–জাজাফী
–
উভয় সংকট বলে একটা কথা প্রচলিত আছে।দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ যার ভুক্তভোগী।ফারাক্কা বাধ বাংলাদেশের জন্য উভয় সংকট তৈরি করেছে।অনেকটা গলায় কই মাছের কাটা ফোটার মত যা গিলেও ফেলা যাচ্ছেনা আবার বেরও করা যাচ্ছেনা।ফারাক্কা বাধ চালু থাকলে বাংলাদেশের নদনদী শুকিয়ে যায় এবং কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতি হয়। অন্য দিকে ফারাক্কা বাধ খুলে দিলেও বাংলাদেশের চরম ক্ষতি হয়।ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি এসে নদনদীকে ছাপিয়ে সেই পানি লোকালয়ে আঘাত হানে। বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা একই সাথে ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের আবাসন ব্যবস্থাকে নাজুক করে তোলে।তাই বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা নামটাই মরণ ফাদ বলে আখ্যায়িত করা যায়।
বছরের পর বছর যে বাঁধ আমাদের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়ে ছিল। পত্রিকাগুলো এটা নিয়ে ঢলাও করে লিখছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ফারাক্কা খুলে দিলে আমাদের সুবিধা হবে। নদীতে পানি আসবে চাষাবাদে সুবিধা হবে কিন্তু আমাদের এটাও ভেবে দেখতে হবে ভারতের মত দেশ না জেনে না বুঝে নিজেদের লাভের দিকটা না দেখে নিশ্চই কোন কিছু করবে না। লাভের কথা বিবেচনা করেই তারা ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করেছিল এবং নিশ্চই কোন সার্থের জন্যই আবার তা খুলে দিতে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে আমাদের গলা ফাটানো চিৎকার তারা কানে তোলেনি আর আজ হঠাৎ করে তারা ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিতে সম্মত হচ্ছে এটা ভাবনার বিষয়। এবং তারই প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের নদী গুলো নাব্য সীমার বাইরে ছাপিয়ে গেছে এবং পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে।নদীতে পানি না থাকলে যতটা ক্ষতি হয় তার থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে অতিরিক্ত পানির কারণে।
ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক ও ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানির একতরফা প্রত্যাহার বাংলাদেশের কেবল প্রতিবেশ ও পরিবেশ ব্যবস্থাই ধ্বংস করেনি বরং এ দেশের কৃষি, শিল্প, বনসম্পদ ও নৌযোগাযোগের মতো অর্থনৈতিক খাতগুলির ওপরও হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে, ভারত তাদের বন্দরকে পলির হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করেছিল। সেই ভারত যে আবার কোন সুবিধার কথা বিবেচনা না করেই ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিতে চাইছে এরকম ভাবা উচিত হবেনা।এবং অলরেডি তার ফল আমরা চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছি।
ইতিহাসের অলিগলি ঘুরে দেখতে পাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে গঙ্গা প্রশ্নে জরুরি আন্তরিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এক যৌথ ঘোষণায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, ফারাক্কা প্রকল্প চালু করার আগে গঙ্গায় বছরে সর্বনিম্ন প্রবাহের সময়কালে নদীর জলবণ্টন প্রশ্নে তারা পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য একটি মতৈক্যে উপনীত হবেন। ঐ শীর্ষ বৈঠকে আরও স্থির হয় যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে কোন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু তাদের মনে মনে ছিল ভিন্নরকম পরিকল্পনা। আর সে জন্যই ১৯৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশকে জানায় যে, ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষা করা তাদের প্রয়োজন। সে সময় ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ১০ দিন ফারাক্কা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড গঙ্গার প্রবাহ প্রত্যাহার করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুমতি প্রার্থনা করে। বাংলাদেশ সরল বিশ্বাসে এতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। ভারত বাঁধ চালু করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের পরেও একতরফাভাবে গঙ্গার গতি পরিবর্তন করতে থাকে যা ১৯৭৬ সালের পুরা শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীসহ কমপক্ষে ২৩০টি নদ-নদী বিধৌত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলির মধ্যে ৫৫টির উৎপত্তি ভারত থেকে এবং তিনটি মায়ানমার থেকে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উপনদী ও শাখানদী বিধৌত মোট এলাকার পরিমাণ ১৭,২০,০০০ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার শতকরা সাত ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭২ সালের নভেম্বরে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। নদী কমিশনের লক্ষ্য ছিল উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলি থেকে সর্বাধিক সুবিধা লাভের লক্ষ্যে যৌথ প্রয়াস চালানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যৌথভাবে তা বাস্তবায়ন করা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস নির্ণয়ের বিশদ পদক্ষেপ সুপারিশ করা এবং পানিসম্পদের সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পগুলোর জন্য সমীক্ষা ও জরিপ চালানো। আমরা দেখেছি নদী কমিশন আদতে বাংলাদেশের জন্য কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গঙ্গার পানি বন্টন সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে গৃহীত ফর্মুলা মোতাবেক ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে দু’দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হবে, এবং ভারত নদীটির জলপ্রবাহের মাত্রা গত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। যেকোন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা পাবে। দীর্ঘ মেয়াদে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনে এবং দুদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু তার পরও ফারাক্কা বাঁধ আমাদের জন্য বাধার দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে ছিল বছরের পর বছর। আর এখন সেই বাধ খুলে দেওয়ায় আমাদের আবার নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ফারাক্কা-উত্তর আমলে গঙ্গার প্রবাহ সংকট নৌপরিবহণ খাতকেও আঘাত হেনেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ৩২০ কিলোমিটারের বেশি প্রধান ও মধ্যম নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়। ভারত কর্তৃক শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির ব্যাপক প্রত্যাহার বাংলাদেশের গঙ্গা-নির্ভর এলাকার জনগণের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ভারত কর্তৃক বছরের পর বছর শুষ্ক মৌসুমের মূল্যবান পানি সম্পদ প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশকে আজও কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহণ, জলসরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের এসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরোক্ষ ক্ষতি হিসাবে আনলে এই পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত ভাবে ফারাক্কা খুলে দেওয়ার কারণে অতিরিক্ত পানি আমাদের দেশে বন্যপরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
আমাদের নদনদী গুলো মৃতপ্রায় ছিল ভারতের একচেটিয়া নীতির উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে থাকা ফারাক্কা বাধ।আগের সেই নাব্যতা আর নেই। কিন্তু একই ভাবে ভারত তার খেয়াল খুশি মত ফারাক্কা বাধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ বড় আকারের ধাক্কা খেলো। এখন নদী গুলো ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারত থেকে বয়ে আসা পানি। কথা ছিল নির্দিষ্ট পরিমান পানি ছাড়া হবে যেন দেশের সার্বিক চাহিদা মেটানো যায় এবং বন্যাপরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। একই সাথে যেন ভারতেও কোন সমস্যা না হয়। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী টাইপের নীতিতে বিশ্বাসী ভারত তার খেয়াল খুশি মত বাধ তৈরি করে পানি আটকে দিয়ে আমাদের যেমন ক্ষতি করছে তেমনি ভাবে খেয়াল খুশি মতই বাধ ছেড়ে দিয়েও আমাদের ক্ষতি করছে।আদতে তাই যৌথ নদী কমিশন কোন কাজেই আসেনি।এখন সময় এসেছে ফারাক্কা নিয়ে কাযর্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করার।ফারাক্কা যদি থাকে তবে সেটা যেভাবে থাকলে দুই দেশের কারো কোন ক্ষতি হবেনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে।নতুবা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছিল সেই অসাধারণ অবদানের গায়ে কলঙ্কতিলক পড়বে।
জাজাফী
ইমেইলঃ [email protected]