বাড়ির নাম “মায়ের ছায়া” আহ দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায়। রোজ যাওয়া আসার সময় বাড়িটির নাম ফলকে চোখ আটকে যায় আর ভাবি এই বাড়ির মালিক তার মাকে কতইনা ভালবাসে।
একদিন বাড়ির গেটটা খোলা ছিল আর বাইরে খেলা করছিল বার তের বছরের এক ছেলে। মনে হলো ও বাড়িরই ছেলে। এখনকার সময়ে হুট করে কারো সাথে কথা বলা বিপদজনক। বিশেষ করে ছোটদের সাথে কথা বলা আরো রিস্ক। বাপ মা এবং অন্যরা ধরেই নেয় ছোটদের সাথে বড়রা কথা বলা মানেই হয় সে ছেলে ধরা নয়তো……!!!!
ছেলেটা তার এক বন্ধু কিংবা প্রতিবেশী ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলছিল। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে খেলা দেখলাম। ওদের খেলা দেখলে নিশ্চই কেউ কিছু মনে করবেনা বরং ওরাই বেশি খুশি হবে। হুট করে একবার বলটা আমার কাছে চলে আসলো। কুড়িয়ে সোজা বলটা না দিয়ে আমি বললাম বল করি তুমি মারো?
ছেলেটা রাজি হলো।এমন ভাবে বল করলাম যেন ছেলেটি বল মারতে পারে। সত্যিই ও বল মারলো এবং খুশি হলো। পরের বলটাও আমাকেই করতে দিল এবং তার পরেরটাও। ক্রিকেট বল দিয়ে তার সাথে বলা চলে ক্ষণিকের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
এক জীবনে আর কখনো দেখা হবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। উদ্দেশ্য ছিল ওর সাথে কথা বলা। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম এই বাড়িটি কি তোমাদের? সে হ্যা বললো। আমি বললাম তোমার বাবা কি তোমার দাদিকে খুব ভালবাসে? কে কে থাকে তোমাদের বাসায়? দাদিও নিশ্চই তোমাদের খুব ভালবাসে।
প্রশ্ন শুনে খেলা ছেড়ে ছেলেটা কথা বলতেই আগ্রহী হয়ে উঠলো। বললো: না না বাসায়তো দাদি থাকেইনা! জানেন দাদি আমাদের খুব আদর করতো….আমি বললাম করতো বলছো কেন? এখন করেনা? ছেলেটি বললো দাদি থাকলেতো আদর করবে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম দাদি মনে হয় মারা গেছেন। বার তের বছরের ছেলেটি কি আমার মনের কথা পড়ে ফেলেছিল? নাকি অনেক মানুষের একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মনের ভাব বুঝতে পারছিল? সে বললো, না না দাদিতো বেঁচেই আছেন তবে আমাদের সাথে থাকেন না। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি দাদি আর নেই। বাবা কিছু বলেন না মাও বলেন না। পরে ফুলি খালা মানে আমাদের কাজের মহিলার কাছে জানতে পারলাম দাদিকে নাকি বৃদ্ধাশ্রম নামক একটা জায়গায় রেখে এসেছেন।
দাদিকে আমার খুব মনে পড়ে। কিন্তু দাদির সাথে দেখা হয়না কথাও হয়না। আমি বললাম তুমি জানো বৃদ্ধাশ্রম কি জিনিস? ছেলেটি বললো: ফুলি খালার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বললেন বৃদ্ধাশ্রম হলো বয়স্ক মানুষদের থাকার জায়গা। সেখানে নাকি বয়স্করা খুব আরামে থাকে।
সরল মনের ছেলেটির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে কেপে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু চিন্তা করেছ?
ছেলেটি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। বললো আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভাল না। তাই বেশি ভাল চাকরি পাবনা হয়তো। তাই বাবা মা যখন বৃদ্ধ হবে তখন তাদের যত্ন যদি না করতে পারি? তাই তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো। কারণ ফুলি খালা বলেছেন বৃদ্ধাশ্রমে নাকি বৃদ্ধরা রাজার হালে থাকে।
একবার আমি ছেলটির সরল মুখের দিকে তাকাই আরেকবার তাকাই বাসার নেম প্লেটের দিকে। যেখানে খুব যত্ন করে পাথর খোদাই করে লেখা আছে “মায়ের ছায়া”
আর ভাবি সেই হতভাগা বাবার কথা যে তার বাড়ির নাম রেখেছে “মায়ের ছায়া” অথচ সেই মায়ের ছায়াঘেরা বাড়িতে মায়েরই ঠাই হয়নি। মাকে রেখে এসেছে বৃদ্ধাশ্রমে। যার ছোট্ট ছেলেটিও তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার কথা ভেবেই রেখেছে যদিও সে জানেনা বৃদ্ধাশ্রম কি যদিও তার বয়স কেবল মাত্র তের বছর।
…………………….
১২ মার্চ ২০১৬
উত্তরা,ঢাকা-১২৩০