নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেক বড় করে তুলেছে। তবে নোবেল পুরস্কারকে এক পাশে সরিয়ে রাখলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সবর্কালের সেরা লেখক কবিদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠতম। একমাত্র মহাকাব্য ছাড়া সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। এবং সাহিত্যের যে শাখাতেই তিনি হেটেছেন সেখানেই রেখে গেছেন তার পায়ের স্থায়ী ছাপ। সেই ছাপ কোন কালেও মুছে যাবেনা এটা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই বিশ্বাস করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একজন বিশ্বমানের কবি যার প্রতিটি লেখা নিয়েই বিস্ময় প্রকাশ করা যায়। তার লেখা গানও তাই সেই অর্থে সাহিত্যের অন্যতম একটি পার্ট। লেখা ও প্রকাশের দিক থেকে শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দশম উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে সুস্থ্যতার লক্ষ্যে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থান করছিলেন। সময়টা ছিল ১৯২৮ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর গ্রন্থ শেষের কবিতা সেখানেই লেখা। শেষের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় প্রবাসী’তে, ধারাবাহিকভাবে ভাদ্র থেকে চৈত্র পর্যন্ত।শেষের কবিতা নামটার মধ্যেই রয়েছে এক কাব্যময়তা ফলে অনেকে একে কবিতার বই ভেবে ভুল করে। আদতে এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম রোমান্টিক উপন্যাস । রোমান্টিকতার দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে শেষের কবিতা বরাবরই প্রথম কাতারে অবস্থান করছে। কপালকুন্ডলাতে যেরকম কোথাও কোথাও রোমান্টিকতার বিচ্ছুরণ দেখা গেছে শেষের কবিতার পুরোটাই রোমান্টিকতায় ভরপুর।
শেষের কবিতার প্রধান চরিত্র অমিত রায় ব্যারিস্টার। ইংরেজি ধাঁচে রায় পদবীকে “রয়” ও “রে”তে রূপান্তর যে কিনা নিজের নামের মূল বক্তব্যটাই বদলে ফেলেছে। নামের অসামন্যতা কামনা করে অমিত এমন একটি বানান বানিয়ে ফেলেছে যাতে ইংরেজ বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে নামটার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেছে-অমিট রায়ে। লাবণ্যের বাবা অবনীশ দত্ত এক পশ্চিমি কলেজের অধ্যক্ষ। মাতৃহীন মেয়েকে এমন করে মানুষ করেছেন যে, বহু পরীক্ষা পাসের ঘষাঘষিতেও তার বিদ্যাবুদ্ধিতে লোকসান ঘটাতে পারে নি। এমন কি, এখনো তার পাঠানুরাগ রয়েছে প্রবল। লাবন্যর বাবার একমাত্র শখ ছিল বিদ্যায়। মেয়েটির মধ্যে তাঁর সেই শখটির সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি হয়েছিল। তাঁর আর একটি স্নেহের পাত্র ছিল। নাম শোভনলাল। অল্প বয়সে পড়ার প্রতি এত মনোযোগ আর কারো দেখা যায় না। প্রশস্ত কপালে, চোখের ভাবের স্বচ্ছতায়, ঠোঁটের ভাবের সৌজন্যে, হাসির ভাবের সরলতায়, মুখের ভাবের সৌকুমার্যে শোভন লালের চেহারাটি দেখবামাত্র মনকে টানে। মানুষটি নেহাত মুখচোরা, তার প্রতি একটু মনোযোগ দিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দুই দিক থেকে আসা দুটো গাড়ি মুখোমুখি সংঘর্ষে পতিত হয়। গাড়ি দুটির একটিতে ছিল বিলেত ফেরত ব্যারিষ্টার অমিত রায় আর অন্যটিতে ছিল লাবণ্য নামের লাস্যময়ী নারীটি। শিলং পাহাড়ের পথে সেই আকস্মিক দুর্ঘটনাই শেষের কবিতার সুচনা করে। অমিত আর লবণ্য পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়। নির্জন পাহাড়ের সবুজ অরণ্য ঘেরা দুর্লভ অবসরে দু’জন দু’জনকে দেখে মুগ্ধ হয়। যার পরিণতি দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত ভালোবাসায়। লাবণ্য পণ করেছিল নির্জন ওই প্রান্তরে সে একাকী বই পড়বে আর পাশ করবে, এমনি করেই তাঁর জীবন কাটবে। সে হঠাৎ দেখতে পেল সে-ও ভালোবাসতে পারে। আর অমিত যেখানে মেয়েদের কাছে সোনার রঙের দিগন্ত রেখা- ধরা দিয়েই আছে, তবু ধরা দেয় না। রুচির তৃঞ্চা মিটিয়ে কত সুন্দরী মেয়েদের পাশ কাটিয়ে এসেছে এতকাল। সেই বন্দি হলো লাবণ্য প্রেমে।
নব্য প্রেমিক প্রেমিকা শিলংয়ের পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে সময় কাটায় গান গেয়ে, আবৃত্তি শুনে, পাখি দেখে আর স্বপ্ন বোনে আগামী দিনের। প্রকৃতি যেন ওদের ভালোবাসার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। এমন সময় অমিত লাবণ্যকে বিয়ে করতে অস্থির হয়ে উঠে। কিন্তু লাবণ্যর মন তাতে সায় দেয় না। লাবণ্য ও অমিতের মধ্যে তখন শুরু হয় ব্যক্তিত্বের সংঘাত। অনেক তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমানের পর অমিত লাবণ্যর ভালোবাসা যখন অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে হঠাৎ করেই তখন ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। এবং সেই সময় অমিতের বোন সিসি ও তাঁর বন্ধু কেতকী শিলং এসে উপস্থিত হয়।
কেতকীর সঙ্গে বিলেতে থাকার সময় অমিতের একটা গভীর মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিল। এবং সে সময়টাতে অমিত কেতকীকে ভালোবেসে যে আংটি পরিয়েছিল, লাবণ্যর সঙ্গে অমিতের বিয়ের খবর শুনে কেতকী সে আংটি খুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে শিলং ছেড়ে চেরাপুঞ্জি চলে যায়। অমিত যে আংটিটি লাবণ্যকে পরিয়ে ছিল সেটিও সে খুলে দেয় অমিতের হাতে। অমিত কি করবে ভেবে পায় না। লাবণ্যর পরামর্শে অমিত চেরাপুঞ্জি যায় কেতকীদের ওখানে। কদিন পর ফিরে এসে দেখে লাবণ্য চলে গেছে শিলং ছেড়ে। কোনো ঠিকানা রেখে যায়নি। এক সময় অমিত ফিরে যায় কলকাতায়। তারও কিছুকাল পরে অমিতের সঙ্গে বিয়ে হয় কেতকীর। এর মধ্যে লাবণ্যর একটি চিঠি আসে অমিতের কাছে। সে চিঠিতে লেখা- ছয়মাস পর রামগড় পর্বতের শিখরে শোভনলালের সঙ্গে লাবণ্যর বিয়ে। প্রথম যৌবনে শোভনলাল লাবণ্যকে ভালোবেসে ছিল; কিন্তু লাবণ্যর অবজ্ঞা ও অপমানে শোভন দূরে চলে যায়। এক সময় শোভনলালকে বরদান করবে বলেই লাবণ্য নিজের অগোচরে অপেক্ষা করে বসে ছিল এতকাল, আর এখন সেই শোভনলালই শেষ পর্যন্ত এলো তাঁর জীবনে।
বাংলা সাহিত্যে রোমান্সে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচাইতে বেশি।আর তার রোমান্টিক উপন্যাসের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় আর পাঠক-নন্দিত হলো ‘শেষের কবিতা’।শেষের কবিতার কিছু লাইন আপনাকে দিবে দর্শনের পূর্ন প্রান,আর কিছু লাইন আপনাকে ভাসাবে রোমান্সের সাগরে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে অমিত কিংবা লাবণ্য দুজনেই তাদের ভালবাসা নিয়ে নাটক করেছে। কারণ অমিত কেতকিকে আগেই ভালবাসার পরও লাবণ্যর রুপ দেখে পাগল হয়ে গেছে যেটা তার ভালবাসায় খুত বলে ধরে নেওয়াই যায়। কারণ খাটি প্রেমিক জীবনে একবারই প্রেম করে। সেই প্রেম নিয়েই সে বেচে থাকে। পক্ষান্তরে অমিত প্রথম প্রেমের কথা ভুলে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত লাবণ্যকে পেতে চায়। ঠিক একই ভাবে লাবণ্যও শোভনলালকে মনে মনে ভালবাসা এবং তাকে বরমাল্য পরানোর স্বপ্ন দেখার পরও অমিতকে ভালবাসার কারণে তার ভালবাসাও প্রশ্ন বিদ্ধ। সব শেষে দুজন আগের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার ফলে একই সাথে প্রেমের সফলতা ও ব্যর্থতা প্রমানিত হয়। অমিত যেমন পুর্ববর্তী প্রেম কেতকীকে পেয়েছে আর হারিয়েছে প্রিয় প্রেম লাবণ্যকে তেমনি লাবণ্য পেয়েছে পুববর্তী প্রেম শোভনলালকে আর হারিয়েছে স্বপ্নাতুর সময়ের স্বপ্নের মানুষ অমিতকে। শেষের কবিতার অমিত আর লাবণ্যর প্রেমকে তাই এক অর্থে বলা যেতে পারে যে ভালবাসার সমাপ্তি ছিল কিন্তু মিলন ছিলনা।