রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। প্রতি বছরের মত এ বছরও পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ ঘিরে অনেক আলোচনা সমালোচনা চলছে। এ বছর একটু বেশিই হচ্ছে কারণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে হাইকোর্টে রীট করা হয়েছে।মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ০৯ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনও সম্পর্ক নেই।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।
তাই নোটিশ পাওয়ার পর ‘অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত’ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
যারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙ্গালীর ঐতিহ্য বলছেন,হাজার বছরের সংস্কৃতি বলছেন তাদেরকে দুই চার কথা বলতে চাই এবং প্রশ্ন রেখে যেতে চাই। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে যতটুকু বুঝেছি পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ আমাদের বাঙ্গালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি হলেও তথাকথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো ভাবেই আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয় এবং এর হাজার বছরের ইতিহাসও নেই।
বৈশাখী উদযাপনের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখে যশোরে। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। আর সেই শোভাযাত্রায় অশুভের বিনাশ কামনা করে শুভশক্তির আগমনের প্রার্থনা করা হয়। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে যশোরে চলে যান তিনি। যশোরে গিয়ে চারুপিঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত যশোরে সীমাবদ্ধ থাকেনি মঙ্গল শোভাযাত্রা।
১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে ঢাকার চারুকলা থেকেও শুরু হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুতে এর নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখেই এমনটা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবেই পরিচিত হয়।
সেই শোভাযাত্রার মূলভাব ছিল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিনাশ। ওই সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সে সময় সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সবার প্রচেষ্টায় তখন এটি বৃহত্তর প্রচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হলো। ১৯৮৫-৮৬ সালের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা। শিক্ষকরা পেছনে ছিলেন, কিন্তু সব কাজ হয়েছে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। এখন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণে একটি প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ষাটের দশক থেকে রমনা বটমূলে গানের মাধ্যমে বৈশাখী উদ্যাপন শুরু করে। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) ঢাকায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করে। যার উদ্যোক্তা ছিল চারুকলার ১৯৮৬ ব্যাচ।
আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, মানুষ যখন তার খর্বিত মৌলিক, মানবিক অধিকার আর বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য সোচ্চার, ঠিক এই সময় হতাশা-যন্ত্রণার মাঝে আনন্দের দীপশিখা জ্বালিয়ে আশার বাণী শোনাবার জন্য চারুকলার ১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষের কিছু তরুণশিল্পী বৈশাখী উৎসবের মধ্য দিয়ে একটি আনন্দ-উদ্দীপনা আনতে প্রয়াসী হয়। ১৯৮৯ সালের ১ বৈশাখে ঢাকা শহরে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার সূচনা হয়। তার আগে ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এই গ্রুপের নেতৃত্বেই জয়নুল জন্ম উৎসব ৮৮-এর আনন্দ শোভাযাত্রার সূত্রপাত ঘটে। তবে বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৬ সালে ১ বৈশাখে শোভাযাত্রার সূত্রপাত ঘটায় যশোরের চারুপীঠের শিল্পী এবং শিক্ষার্থীরা। চারুকলা ইনস্টিটিউটের (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং বর্ষবরণের উৎসব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয় পর্যায়ে রূপলাভ করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে উপাচার্য অধ্যাপক আবু ইউসুফ স্যারের সময়। একটি বড় বাঘ ও বক, অনেক ঘোড়া এবং মুখোশ বানানোর দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক আলপ্তগীন তুষারের ওপর, যা ছিল তার ঢাকা চারুকলার অভিজ্ঞতার ফসল।
ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি সংস্কৃতিক বলয় তৈরির জন্য শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান স্যার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে কাজ করেছিলেন। সেই লক্ষ্যে শিল্পী নাজমা আক্তারের পরিকল্পনা এবং ভিসি স্যারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ খুলে আলপ্তগীন তুষারকে চট্টগ্রাম থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সিনিয়রিটির নিয়ম মেনে অর্পণ করেন। ২০১৪ সালে একটি বাঘ এবং বক তৈরি করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ। সেটা নিয়ে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৫ সালে পরাক্রমশালিতার প্রতীক হিসেবে বড় একটি হাতি বানানো হয়েছিল। এসব তৈরির মূল দায়িত্ব পালন করেন আলপ্তগীন তুষার। সঙ্গে সহযোগিতা করেন সহকর্মী শিল্পী রশিদ আমিন, রেজাউল সাদাত, ইমাম হোসেন সুমন এবং চারুকলার ছাত্রছাত্রী।
১৩ এপ্রিল ২০২৩