আজই শেষ করলাম আনিসুল হকের লেখা “সেলাই” উপন্যাসটি। পড়ে কেমন লেগেছে তা জানানোর জন্যই মুলত আজকের এই লেখাটি। হতে পারে এই লেখা পড়ে কারো কারো উপন্যাসটি পড়তে ইচ্ছে করবে। আবার এও হতে পারে আমার উপস্থাপনার দুর্বলতার কারণে অনেকেই বইটি পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এই বইটির পটভূমিই হয়তো আমার রিভিউয়ের দুর্বলতা থাকার পরও পাঠককে পড়তে আকৃষ্ট করবে।
সেলাই শব্দটি যখন শিরোনাম হিসেবে দেখি তখন মনে হতেই পারে এটি একটি ছোট গল্প।ছোট গল্প না হলেও হতে পারে একটি বড় গল্প।কিন্তু সেলাই আনিসুল হকের একটি উপন্যাস। তবে ভিন্ন ভাবে দেখলে এটিকে বড় গল্প বললেও ভুল হবেনা।যেমন সাহিত্য সমালোচকদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কোন উপন্যাসকে বড় গল্প বলে উল্লেখ করেছেন।কিন্তু গল্প বা উপন্যাসকে ছাপিয়ে গেছে এই লেখাটি। এটি একটি গল্প হয়েও গল্প নয়, আবার একটি উপন্যাস হয়েও উপন্যাস নয়।সেলাই শিরোনামের আড়ালে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কষ্টের কথা।যা কেবল মাত্র গল্প উপন্যাসের মত ক্রমাগত ভাবে বলে যাওয়া কোন দুঃখের কল্পিত কাহিনীই নয় এটি সত্য ঘটনা।
স্বজন হারানোর ইতিহাস বাংলাদেশে বহুকালের পুরোনো রীতিই হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু বিগত সময়ে স্বজন হারানোর ব্যথার সাথে এবারেরটার আকাশ পাতাল ব্যবধান।বিগত সময়ে আমরা হয় ভাষার জন্য স্বজন হারিয়েছি নয়তো একটি স্বাধীন দেশের জন্য স্বজন হারিয়েছি। কিন্তু আনিসুল হকের লেখা সেলাই উপন্যাসটির পটভূমিও স্বজন হারানো বিয়োগ ব্যথার সমন্বয়।রানা প্লাজা নামটি বললেই এ দেশের মানুষের মনে ভেসে ওঠে সেই হঠাৎ নেমে আসা বিপদের স্মৃতি।
সাধারণত সবাই জানে রানা প্লাজা শুধু শুধু ভেঙ্গে পড়ে অনেক মানুষ মারা যায়নি বরং এক ভাবে বলা চলে মানুষ গুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ ভবনে ফাটল ধরার পর পুরো ভবনটি অনিরাপদ ঘোষণা করার পরও পোষাক শিল্পমালিকেরা জোর করে শ্রমিকদের কাজে যেতে বাধ্য করেছিল এবং নিজেদের সংসার নিজেদের চাকরি বাঁচাতে বাধ্য হয়ে সেদিন তারা কাজে গিয়েছিল। সেই যে বাড়িতে বলে গিয়েছিল ফিরে আসবে কিন্তু আসতে পারেনি।ঢুকবো কি ঢুকবোনা এই দ্বিধা মনে নিয়ে কাজে ঢুকে না ফেরার দেশে চলে গেল কত জন। কতজন বেচে থেকেও মরার মত বেচে আছে আজও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।
সময়ের আলোচিত লেখক আনিসুল হক রানা প্লাজার সেই মর্মান্তিক ঘটনাকে পুজি করে লিখেছেন তার সেলাই উপন্যাসটি।সেলাই উপন্যাসটিতে একক ভাবে কোন কেন্দ্রিয় চরিত্র নেই। আবার নেই বললেও ভুল হবে কেন্দ্রিয় চরিত্রতো স্বয়ং রানা প্লাজা।তৎতালিন সময়ে দেশে বিদেশে সব থেকে আলোচিত ছিল এই রানা প্লাজা। দশতলা ভবন ধ্বসে যে পরিমান মানুষ মারা গিয়েছিল তা ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।মানুষের বেচে থাকার যে আকুতি সেদিন বেরিয়ে এসেছিল ধ্বসে পড়া ভবনের ভিতর থেকে তা শুনলে যে কোন পাষাণ হৃদয়ও কেদে উঠতো।
উপন্যাসে দেখতে পাই এমন একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে যার ব্যাগে একটা ভাজ করা চিঠি ছিল যে তার মাকে লিখেছে সে যে মাসে ৬০০ টাকা বাড়িতে পাঠায় তা থেকে কিছু কিছু বাচিয়ে যেন ডাক্তার দেখায়।আর বেতন বাড়লে সে আরো বেশি করে টাকা পাঠাবে বাড়িতে।চিঠিটা তার মায়ের হাতে পৌছার আগেই সে না ফেরার দেশে চলে গেল।যার উপর নির্ভর করে বেঁচে ছিল পুরো পরিবার।বিঁজলী নামে যে চরিত্রটিকে আমরা দেখতে পাই সে সন্তান সম্ভাবা। তার স্বামী নজিবর রানা প্লাজাতেই একটা গার্মেন্টসে চাকরি করে।সেদিনও কাজে যাবার আগে দুজনের মধ্যে কথা হয় ছেলে হলে নাম রাখবে শাকিব কারণ নায়ক শাকিব খানকে তাদের ভাল লাগে। আর মেয়ে হলে রাখবে মৌসুমী।নজিবর আর ফিরে আসেনা।বিজলী ঠিকই একদিন শাকিবের মা হয় কিন্তু নজিবর আর বাবা ডাক শুনতে পারেনা।
রানা প্লাজায় সেদিন যারা উদ্ধার কাজে যুক্ত ছিল তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দাউদ নামে একজন ছিল যে রানা প্লাজার একটা প্রতিষ্ঠানের মাইক্রো চালাত আর তার স্ত্রী ওখানে কাজ করতো।সে স্ত্রীকে খুজছে কিন্তু পাচ্ছেনা।তা বলে সে থেমে নেই। যাকে জীবিত পাচ্ছে উদ্ধার করছে যার লাশ পাচ্ছে সেটাও সে উদ্ধার করছে।এভাবে সে প্রায় ভুলেই যায় তার স্ত্রীও চাপা পড়েছে। সে যখন আশা ছেড়েই দিয়েছিল তখন দেখা গেল তার স্ত্রী বেঁচে আছে।বেঁচে থাকার যে কী আনন্দ তা কেবল তখনই বুঝতে পারে।
রাশেদা নামে যে চরিত্রটিকে দেখতে পাই সে বাচার আকুতি জানায় আর সবার মত। সে বলে তার দুই পা চাপা পড়েছে। দরকার হলে পা দুটো কেটে হলেও তাকে বাচানো হোক।লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে সাবের নামের উদ্ধার কর্মীটি লোহা কাটার করাত দিয়ে তার দুই পা কেটে শরীর থেকে আলাদা করে।দুজনকে যখন বের করে আনা হয় তখন সাবের জ্ঞান হারায়।
পুরো উপন্যাস জুড়ে রানা প্লাজার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। কোথাওবা আনন্দও আছে। যখন একজন জীবিত উদ্ধার হচ্ছে তখন যেন চারদিকে লটারি জেতার মত আনন্দ।আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই শোকের ছায়া নেমে আসছে।যখন একটা লাশ বের করে আনা হচ্ছে।
ঘটনাচক্রে দেখা যায় এক সালামের লাশ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ লেগে যায়। শেষ পযর্ন্ত যে পরিবার সালামের লাশ নিয়ে গিয়ে কবর দেয় তারা সরকারী ভাবে কিছু অনুদানও পাচ্ছে। এমন এক রাতে সালাম ফিরে আসে বাড়িতে।তার স্ত্রী দরজা খুলে দেখে তার স্বামী জীবিত ফিরে এসেছে। এটা তার কাছে বিস্ময়কর। সে তবে কার লাশ নিয়ে এসে কবর দিয়েছে?সালাম ভাগ্য গুনে বেঁচে গিয়েছিল।তাকে রানা প্লাজাতেই যেতে হয়নি। সে মলম পার্টির কবলে পড়ে একদিন অচেতন হয়ে ছিল ফলে সে ধ্বংসজজ্ঞ থেকে বেচে গেছে। কিন্তু লোক জানাজানি হলে পাওনা টাকাটা পাবেনা ভেবে সে রাতের আধারেই সীমান্তের কাছে বোনের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। যেন তিন চার মাস পর টাকাটা হাতে আসলে ফিরে যেতে পারে। অন্যদিকে দেখতে পাই সত্যিকারের যে সালাম মারা গিয়েছিল তার পরিবার হাহুতাশ করে।তারা কি এক জীবনে কোন দিন তাদের সালামের লাশটাও পাবেনা!
রানা প্লাজায় যত বেওয়ারেশ লাশ ছিল তাদের শেষ পযর্ন্ত স্থান হয়েছিল জুরাইন কবরস্থানে।হয়তো অন্যান্য কবরস্থানেও ঠাই হয়েছিল।যে ছোট্ট শিশু শাকিবের জন্ম হলো সে আজীবন অপেক্ষা করেও তার বাবাকে ফিরে পাবেনা।
আনিসুল হক তার সেলাই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে তৎকালিন সময়ে প্রকাশিত প্রথম আলোর সংসাদ হুবহু ব্যবহার করেছেন আবার কোথাও অনুলিখন করেছেন যা তিনি শুরুতেই পাঠককে বলে রেখেছিলেন।
সেলাই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বার বার ভেসে উঠছিল রান্না প্লাজার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত সেই সব হতভাগা মানুষের মুখ।এটি তাই একটি উপন্যাসের আড়ালে হয়ে উঠেছে একটি বেদনার কাব্য। এটি হয়ে উঠেছে স্বজন হারানো মানুষের স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে থাকার মত একটি বই। তবে আনিসুল হক রংপুর ও তার আশেপাশের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে কোথাও কোথাও আপনি তুমিতে কিছুটা সমস্যা করে ফেলেছেন।যদিও আমি ঠিক এ ব্যপারে সঠিক কিছু বলতে পারছিনা।
যেমন এক স্থানে তিনি লিখেছেন “তাকে শ্বাস নিতে হয় জোর করে।তার কষ্ট হয়।তার উপরে যদিল এই ভাবে কাউয়ায় ডাকপাড়ে,বুকটা ধরাস করি উঠে কিনা কন”।এখানে কিন্তু বিজলী নিজে কথা গুলো বলছেনা যে সে কাউকে প্রশ্ন করবে “বুকটা ধরাস করে উঠে কিনা কন”। কারণ তখন বিজলীর সামনে কেউ বসা ছিলনা এবং সে কারো সাথে কথাও বলছিলনা। দেখা যাচ্ছে লেখক বা বর্ননাকারী নিজে বলছেন।ওখানে শুরুতে তিনি স্বাভাবিক ভাষায় বলে শেষে এসে আবার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন যা সংগত হয়নি।
সেলাই উপন্যাসে আরো যে অংশটি যুক্ত হতে পারতো তা হলো উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পরও অগণিত মানুষ আজীবনের জন্য নিখোজই থেকে গেল সেটার বিস্তারিত বনর্না।থাকতে পারতো জুরাইনে পরিচয়হীন যে সব লাশ দাফন করা হয়েছিল তার বর্ননা। থাকতে পারতো কোন ধরনের সন্ধানই পাওয়া যায়নি এমন পরিবারের আরো কিছু কথা।কিন্তু সেসব কথা না থাকার পরও এটিকে ছোট চোখে দেখার উপায় নেই।রানা প্লাজা বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি অভিশপ্ত নাম। সেই অভিশপ্ত নামটি যেন কোন দিন হারিয়ে না যায় তার একটি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আনিসুল হক।সেই সব অগণিত স্বজন হারানোমানুষ গুলি ‘সেলাই’ উপন্যাসটি হাতে নিয়ে স্মৃতিকাতর হতে পারবেন। ফিরে যেতে পারবেন তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কাছে যাদেরকে তারা রানা প্লাজার মাটির নিচেয় আজীবনের জন্য মিশিয়ে দিয়ে এসেছেন।
————————————————————-
#জাজাফী
২৩ এপ্রিল ২০১৭
—————————————————–
উপন্যাসঃ সেলাই ।
লেখকঃ আনিসুল হক (Anisul Hoque)।
পটভূমিঃ রানা প্লাজা।