Thursday, November 21, 2024
Homeচলচ্চিত্রস্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র

–জাজাফী

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ মুক্তি পায় ১৯৮০ সালে। তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, এই ছবির নির্মাতা বাদল রহমান ভারতের পুনে থেকে চলচ্চিত্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে ছবিটি নির্মাণে হাত দেন। পেয়েছিলেন সরকারি অনুদানও। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচ্চিত্রটির মূল কাহিনি এরিখ কাস্টনারের হলেও এর চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন বাদল রহমান নিজে। বিদেশি গল্প পরেও নিজ দেশের সমাজ-বাস্তবতাকে অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছিল এতে। চলচ্চিত্রের কাহিনিতেও আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। এতে মূল চরিত্র হলো এমিল। খুদে গোয়েন্দা হিসেবে দুর্দান্ত অভিনয় করা সেই এমিল নিজেই এখন যেন রহস্যঘেরা। অভিষেক ছবির পর আর দেখা মেলেনি তার। দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সেই শিশু এমিল এখন কোথায়? কীভাবে তার কাটে দিন? এখনও কি পর্দার মতোই গোয়েন্দাগিরিতে আগ্রহ আছে? নাকি খোলনচলে বদলে গেছে সব! এমন প্রশ্ন অনেক দর্শকের মনে। এমিল নামের সেই দূরন্ত গোয়েন্দা কিশোরের আসল নাম রেয়াজ শহীদ।


বর্তমানে মালয়েশিয়ার জহর বাহরু শহরে তার বসবাস।এর আগে ঢাকাতে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে হেড অব আইটি হিসেবে কাজ করতেন। মালয়েশিয়া ২০১৮ সালে এসেছেন। সেখানেও একটা আমেরিকান স্কুল-শ্যাটাক সেন্ট ম্যারিস ফরেস্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আইটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন।



বাংলাদেশের সরকারি অনুদানে প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। এই চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়ার পুরো গল্পটা দারুণ ছিলো।   ছবির পরিচালক বাদল রহমান ৭৩/৭৪-এর সময় পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করতে যান। ওনার সঙ্গে আরও অনেকেই গিয়েছিলেন। সেখানে বাদল রহমান ফিল্ম এডিটিংয়ের ওপর ডিপ্লোমা করে দেশে ফেরেন ৭৬/৭৭ সালের দিকে। তাঁর সাথে সালাহউদ্দীন জাকী ও ছিলেন। দু’জনই সরকারি অনুদান পান চলচ্চিত্র বানানোর জন্য। বাদল রহমান পেলেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র জন্য আর সালাহউদ্দীন জাকী পেলেন ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের জন্য। দুটিই খুব চমৎকার গল্প। তখন তো রেয়াজ শহীদ অর্থাৎ আজকের খুদে এমিল খুবই ছোট। তবে তিনি তখনই জানতেন, এই দুটো ছবি অনুদান পেয়েছে।



১৯৭৭ সাল। রেয়াজ শহীদ পড়াশোনা করছেন উদয়ন স্কুলে, ক্লাস সিক্সে। বাদল রহমানের সাথে তাদের পরিবারের একটা যোগাযোগ ছিল। রেয়াজ শহীদ অর্থাৎ এমিলের ফুফুর বাসায় প্রায়ই আসতেন আড্ডা দিতে। হঠাৎ একদিন ডেকে বললেন, ‘তোমার ফাইনাল পরীক্ষা কবে শেষ হবে?’
রেয়াজ শহীদ ওনাকে বললেন, নভেম্বরের শেষেই পরীক্ষা শেষ হবে।তখনও তিনি ছবির বিষয়ে কিছু জানতেন না। এরপর একদিন বলেই বসলেন, ‘‘আমি তো ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নিয়ে একটা চলচ্চিত্র বানাচ্ছি। আমি তোমাকে মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চাই।’’



এর আগে রেয়াজ শহীদ তথা এমিলের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর তেমন কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। যদিও তার পরিবার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই ছিল। প্রয়াত আলমগীর কবির তার মামা হন। মানে এই পরিমণ্ডলে তাদের পরিবারের অনেকেরই বেশ যোগাযোগ ছিল এবং এখনো আছে।  কিন্তু নিজে সিনেমা করবে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে- এসব মাথায় আসেনি।
তবে বলার পর সে খুব বিস্মিত হয়। যেটাতে বেশি কৌতূহল জেগেছিল সেটা হলো, যখন বাদল রহমান বললেন, ‘আমরা খুলনা শুটিং করবো।’



চলচ্চিত্রটি দেখলে জানবেন, এমিল খুলনার ছেলে। ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত সে খুলনাতেই ছিল। সেখানে যাওয়ার বিষয়টা অ্যাডভেঞ্চারের মতো লেগেছিল তখন। আবার বাদল রহমানের নিজেরও ছেলেবেলায় খুলনায় একটা বড় সময় কেটেছে। শহরটিতে উনি সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়তেন। সিনেমায়ও দেখানো হয়েছে, এমিল খুলনা সেন্ট জোসেফ স্কুলের ছাত্র।


সিনেমায় সুযোগ পাওয়ার পর এমিলের মা অর্থাৎ রেয়াজ শহীদের মা অখুশি হননি। একটু চিন্তিত ছিলেন। তবে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হতে যাচ্ছে। তাদের কাছে এটাই ছিল বড় বিষয়। রেয়াজ শহীদের তখন যে বয়স ছিল তাতে এসব কিছুই বুঝতে পারেন নি। তবে শুধু জানতেন, খুলনা যাবেন। খুলনায় তখন ১৫ দিন শুটিং হয়েছিল। ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালে।  শুটিং শুরু হয়েছিল ৭৭ সালে। তারপর মাঝে বন্ধ ছিল। এরপর আবার শুরু হয় ৭৮ সালে। তবে অধিকাংশ শুটিং হয়েছিল ৭৯ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অধিকাংশ শুটিং হয়। যেমন, ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে, চোরকে ধাওয়া করে যাওয়া, সাকুরার ওখানে। তারপর ডাবিং, এডিটিংসহ সবকিছু মিলিয়ে শেষ করতে সময় লেগেছে ১৯৮০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে।


অর্থ খুব বড় একটা বিষয়। সিনেমার শুটিং প্রায় ৬-৭ মাসের ওপরে অর্থের অভাবে বন্ধ ছিল। বাদল রহমান এই সিনেমা নির্মানের জন্য অনুদান পেয়েছিলেন তিন লাখ টাকা বা এর অল্প কিছু বেশি। এরপর পুরোটাই বাদল রহমানের ইনিশিয়েটিভ থেকে তৈরি করতে হয়েছিল। অনুদান পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু একটা ছবি বানাতে গেলে স্পেশালই মন মতো কারিগরি ব্যবস্থা নিয়ে, ভালো কলাকুশলীদের নিয়ে যদি করতে হয় তবে সেটা ওই টাকায় হয়ে ওঠে না। এজন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে ডোনেশন সংগ্রহ করা হয়েছিল। এমনকি তিনি নিজের পকেট থেকেও একটা বড় অংশ খরচ করেছেন। আরেকটা বিষয় ছিল, এই চলচ্চিত্রে কোনও কলাকুশলী পারিশ্রমিক নেননি। শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা সাহেব ছাড়া আর অভিনেতাদের কেউই পারিশ্রমিক নেননি। রেয়াজ শহীদ তথা এমিল সহ অন্যান্য বাচ্চারা তো বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে। বাকিদের মধ্যে যেমন, বাদল রহমানের বন্ধু সিনেমেটোগ্রাফার প্রয়াত আনোয়ার হোসেন সাহেবও পারিশ্রমিক নেননি। অথচ উনি কিন্তু তখনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন খ্যাতিসম্পন্ন সিনেমেটোগ্রাফার। এছাড়াও উনি তখন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ নিয়ে কাজ করছিলেন। 



শিশু এমিল শুটিং করতে করতে কৈশোর ছুঁই ছুঁই করছিল।সিনেমায় লক্ষ করলে দেখা যায়, খুলনার এমিল আর ঢাকার এমিলের মধ্যে পার্থক্য আছে। এমিলের গলার স্বর বদলে গিয়েছিল। ক্লাস সিক্সের শেষে শুরু হলো। এরপর শুটিং বন্ধ হয়ে যখন আবার শুরু হলো তখন ক্লাস সেভেনের মাঝামাঝি। ওই সময়টায় এমিলের গলার স্বর বদলে যাচ্ছিল। উচ্চতাও একটু বেড়েছিল। সমালোচকরা অবশ্য খুব একটা খেয়াল করতে পারেননি। 




ছোট্ট এমিল যে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছে, এমন কোনও অনুভূতিই ছিল না তার মধ্যে। মূল বিষয় ছিল অ্যাডভেঞ্চার।তগুলো বাচ্চা, সবাই সমবয়সী। পুরোপুরি বাচ্চাদের জন্য একটা প্লট এটাই তো বাংলাদেশে প্রথম। এখনও একমাত্র ওই সিনেমার প্লটই বাচ্চাদের জন্য ছিল।

চলচ্চিত্র যখন মুক্তি পেলো,  এমিল  তার পরিবার সহ তখন ক্যান্টনমেন্টে থাকতো। ওই সময় ১৯৮০ সালে বন্যার পানি ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় ঢুকে পড়ে। রেয়াজ শহীদ তথা এমিলদের বাসায়ও পানি চলে আসে। তাই ঐ সময় কিছুদিন মগবাজারে তারা তার ফুফুর বাসায় ছিল। যেখানে বাদল রহমান আসতেন। যখন ক্যান্টনমেন্ট সিনেমা হলে ছবিটা আসে এলাকার অনেকেই জানতো না এমিল চরিত্রে যে ছেলেটি অভিনয় করেছে সে খোদ ক্যান্টনমেন্টেই আছে।সিনেমা দেখার পর পাড়ার সবাই দেখে তো অবাক। এটা শুনে অনেক মজা রেয়াজ শহীদ খুব মজা পেয়েছিল।


এমিল চরিত্রে অভিনয়টা তার কাছে থ্রিলিং ছিল যে সে একটা চলচ্চিত্রে কাজ করেছে, সেটা সিনেমা হলে দেখাচ্ছে। যেদিন রিলিজ পায় মনে তখন রেয়াজ শহীদ ক্লাস নাইনে পড়তো। বাংলা টিচার জামিলা হঠাৎ ক্লাসে এসে বললেন, ‘আজকে শুক্রবার বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। এখানে আমাদের ছাত্র রেয়াজ অভিনয় করেছে প্রধান চরিত্রে। এটা আমরা সেলিব্রেট করবো। ওকে সবাই কনগ্রেচুলেট করো।’ সবাই তখন তালিও দিল। আরেকটা বিষয় হলো, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’তে এমিলের সাথে যারা ছিলেন বিভিন্ন চরিত্রে, তারা অনেকেই উদয়নের ছাত্র। যেমন- শিপলু, তারপর ইমরান। ইমরান তো তার ক্লাসমেট। ওই সময় এটাই ছিল স্কুলের বড় খবর। রাস্তায় চলতে গেলে সবাই দেখিয়ে বলতো, ওই যে এমিল যাচ্ছে। প্রথম প্রথম সবার অ্যাটেনশন পেয়ে খুব লজ্জা লাগতো। বাইরে বেরুলেও অনেকেই জিজ্ঞেস করতো, এই তুমি এমিল না? সেও লজ্জা পেয়ে বলত, হ্যাঁ আমিই এমিল। 



ছোট সেই দূরন্ত এমিল এখন বড় হয়ে গেছে। তার সন্তানরা জানে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। কয়েক বছর আগে তিনি তার মেয়েকে নিয়ে কানাডা গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করানোর জন্য। সেখানে  বড় এমিলের অনেক বন্ধুরাও আছে। কানাডা যাওয়ার পর সবাইকে এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত করা  হলো। সেখানেই এক বন্ধু দাওয়াতের মাঝখানে সবার সামনে বিষয়টা বলে উঠলো।



চলচ্চিত্রটি করতে গিয়ে খুদে অভিনেতারা খুব আনন্দ পেয়েছিল কারণ বাদল রহমান সবকিছু শিশু শিল্পীদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ কারণে খুদে শিল্পীরা যে অভিনয় করছে তা তারা বুঝতেই পারেনি। সব ছিলো একদম ন্যাচারাল। অন্যান্য যারা ছিলেন যেমন, গোলাম মোস্তফা, সারা যাকের, বেনু জামান তাদেরকেও তিনি কখনও বলেননি কী কী করতে হবে। মানে কিছু চাপিয়ে দেননি। তিনি সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিয়েছেন আর চরিত্রটার একটা ছোট্ট আইডিয়া দিয়েছেন।এর ফলে চলচ্চিত্রটি দারুণ ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।



চলচ্চিত্রে অনেক ডায়লগ আছে যেগুলো স্ক্রিপ্টে ছিল না। এসব কিন্তু অন দ্য স্পট ইম্প্রুভাইজ হয়েছে। বাদল রহমান ন্যাচারালি একটা শিশু কীভাবে কথা বলে, কেমন আচরণ করে সেগুলো যেন বের হয়ে আসে এজন্যই কখনও চাপিয়ে দেননি।  

আরেকটা বিষয় হলো, প্রায় ১০-১৫ জন বাচ্চা কাজ করেছে। এদের সামলানো কিন্তু ছোটখাটো বিষয় নয়। উনি কখনও বিরক্ত হননি।শিশুশিল্পীরা সবাই ছিলো সমবয়সী। শুটিংয়ের সময় দেখা যেত সবাই স্পটে গিয়েই খেলা শুরু করে দিয়েছে। কোনও সিনের শুটের আগে বাদল রহমান ডাক দিলেন, এই সবাই আসো। এমিলরা তখন দৌড়ে এসে শুট করতো। শুট শেষ আবার দৌড়ে খেলতে চলে যেত। পুরো হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে ছিলো সবগুলো বাচ্চা। চমৎকার সময় কেটেছিল।



দর্শক মনে এখনো প্রশ্ন জাগে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর দ্বিতীয় পর্ব হতো তাহলে কেমন হতো? মানে এমিলরা সবাই এখন বড় হয়ে গেছে। এখন তাদের গোয়েন্দা বাহিনী কাজ নিয়ে যদি চলচ্চিত্র হয় তাহলে মন্দ হবে না। একজন এমিল তার অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তাইতো চলচ্চিত্র থেকে দূরে থেকেও তিনি মানুষের হৃদয়ে আছেন। অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও কেউ কেউ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেন না অথচ মাত্র একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি যুগযুগ মানুষের হৃদয় জুড়ে আছেন। এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী আজও অম্লান।

Most Popular