Thursday, November 21, 2024
Homeপ্রবন্ধউচ্চতর ডিগ্রি নাকি দ্রুত কর্মসংস্থান

উচ্চতর ডিগ্রি নাকি দ্রুত কর্মসংস্থান

রূপকথার গল্পের মত বলতে হয় সে বহুকাল আগের কথা এদেশের মানুষ লেখাপড়া শিখতো জ্ঞানার্জনের জন্য কিন্তু এখন আমরা লেখাপড়া শিখি একটা ভাল চাকরির আশায়।আমাদের দেশে লেখাপড়া,উচ্চতর ডিগ্রি সবই মূলত একটি ভাল কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে।এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা শ্রেয়? উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন নাকি দ্রুততম সময়ে স্বাবলম্বি হওয়া?আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশে পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যে প্রতিটি পরিবার চায় তাদের সন্তান শিক্ষিত হোক কিন্তু সেই শিক্ষিত হোক কথাটিকে সত্যে পরিণত করতে গিয়ে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।সীমিত আয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচ যোগান দেওয়া পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।এমতাবস্থায় পরিবার কিন্তু মন থেকে এটাও চায় তাদের সন্তান যদি সংসারে হাল ধরতো তাহলে কিছু না হোক একটুখানি সুখের দেখা পাওয়া যেত।

আপনি যদি উচ্চবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তও না হয়ে থাকেন তাহলে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে তা আপনি অনুভব করতে পারবেন। আজ থেকে কয়েক দিন আগে ৫ জুলাই আমার পরিচিত অনেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭৮ তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে জয়েন করেছে এবং আপনি শুনলে অবাক হবেন তাদের সিংহভাগই এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে যাদের ফলাফল বের হয়নি।এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার আগেই তারা দেশের প্রথমশ্রেনীর একটি চাকরি পেয়েছে যা তাদের জীবনকে আমুল বদলে দেবে।পাশাপাশি আপনার আমার ছেলে মেয়ে ভাই বোন কিংবা অন্য কারো ছেলে মেয়ে ভাইবোন যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা দিনরাত অবিরাম পরিশ্রম করছে কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন একটা বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য।আমি আগেই বলেছি যে আমরা যে যেখানে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয় নিয়েই পড়িনা কেন আমাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু একটাই আর তা হলো ভাল একটা চাকরি। দু চারজন হয়তো ভাল ফলাফল করে শিক্ষকতা পেশায় আসবে এবং জ্ঞান বিলাবে সেটাও একপ্রকার ভালমানের একটি চাকরি পাবার নামান্তর।

আমি যদি আমার বন্ধুদের কথা বলি তাহলে বলতে হয় তাদের মধ্যে যারা সেনাবাহিনীতে কিংবা অন্য কোন বাহিনীতে কিংবা মনে করি কোন একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কোন পদে চাকরি নিয়েছে যাদের বেতন ধরে নেওয়া যেতে পারে মাত্র দশ থেকে পনের হাজার টাকা।পক্ষান্তরে আমি কিংবা আমাদের কারো সন্তান দেশের সব থেকে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে সেরা বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলো এবং পড়াশোনায় খুব মনোযেগি হলো। এই দুজনের মধ্যে অনেক কিছুর পার্থক্য গড়ে উঠবে। একজন হয়তো লেখাপড়া করে অনেক ভাল রেজাল্ট করবে এবং তাকে সে জন্য চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে তার পর সে একটা চাকরি পাবে এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে তার বেতন হবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে আমাদের যে বন্ধু সাধারন একটা প্রতিষ্ঠানে হয়তো সেলস ম্যানের চাকরি নিয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার পরই সে এই ছয় বছরে কয়েক লাখ টাকার মালিক হয়ে যাবে যা তাকে এবং তার পরিবারকে আমার তুলনায় অনেক বেশি সুখ এনে দিতে সক্ষম।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমি যখন একটা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশনারী লেভেলে ত্রিশ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেব ঠিক সেই সময়ে আমারই বন্ধুর ছয় বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা জমা হবে,একটা দুটো প্রোমশান পাবে এবং পাশাপাশি সে যদি প্রতি মাসে দু হাজার টাকা করেও জমা করে রাখে তাহলে ওই ছয় বছরে তার জমাকৃত টাকার পরিমান দাড়াবে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা।অনেকটা খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড়ের মত বেশি বেতন পেয়েও তখন আমি তাকে আদতে ছাড়িয়ে যেতে পারবো না।এটাতো গেল সাধারণ লেভেলে যারা চাকরি নিয়েছে তাদের উদাহরণ।পাশাপাশি যারা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর ভাল কোন চাকরি নিয়েছে তাদের অবস্থা আরো উন্নতির দিকে যা কল্পনাতীত।

যেমন আমার এক বন্ধু যে সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে জয়েন করেছিল এবং চাকরি জীবনে সে জাতিসংঘ মিশন করে এসেছে।ওই মিশন থেকে সে যে আর্থিক সুবিধা লাভ করেছে তা আমি আইবিএ থেকে পাশ করে ঠিক কতদিনে অর্জন করতে পারবো সেটাকি আপনি অনুধাবন করতে পারবেন? ধরুন আমি আইবিএ থেকে ভাল সিজিপিএ নিয়ে পাশ করে দেশের বড় কোন একটা প্রতিষ্ঠানে বেশ ভাল পদে চাকরি পেলাম এবং শুরুতেই আমাকে পঞ্চাশ হাজার বা তারও বেশি বেতন দেওয়া হলো। তার পরও দেখা যাবে আমার যে বন্ধু জাতিসংঘ মিশন করে এসেছে তার অর্জিত সম্পদের সমান আয় করতে আমাকে কয়েক বছর পার করতে হবে।আদতে যদিও কথাটা সেরকম নয়।কেননা আপনি যত উচু পদের চাকরি করবেন আপনার ব্যয়ও ততোধিক হবে।ফলে খরচের পর খুব বেশি জমাতে পারবেন বলে মনে করিনা।

বুয়েট,আইবিএ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিষয়গুলো বাদ দিলে বাকি সব ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করলে বেশ হতাশ হতে হয়।তারা প্রতিবছর ভাল ফলাফল করে পাঁচ ছয় বছরে মাষ্টার্স ডিগ্রি অজর্ন করে একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যায় কিন্তু চাকরি হয়না। ফলে দেখা যায় এইচএসসির পর মুলত সে একটা কর্মসংস্থান করতে প্রায় নয় থেকে দশবছর পার করে ফেলে যে সময়টাতে অন্য বন্ধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগই পায়নি কিংবা চেষ্টাও করেনি বরং কাজে নেমে পড়েছে তার অর্জিত সম্পদ তখন দেখার মত।

এতো সব কথা বলার মানে এই নয় যে আমি উচ্চশিক্ষার পক্ষে নই।আমিও চাই দেশের প্রতিটি নাগরিক উচ্চশিক্ষিত হোক।কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে,পারিবারিক দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করে আমার মনে হয়েছে উচ্চশিক্ষার চেয়ে দ্রুত কর্মসংস্থান অধিক জরুরী।কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে দ্রুত কর্মসংস্থান কিভাবে সৃষ্টি হবে?চিন্তা করে দেখুন বিগত বছর গুলিতে আমাদের দেশে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা কি পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে।এমনকি তাদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখা হচ্ছে।দেশের ভিতরেই যারা হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমিয়ে বিলিয়নিয়ার তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের উন্নতির জন্য,দেশ থেকে বেকারত্ব কমানোর জন্য এবং অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য মূলত ঐ সব টাকাওয়ালাদের স্বদিচ্ছার খুবই প্রয়োজন।ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা জমিয়ে না রেখে সেগুলো সঠিক ভাবে বিনিয়োগ করলে,নতুন শিল্প কারখানা তৈরি করলে এদেশের অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হত।তখন দেখা যেত কোন পরিবারের একাধিক সন্তান থাকলে একজন হয়তো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় সংসারের হাল ধরে বাকিদের উচ্চশিক্ষিত হতে সহযোগিতা করতে পারতো।তখন আমরা বলতে পারতাম যে আমরা শিক্ষার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছি।

সরকার চাকরির বয়স বাড়াবেনা বলে তাদের সিদ্ধান্তকে খুটির সাথে শক্তভাবে বেধে রেখেছে।অন্যদিকে পযার্প্ত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও সে পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় ক্রমাগত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ একদিন বেকারদের ভারি নিঃশ্বাসে কেপে উঠবে।দেশকে উন্নত করতে হলে সবার আগে চাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি।কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত তৈরি করে লাভ কি?সেটা হয়তো পরিসংখ্যনের দিক থেকে এগিয়ে রাখবে যে আমাদের দেশের সিংহভাগ লোক উচ্চশিক্ষিত কিন্তু অন্যদিকে যে পিছিয়ে যাবে সেটা কেন আমরা ভাবছিনা।

এখনই আমাদের আফসোস করতে হচ্ছে যে পরিমান শিক্ষার্থী এ প্লাস নিয়ে পাশ করছে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তিরসুযোগ দিতে পারছিনা আর সেই সব শিক্ষার্থীরা যখন কোন না কোন প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হবে তখন তাদেরকে আমরা কোথায় রাখবো?শিক্ষার্থীরা হলো ফসলের মত।আপনি অনেক ফসল উৎপাদন করলেই হবেনা বরং সেগুলো যত্নকরে রাখার মত ব্যবস্থাও করতে হবে।শুধু উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ দিলেই হবেনা বরং সেই ডিগ্রিধারীদের কাজেরও সুযোগ দিতে হবে।

আমি উচ্চশিক্ষার পক্ষে থেকেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমাদের দেশের জন্য উচ্চতর ডিগ্রির চেয়ে দ্রুত কর্মসংস্থানকেই প্রাধান্য দিতে হবে।এটা মনে রাখা আবশ্যক কর্মহীন মানুষ কখনো দেশকে এগিয়ে নিতে পারেনা তারা বরং দেশের বোঝা হয়ে থাকে।তাই সবার আগে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারলে তবেই আমাদের উন্নত দেশের কাতারে পৌছার স্বপ্ন সত্যি হবে।

–জাজাফী

৬ জুলাই ২০১৭

ওয়েবসাইট www.zazafee.com

229 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Most Popular