আধুনিক সভ্যাতার চরম উৎকর্ষতার এই যুগে বিশ্বের প্রায় তিনশোকোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। বর্তমান বিশ্ব ক্ষুধা,দারিদ্র,অপুষ্টি,নিরক্ষরতা,জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আলোচনার শীর্ষে সন্ত্রাসবাদ। যা গোটা বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছে।সম্প্রতি বাংলাদেশের অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি হোটেলে যে হামলা হয়েছে তা সত্যিই ভয়ের কারণ।এর আগে বাংলাদেশে সম্ভবত এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি।যেহেতু সন্ত্রাসবাদের সবর্জন স্বীকৃত কোন সংজ্ঞা নেই তাই কারা সন্ত্রাসী বা কারা সন্ত্রাসী নয় তা নিরুপন করা বেশ দুরুহ।বলা হয়ে থাকে “One Mans Terrorist is another mans Freedom Fighter” অর্থাৎ যে একজনের কাছে সন্ত্রাসী সে অন্যজনের কাছে মুক্তিযোদ্ধা। যেমন কশ্মীরীদের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব সহ অনেকের কাছে তারা স্বাধীনতাকামী। তাদের যৌক্তিক দাবী খোদ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত।অনুরুপ ভাবে ইসরাইলি বাহিনী যখন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়ে নিরাপরাধ লোকদের হত্যা করে, তাদের বাড়ি ঘর ধ্বংস করে তখন তা বিবেচিত হয় আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে । পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনিরা পাল্টা আক্রমন করলে তা সন্ত্রাসবাদ বলে উচ্চবাচ্য করা হয়। মার্কিন তাবেদারী না করলে কতিপয় রাষ্ট্র হয় সন্ত্রাসীদের মদদদাতা।পক্ষান্তরে কন্ট্রাবিদ্রোহীদের সহ বিভিন্ন গুপ্তহত্যা ও গণহত্যার জন্য মার্কিনীরা যখন সামরিক সহায়তা দেয় তখন তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করা হয়না। এই কথা বলে সভ্যতার মূখোশ পরা যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের মত একটি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। মূলত যতদিন পযন্ত বিশ্বে মৌলিক মানবাধিকার ও সবার জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন পযন্ত সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসবাদের সীমারেখা নিরুপন সম্ভব হবেনা।সন্ত্রাসবাদ বা Terrorism শব্দটির উদ্ভব হয় ফ্রান্সে ১৭৮৯-১৭৯৯ সালে ফরাসী বিপ্লব চলাকালীন সময়ে। এ সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু এবং জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে The Regime de La Terreur (Reign of Terror) নামে একটি বিশেষ পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং সহিংস কর্মকান্ডের জন্য এই Terror রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ারে পরিণত হয়। মনে করা হয়ে থাকে ঠিক তখন থেকে Terror শব্দটি নেতিবাচক ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। ব্রায়ান জেংকিন্সের মতে “রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে শক্তির প্রয়োগ বা শক্তি প্রয়োগের হুমকিই সন্ত্রাসবাদ”। অনেকেই মনে করেন সন্ত্রাসবাদের কারণ নিয়ে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ সন্ত্রাস একটি অশুভ শক্তি এবং একে নিমূর্ল করাই মূল কথা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালালে তা আরো সন্ত্রাসের জন্ম দেবে।
কেননা রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক এমনকি ধমীর্য় কারণেও সন্ত্রাসবাদের জন্ম হতে পারে। অনেক ধমীর্য় গোষ্ঠী আছে যাদের ধারনা তাদের বিরোধীদের হত্যা করে নির্মূল করতে পারা পুন্যের কাজ। তেমনি অনেক উগ্রপন্থী খ্রিষ্ঠান ও এটাকে Crusade বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ মনে করেন। ফলে এরাই জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসবাদে। কখনো কখনো ধর্মীয় মূলনীতির অপব্যাখ্যার ফলে সৃষ্টি হয় ধর্মীয় উগ্রবাদ যা ক্রমান্বয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত করে। বাস্তবতা আরো কঠিন। আমরা কেবল সন্ত্রাসবাদ সন্ত্রাসবাদ করে করে গলা ফাটাই। সন্ত্রাসবাদকে চিরতরে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য লাখ লাখ নিরীহ মানুষকেও হত্যা করতে দ্বিধা করিনা। কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনা কেন সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। এটা ভুলে গেলে চলবেনা যে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো যখন তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে অন্যায় কর্মকান্ডে অর্থনৈতিক ও সামরিক মদদ যোগায় তখন প্রায় নিরস্ত্র নিযাতিত জনগণ অনন্যোপায় হয়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে মাকির্নীদের ইসরাইলকে অনৈতিক কাজেও আর্থিক সমর্থন যোগানো। এর ফলে ইসরাইলরাই আক্রান্ত হচ্ছেনা খোদ আমেরিকাকেও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শুধু ধর্ম ও বর্ণের কারণে অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত বৈষম্য ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। কোন অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যখন ধর্মীয় ও বর্ণবাদী কারণে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখন মারাত্মক সামাজিক অসন্তোষ ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। অপেক্ষাকৃত দুবর্ল রাষ্ট্রগুলোর ওপর ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসন ব্যপক সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়ে গোটা বিশ্বকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে আমরা এর বিকাশ লক্ষ্য করেছি। এমনকি একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এই যুগে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানস্তান,ইরাক সহ বিভিন্ন দেশে চালানো আগ্রাসন গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে।ফলে জন্ম নিয়েছে তালেবান,আলকায়দা কিংবা আইএসের মত সংগঠনগুলো।
যুক্তরাজ্যের লিচেষ্টরশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এন্ড্রু সিল্কের মতে, পাল্টা সন্ত্রাস তথা সন্ত্রাসের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমননীতির ফলে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হওয়াতো দূরের কথা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ সন্ত্রাসবাদকে ঘৃণা করে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তারা বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়।তাই যেসব পরিস্থিতির কারণে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্ম হয় সেসব চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারলেই কেবল সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করা সম্ভব। বিশ্ব এখন এমন এক সময় পার করছে যখন সন্ত্রাস মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী।অধিকার হারা মানুষ অধিকারের জন্য সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে। বিশ্ব ব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দিয়ে আবার সন্ত্রাস দমনের নামেও রাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। মানুষ কখনো সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায়না, পরিস্থিতিই তাকে সন্ত্রাসী করে তোলে। তাই বিশ্বব্যপী সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের কারণ গুলো চিহ্নিত করে প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলে সন্ত্রাসবাদ আপনাআপনি কমে যাবে।মাহাত্মাগান্ধীর ভাষায় “চোখের বদলে চোখ নেওয়ার রীতি গোটা জাতিকে অন্ধ করে দিচ্ছে”।আমরা একটি শান্তিময় বিশ্বের স্বপ্ন দেখি। আগামীর বিশ্ব হোক সন্ত্রাস মুক্ত। নূর হোসেন বেঁচে থাকলে হয়তো নতুন করে বুকে পিঠে লিখতেন “সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক,গোটা বিশ্ব শান্তি পাক”।
……………..
১৩ মার্চ ২০১৭ পোষ্ট। এটি মূলত গতবছর লেখা। তারিখ মনে নেই।