আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনেকক্ষণ হলো আমার বৈঠকখানায় বসে আছেন। পুজো সংখ্যার জন্য আমার একটা গল্প দেওয়ার কথা ছিল। তিনি ঐ গল্পটার জন্য জায়গাও খালি রেখেছেন।আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম একটা গল্প অবশ্যই দেব। তিনি সম্ভবত ভরসা পাননি তাই তাঁর এক সহসম্পাদকের হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে দেবার জন্য। খাম দেখলেই এখন বুঝতে পারি টাকা পয়সা নয়তো চেক। খুলে দেখি চেক পাঠিয়েছেন।আমার একটি গল্পের জন্য যতটা সম্মানী আমি আশা করি তিনি ঠিক সেরকমটাই পাঠিয়েছেন। উপন্যাস ছাড়া অন্য কোন লেখার জন্য আমি সাধারণত অগ্রিম টাকা নেইনা। আনন্দবাজারের জন্য একটি গল্প লিখে দেব বলে যখন কথা দিয়েছি তখন অবশ্যই দেব। কিন্তু সম্পাদক সাহেব সম্ভবত ঠিক ভরসা না পেয়ে অগ্রিম চেক পাঠিয়েছেন যেন গুরুত্বটা একটু বেশি হয়।
আমি সহসম্পাদকের হাত থেকে খামটি নিয়ে তাঁকে বলেছিলাম সম্পাদক সাহেবকে বলবেন আগামী রবিবার কাউকে পাঠিয়ে গল্পটি নিয়ে যেতে।যে কাউকে পাঠিয়ে দিলেই গল্পটি নিয়ে যেতে পারবে।দুদিন পর গল্পটা লিখে ফেললাম। রবিবার আসতে বেশি দেরি নেই। লেখার খাতাটা টেবিলের উপর রাখাই ছিল। আজ যে সেই রবিবার তা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। কবি জয়গোস্বামীর বাসায় মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রন ছিল। সেখানে আরো দু চারজনের সাথে দেখা হওয়ায় আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল। বাসায় ফিরে দেখি বৈঠকখানায় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক স্বয়ং উপস্থিত।ওঁকে দেখে মনে পড়লো আজতো লেখাটা দেওয়ার কথা ছিল।
বৈঠকখানার সোফাতে বসে কুশল বিনিময় শেষে সম্পাদক সাহেবকে আস্বস্ত করলাম আপনার দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই,আমি আপনার জন্য গল্প লিখে রেখেছি।আপনি নিজে না এসে কাউকে পাঠিয়ে দিলেও গল্পটি নিয়ে যেতে পারতো। তিনি মুচকি হেসে বললেন আপনার লেখা বলে কথা। নিজ হাতে নিয়ে যেতে পারার আনন্দই আলাদা। আর তা ছাড়া দেখা হলে দু’চারমিনিট আলাপও করা যাবে। আমি বললাম তা বেশ বলেছেন। এবার কার কার লেখা যাচ্ছে বলুনতো। বাংলাদেশের কারো লেখা কি নিচ্ছেন। সম্পাদক সাহেব আক্ষেপ করে বললেন এ ক’বছরে বাংলাদেশের লেখকেরা খুব এগিয়েছে। তাঁদের লেখার মানও বেড়েছে। এপার বাংলায় সমরেশ মজুমদার,শীর্ষেন্দু আর আপনি ছাড়া গল্পকারতো তেমন নেই।আপনি মৃন্ময় আচার্য একাইতো গল্পের ঝুলিটাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। কবিদের মধ্যে জয়গোস্বামীতো সবার উপরে। কিন্তু বাংলাদেশে আপনি নাম বলে শেষ করতে পারবেন না। বাংলা সাহিত্য এখন বাংলাদেশী লেখক কবিদের সম্পদে পরিণত হচ্ছে। তাঁরা আমাদের লেখা দিতেই চায়না। এর প্রধান কারণ আমরা একসময় ওঁদের লেখাকে পাত্তাই দিতাম না।
কথার ফাঁকে পরিমল এসে চা দিয়ে গেল। আমরা এক বাসাতেই থাকি। গ্রাম থেকে এসে আমার সাথেই থেকে গেল।নানা কাজে আমাকে সে সহযোগিতা করে।কাজের লোক বলে যে কথাটি আছে আমি আসলে তাকে সেই ঘরানার মধ্যে ফেলতে চাইনা।সে পরিবারের সব কাজ করে পরিবারেরই অংশ হিসেবে।আমরা একই সময়ে একই টেবিলে বসে খাই এতে আমাদের জাত যায়না। বিশ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে কখন কোন সময়ে এ বাসায় চা কফির দরকার।চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সম্পাদক সাহেবকে বললাম বাংলাদেশী সাহিত্যিকদের লেখাও আমাদের লেখার সাথে রাখতে পারলে পাঠক দুই বাংলার সাহিত্যের স্বাদ পেত। সিনেমা তৈরি হচ্ছে দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় যদিও তা নিয়ে খুব অসন্তোষের জন্ম হয়েছে তবে সাহিত্যে দুই বাংলাকে এক মলাটে আনতে পারলে কোন অসন্তোষ তৈরি হত কিনা বলতে পারছিনা। দুই বাংলা যদিও দুটি ভিন্ন দেশ তবে ভাষা যেহেতু এক তাই সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি হলে মন্দ হতনা।এ ব্যাপারে আপনাদের মত পত্রিকাওয়ালারা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
চায়ের কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখতে রাখতে সম্পাদক সাহেব বললেন দুই বাংলার লেখা এক মলাটে আনার চেষ্টা করবেন। আমি বললাম বসুন আমি আপনার জন্য রেডি করা লেখাটি নিয়ে আসি। লেখা শেষ করে টেবিলের উপর বই চাপা দিয়ে রেখেছিলাম গল্পটা মোট দশ পৃষ্ঠার লেখা।পৃষ্ঠা গুলো বইয়ের নিচ থেকে নিয়ে একটা খামে ভরে সম্পাদকের হাতে তুলে দিলাম।তিনি খাম থেকে লেখা বের করে আমার সামনেই পড়তে শুরু করলেন। তার আগে জানতে চাইলেন আমার সময় হবে কিনা। আমি সম্মতি দিলে তিনি পড়তে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য একটাই কোথাও খটকা লাগলে তিনি জেনে নিবেন। কম্পোজের সময় এতে সুবিধা হবে। অনেক সময় হাতের লেখা বুঝতে অসুবিধা হয়।গল্প পড়া শেস করে সম্পাদক কিছুটা উসখুশ করতে লাগলেন। আমি বললাম কি হলো গল্পকি ভাল হয়নি? তিনি বললেন আপনার লেখা গল্প ভাল হবেনা এটা কেউ বিশ্বাস করবে? তবে এই গল্পটা দারুণ ভাবে শুরু হয়েছে এবং শেষও হয়েছে তারুন ভাবে কিন্তু সমস্যা হল মাঝখানে এসে গল্পটায় চ্ছেদ পড়েছে। মনে হচ্ছে কি যেন ছুটে গেছে। একটা পযার্য়ে গল্পটা ঠিক মিলছেনা।
আনন্দবাজারের সম্পাদকের হাত থেকে গল্পটি নিয়ে জানতে চাইলাম কোন জায়গায় ওরকম মনে হয়েছে। তিনি দেখিয়ে দেওয়ার পর নিজে একবার পড়লাম। সম্পাদক ঠিকই ধরেছেন। গল্পটা ঐ জায়গায় এসে ঠিক মিলছেনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে গল্পটায় কোথাও এরকম চ্ছেদ ছিলনা।পৃষ্ঠা নাম্বার মিলিয়ে দেখতে গিয়ে খেয়াল হল ছয় নাম্বার পৃষ্ঠার পর সাত নাম্বার এবং আট নাম্বার পৃষ্ঠা মিসিং। সম্পাদকও তখন সেটা খেয়াল করলেন। আমি আবার লেখার টেবিলে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু ঐ পাতাটা পেলাম না। পরিমলকে ডেকে জানতে চাইলাম আমার লেখার টেবিলের আশেপাশে কেউ গিয়েছিল কিনা,কোন কিছুতে হাত দিয়েছিল কিনা।সে জানালো ছোট বাবু গিয়েছিল। ছোট বাবু মানে আমার ছেলে বিজয়। এবার পাঁচ বছরে পড়েছে।
বিজয়কে ডাকলাম সে এসে সম্পাদক সাহেবকে নমস্কার জানিয়ে পাশের সোফায় বসলো। সে তার মায়ের কাছ থেকে বেশ আদব কায়দা শিখেছে। ওর মা বনেদী ঘরের মেয়ে তাই ছেলেকে খুব ছোটবেলা থেকেই আদব কায়দা রপ্ত করিয়েছে। কারো শিখিয়ে দেওয়া ছাড়াই নমস্কার দেওয়া দেখে সম্পাদক সাহেব খুব বিস্মিত হয়েছেন। আমি বললাম বাবা বিজয় তুমিকি আমার লেখার টেবিলে গিয়েছিলে? সে বললো গিয়েছিল। আমি জানতে চাইলাম কেন গিয়েছিলে? ওর কথা থেকে জানা গেল প্লেন বানাবে বলে আমার লেখার টেবিলে গিয়েছিল কাগজ নিতে। যে খাতায় লেখা হয় মাঝে মাঝে কাগজওয়ালার কাছে তা কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়া হয় এটা সে দেখেছে এবং তা থেকে ভেবে নিয়েছে যে কোন লেখা কাগজের দরকার নেই। তাই সাদা কাগজ না নিয়ে প্লেন বানানোর জন্য ওখান থেকেই একটা কাগজ নিয়েছে যেখানে আমি আনন্দ বাজারের পুজো সংখ্যার জন্য গল্প লিখেছিলাম।
ছেলের কথা শুনে সম্পাদক সাহেব অবাক হলেন। আমি বললাম চিন্তা করবেন না দশ মিনিট বসুন আমি একপাতা নতুন করে লিখে দিচ্ছি। ছেলেটা যেটা দিয়ে প্লেন বানিয়েচে তা হয়তো পাওয়া যাবেনা। আমি বিজয়কে যেতে বলে সম্পাদকের সামনে বসেই মিলিয়ে লিখতে চেষ্টা করছি। ঠিক আগেরটুকুর মত হবে এমনটা আশা করা বোকামী। হয় তার চেয়ে ভাল হবে নয়তো তার চেয়ে খারাপ হবে। এক প্যারামত লিখেছি তখন সাইকরে একটা কাগজের প্লেন এসে পড়লো টেবিলের উপর। তাকিয়ে দেখি বিজয় দরজায় দাড়িয়ে আছে। প্লেটা হাতে নিতেই বুঝলাম এটাই লেখার হারানো অংশ। ছেলের সাধ করে বানানো কাগজের প্লেনটা ভেঙ্গে ওর মনে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলনা।সম্পাদকের মূখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম তিনি চাইছেন প্লেনটা ভেঙ্গে আগের লেখাটাই নিতে। আমার মন অবশ্য তা বলছিলনা। দ্বিধান্বিত ছিলাম।
ধীর পায়ে বিজয় এসে টেবিলের সামনে দাড়ালো তারপর প্লেনটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো বাবা আমি না হয় আরেকটা কাগজ নিয়ে নতুন প্লেন বানিয়ে নেব। আমি বুঝিনি লেখা কাগজও দরকারী হয়। ছেলের উপস্থিত বুদ্ধি আমাদের দুজনকেই মুগ্ধ করলো। পুজা সংখ্যা বের হবার পর সম্পাদক নিজে এলেন সৌজন্য সংখ্যা দিতে। কোলকাতার উপকন্ঠেই আমার বাড়ি। সম্পাদক সাহেব সাথে করে একটা ব্যাটারি চালিত রিমোটকন্ট্রোল প্লেনও নিয়ে এসেছিলেন বিজয়ের জন্য। সেটা পেয়ে বিজয় ভীষণ খুশি। কাগজের উড়োজাহাজের আনন্দ সে খুঁজে নেবে যান্ত্রিক উড়োজাহাজে।
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭