সাত খুন মাফ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু বাস্তবে কেউ কোন দিন দেখেছেন এটা? হু এটা আমি দেখেছি।আমার সাথে আরো অনেকে দেখেছে। মানে যারা ক্যাডেট কলেজে পড়ে তারা অন্তত দেখেছে। আজ সেরকমই একটা গল্প শোনাতে এলাম।
রাজপুত্রের মন খারাপ। মন খারাপ তার কারণ এবারই সে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে। চাইলে এটা নিয়ে সে প্লাকার্ড হাতে ফেস্টুন মাথায় বেঁধে পদযাত্রা করতে পারে। কিন্তু এমন একটা সময় চলছে যে রাজপুত্রর সেটা করা সম্ভব হচ্ছেনা। গত বছর এই দিনটার কথা তাই বার বার রাজপুত্রর চোখে ভাসছে। এটা একটা বিশেষ দিন। এই দিনেই সে ভুবন আলো করে তার মায়ের কোলে ঠাই নিয়েছিল। আজ রাজপুত্রর জন্মদিন। জন্মদিনটা এবার বোধ হয় খুব সাদামাটাই হয়ে যাচ্ছে।
অথচ এইতো গত বছর জন্মদিনে কলেজে কত কিছুইনা হলো। তার একটা ফিরিস্তি দেওয়াই যেতে পারে।
আমি আর আমাদের রাজপুত্র একসাথেই পড়ি।মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ। বিদ্যাই বল কথাটিকে বুকে ধরে এক একটা দিন পার করছি। রাতে লাইটস অফের ঘন্টা বাজার পর সবাই যখন একটু একটু করে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে আমি দেখলাম রাজপুত্র তখনো জেগে আছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই সে বললো নারে একটু পরে ঘুমাবো। কি কারণে যেন আমারও ঘুম আসছিলনা। আমাদের এই রাজপুত্রর নাম প্রান্ত। প্রন্ত নামটা ঘরে বাইরের কিন্তু বনেদি নাম শাশ্বত। ক্যাডেট শাশ্বত।
আমি দেখলাম ও ডায়েরি নিয়ে কি যেন লিখছে। ডায়েরি লেখার মধ্যে আমি নেই। ঘুমাতে চেষ্টা করতেই ঘুম নেমে আসলো চোখে। কিন্তু বারটার কিছু আগেই কেন জানিনা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আমি দেখলাম ও তখনো জেগেই আছে। আমি অবাক হলাম। ভোর হতে না হতেই যেখানে ব্যস্ততম দিন শুরু হবে সেখানে না ঘুমিয়ে জেগে থাকার সুযোগ কোথায়। আমি যে জেগেছি তা ওকে বুঝতে দেইনি।
ঠিক বারটা বাজার এক দু মিনিট আগে ডায়েরিটা বন্ধ করে ও উঠে দাড়ালো।কাবার্ড(আলমারী) থেকে খুজে পেতে একটা ছোট্ট আয়না বের করলো। আয়নাটা নিজের সামনে ধরে রেখে শোনা যায়না এমন আস্তে করে বললো হ্যাপি বার্থডে টু মি!! আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। আরে তাইতো আজতো শাশ্বতর জন্মদিন আর শালা আমি ভুলেই গেছি। অন্যরাও ভুলে বসে আছে! বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ও হকচকিয়ে গেল।আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম হ্যাপি বার্থডে শাশ্বত। সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো। সম্ভবত আমি একটু শব্দ করেই বলে ফেলেছিলাম। আরো একজন দুজন জেগে উঠলো। তবে তারা কিছু বুঝতে পারেনি কি ঘটছে।
সকালে ড্রেস ইন্সপেকশানের ফল ইন।আমরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছি।আগের রাতেই ঘুমানোর আগে আমি সব ঠিকঠাক করে রেখেছি।জুতা মেটাল পলিশ করে রেখেছি। হঠাৎ শাশ্বতকে হাক ছাড়লেন স্টাফ। এই আপনার জুতা পলিশ নেই কেন?শেভ করেন নাই,মেটাল পলিশ নাই,ভেস্ট পরেন নাই। ফ্রন্টরোল,শুরু করেন ফ্রন্ট রোল। ওদেখি বিপদে পড়ে গেছে। আমার হঠাৎ মনে পড়লো আরে আজতো ওর বার্থ ডে। আমি হাত উচিয়ে বললাম স্টাফ,বাদ দেন আজকে। আজকে ছেলেটার বার্থ ডে! স্টাফের মনটা মোমের মত গলে গেল। আরেকটু হলে পানি হয়ে গড়িয়ে যেত। তিনি বললেন আচ্ছা যান আজকের মত মাফ করলাম। তবে কাল থেকে কিন্তু এ গুলো চলবেনা বলে দিলাম।
আমি সময় মত পিটিতে অংশ নিলাম। কিন্তু শাশ্বত সেদিন কিভাবে কিভাবে যেন পিটিতে লেট করলো। সারা বছর ও কিন্তু পিটিতে লেট করেনা কখনো। স্টাফ পিটিতে লেট করে আসার জন্য ওর নাম নোট করতে গেল। আমি বললাম না না স্টাফ ওর নাম আজকে নোট করেন না। আজ ওর বার্থ ডে! স্টাফ বললেন ঠিক আছে যান বার্থ ডে বলে নাম নোট করলাম না।
ক্লাস রুমে বসে আছি।শাশ্বত আমার পাশের রোতে বসা।ফিজিক্স স্যার ক্লাস নিচ্ছেন।শাশ্বত বললো স্যার টয়লেটে যাব। ফিজিক্স স্যার আবার ইংরেজী ছাড়া কথাই বলেন না।তিনি বললেন নো ভিজিটিং টয়লেট ইন মাই ক্লাস! ইংরেজী শুদ্ধ অশুদ্ধ নিয়ে তিনি কখনো মাথা ঘামান না।এখানেও আমার বাম হাত ঢুকাতে হলো।বললাম স্যার যেতে দিন। আজকে ওর বার্থ ডে। স্যারের মুখটা থমথমে ছিল কিভাবে কিভাবে যেন সেটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত নরম হয়ে গেল। তিনি বললেন যাও। মনে করো আমার পক্ষ থেকে এটা তোমার জন্য বার্থডে ট্রিট।মনে মনে হাসবো না কাদবো বুঝলাম না।টয়লেটে যেতে দেওয়াও যদি বার্থ ডে ট্রিট হয় তাহলে আর বাকি থাকলো কি!
গেমস টাইমটা অসাধারণ কাটে আমার। অন্যদেরটা জানিনা।সকাল থেকে শাশ্বতর বার্থডে উপলক্ষে আমার বার বার বামহাত ঢুকাতে হচ্ছে।আমি মনে মনে প্রস্তুত হলাম গেমস টাইমেও নিশ্চই কিছু না কিছু ঘটবে। এবার মড়ার উপর খাড়ার ঘা। গেমসের সময় অ্যাডজুটেন্ট হাক ছাড়লেন শাশ্বতকে দেখে। ইউ ব্লাডি ইডিয়ট। হোয়াট ইজ দ্যা কন্ডিশান অফ ইওর পিটি স্যু? গো গেট আ শেল। আমি ভাবছিলাম আর একটুর জন্য ওকে না দুটো ইডি দিয়ে দেয়। অ্যাডজুটেন্টের সামনে কথা বলার মত সাহস কজনের আছে?কি জানি কি হলো হাত উচু করলাম।
বললাম স্যার আজকে ওর বার্থ ডে.. ভেবেছিলাম এবার নির্ঘাত আমাকেই এক্সট্রা ড্রিল দিবে। স্যার বললেন সো…..? গো ব্লাডি হারিআপ। এবার আর বাম হাত ঢুকিয়েও শাশ্বতকে বাচাতে পারলাম না। পানিশমেন্ট খাওয়ার পর অ্যাডজুটেন্টের মুখের দিকে তাকানোর সাহস ওর ছিলনা। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম অ্যাডজুটেন্টের মূখে হাসি ফুটে উঠেছে। তিনি বললোন ইউ বার্থডে বয় কাম হেয়ার এবং গো টু ক্যাফেটেরিয়া এন্ড এনজয় হোয়াট ইউ ওয়ান্ট।ট্রিট ইজ অন মি। অ্যাডজুটেন্টের কথা শুনে তিন কোটি ওয়াটের বাল্বের মত শাশ্বতর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যদিও তিনকোটি ওয়াটের বাল্ব টমাস আলভা এডিসন কেন তার চৌদ্দপুরুষও কল্পনাও করতে পারবেনা।
আহা কলেজে বার্থডে হওয়ার কত সুবিধা। সাত খুন মাফ বলে যে কথা আছে এটা তার থেকে কম কিসে?
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শাশ্বত বিড়বিড় করে বললো জীবনের সেরা জন্মদিন ছিল এটা।কিন্তু সকাল থেকে রাত অবধী আমি যে তার জন্য এতো কিছু করলাম সে একটুও সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো না।আমরা শুধু মনে মনে ভাবি ইস কেন যে কলেজে বার্থডেটা পড়েনা।
সেই রাজপুত্রটার আজকে জন্মদিন। সে এখন কলেজে নেই তাই জানিনা তার গত বছরের জন্মদিনের কথা মনে আছে কিনা।শুনেছি আজ সন্ধ্যায় ওয়েস্টিনে এক জমকালো জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে রাজপুত্রর।আমাকে জানায়নি সে। জানানোর প্রয়োজনও নেই বোধ করি।কারণ আজকের পার্টিতেতো কেউ মেটাল পলিশ নিয়ে কথা তুলবেনা কেউ টয়লেটে যেতে নিষেধ করবেনা,কোন স্টাফ ফল ইনে দেরি করার ওযুহাতে নাম লিখে নেবেনা।তাই সেখানে আমার থাকা আর না থাকা সমান।
আমাকে দাওয়াত দেয়নি বলে আমার মনখারাপ তা কিন্তু নয়।আমি আমার মত আছি। সে যদি যেতে বলে আমি যে কোন সময় যেতে প্রস্তুতি আছি। সন্ধ্যার কিছুক্ষন পর আমার ফোনটা বেজে উঠলো।স্ক্রিনে ওর নামটাই দেখতে পেলাম।রিসিভ করে শুভজন্মদিন বলতেই আহ্লাদে গদগদ হয়ে ও বললো শোন তেমন কিছু করা হচ্ছেনা ছোটখাট একটা পার্টি দিচ্ছি।আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি তুই চলে আয়।মনে মনে এতো বেশি খুশি হলাম যে ওর বিগত দিনের সব ভুল এবং আগামীতেও যত ভুল করবে তা অগ্রিম মাফ করে দিলাম।আহ দোস্তর জন্মদিন বলে কথা।
আমি আম্মুর কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে একটা ভাল ব্রান্ডের পারফিউম কিনলাম।অপেক্ষায় আছি ওর গাড়ির জন্য।বাইরে থেকে উচু গলায় কেউ একজন ডাকলো নাম ধরে।গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারলাম এটা সাদমান ছাড়া কেউ নয়।শাশ্বত তাহলে সাদমানকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়েছে আমাকে নিয়ে যেতে! নিজেকে ভিআইপি ভাবতে ইচ্ছে হলো। গায়ে তিন পদের সেন্ট মেখে ওর জন্য কেনা গিফটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি সাদমানই দাড়িয়ে আছে।
কাছে যেতেই বললো বাড্ডি দারুন পার্টি হবে আজকে।আসে পাশে তাকিয়ে কোথাও কোন গাড়ি পেলাম না।সাদমানের সাথে একটা ফনিক্স সাইকেল। সেই সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে চলেছি শাশ্বতর জন্মদিনের পার্টিতে। যে পার্টিটা সে আয়োজন করেছে ওয়েস্টিনে।কিন্তু ভেবে পাচ্ছিনা উত্তরা থেকে এই লক্কড়ঝক্কড় সাইকেলে করে কতক্ষণে ওয়েস্টিনের পার্টিতে যেতে পারবো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা বাসার সামনে থামলো সাদমানের সাইকেল।দেখি গেটে দাড়িয়ে আছে তুর্য।আমি বুঝে উঠতেই পারিনি সাদমান কেন আমাকে এখানে নিয়ে আসলো আর তুর্যইবা এখনো এখানে দাড়িয়ে আছে কেন। পরে ভাবলাম মনে হয় এখান থেকে সবাই মিলে কোন পাজেরো মার্সিডিজ বা অন্য যে কোন গাড়িতে করে আমরা পার্টিতে যাব।তুর্য আমার কাধে হাত রেখে বললো দোস্ত আজকে সেই মজা হবে।আমি মনে মনে খুশিই হলাম।রুমে ঢুকতেই দেখি শাশ্বতর আম্মু।
আন্টিকে আমি আগে থেকেই চিনি।তার মানে এটা শাশ্বতদের বাসা!তাহলে যে সবাই বললো ওয়েস্টিনে পার্টি হবে।আমি কিছু বললাম না। রাত সাড়ে দশটার দিকে আমরা বাসার ছাড়ে উঠলাম।মনে পড়ে ফজলুল হক হাউজের ছাদে উঠে আমরা কত কি করতাম। ছাদে বিশাল একটা পাটি পেতে দেওয়া আছে সেখানেই বসে আছে শাশ্বত।যার জন্মদিন সে।ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওর জন্য আনা গিফটটা ওকে দিলাম। খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিল।একটু পরেই আন্টি একটা কেক নিয়ে উপরে আসলেন।আমরা কেক কাটলাম জন্মদিনের।এর পর একটা টিনের জারে মুড়ি আর চানাচুর দিয়ে গেলেন।সেই টিনের জারটা ছিল খুবই পুরোনো এবং জং ধরা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম বাহ শাশ্বত এই তাহলে তোর ওয়েস্ট টিনের পার্টি!!!!!!!তুর্য সাদমান সহ বাকিরা হেসে উঠলো। আকাশে তখন জোছনারা খেলা করছে। আমার কেন যেন মনে হলো আমরা শাশ্বতদের বাসার ছাদে নই আমরা ফজলুল হক হাউজের ছাদে ক্যাডেটদের প্রিয় থেকে প্রিয়তর মুড়ি চানাচুর পার্টি করছি।কলেজে কারো জন্মদিন মানেই যেটা ছিল অবধারিত।পার্টি শেষে সেদিনও শাশ্বত বললো জীবনের সেরা পার্টি ছিল এটা।আমি জানি বাকি জীবনে যতবার ওর জন্মদিন আসবে সে সেই জন্মদিনটাকেই আগের জন্মদিনের চেয়ে সেরা বলবে।
বলুকনা বলতে তো দোষ নেই। কদিন পর ক্লাস ইলেভেনে কলেজে গিয়ে এবারের জন্মদিন নিয়ে গল্পের ঝুলি খুলে বসবে তুর্য আর সাদমান।আমি তখন ভাব করবো যে আমি কিছু জানিইনা।আর চমকে উঠে বলবো ওর জন্মদিন ছিল?ওহহোরে দেখ আমি কত্ত বড় ইডিয়েট যে ওকে শুভেচ্ছা জানাতেই ভুলে গেছি। এই শাশ্বত এই প্রান্ত এই রাজপুত্র শুভজন্মদিন!