি। নদী মরে যাক তাতে আমাদের কি? আমরা আছি আমাদের তালে। এটাই যেন হয়ে উটেছে আমাদের ধ্যানজ্ঞান। নদী যেভাবে মরে যাচ্ছে,শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে বলা যেতে পারে আর কয়েক দশক ধৈর্য ধরে থাকলে হয়তো পদ্মাসেতুর দরকার হতোনা। পদ্মাও যে অন্য নদীর মত মরে যাবেনা তার গ্যারান্টি আমাদের কাছে নেই। আমাদের পুবর্পুরুষেরা যেমন হারিয়ে গেছে একদিন নিশ্চই আমরাও হারিয়ে যাব। ঠিক একই ভাবে অগনিত নদী যেমন নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় তেমনি অনাদর অবহেলায় একদিন হয়তো ঢেউতোলা পদ্মাও তার ভরা যৌবন হারিয়ে মরে যাবে, আর তখন সেই পদ্মার মাঝ দিয়ে আমরা গাড়ি চালিয়ে পার হতে পারবো, যদিনা আমরা সচেতন হই।
বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ সুতরাং নদী এদেশের মায়ের মত। এদেশে নদীর যে অবদান এবং আবশ্যকতা তা সহজেই অনুমেয়। সেচ কাজ চালানো থেকে শুরু করে ব্যবসা বানিজ্যে নদীপথ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকটি নদী বাদে প্রায় সিংহভাগ নদীই তার নাব্যতা হারিয়েছে। বর্ষার মৌসুমে কিছুটা পানি থাকলেও সেটির অগভিরতার কারণে ভারি নৌযান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে থাকে। ফলে ব্যবসা বানিজ্যের পরিবহন পথ হিসেবে সব থেকে স্বল্প ব্যায়ী নদীপথ আমরা ব্যবহার করতে পারিনা।
আমাদের নদীগুলো ক্রমাগত ভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় ভারি বর্ষনে আবাদী জমি থেকে স্রোতে মাটি কেটে সেটা নদীতে গিয়ে পড়ছে ফলে নদী ভরাট হচ্ছে। অপরদিকে শিল্প কারখানা সহ নানা বর্জ্য নদীতে ফেলায় নদীর নাব্যতা হারাচ্ছে। নদীর নাব্যতা না থাকায় বর্ষায় দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ বন্যা অন্যদিকে চৈত্রের খরতাপে দেখা দিচ্ছে পানিশুন্যতা। চারদিক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভারত নির্মিত ফারাক্কা বাধ ও আমাদের নদীর নাব্যতা হারানোর জন্য দায়ী। নদী যদি সব সময় প্রবাহমান থাকতো তাহলে যে পরিমান নাব্যতা হারিয়েছে তার তুলনায় অনেক কম নাব্যতা হারাতো। যখন আমাদের পানির দরকার তখন আমরা তা পাচ্ছিনা আবার যখন পানির চাহিদা কম তখন হুট করে পানি আসছে যা আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে নানা সংকট সৃষ্টি করছে।
আমরা যদি নদীর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করি তাহলে ফিরে যেতে হবে একাত্তুরে। অপেক্ষাকৃত অনেক দুবর্ল অস্ত্র নিয়েও বাঙ্গালীরা দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিল যে কয়টি কারণে তার মধ্যে বুকে অসীম সাহস যেমন একটি তেমনি নদীমাতৃকতাও অন্যতম। আমরা দেখতে পাই বর্ষার মৌসুমে মুক্তিবাহিনী সব থেকে সফল এর প্রধান কারণ ্ ামাদের সাথে নদীর গভীর সম্পর্ক। মুক্তিযোদ্ধারা অনায়াসে ঝড়বৃষ্টিতেও নদী সাতরে অভিযান চালাতে পেরেছে পক্ষান্তরে হানাদার বাহিনী নদীর কাছে অচেনা ছিল বলে তারা তেমন সাতারও জানতো না ফলে বৃষ্টির দিনে যেমন তারা তেমন তৎপর ছিলনা তেমনি নদী পথেও তারা ছিল অপটু।ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই শত্রুকে ছিন্ন ভিন্ন করতে পেরেছে। সেই সব নদীই আজ মৃতপ্রায়। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে যে নদী আমাদের জন্য সহায় ছিল,যে নদীর জন্য এ দেশ নদীমাতৃক দেশ বলে পরিচিতি পেয়েছে সেই সব নদী অনাদর অবহেলায় মরে যাচ্ছে।
আমরা সবাই জানি ইট বানানোর জন্য মাটি লাগে।আমরা নিবির্চারে ফসলের জমি নষ্ট করে ইট বানানোর মাটি সংগ্রহ করে একই সাথে দুটি ক্ষতি করছি। ফসলের জমি নষ্ট করছি ফলে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে যা আমাদের জন্য হুমকি স্বরুপ। আমি বলতে চাই নদীর মাটি দিয়েও ইট হয়। ফসলের জমি নষ্ট না করে ইট তৈরির জন্য নদীর মাটি ব্যবহার করা হোক। এতে করে একই সাথে অনেক গুলো উপকার সাধীত হবে। ইট তৈরির মাটি পাওয়া যাবে পাশাপাশি নদী খনন ও হবে। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন দেশের অনেক নদী থেকেই বালু তোলা হচ্ছে কিংবা মাটিও তোলা হচ্ছে কিন্তু নদীর নাব্যতা ফিরে আসছেনা। এর প্রধান কারণ অপরিকল্পিত ভাবে মাটি ও বালু উত্তোলন। আমি বেশ কিছু নদী থেকে বালু ও মাটি তোলা দেখেছি তারা নদীর কিনার ঘেষে বালু ও মাটি তুলছে ফলে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে প্রশস্ততা বাড়ছে।
একটি নদীর প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাওয়া মানেই নদী তীরের জমি কমে যাওয়া। এইভাবে বালু বা মাটি তুললে নদীর নাব্যতা ফিরে আসবেনা। নদী খনন মানে নদীকে প্রশস্ত করা নয় বরং নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করা। আমরা কেউ সেটা করছিনা। মাঝ নদী থেকে মাটি উত্তোলোনের খরচ বেশি দেখে আমরা নদীর তীর কেটে সমতল ভূমি নষ্ট করে নদীকে প্রশস্ত করার নামে দেশের ক্ষতি করছি। সরকারের উচিত এ ব্যপারে কঠোর নির্দেশ দেওয়া যে ইট তৈরি করতে হলে অবশ্যই নদী খনন করে মাটি নিতে হবে। আর কোন ফসলের জমি নষ্ট করে ইট বানানো যাবেনা। সে ক্ষেত্রে শুধু মাত্র ইট ব্যবসায়ীদের উপরদায় চাপিয়ে দিলে সেটা ঠিক হবেনা।সরকারকে সবার্ত্মক ভাবে তাদের পাশে দাড়াতে হবে। তাদের ঐ কাজে অতিরিক্ত যে ব্যয় হবে তা সরকার বহন করলে দু’পক্ষই লাভবান হবে। সরকার নিজে ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করলে পুরো ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হতো যা সময় সাপেক্ষ্য এবং বেশ ব্যয়বহুল। অন্যদিকে ইট তৈরির জন্য যারা মাটি তুলবে তাদের আর্থিক সহায়তা দিলে ইটতৈরির জন্য তারা মাটি তুলবে পাশাপাশি নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে এবং নাব্যতা ফিরে আসবে।
কেউ নিজের পরিমিত ব্যয় থেকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে চাইবেনা। মনে রাখতে হবে এই নদী আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কৃষি কাজে যেমন নদীর সীমাহিন গুরুত্ব তেমনি ভৌগলিক নানা দিক থেকেও নদী তাৎপযর্পুর্ন।একসময় আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতাম সেটা নদীর কল্যাণে। যেখানে নদীর নাব্যতা ছিল ফলে প্রচুর মাছও জন্মাতো। এখন নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে আর আমরাও হারিয়েছি মাছে ভাতে বাঙ্গালী পরিচয়। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে,প্রচুর কল কারখানা হচ্ছে বলে নদীকে আপনি অবহেলা করতে পারবেন না। আমাদের চেয়ে পঞ্চাশ বছর আগে যে সব দেশ ডিজিটাল হয়েছে তারাও তাদের নদীকে বাচিয়ে রেখেছে। টেমস নদীর কথা ভেবে দেখুন। চলুন ঘুরে আসি ইতালির ভেনিস নগরীতে,যে নগরী পুরোটাই নদীর উপর ভাসমান। যারা কোন কালেও নদীমাতৃক দেশ ছিলনা তারা যদি নদীকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকে তাহলে নদীমাতৃক দেশ হয়ে আমাদেরকি উচিত নয় তাকে বাঁচিয়ে রাখার। নদী পরিবেশের একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ।
বিশেষ করে আমাদের দেশের জন্য নদী অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন।আমাদের মনে রাখতে হবে নদী বাচলে এই দেশ আরো দ্রুত শিল্প সমৃদ্ধ হবে। আমরা খাদ্য এবং অর্থকারী ফসলে স্বয়ংসম্পুর্ন হয়ে বিদেশে রপ্তানী করতে পারবো। আসুন নাব্যতা হারানো নদীগুলোরদিকে সুদৃষ্টি দেই এবং তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দেই। এদেশের প্রতিটি নদী তার নাব্যতা ফিরে পাক। সকাল সন্ধ্যা পালতোলা নৌকা ভেসে বেড়াক তার বুকে। জেলেরা জাল ফেলুক আর ফিরে আসুক মাছে ভাতে বাঙ্গালী পরিচয়ের সেই উজ্জল দিনগুলি।
জাজাফী
২৮ জুন ২০১৭
নদীর নাব্য ফিরে আসুক শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০১৭