Thursday, November 21, 2024
Homeপ্রবন্ধঅনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। যে স্বপ্ন দেখতে জানে এবং সেই স্বপ্নটাকে সত্যি করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে সে সফল হয়। তার স্বপ্নটা সত্যি হয়ে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। মাতৃভাষা বাংলা করার স্বপ্নে বিভোর আবদুল মতিনেরা কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধুর সেই দৃপ্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বপ্ন সত্যি করার মিছিলে শামিল হওয়া কোটি বাঙ্গালীর দৃপ্ত শপথই প্রমান করে স্বপ্ন যদি দেখার মত দেখা যায় তবে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়।

অথচ আমাদের স্বপ্ন গুলো একটু একটু করে মরে যায়। বুকের মধ্যে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা স্বপ্নটা ভেঙ্গে যেতে সময় লাগেনা। কেবল মাত্র পরিসংখ্যনের দিকে তাকালেই আমাদের দুই তৃতীয়াংশর স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই। কিছুদিন আগে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে যে ছেলে মেয়েগুলো তাদের এখন অখন্ড অবসর থাকার কথা ছিল।কথা ছিল তারা এই সময়টিতে পছন্দ মত জায়গায় ঘুরতে যাবে,আড্ডা দেবে,সিনেমা দেখবে,গল্পের বই পড়বে এবং শান্তিমত ঘুম দেবে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে ওগুলোর কোনটাই জুটছে না।

এসএসসি পরীক্ষা এবং এর রেজাল্টের জন্য তারা যতটা না চিন্তিত, তার থেকে কয়েক গুন বেশি চিন্তিত কলেজে ভর্তি নিয়ে।আশা নিরাশার দোলাচালে বোর্ড পরীক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের পড়তে হচ্ছে কলেজ ভর্তি পরীক্ষার পড়া।আমরা কখন যেন নিরবে খুন করেছি তাদের কিশোর মনের অবসর সময়টাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতা কলে পিষে মেরেছি।পাশ করা ছাত্র ছাত্রীদের তুলনায় কলেজ সংখ্যা, বিশেষ করে মানের দিক থেকে এগিয়ে থাকা কলেজ সংখ্যা সীমিত হওয়ায় পরীক্ষার পর অবসরে সময় কাটানোর বিপরীতে তাদেরকে ভর্তি যুদ্ধে নামতে হচ্ছে।কিন্তু তারা জানেই না সেই যুদ্ধে তাদের কোন কোন ভাগ্যবান ভাগ্যবতী জয়ী হবে, আর কাদের আশা ভঙ্গ হবে।

অধিকাংশর আশা ভঙ্গ হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, কারণ পছন্দসই কলেজ সংখ্যা সীমিত।ফলে কাউকে না কাউকেতো সুযোগ বঞ্চিত হতেই হবে।

সারা দেশে আবারও যখন এক যোগে শেষ হতে চলেছে এইচ এস সি পরীক্ষা তখন তাই সেই স্বপ্ন ভঙ্গের ভয় মনের মধ্যে হানা দিতে শুরু করেছে।যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের মনে কত স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে।তাদের সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তাদের বাবা, মা, পরিবার পরিজন।ছেলেটি বা মেয়েটি ডাক্তার হবে, নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হবে, নয়তো ভাল কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে এমন স্বপ্নই দেখেন সবাই।কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর যখন ভর্তি পরীক্ষার সময় আসে তখন একে একে ক্রমাগত ভাবে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।স্বপ্নরাও মরে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সীট সংখ্যা অপ্রতুল এবং পাশ করা ছাত্র ছাত্রীদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাও হাতে গোনা হওয়ার ফলে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।এখন গোল্ডেন জিপিএধারী ছাত্র ছাত্রীই বিশ,ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যা আপাত দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট সীট সংখ্যার থেকেও বেশি।

শিক্ষা ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা হয়তো পরীক্ষায় বিগত বছর গুলোতে ভাল রেজাল্টের এই পরিসংখ্যন দিয়ে প্রমান করে দেবে কেউ কেউ। কিন্তু বাস্তবতা কতটা নিমর্ম তা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া ওই সব মেধাবী ও তাদের পরিবারের মানুষই বুঝতে পারে।

ছাত্রছাত্রীরা এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই ভর্তি যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে অংশ নিতে ভর্তি হয়ে গেছে কোচিং গুলোতে।প্রতি বছর আমাদের কোন কোন শিক্ষাবিদ কোচিং বানিজ্য বন্ধের কথা বললেও খোদ সেই সব শিক্ষাবিদদের ভর্তি পরীক্ষার্থী সন্তানেরাই সবার আগে ভর্তি হচ্ছে কোচিং সেন্টার গুলোতে।

পথে কুড়িয়ে পাওয়া দুই টাকার একটা নোট হারিয়ে গেলে যতটা না কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় যদি সেই দুই টাকার নোটটি কষ্টার্জিত হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে বা ভাল কলেজে ভর্তির সুযোগ না পেলে কষ্টটা যতটা হওয়ার কথা তার চাইতে কয়েক গুন বেশি কষ্ট হয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হতে হয় তার জন্য।নীলফামারী,কুড়িগ্রাম বা সুদুর বাগেরহাটের অজপাড়া গায়ের দিনমজুরের ছেলে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন বুকে নিয়ে সারা বছরের ধান গম বিক্রি করে কিছু টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকা শহরে আসে তখন সে প্রথমেই চমকে ওঠে।

এ শহর,এ শহরের লাল নীল বাতি আর ব্যস্ততার ভীড়ে তার স্থান কোথায়।অনেক কষ্টেও সে যদি কোন একটা মেসে ওঠে তবে খরচ চালানো এবং পড়াশোনা চালানোর ধাক্কায় সে হাপিয়ে ওঠে। তার স্বপ্নটাতো তখনই অর্ধেক মরে যায়।

অন্যদিকে কেউ কেউ তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢাকাতে ওই অল্প কয়েক মাসের জন্য শত ত্যাগ স্বীকার করে হলেও বাসা ভাড়া নিতে বাধ্য হয়।সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে চায় সব বাবা মা ই।তাইতো যাদের ন্যুনতম সামর্থ আছে তারা চড়া মুল্যের এই বাজারে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতেও পিছপা হয়না।

সেই বাবা মা এবং সেই সন্তান যখন চেষ্টা করে স্বপ্নটাকে সত্যি করতে তখন তার থেকেও হয়তো বেশি মেধাবীরা তাকে পিছনে ফেলে ভর্তি যুদ্ধে এগিয়ে গিয়ে সেই স্বল্প সংখ্যক আসন জিতে নেয়।তখন ওই সব পরিবার এবং যাকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা সেই শিক্ষার্থীর কি পরিণতি হয় ভেবে দেখার কেউ নেই।হয়তো কেউ কেউ বলবেন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে কারো জীবন বৃথা হয়ে যায় না। তা হয়তো ঠিক কিন্তু যে হত দরিদ্র কৃষকের ছেলেটি সরকারী মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল সে নিশ্চই ক্ষমতা রাখেনা বেসরকারীতে পড়ার। কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে ডাক্তার হওয়ার সুযোগ দেওয়ার  ক্ষমতা রাখেনা।

আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল পরিবার হয়তো তাদের সন্তানদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে দেশে বিদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নির্ভর করতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের অগণিত হতদরিদ্র চাষাভোসা দিনমজুরের ছেলে মেয়েদের কি হবে।তাদের স্বপ্ন কি এভাবেই অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যাবে।আগামীর বিশ্বকে মেধার বিশ্ব বলা হচ্ছে। সেই বিশ্বে টিকে থাকতে হলে মেধার অবমূল্যায়ন রোধ করতেই হবে।আর সে জন্য দরকার শিক্ষা খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ এবং আরো বেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।পদ্মাসেতুর মত বড় প্রকল্পের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন বৃদ্ধির দিকেও তাই নজর দেওয়া উচিত।সেটা না করতে পারলে সবার অগোচরে ফুটে ঝরে যাওয়া কোন সুগন্ধী ফুলে মতই হয়তো ঝরে যাবে হাজার হাজার অমিত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী। সেই সাথে ক্রমাগত ভাবে স্বপ্ন ভাঙ্গার মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে।

……………………………………………………

২০ মে ২০১৬,দৈনিক ইত্তেফাক।

116 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Most Popular