আজাদের মাকে আমরা হয়তো ঠিক সেভাবে চিনতাম না যদি না একজন আনিসুল হকের জন্ম হতো।আমি সেই আজাদের মায়ের কথা বলছি যিনি অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে গেছেন জুরাইন কবরস্তানে। তিনি সেই মা যিনি সন্তান ভাত খেতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি নিজ হাতে তুলে শেষ বারের মত ভাত খাইয়ে দিতে পারেন নি বলে জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত ভাত খাননি। তিনি সেই মা যিনি সন্তান বিছানায় ঘুমাতে পারেনি বলে জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত বিছানায় ঘুমান নি। এই কথা গুলো বলছিলাম আনিসুল হক ও তার উপন্যাস “জেনারেল ও নারীরা” সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে। আনিসুল হক তার মা উপন্যাসে শহীদ আজাদের মাকে যেভাবে চিত্রায়ন করেছেন তা যে কোন শ্রেনীর পাঠকের চোখে শ্রাবণধারা আনবে এটা নিশ্চিত।
আনিসুল হক একজন শক্তিমান লেখক হিসেবে অনেক আগেই বাংলাসাহিত্যের আকাশে উজ্জল হয়ে জ্বলতে শুরু করেছেন।লিখেছেন অনেক টিভিনাটক এবং তার লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়।মা উপন্যাসটি লিখে তিনি আমাদেরকে যেভাবে মোহিত করেছেন এর আগে কোন লেখক ঠিক সেভাবে করেছেন কিনা সন্দেহ আছে। সুলেখক আনিসুল হক রম্য রচনাতেও যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখিয়েছেন। তার লেখা “আবার তোরা কিপ্টে হ” রম্য রচনাটি তাই পাঠকের মনে দাগ কেটেছে। শিশু সাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি বিগত বছরে এবং এ বছরে গুড্ডু বুড়োর কান্ডকারখানা এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সীর কাছে হয়ে উঠেছে সুপাঠ্য।
কিন্তু আনিসুল হক তার “মা” উপন্যাসটি যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন বাকি গুলোতে ঠিক সেই ধারা সেই আবেগ ছিলনা।
কিন্তু তার ক্ষুরধার কলমের ধার যে কোন অংশে কমেনি তা তিনি আবার প্রমান করলেন।’জেনারেল ও নারীরা’- নামে এক অসাধারণ উপন্যাস নিয়ে আবার হাজির হলেন আমাদের সামনে।বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকে এখন পযর্ন্ত প্রতিটি মুহুর্তই যেন এক একটা ইতিহাস।১৭৫৭ সালে মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতা থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড সব এক একটা করুণ ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় পাতায় যারা খুজে ফেরেন বাংলাদেশের জন্ম কাহিনী তারা নিশ্চই কম বেশি দেশকে ভালবাসেন। সেই সব দেশ প্রেমীদের জন্য দেশ এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে সব থেকে গুরুত্বপুর্ন অধ্যায়কে সুনিপুণ হাতে শব্দের পর শব্দ জোড়া লাগিয়ে অসাধারণ এক সাহিত্য কর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন আনিসুল হক।’জেনারেল ও নারীরা’- যেন বাংলাদেশেরই জন্ম কাহিনী।হুমায়ুন আজাদের “লাল নীল দীপাবলী” যেমন বাংলা সাহিত্যের জন্মইতিহাস বহন করছে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠাও যেন চিত্রের মত চিত্রায়িত হয়েছে আনিসুল হকের ‘জেনারেল ও নারীরা’ গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে পাকিস্তানী হানাদারদের কুৎসিত নৃশংসতার কোনটাই বাদ পড়েনি।ইয়াহিয়া খানতের নোংরামীর ইতিহাস কম বেশি সবাই জানলেও অনেক অজানা তথ্যও নতুন করে চোখে ভেসে উঠবে। উপন্যাসের নামের আড়ালে এটি তাই হয়ে উঠছে সমৃদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় অধ্যায়ের একটি দলিল।কেননা সুলেখক আনিসুল হক শুধু মাত্র উপন্যাস হিসেবেই নয় এটিকে করেছেন তথ্য সমৃদ্ধ একটি বই যার প্রমাণ স্বরুপ তিনি জুড়ে দিয়েছেন তথ্যসুত্র। ইতিহাসের প্রমত্ত ধারায় কেবল মাত্র গা ভাসিয়ে না দিয়ে লেখক তার সুনিপুন হাতে তুলে ধরেছেন বাস্তব চিত্র।তাই ‘জেনারেল ও নারীরা’ কেবল মাত্র একটি উপন্যাসের তকমা লাগিয়েই পার পেতে পারেনা বরং এটিকে আরো অনেক অভিধায় অবিহিত করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পেরে যারা আক্ষেপ করেন তারা এই বইটি পড়ে এক নিমিষে হারিয়ে যেতে পারেন সেই সব উত্তাল ভয়াল দিনে।একথা নিশ্চিত করেই বলা চলে “মা” উপন্যাসের পর সুলেখক আনিসুল হক আবার একটি অসাধারণ গ্রন্থ নিয়ে হাজির হলেন বাংলার আকাশে।যে গ্রন্থটি তার স্বীয় স্বকীয়তাবলে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে বলেই অনেক বোদ্ধা পাঠক মনে করেন।
আনিসুল হকের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরো অনেক লেখা বেরিয়ে আসুক এবং আমরা মুক্তিযুদ্ধকে আরো কাছ থেকে দেখি সেই প্রত্যাশাই করে অধিকাংশ পাঠক। তাই সবর্পরি আনিসুল হককে আমাদের ধন্যবাদ দিতে কাপন্য করা উচিৎ নয়। তিনি তার ‘জেনারেল ও নারীরা’ বইটির জন্য আরো একবার ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখেন।ধন্যবাদ আনিসুল হক কে।
………………….
#জাজাফী
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬