কবিতার ক্লাশে বসে তোমাকে খুঁজেছি শুধু ।কবির ভাষায় তিনি যাকে খুঁজেছেন সে হয়তো কোনো অপ্সরা,আফ্রোদিতি,স্বপ্নের রাজকুমারী।কিন্তু পাঠকমাত্রই কবিতার ক্লাসে কবির কবিতায় বুদ হয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও একটি বার কবির মুখ কল্পনা করে।বিস্মত চোখে কবির লেখা কবিতার প্রেমে পড়ে বারংবার। বাংলা কবিতার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস যা অন্যান্য অনেক ভাষার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে কম।ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলা কবিতার প্রধান যে কয়জন কবির নাম সবার আগে চলে আসবে তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একজন। বাংলা কাব্যজগৎ প্রধানত রবীন্দ্রনাথকে ভিত্তি করে উঠে দাঁড়িয়েছে এমন কথাও সাহিত্যবোদ্ধাদের মুখে হরহামেশাই শোনা যায়। কেননা তিনিই বিশ্ব দরবারে বাংলাসাহিত্য তথা বাংলা কবিতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা কাব্য বিশ্বদরবারে খুব বেশি পৌঁছাতে পারেনি।হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত না হলে বাংলা সাহিত্য বিশ্ব দরবারে যতটা পরিচিত হয়েছে তার সামান্য অংশও পরিচিতি পেতো না। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের কাছে বাংলা সাহিত্যের অনেক ঋণ আছে। রবীন্দ্রকাব্যের এই সাফল্য এবং অবদানের কথা স্বীকার করে নিলেও আমাদেরকে বলতে হবে বাংলা কবিতাকে হাঁটতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্র-পরবর্তী ষাটের দশকের কবিরা। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র কাব্যভাষার মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে করেছেন সমৃদ্ধ,পাঠকপ্রিয়। শহীদ কাদরী,শঙ্খঘোষ,বিনয় মজুমদারেরা তাই বহুল পঠিত।
আধুনিক বাংলা কবিতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। ষাটের দশকের ‘রেনেসাঁ’ ছাড়া আমরা বিশ্বতালে তাল রেখে চলা শিখতে পারতাম না, আমাদের সেই বিরল আত্মবিশ্বাসটুকু আত্মস্থ হতো না যেটি না আসলে একটি সংগ্রামরত জাতি জগৎ-সম্মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, যেমন পারে না একটি অর্বাচীন বালক ভাব প্রকাশের ভাষাহীন হয়ে সৃষ্টিশীল হতে, শত মেধা থাকা সত্ত্বেও। ষাটের দশকের কবিতার ভুবন, তার শিল্পলোক, সেই বালকটিকে এক মেধাসম্পন্ন জাগতিক সম্ভাবনার একটি আত্মনির্ভর পাটাতন দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একটি জাতি-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়। ষাটের দশকের সেই কবিদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য তাদের একজন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। যিনি তাঁর আপন আঙ্গিকে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন অন্য এক উচ্চতা।তাঁর কবিতা রবীন্দনাথ থেকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত একথা তিনি নিজেও কখনো দাবী করেন নি, আবার এ কথাও কোনভাবেই স্বীকার করা যাবে না যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘রবীন্দ্রানুসারী’ কবি।দরিয়া পাড়ের এই কবি আপন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল,তাঁর কবিতায় এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সুমধুর গাঁথা জয় গান তাকে ’জাতিসত্ত্বার কবি’ সাম্মানে ভূষিত করে। ‘জাতিসত্তার কবি’ উপাধী বিষয়ে আমরা উল্লেখ করতে পারি কবির কবিতার একটি লাইন—
‘যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ’।
একটি মাত্র লাইনের মধ্যেই কত কিছু বলা হয়ে গেছে। অসাধারণ ভাবে অনেক অব্যক্ত কথা ফুটে উঠেছে । নুরুল হুদাকে আমরা অনায়াসেই বহুমাত্রিক কবি হিসেবে সম্মোধন করতে পারি কেননা তিনি কেবল মাত্র কবিতা রচনাই নয় বরং অন্যান্য বিষয়েও অবদান রেখে চলেছেন। তিনি বাংলা কাব্যে স-চেতন কাব্য আন্দোলনের প্রধান সংগঠক । জীবন থেকে পেরিয়ে গেছে সত্তরের অধিক বসন্ত।তবু্ও যেন এখনো তরুণ। যে কোনো তরুণের চেয়ে এখনো তিনি লেখালেখিতে বেশ প্রাণ খুঁজে পান। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানকে কবি নুরুল হুদা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি নির্দ্বিধায় বলেছিলেন নুরুল হুদা বাংলা সাহিত্যের একজন‘গুরুত্বপূর্ণ কবি’ তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প এক অবধারিত চিরসত্য রূপে ধরা দিয়েছে। কবি নূরুল হুদা তাঁর কবিতায় অত্যন্ত শিল্পিতভাবে স্বতন্ত্র্য এক ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তার কবিতার প্রতি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দাবী করেছেন। সেটা তিনি পেয়েও গেছেন এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যেমন জাতীসত্ত্বার কবিতায় তিনি লিখেছেন-
বুনতে বুনতে বেড়ে উঠি, বুনতে বুনতে বুড়ো হয়ে যাই;
আমার অস্তিত্ব জুড়ে অসংখ্য সুতোর দাগ
বুকের গভীরে ঘোরে জন্মস্মর সুতো-কাটা কল
শিরায় শোণিত-স্রোতে
সুতোর মতোন কত শ্বেত শুভ্র নদী
পলিহীন প্লাবনবিহীন
সে নদীতে ভেসে ওঠে নাওয়ের বহর,বুকে তার
হাসন-লালন আর এক তারে বাঁধা লক্ষ সাঁই;
পুনর্বার
এই ডাঙা ছেড়ে যাই শ’খণ্ড স্বদেশ ছেড়ে অখণ্ড স্বদেশে
যাই মূল স্বপ্নে যাই ।
কবির এই কাব্য ভাষায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বিশাল এক ইতিহাস। তাঁর এই কাব্য-নান্দনিকতা কাব্য-পিপাসু মানুষকে প্রাশান্তি দেয় এবং তিনি অনায়াসে জাতিসত্তার কবি বলে সকলের আন্তরিক স্বীকৃতি পেয়ে যান । তিনি আরেক স্থানে যেমন লিখেছেন,
‘ভালোবেসে জীবনকে আনগ্ন চেয়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি
রাজধর্ম পিছে ফেলে পিছে ফেলে গোত্রের আরতি
লোকধর্মে লোকসংঘে সুদীক্ষা নিয়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি ।’
১৯৭২ সালে মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে কবির উৎকর্ষ এবং পরিণতিবোধের স্বাক্ষর রয়েছে যেমন একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
দূরে যাচ্ছো, বৃষ্টিপাত থেকে দূরে যাচ্ছে রিমঝিম পায়
বাজিয়ে শঙ্খের চুড়ি, হাওয়ায় এলিয়ে দিয়ে কালো কেশদাম
ঘুর্ণি নৃত্যে মেতে দূরে যাচ্ছো, দূরে যাচ্ছো তুমিও উর্বশী।
পাঠক মাত্রই এ গ্রন্থে কবির মধ্যে কিছু প্রস্তাবনা দেখতে পারবেন। এই গ্রন্থের কবিতা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে কবির হৃদয়ে প্রেম-বিরহ নস্টালজিয়া থাকলেও কবি তাতে কাতর নন, কবি তাঁর অতীতকে ফিরে আসতে আহবান জানান; তারপর অতীত আর বর্তমানের তফাৎ মহাকালীয় চেতনায় একীভুত করে ফেলেন। যেমন একস্থানে এসেছে:
‘যেখানেই হাত রাখি তোমার শরীর’
সুতরাং ‘সুতনুকা, আজ থেকে তোমাকে বিশাল বিদায়।’
আমাদের মনে হয় কবি কোনো সংকীর্ণ প্রত্যাশা দ্বারা আক্রান্ত নন যদিও কবির দুঃখ বিশাল, চেতনা বিশাল; যেমন এক কবিতায় তিনি লিখেছেন
‘যেন বৃদ্ধ সফোক্লিস
গ্রীসীয় খাড়ির মতো ক্লান্ত,
ভারি পাপড়ি জড়িয়ে অ্যাজিয়ান তীরে এসে দাঁড়ালো হঠাৎ।’
কবি সংকীর্ণ শব্দবন্ধ পরিত্যাগ করে ঐতিহ্যের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন।কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা তাঁর অসংখ্য কবিতায় চিত্রকল্পের ও আর্দশমান নানা উপমান সাদৃশ্য বর্ণনায় দ্যোতিময় করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ আমরা উল্লেখ করতে পারি ‘কোনো বৃক্ষ বিহঙ্গকে’ কবিতার নিম্নলিখিত লাইনগুলি-
“পালক রয়েছে পড়ে, উড়ে গেছে ডানা।
মন আছে, শরীরে উধাও। মধ্যদিন মধ্যরাত কোথায় কখন
হঠাৎ যাত্রার শুরু, কখন যে ট্রেন
নিজেই পালাতে গিয়ে জীবনের সূক্ষ্ম মেমব্রেন
ছিঁড়ে ফেলে চোখা শিঙে জেদী ম্যাটাডোর।
দরোজা খুলতে গিয়ে, দেখা যায়, খোলা আছে দোর।
আবদ্ধ থাকে না;
বৃক্ষের ও রয়েছে পাখা। কোনো বৃক্ষ বিহঙ্গেকে
পেছন ডাকে না’।
কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদার কবিতায় প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে স্বদেশ স্বজাতির বিরল পদচারণর সম্মোহনদীপ্ত কালের মহাজাগরনী শক্তি। ‘দরিয়া চূড়ায়-বাড়ি’ কবিতাটি পড়লে কবির উদ্দাম- উচ্ছাস ভরা জীবনের কিভাবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এবং সে সংগ্রামে তিনি বিজিত হওয়ায় স্বপ্ন দেখেন তাঁর চিত্রলেখা ।
“একটি ঢেউ দুই ঢেউ লক্ষ- কোটি হাজার
ঢেউরের পরে ঢেউ ভাসছে। হাসছে বেশুমার
চলখলবল টলে ওরা, উছলে পড়ে ঘাড়ে
ঘোর বর্ষায় মত্ত ফনায় ছোবল মারে পাড়ে।
জোয়ার যখন ফুঁসে উঠে রোষে ওদের শ্বাস
ক্ষুধার থাবায় হোটেল মোটেল করছে বেকার গ্রাস
ভাটার সময় নিচ্ছে টেনে বেমান দরিয়া
নারী পুরুষ মাটি কাঁকড় সামনে যাকেই পায়।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এ কবিতার মধ্য দিয়ে তার নাড়ীপোঁতা জীবনের উচ্ছ্বাস উদ্ভাসিত হয়। বাংলা কবিতায় তার আগমন প্রাক স্বাধীনতা পর্বে হলেও, উন্মোচন পর্ব স্বাধীনতা উত্তরকালে। সময়ের পথ পরিক্রমায় তার কবিতার প্রকাশভঙ্গির বহুতর ভাঙাচুরা চলেছে, চলেছে বির্নিমাণের ও বিবর্তনের বীক্ষা। স্বাধীন দেশের জাতীসত্ত্বার ভাবনা কবি নূরুল হুদার ভাবনাকে গতিশীল করেছে। দেশ, জগৎ, মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি, নারী নানা রূপ-রস বৈচিত্র্যে প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। এই আঙ্গিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবি নূরুল হুদা নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নিজে হয়ে উঠেছেন কবিতার পাঠশালা। তার কাব্য ভাষা, স্বাতন্ত্র নির্মাণশৈলী তাকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায় যেখানে নুরুল হুদা তার প্রাতস্বিক অবস্থানকে কাব্যকলার উঠোনে জায়গা দিতে পেরেছেন। ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাড়িত কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা শুরু থেকেই তার কাব্য সুষমায় যোগ করেছিলেন ভিন্নমাত্রা। মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ঐতিহ্যকে তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে। তার শিল্পচিন্তা কিংম্বা কাব্যকলার শব্দ নির্মাণ কাঠামোর বিন্যাসি আয়োজন সবখানেই তিনি এগিয়েছেন বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসকে ধরে। যে কারণে দেখি, কবির জন্মস্থানের প্রতি তার যে টান কিংম্বা মৃত্তিকা সংলগ্নতা তাকে তাড়িত করেছে কাব্যকলার মধ্যেও তার জন্মদাগকে তুলে ধরার নিরন্তন প্রয়াস। যে কারণে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমরা সশস্ত্র শব্দবাহিনী’ এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’-এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতারগুলোর দিকে তাকালেই আমরা দেখি জাতিসত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে উঠে এসেছে। তার কবিতার অনন্য বিষয় বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণে তার ত্যাগ, তার সংগ্রাম, তার নিরন্তর যুদ্ধ। যে যুদ্ধের মধ্যে বসে তিনি সৈনিক কবি-কবিতার বরপুত্র লিখে চলেন দেশপ্রেমের ইশতেহার। তাঁর এই কাব্যসত্তা বাঙালির আবহমানকালের শক্তিমত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই তার “শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি” কবিতায় দেখতে পাই-
সংঘাতে বিক্ষুব্ধ হই, নৈরাশ্যে তাড়িত হই, নেমে আসি পথে
শব্দশোভা জ্বলে ওঠে মিছিলে মিছিলে-শব্দ হয় সুতীব্র শ্লোগান
গণদাবী, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ অনন্তর প্রতিশ্রুত হয়
শব্দ নয় শুধু মোম, শব্দ নয় সামরিক দেয়াল
বিশাল তিমির মতো একটি নতুন দ্বীপ
আজ রাতে জাগবে সাগরে, ক্রমে ক্রমে বাড়বে ভূবাগ
শ্যাম বৃক্ষের সারি, পাখিডাকা বন আর দৃপ্ত জনপদ
যাবে সেই দ্বীপে-স্বদেশ স্বজনহীন এই সব অনাত্মীয় মানুষের ভিড়ে
অবশেষে মিশে যেতে হয়, এসো সাথী হই;
জলমগ্ন হে দ্রাবিড়া, আমাদের যুগলাঙ্গ যাত্রা শুরু হোক।’
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতা নির্মাণের নানা পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে বাস্তবতার কবিতায় তার মেধা-মনন শক্তিকে নিয়োজিত করেছেন কাব্য নির্মাণের এমন এক জিজ্ঞাসায়, যেখানে বহুর আকাঙ্খা আছে। তিনি বহুর আকাঙ্খা ও স্বপ্নকে সচেতন কাব্য-নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিল্প-সত্তা মানবমুখি করে তোলার চেষ্টা করছেন যা ইতিহাসের দাবীর সংগে সম্পৃক্ত। এ’দিক দিক থেকে তিনি প্রান্তিকতার কবিতায় বিশ্বাসী নন, কবিতার বহু মাত্রিকতা-প্রিয়তার অনুগামী। কোন হৈ চৈ নেই, আছে স্বপ্নগুলো সচেতন ভাবে পাঠকের মনে জাগরিত করে চিন্তা-কর্ম-ভাবনায় নতুন জিজ্ঞাসার উদ্রেক ঘটানো। নতুন হৃদ-স্পন্দনে মানুষকে সম্পৃক্ত করা। কবি যেমন তাঁর জাতিসত্তার কবিতায় সচেতন ভাবেই একটি জাতির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মধ্যদিয়ে তাঁর আদি পর্বের ইতিহাস, ইতিহাসে তার বিস্তার, তার সংগ্রাম, জয়-পরাজয়, নির্মাণ এবং বিবর্তন ইত্যাদিকে কাল পঞ্জির মতো বিশ্লেষিত করে কাব্য-রসায়ন নির্মাণ ও পূনর-নির্মাণ করছেন এবং শিল্প-মানকে অটুট রেখে কবিতা কে নতুন স্বপ্ন-ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কর্ম-মুখর রয়েছেন ।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় নূরুল হুদার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, ‘আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী’ । প্রচলিত কাব্যপাঠের অভ্যাসকে ব্যাহত করেছে, কবিতার অবয়বের দিকে দিয়েও পূর্ববর্তী গ্রন্থের কবিতা থেকে পৃথক হয়ে গেছে। কোনো পড়ুয়া যদি প্রথমেই তাঁর এই গ্রন্থটি পাঠ করেন, তাহলে ঠিক কবিকে আবিস্কার করতে পারবেন না। কেননা, এই কাব্যের অনেক কবিতাই প্রাথমিক পাঠে মনে হয় নিতান্তই সহজ সরল যেমন:
পেলুম টাকা একটি টাকা টাটকা পেলুম
বুকে রাখলুম মুখে ঢাকলুম হাতে রইল ফাঁকা
পেলুম টাকা একটি টাকা হাটকা পেলুম
কেমন টাকা? আরশি টাকা, হাজার মুখ আঁকা
কাহার আরশি? রাজার আরশি, বাজার দরে হাঁকা।
নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে কবি নূরুল হুদা নির্মাণ করে চলেন তার কবিতার ঘর গেরস্থালি। একুশ থেকে একাত্তর, দ্রাবিড় থেকে বাঙালি, সবকিছুই তার কবিতার উপজীব্য। যে কারণে আমরা দেখি, একুশের সঙ্গে তিনি পদ্মাপাড়ের ঢেউ সোয়ারের তুলনা করে লিখে চলেন কবিতা।
‘একুশ তো বাইশ নয়,বিশও নয়
একুশ কেবল একুশও নয়,
কত একুশ এলো গেলো
একুশ কি তবু একশই থেকে গেলো?
জীবনের তুমুল আলোড়ন, কোলাহল, ইতিহাস আর ভূগোলের অবস্থান নিয়ে কবি তাঁর তৃতীয় কার্বগ্রন্থ ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ নিয়ে হাজির হন ১৯৭৫ এ। এ গ্রন্থের নামের মধ্যেই বিবেচ্য বিষয় সংকলিত হয়ে আছে। ইতিহাসের কালচেতনার মধ্যে নুরুল হুদার অভিযাত্রা, রোমান্টিক মানসিকতার চেয়ে ক্লাসিক কাঠামোর দিকে তাঁর পক্ষপাতিত্ব; যে বিষয় এবং দার্শনিক বিষয়াদি তিনি রূপ দিতে তৎপর এ গ্রন্থে তার বিকাশ ঘটেছে। এ গ্রন্থে মুহম্মদ নূরুল হুদা যে দ্রাবিড়ার প্রতি নিবেদিত সে ‘মিথুনের শেষ নামে শাড়িহীনা, বিব্রস্ত্রা, আদিমা।’ তাঁর নায়িকারা রক্ত মাংসের নারী, মাতৃতান্ত্রিক কৃষিপ্রধান সমাজের নারী যারা শস্যবীজ রোপন করেছে, ধারণ করেছে মানব জীবাণু। যেমন তিনি “গৃহমুখী” কবিতায় লিখেছেন-
কে কোথায় কোন পাড়ে সুখে দুঃখে বেঁধেছিল নীড়
সবুজ চরের মতো প্রণয়িনী আঁচালের কাছে
সমর্পিত কে সেই যুবক।
তাঁর কবিতায় আছে দীপ্তির মনন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তির কল্পনাময় প্রতীক ও রহস্যময় ভাষণ। সেই সাথে দেখতে পাই একটি সমান্তরাল প্রতিধ্বনি এবং বহুমাত্রিকতা। প্রতিটি চরণে তিনি তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন প্রকৃতির অতিক্ষুদ্র বিষয়াবলি। দরিয়াপাড়ের কবি তাই কবিতা লিখতে হারিয়ে যান নিজের শৈশব-কৈশোর বেলায় দরিয়া নগরে।
বিশ্ববিখ্যাত কবিদের কবিতার দিকে তাকালে আমরা উদাহরণ স্বরুপ শেলীর প্রসঙ্গ টানতে পারি। শেলীর কাব্যের বিশেষ গুণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই গতিশীলতা, প্রচন্ড হৃদয়াবেগ, মূর্তবাণী যেন বিশাল মানব সমুদ্রে মিলিত হয়।শেলীর সাথে তুলনা করছি না কিন্তু সমান্তরাল ভাবে দেখতে গেলে আমরা দেখতে পাই কবি নুরুল হুদার কাব্যেও সেই একই রকম আবেগ এবং বিশেষ করে মানব প্রেমেরই অনুষঙ্গ হয়ে থাকে তার পর সেটা ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তটভূমির দিকে। আমরা একপলকের জন্য ঘুরে আসতে পারি তাঁর ‘জাতিসত্তার কবিতায়’। যেমন–
‘তোমার স্মৃতিতে আজ লেখা হয় জীবনের লাল ইতিহাস
তোমার হাড়ের বহ্নি তাপ দেয় গৃহে গৃহে শীতার্ত নিশীথ’।
কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর মধ্যে রয়েছে আরও নানাবিধ প্রতিভা। তিনি সমান ভাবে একজন ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য সমালোচক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক। নূরুল হুদার জীবনে কবিতাই সব। কবিতাকে তিনি তাঁর জীবনের প্রধান বিষয় হিসেবে নিয়েছেন। তিনি চিন্তা করছেন এবং অতীতের ইতিহাস নিয়ে তাঁর কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। ‘আমরা তামাটে জাতি’ শীর্ষক কাব্য গ্রন্থের কবিতায় কবি তাঁর স্বকীয়তাকে তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘রোদ্দুর নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।
কবির অধিকাংশ কবিতায় নানা বিষয় মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি প্রাণী ও জড়, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান, মিথ ও প্রাসঙ্গিকতা, উপাখ্যান ও দর্শন, ঐতিহ্য ও পুরাতত্ত্ব, মহাজাগতিক বস্তু থেকে গাণিতিক প্রস্তর প্রভৃতির ব্যঞ্জনায় গড়ে তুলেছেন তাঁর ফিকশনাল ডাইমেনশনে। আমাদের এ পারিপার্শ্বিক বিশ্বের মধ্যে নবায়ন করতে চেয়েছেন এক ভিন্ন মাত্র। তাই তাঁর কবিতায় রূপক, সাঙ্কেতিকতা, আঙ্গিক, ভাষা, চিত্র ও দৃশ্যকল্প এক ভিন্নধর্মী মেটাফর তৈরি করেছে। এ ভিন্ন মেটাফর কবি হিসেবে তাঁর সময়ের থেকে তাঁকে আলাদাভাবে পৃথক করেছে। ধ্যানী ও জ্ঞানী মানুষ তিনি। কবিতার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন সারাটা জীবন। বিপুল বৈষয়িক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কবিতার সাথে থেকেছেন। শুধু কবিতার সাথে পেতেছেন অভাবের সংসার । যাঁরা কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন তাঁরা জানেন নির্লোভ, নিরহংকার, সদালাপী, কবিতার স্বপ্নে বিভোর এই অসামান্য মানুষ কত সহজ ও সরল জীবন যাপন করেন। আমি নিজে কবি নূরুল হুদাকে যখন চিনতাম না সেই সময়ে দেখেছি বইমেলাতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন, কারো কারো সাথে গল্প করছেন। এর বহু বছর পর জানতে পেরেছি সাদামাটা যে মানুষটিকে আমি বইমেলায় ঘুরতে দেখেছি তিনিই নূরুল হুদা।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার উতল তরঙ্গের পাশে গহন-উন্মুক্ত কিন্তু যুক্তিশীল, শিকড়িত কিন্তু মুক্তচিত্ত প্রবন্ধ-সমালোচনার একটি নির্জন নহর বয়ে চলেছে।’কবি নূরুল হুদা আধুনিকতম চিন্তার বিচিত্র-মুখী প্রকাশের মধ্য দিয়ে নতুনত্বর দিকে পাঠককে আহ্বান করেন- পাঠককে উপেক্ষা করার সুযোগ না দিয়েই।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সৃষ্টিশীলতায় দ্বৈতসত্তা বিরাজমান। প্রথম সত্তায় আমরা তাঁর কবিতায় হই আকৃষ্ট, হৃদয়াবেগ দিয়ে তা গ্রহণ করি; আর তাঁর কবিতার দ্বিতীয় সত্তায় আমরা লাভ করি বহুমাত্রিক চিন্তা-উদ্রেককর বিচিত্র অনুষঙ্গ, যা পাঠ করতে আমরা হই আচ্ছন্ন ও সম্মোহিত। সৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ কবির কবিতা শুধু আকৃষ্ট করে না, আকৃষ্ট স্তর পার হয়ে তা বিশেষ আচ্ছন্নতা বিস্তার করে, যেখানে তার রচনায় বহুমাত্রিক জ্যোতিবলয়ের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। মুহম্মদ নূরুল হুদার অধিকাংশ রচনায় আমরা এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি।
১৯৮৩ সালে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা-র কাব্যগ্রন্থ “শুক্লা শকুন্তলা” প্রকাশ পায়। কবি তাঁর শুক্লা শকুন্তলা কাব্যগ্রন্থে সরল ও অনাড়ম্বর ভঙ্গিমায় অনায়াসলব্ধ এক নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন যা পাঠকের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য। আধুনিক বাংলা কবিতায় শুক্লা শকুন্তলা এক অনন্য সংযোজন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো শিরোনামহীন চতুর্দশপদী সনেট। শুক্লা শকুন্তলার সনেটগুলো পাঠককে এক অদ্ভুত ঘোরের ভেতর প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়। যেমন একটিতে তিনি লিখেছেন-
‘অনসূয়া, প্রিয়ংবদা বাঁচাও, বাঁচাও
অহেতু উত্যক্ত করে দুর্বৃত্ত মধুপ;
এই হুলে বড় জ্বালা, হুল নয় ধুপ;
যুগলে বাঁচাও, সখি, নয় মাথা খাও।’
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আত্মগরিমায় উচ্ছ্বসিত হয়ে চিৎকার করে ঘোষণা করেন তাঁর ভাষা এবং দেশের শ্রেষ্ঠত্বের এবং কবিতার মাধ্যমে বলে ওঠেন, ‘যত দূর বাংলা ভাষা তত দূর এই বাংলাদেশ’। বাংলা কবিতা চর্চার ইতিহাসে এতো বলিষ্ঠ ইশতেহার এর আগে এমনভাবে কেউ কখনও উচ্চারণ করেন নি। এই ইশতেহারের মাধ্যমে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন বাংলা ভাষা আজ আর নির্দিষ্ট কোন জাতি বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ নেই।
তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন পরিশ্রমী কবি। শব্দ নির্বাচন, প্যারাডাইমিক শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে তিনি সবসময় চিন্তাভাবনা করেন, এর প্রতিফলন তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতায় কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় ঠিকই, তবে মাঝে মধ্যে মনে হয় নির্মাণকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। সৃষ্টি ও নির্মাণ কবিতার লক্ষণ বা গুণ হিসেবে যেভাবে চিহ্নিত, সেগুলোর ধারণাই তাঁকে নির্মাণের পথে নিয়ে গেছে। তবে নির্মাণের পথ বেয়ে কোনো কোনো সময় সৃষ্টির স্তরেও উঠে যান। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতা নির্মাণের নানা পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে বাস্তবতার কবিতায় তার মেধা-মনন শক্তিকে নিয়োজিত করেছেন কাব্য নির্মাণের এমন এক জিজ্ঞাসায়, যেখানে বহুর আকাক্সক্ষা আছে। তিনি বহুর আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নকে সচেতন কাব্য-নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিল্পসত্তা মানবমুখী করে তোলার চেষ্টা করছেন, যা ইতিহাসের দাবির সাথে সম্পৃক্ত।
বাংলা কবিতা মানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোট বড় অনেক কবিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অনুসরণ করেছেন,ভক্ত হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। কবি নূরুল হুদাও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তেমনই একজন সৃজনশীল ভক্ত। তিনি তাঁর কবিতায়, লেখা বিশ্লেষণে কবিগুরুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নানা অণুসঙ্গ তুলে ধরেছেন।
কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দিগন্তের খোসা ভেঙে’ দ্বিতীয় কবিতা ‘কবিতাই সত্যাসত্য’ শিরোনামে বলেন:
ওইপাশে বসেছে ভুসুকু
এই পাশে দুখু
বারান্দায় চন্ডীদাস আর মাইকেল
শতাব্দীর শেষ চৈত্র
ঠাকুরের আঙিনায়
কবির মাইফেল।
শতবর্ষ পরে নয়
নয় আরো আগে
অনন্ত অনঙ্গ বঙ্গে
আজ শুধু
কবিরাই জাগে।
মৌলিক কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ সাহিত্যে বেশ সময় ব্যয় করেছেন। বহু বিখ্যাত বিদেশি কবির কবিতা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুদিত কবি ইয়েট্স দুইটি ছোট কবিতা সহজেই পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটে।
‘পান সঙ্গীত’ শিরোনামে কবি ইয়েটস কবিতা অনুবাদ করেন এভাবে:
মুখে সুরার পান পেয়ালা
চোখে প্রেমের বসবাস;
বুড়িয়ে গিয়ে মরার আগে
এই সত্য মানছি খাস;
মুখে তুলি পানপেয়ালা,
তোমাকে দেখি, ফেলি দীর্ঘশ্বাস।
অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিরা মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে খুব দূরে সরে না গেলেও ভাষার বাহ্যিক বিষয় পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। বাংলা কবিতার এই ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আধুনিককালের দক্ষ কাব্যশিল্পী কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাই তাঁর “শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি” কবিতায় লেখেন-
‘ভয়শূন্য জয়শূন্য জীবনের গূঢ়তম অর্থশূন্য তুমি তো বিষাদ
গুরুভার উরু মেলে নিরাসক্ত শুয়ে থাকো তুমি স্বর্ণনিভ
আমিতো অস্থির অস্থি, ঘানিক্লান্ত, জীবনের বিবর্ণ বলদ
মহাকাল স্তব্ধ হলে তুমি কি সন্তুষ্ট হও, হে অতীত বিমূঢ় অতীত?’
এই পঙক্তিগুলি পাঠককে এক ব্যতিক্রমী কাব্য-মূর্ছনায় আবিষ্ট করে তোলে। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। পাঠকের পুরো মনোযোগ তিনি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারেন অনায়াসে, পাঠককে এক মোহাচ্ছন্ন আবেগের দিকে হাঁটতে বাধ্য করেন।
কবি তাঁর দীর্ঘ কাব্য-সাধন জীবনে লিখেছেন প্রচুর যা নিয়ে বিস্তর গবেষণার দাবী রাখে। কবি নূরুল হুদা পশ্চিমের নানা কাব্য আন্দোলন, তত্ত্বের অন্ধ ধারক হন নি, তিনি বরং নিজের সংস্কৃতির ঐতিহ্যে আত্মিকরণের মধ্যমে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতায় অবগাহন করে আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছেন । মিশেয়ে দিয়েছেন আধুনিক সকল দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতার প্রতিটি লাইনে। সংগত কারণেই তাঁর কাব্য-প্রতিভা ও গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয়। কবির ভাষায় তাই আমরা বলতেই পারি-
“শ্যামাঙ্গিনী,
এতোকাল আমিও বুঝিনি,
কবিতার ক্লাশে বসে তোমাকে খুঁজেছি শুধু,
কবিতার দুধশাদা চরণ খুঁজিনি।”
–জাজাফী
(কবিতার ক্লাশে বসে তোমাকে খুঁজেছি শুধু / স্বজনহীন এই সব অনাত্মীয় মানুষের ভিড়ে)
10 থেকে 23 নভেম্বর 2021
সহায়ক রচনা:
১. জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ৬৫তম জন্মবার্ষিকী স্মারক সংখ্যা, সম্পাদক : কামরুল
ইসলাম
২. জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ৬৬তম জন্মবার্ষিকী স্মারক সংখ্যা, সম্পাদক : ফরিদ
আহমেদ দুলাল, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।
৩. কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার জন্মদিন,সাহিত্য বার্তা, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
৪. মুহম্মদ নূরুল হুদা’র কবিতা: একটি তুলনামূলক পাঠ-প্রয়াস- আশরাফ জুয়েল
৫. মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা
৬. মুহম্মদ নূরুল হুদা- উইকিপিডিয়া নিবন্ধ
৭. কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদার সাক্ষাৎকার- শ্যামল চন্দ্র নাথ, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ১৭ আগস্ট, ২০১২
৮. ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা-বিনয়ক সেন
৯. বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা বিষয় ও প্রকরণ – বায়তুল্লাহ্ কাদেরী
23 নভেম্বর 2021