আমাদের জীবন আজ আনন্দ বেদনার মহাকাব্য হয়ে গেছে।আমরা প্রতিনিয়ত খুশির সওদা করতে গিয়ে এক সমুদ্র দুঃখ নিয়ে ফিরে আসছি। সেই দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের স্বজন।২১ আগষ্ট হঠাৎ করে আবারও বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগলো। এ নিয়ে মোট তিনবার আগুন লেগেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শপিংমলে।
আমরা শপিং করতে যাই খুশি নিয়ে আর ফিরে আসি স্বজন হারানো ব্যাথায় বুক চাপড়াতে চাপড়াতে।এর আগে দুইবার যখন আগুন লেগেছে তখন এই শপিংমলের সংশ্লিষ্টদের আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিল।আমার জানতে পেরেছি বিগত দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার কোন রিপোর্ট কোথাও জমা পড়েনি।
এরকম একটা স্বনামধন্য শপিংমলে অনাহুত ভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তাই জন মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে।ফায়ার সার্ভিসের ২৯টা ইউনিট একাধারে অগ্নিনির্বাপন কাজে নিয়োজিত থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনলেও ততোক্ষণে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে।
শুধু বসুন্ধরা সিটির ঘটনাই নয় বরং দেশে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অগ্নিকান্ডের ঘটনা আমরা দেখছি।তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা আজও আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। কিন্তু তার পরও আমাদের মধ্যে সচেতনতার বড়ই অভাব।
একের পর এক দেশের আনাচে কানাচে শপিংমল, শিল্পকারখানায় আগুন লেগে রক্তমাংসের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।এভাবে আর কত দিন? কেন আগুন লাগছে শপিংমল কিংবা শিল্প কারখানায়? কী এর রহস্য? এর থেকে কি কোনই প্রতিকার নেই? কোন ভাবেই কি আগুন লাগা থামানো যায়না? আগুন লাগার কিছু সাম্ভাব্য কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তাড়াহুড়ো করেই হোক আর খরচ বাচাতে গিয়েই হোক নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে।
পোষাক শিল্পে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বিশেষত যে কারণটি লক্ষ্য করা যেতে পারে তা হলো কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক কর্মচারি ধুমপান করে। যখন বিরতী দেয়া হয় তখন অনেকেই এখানে সেখানে দাড়িয়ে ধুমপান করে।
এরপর যখন ঘন্টা বা সাইরেন বাজে কাজে ফিরে যাওয়ার তখন অনেকেই হাতের সিগারেট বা বিড়ির অবশিষ্টাংশটুকু যত্রতত্র ফেলে দেয়। সেই রেখে যাওয়া সিগারেটের অল্প একটু আগুন ভেতরের তাপে আরো বেশি উত্তপ্ত হয় এবং একসময় ভয়াবহ আগুন হিসেবে সব জ্বালিয়ে দেয়। মশার কয়েল থেকেও অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত হতে পারে।
বিগত বছর গুলোতে দেখা গেছে দেশের আনাচে কানাচে শপিংমল সহ শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেশ অনেক বার আগুন লেগেছে এবং প্রতিবারই বেশ কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে। যার সবচেয়ে ভয়াবহতা দেখেছি তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকান্ডে। শত শত মানুষ লাশ হয়ে আজীবনের মত হারিয়ে গেছে।
যাদের অনেককেই কেউ চিনতেই পারেনি। কোন কোন মা তার ছেলেকে শেষ বারের জন্যও দেখতে পায়নি। কোন কোন শিশু তার বাবা মাকে শেষ বারের জন্য বাবা-মা বলে ডাকতে পারেনি। গবেষণায় দেখা গেছে আগুন লাগার সাথে সাথে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনা।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে এবং ভয়াবহ রুপ নিতে যতটুকু সময় লাগে তার অনেক আগেই ভবন থেকে সব মানুষ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে। তাহলে কেন সেটা হচ্ছেনা? তার কারণ হতে পারে এরকম যে গার্মেন্টস গুলোতে ঘুরে দেখা গেছে প্রায় সবগুলোতেই একটাই মাত্র পবেশপথ এবং সেই প্রবেশ পথটাও খুব বেশি প্রশস্থ নয়। এ ছাড়া সেটা সব সময় বন্ধ রাখা হয়। ফলে আগুন লাগার পর ভয়ে আতংকে সবাই যখন ছোটাছুটি করে গেটের কাছে আসে এবং দেখে গেট বন্ধ তখন তারা দিশাহারা হয়ে পড়ে। সেই হুড়োহুড়িতেই অনেকে চাপা পড়ে আবার অনেকে জ্ঞান হারায়। এর ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
শপিংমল কিংবা কারখানা গুলোতে অগ্নি নিবার্পক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়না।
কোন এক ফ্লোরে আগুন লাগলে সাথে সাথে যদি অটো অ্যালার্মিং সিস্টেম চালু থাকে তবে অন্য ফ্লোরে অবস্থানরতরা আগেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অন্তিম মুহুর্তে সবাই বুঝতে পারে আগুন লেগেছে। ফলে তারা দিশা হারা হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শপিংমল গুলোতেও সব সময় ভবনের ছাদ বন্ধ থাকে। ফলে দুর্ঘটনার পর ছাদ দিয়ে সহজেই কেউ বেরিয়ে আসতে পারেনা । দেশে শপিং মল,আবাসিক হাউজিং কিংবা শিল্প কারখানা নির্মানের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা জোরালো তা নিশ্চিত না হয়েই ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ফলে দুঘর্টনার সময় হতাহতের পরিমান বাড়ে।
কোথাও কোন অবস্থাতেই আগুন লাগুক এটা কারো কাম্য হতে পারেনা। সচেতনতাই পারে এর থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
প্রথমত ভবন নির্মামের সময় সচেতন ভাবে মানসম্মদ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে যেন বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আশংকা শুন্যের কোটায় নেমে আসে। একই সাথে বিপদ কালীন দ্রুত বাহির হওয়ার মত বিকল্প ব্যবস্থাও রাখতে হবে। ভবনের ছাদ সবর্দা খোলা রাখতে হবে এবং ভবনের ছাদের থেকে অস্থায়ী প্রস্থান ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভবন ব্যবহারের জন্য চালু করার আগেই নিম্চিত হতে হবে যে সেখানে পযার্প্ত অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থা আছে। ফায়ার স্টিংগুইশার বা ফায়ার এলার্ম বা ওয়াটার হোস পযার্প্ত না থাকা পযর্ন্ত ভবন ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া যাবেনা। ভবনে নিয়োজিত কর্মচারিদের নিয়োগের আগেই ভালভাবে বিপদ কালীন করনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কেননা এতে করে সবাই ধীর স্থির ভাবে কিভাবে বিপদ থেকে বাঁচা যায় তা বুঝতে পারবে। এলার্মিং সিস্টেম নাজুক থাকায় এক ফ্লোরে আগুন লাগলে অন্য ফ্লোরের মানুষ তা জানতেই পারেনা। তাই এলার্মিং সিস্টেমের দুর্বলতা দুর করতে হবে যেন আগুন লাগার সাথে সাথে সবাই সেটা বুঝতে পারে। পযাপ্ত সিসিটিভির ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন কোথায় কি হচ্ছে তা সহজেই মনিটর করা যায়। এতে করে বিপদের আশংকা কমে যাবে। শপিংমল এবং শিল্প কারখানার জন্য প্রতি ফ্লোরে অন্তত একজন করে মনিটরিং অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। তাদের দায়িত্ব প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা ঘুরে ঘুরে শপিংমল বা কারখানার সব কিছু দেখাশোনা করা। কোথাও কোন সমস্যা থাকলে তার সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া। এমনকি প্রতি সপ্তাহে বা মাসে বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক সব সংযোগ ও অন্যান্য ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে হবে ঠিক আছে কিনা।
আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে। আমরা কেউ চাইনা আর কোন ভাইবোন বন্ধু আগুনে পুড়ে বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাক। সবাই সচেতন হলেই কেবল আশা করা যাবে যে আর কোন পুড়ে যাওয়া লাশর ছবি কোন পত্রিকার পাতায় আমাদের দেখতে হবেনা।
২৩ আগষ্ট ২০১৬,দৈনিক ইত্তেফাক।