এই মাত্র পড়ে শেষ করলাম মা উপন্যাসটি।বহু বছর আগে ম্যাক্সিমগোর্কির লেখা বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস “মা” পড়েছিলাম।তখন আমার বয়স অনেক কম ছিল এবং সাহিত্য তখন এখনকার চেয়েও অনেক কম বুঝতাম।যদিও এখনো বলার মত তেমন কিছু বুঝিনা তার পরও পড়াশোনার পরিধি বাড়ার পাশাপাশি বয়সের ছুটেচলায় কিছুটা বুঝতে শিখেছি।আনিসুল হকের লেখা মা উপন্যাসটিকে তাই বিশ্বসাহিত্যের অংশ বলে মনে করতে আমার দ্বিধা হয়না।শুনেছি অলরেডি অনেক গুলো ভাষায় উপন্যাসটি অনুদিত হয়েছে।বিশ্বের অগণিত ভাষার অগণিত সাহিত্য প্রেমিদের হাতে এই বইটি তুলে দেওয়া উচিত।
এতো বিখ্যাত উপন্যাস হওয়ার পরও কিভাবে কিভাবে যেন আমিও প্রায় চৌদ্দ বছর পার করে দিয়েছি এটা পড়তে। এটাওকি কোন কাকতালীয় ব্যপার কিনা জানিনা।মা উপন্যাসের গল্প আমি অনেক আগেই শুনেছি।এবং অনেকবার শুনেছি স্বয়ং লেখকের মুখে।ভাষা প্রতিযোগ কিংবা গণিত উৎসবে আনিসুল হক যখন বলতেন আজাদের মায়ের ভাত না খাওয়ার গল্প তখন চোখ দিয়ে পানি চলে আসতো।শুধু ওইটুকু কথা শুনেই এতো ভালবাসা জমে গিয়েছিল তা বলার নয়।কত মানুষের কাছে কথা গুলো বলেছি তার হিসেব নেই।কোন এক অজ্ঞাত কারণে এই লেখাটি পড়তে এতো দেরি হলো।দেরি হলেও যে পড়তে পেরেছি এখন ভাল লাগছে।
প্রথম দিকে লেখকের বর্ননা থেকে আজাদের মাকে আমার কেন যেন ভাল লাগছিলনা। বার বার মনে হচ্ছিল তিনি ততোটা দেশ প্রেমী নন যতটা হওয়ার আশা করেছিলাম। কারণ তিনি কেবল ছেলের কথা ভাবতেন,ছেলেকে আগলে রাখতে চাইতেন এবং ছেলে যেন বাইরের সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে সেই চেষ্টা করতেন।উপন্যাসের ওই সব অংশ পড়তে গিয়ে বার বার রাগ হয়েছে।অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক।আমিওতো চাই মা বলুক যা দেশের জন্য যুদ্ধ কর,ঠিক যেমন আজাদ করেছিল।কিন্তু মা তাকে কিছুতেই মিছিল মিটিংএ যেতে দিতে আগ্রহী ছিলেন না।
যে মা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এক কাপড়ে বড়লোক স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারেন তিনি অত্যন্ত কঠোর এবং একরোখা এটা ভাবাই যায়।আজাদের বাবা আজাদের মাকে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন।কুটবুদ্ধিতে কান দিয়ে তিনি প্রথমে আজাদকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন এবং তিনি আজাদকে করাচিতে পাঠিয়ে আজাদের মাকে একাকী করে দিয়ে বিষন্ন করতে চেয়েছেন। ভেবেছিলেন এতে তিনি হয়তো ফিরে যাবেন কিন্তু আজাদের মা সাফিয়া বেগম হার মানেন নি।তার পর আজাদের বাবা কুটবুদ্ধি শুনে তাকে তার বাড়ি ছাড়াও করেছেন কিন্তু কিছুতেই তাকে টলানো যায়নি। আলিশান বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি বলেছিলেন বেচে থাকতে আজাদের বাবা তার মুখ দেখতে পারবে না সত্যি সত্যিই তিনি সেটাই দেখিয়েছেন।
যুদ্ধ শুরু হলে আজাদের মাকে আমি অন্যরুপে দেখতে পেলাম।অনায়াসেই তিনি আজাদকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।তবে তিনি পীর সাহেবকে খুব মান্য করতেন।পীর সাহেব বলেছিলেন বলেই তিনি আজাদকে যুদ্ধে যেতে দিয়েছিলেন।সম্মুখ সমরে আজাদ খুব বেশি অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে আজাদ অনেক স্মরণীয় একটি নাম। এক মা যে তার ছেলেকে বলে বাবা শক্ত হয়ে থাকিস।কোন কিছু স্বীকার করিস না সেই মা কে সালাম জানাই।
আনিসুল হকের লেখা সব থেকে নামকরা বই এটা।সবাই এটিকে উপন্যাস বলে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেও আমি এটাকে কেবল মাত্র উপন্যাসের তকমায় আটকে রাখতে চাইনা।আমার মতে এটি ইতিহাসের একটা আকর।মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথা এই বইয়ে আমি জানতে পেরেছি। লেখক সব শেষে গ্রন্থপুঞ্জি দিয়ে আরো উপকৃত করেছেন।ফলে মুক্তিযুদ্ধকে জানতে আগ্রহীরা ওই রেফারেন্স বই গুলোও পড়ে দেখতে পারবে।
পৃথিবীর প্রতিটি মাই অসাধারণ।তবে আজাদের মা একটু বেশিই অসাধারণ ছিলেন।সবাই জানতো তার একটি মাত্র সন্তান আজাদ কিন্তু আদতে তার ছিল অনেক সন্তান। যেন পুরো মুক্তিবাহিনীই ছিল তার সন্তানে ভরপুর।আজাদের বন্ধুদের কেউ কেউ যেমন তাকে আম্মা বলে ডাকতো তেমনি আজাদের কাজিনদের অনেকেই তাকে আম্মা বলেই ডাকতো। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন সবার মা।বঙ্গ মাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে কেন বঙ্গমাতা বলা হয় জানিনা তবে শহীদ আজাদের মাকে বঙ্গমাতা বললে এতটুকুও ভুল হবেনা।
আনিসুল হকের অনেক বই আমি পড়েছি এবং এখনো পড়ছি। সেই সব বইয়ের মধ্যে অসাধারণ অনেক বই আছে।মা বইটি তার লেখা হাতে গোনা কয়েকটি সেরা বইয়ের একটি।মুক্তিযুদ্ধ এবং এক অসাধারণ মায়ের গল্প তিনি তুলে ধরেছেন সুনিপুন ভাবে। লেখক আনিসুল হক তার লেখা মা বইটার মাধ্যমে মূলত আজাদ হয়েই ফিরে এসেছেন আমাদের মাঝে। আজাদ বলেছিল যদি সে বিখ্যাত হয় তাহলে তার মাকে নিয়ে লিখবে এবং সেটা বিশ্ববাসী জানবে। আজাদ নেই,আজাদের মায়ের অগণিত সন্তানের মধ্য থেকে একজন আনিসুল হক আজাদের হয়ে কিংবা আজাদ রূপে আবির্ভূত হয়ে সেই মায়ের কথা লিখেছেন আন্তরিকতার এতটুকুও কমতি না রেখে।
পাঠক মাত্রই তাই মা উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে চোখে জল ফেলবে।আমি এখনো জাহানারা ইমামের লেখা “একাত্তুরের দিনগুলি” পড়িনি।হয়তো কাল পরশু থেকেই পড়তে শুরু করবো।মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির কথা জানতে মনটা অস্থির থাকে। আজাদদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি সে জন্য আমরা তাদের কোন দিন ভুলবো না।
মা
আনিসুল হক
২২ এপ্রিল ২০১৭ রাত ৩.২৭