আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে প্রতিনিয়ত নানা রকম ঘটনা ঘটে। অনেক অন্যায়,অবিচার,অনিয়ম ঘটে। আবার ভালো কাজও হয়ে থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের সমাজের মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই ধারাটা খুবই চোখে পড়ে। তবে যে কথা যাদের বলা উচিৎ তারা সাধারণত বলে না। যে লেখা যাদের লেখা উচিৎ তারা তা লেখে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখি যোগ্যতম মানুষটি ক্ষেত্রবিশেষে নিরব ভূমিকা পালন করে। যোগ্য মানুষটি যখন নিরব ভূমিকা পালন করে,নিশ্চুপ থাকে, তখন আমার মত সাধারণ মানুষ সেই ঘটনা বা বিষয় নিয়ে কথা বলে,লেখে,বিবৃতি দেয়। ফলে দেখা যায় কথাগুলো যেমন হওয়ার কথা থাকে তা হয় না। লেখাগুলো যেমন হওয়ার কথা তা হয় না। এবং আমাদের লেখা বা বলার মাধ্যমে আদতে ওই ঘটনাগুলোতে তেমন কোনো ফল দেয় না, কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। হয়তো বন্ধু তালিকায় থাকা দু’চারজন সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে এর বেশি কিছু না। কিন্তু আমরা যাদের বিষয়ে আশা করি যে তারা যদি ওই একই বিষয় নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করতেন তবে কতইনা ভালো হতো। তাহলে আর আমাদের মত সাধারণ মানুষ নিজের মত করে মনগড়া উক্তি বা মতবাদ প্রচার করতো না বা করার প্রয়োজন হতো না। কোনো একটি অন্যায় সংগঠিত হলে তার সমাধানকল্পে সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী,জ্ঞানী,বিশেষজ্ঞ তাদের যথেষ্ট ভূমিকা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।
আমাদেরও একটা সময় ছিলো যখন পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় যা লেখা হতো তা সংশ্লিষ্ট মহল গুরুত্বের সাথে দেখতো এবং সেগুলো আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতো। টেলিভিশন টকশোতে বা কোথাও প্রতিবাদ মিছিল হলে তা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। যৌক্তিক দাবীদাওয়ায় যখন সুশীল সমাজ একাত্ত্বতা ঘোষণা করতো তখন সংশ্লিষ্ট মহল তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতো। কিন্তু সেই যুগ অতীত হয়ে গেছে। এখন আমরা দেখি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে গেছে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একদল যে পক্ষ নেয় অন্য দল বিরোধীতা করে, বিরোধী যুক্তি দেয়। ফলশ্রুতিতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আবার অনেক সময় আমরা দেখি একই রকম দুটি ঘটনার একটিতে যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে অন্যটিতে তা দেখাচ্ছে না। অথচ দুটোই অন্যায় এবং প্রতিবাদ করতে হলে দুটোর বিষয়েই করতে হবে। আজ আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। সাদা দল, নীল দল সহ আজ কত রকম দল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে সব সময় কাজ করে। দলীয় এজেন্ডার বাইরে কেউ যৌক্তিক কথা বললেও তার বিরোধীতা করে,অসহযোগ মনোভাব দেখায়। এতে হয়তো তারা দলীয় নেতাদের কাছে বা হাইকমান্ডের কাছে বাহবা পায় কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে তা অনেক বাজে প্রভাব ফেলে। সেই একই মানুষ যখন ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখন তাদের ন্যায্য দাবিও একই ভাবে সেই সময়ে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা অবজ্ঞা করে বা দমিয়ে রাখে। এর ফলে দেখা যায় যখন যেই দায়িত্বে থাকুক না কেন ক্ষতিটা পুরো জাতির হয়।
শুধু সুশীল সমাজই নয় একই সাথে রাষ্ট্রের শক্তিশালী স্তম্ভ তথা সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়ার ভূমিকাও এখন শতভাগ প্রশ্নবিদ্ধ। অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকা,টিভি চ্যানেলের সংবাদ শিরোনাম দেখলে ন্যুনতম জ্ঞান আছে এমন সবাই বুঝবে হলুদ সাংবাদিকতা কাকে বলে। গত কয়েক বছর এর হার বেড়েছে অনেক বেশি। আমরা যদি প্রতিদিনের মিডিয়ার সংবাদ শিরোনামগুলো দেখি এবং তাদের কার্যকলাপ দেখি তবে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখনতো অনেকে তাদের কার্যক্রম দেখে হাসাহাসি করে তাদেরকে ইমেরিটাস সম্পাদক বলে আখ্যায়িত করে থাকে। তারা যদি একটি নির্দিষ্ট দলের তাবেদার হয়ে কাজ করে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করে তবে সেই গোষ্ঠী বা দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকবে তখন তাদের অবস্থা কেমন হবে তা কিন্তু এখনকার সময়েই দেখা যায়। এক সময় অন্য দলের হয়ে কাজ করা মিডিয়াগুলোর বর্তমান হাল নিশ্চই কারো অজানা নয়। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ ঠিক কী আশা করতাম? আমরা চাইতাম রাষ্ট্রের এই শক্তিশালী স্তম্ভটি সব সময় নিরপেক্ষ থাকুক। লেখকের কলমের ধার অক্ষুন্ন থাকুক। সাংবাদিকের কলম আর মুখ নিরন্তর ভাবে যেন কারো গোলামী না করে একনিষ্ঠ থাকে ন্যায়ের পথে। তবেইতো কেউ ক্ষমতার মসনদে বসে অন্যায় করতে গেলে কেপে উঠবে, ভয় পাবে, ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ ফেলবে। আর যখন তারা জানবে ” আমার বাড়ি আমি মেম্বর আমার বউ চেয়ারম্যান” তথা আমরা যা কিছু করবো তার জন্য কেউ আঙ্গুল তুলবে না, কলম ধরবে না,প্রশ্ন করবে না। ফলে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। তখন তারা যা খুশি তাই করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি আমাদের সমাজে এমনটি হতে দেখছি প্রতিনিয়ত।
অন্যায় জেনেও চুপ থাকছে অনেকে যাদের কথার ওজন ছিল অনেক বেশি। যাদের কথার এবং লেখার ওজন অনেক বেশি ছিল তারা সবাই কিন্তু এমনি এমনি চুপ হয়নি। একটু একটু করে সেই শ্রেণীর অনেক মানুষ যখন বিভিন্ন দলের তাবেদারি করতে শুরু করে তখন অল্প সংখ্যক নিরপেক্ষ ওজনদার মানুষ আর একা কিছু বলার সাহস পায় না। কারণ কিছু বললে তাদের অস্তিত্বই থাকবে না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা চুপ থাকে। এর মাঝেও অবশ্য দুই চারজন কথা বলে। কিন্তু যখন অসংখ্য গাড়ির হর্ণের শব্দের মাঝে কেউ একা বাঁশি বাজায় তখন সেই বাঁশির সুর আর সুমধুর হয় না এবং আলাদা করে কারো কানে বাজে না। এর বাইরে ন্যায্য কথা বলতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব হারানো,প্রিয়জনকে তাদের প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা দেওয়ার ভয় থেকেও চুপ থাকে। আমি বলি মাথা বিক্রি করে দেওয়া। সাস্টের সম্মানিত শিক্ষক আব্দুল হামিদ স্যারের একটা বই আছে “ মস্তিস্কের মালিকানা”। আমি বলি আমাদের দেশের অনেকেরই মস্তিস্কের মালিকানা আর তার নিজের হাতে নেই!
সাম্প্রতিক সময়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা নিয়ে আমরা অর্বাচীনরা কথা বলেছি। প্রতিবাদ করেছি। আমাদের মত করে বুঝে বা না বুঝে আলোচনা সমালোচনা করেছি। আমাদের সেই বলায়,সেই প্রতিবাদে তেমন কিছু হয়নি কারণ আমরা প্রভাববিস্তার করার মত কেউ নই। ফলে অনেক গুলো শক্তিশালী হাত যখন এক হয়ে কোনো একটি ন্যায়কে অন্যায় বলে চেপে ধরে তখন ন্যায়ও তাদের সামনে থমকে দাঁড়ায়। আমরা আসলে সত্যের পক্ষে নেই। আমরা আজ দলীয়করণে এতোটাই লিপ্ত হয়ে পড়েছি যে নিজ মতাদর্শী হলে সে অন্যায় করলেও তাকে সমর্থন যোগাই,বাহবা দেই। আর ভিন্নমতাবলম্বী হলে সে ন্যায় সংগত হলেও আমরা তার বিরোধীতা করি। এভাবেই আমাদের সমাজের অবক্ষয় চলছে। এভাবেই আমাদের সমাজকে আমরা ক্রমাগতভাবে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কবে আমরা সেই সব মানুষের কলম থেকে ন্যায়ের পক্ষে শব্দের পর শব্দ সাজাতে দেখবো। কবে আমরা সেই সব ওজনদার মানুষের পক্ষ থেকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদী কন্ঠ শুনবো? আমার আশা করতে ইচ্ছে করে কিন্তু আজ আর আশা করার সাহস দেখি না। ওজনদার মানুষদের নিরবতা পালন করা দেখে,চুপ থাকতে দেখে অভিমান হয়। নিজেকেই তাই যতটা পারি ওজনদার মনে করে কথা বলি,লিখি,প্রতিবাদ করি। কিন্তু সেই কথায়,সেই প্রতিবাদে তেমন কোনো ফল হয় না। কোনো পরিবর্তন আনতে পারি না। কারণ আমার চারপাশে যারা আমার চেয়ে ওজনদার তারা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে চাপা দেয়। তাই আমাদের মত অভাজনদের দুঃখ করা ছাড়া কিছুই থাকে না। আক্ষেপ নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে হয় “ অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ” সেই সাথে মনে মনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার লাইন বলে নিজেকে সান্তনা দিতে হবে “নিশ্চল নিশ্চুপ! আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিঁধুর ধু “
- জাজাফীর দিনলিপি
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩