Thursday, November 21, 2024
Homeগল্পইবনের বাবা

ইবনের বাবা

প্যারেন্টস ডে তে সবাই বাবা মাকে নিয়ে আসলেও ইবন বাবা মাকে প্যারেন্টস ডের কথা বলেইনি।ইবন ক্লাস ফোরে পড়ে।সবাই যখন অডিটোরিয়ামে বাবা মায়ের সাথে আড্ডায় মেতে আছে ইবন তখন স্টেজের পিছনে মুখ গোমরা করে বসে আছে।একটু পরে তাকে মঞ্চে উঠে কিছু বলতে হবে।ক্লাসে এতো ছাত্র ছাত্রী থাকতে তাকেই সিলেক্ট করায় খুব রাগও হচ্ছে।বাবা মার উপর তার ভীষণ রাগ।মনে মনে ভেবেছে আজ ইচ্ছে মত বলবে।একসময় তার ডাক পড়তেই মঞ্চে উঠলো ইবন।সবাই হাততালি দিয়ে ওকে অভিনন্দিত করলো। কিন্তু সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ইবন প্রথমেই যে কথাটা বলে উঠলো তা হলো “প্যারেন্টস ডে নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।আমাকেতো বাবা মা ভালই বাসে না, তাহলে আমি বাবা মাকে নিয়ে কিইবা বলতে পারি।“

ওর কথা শুনে পুরো স্কুল অডিটোরিয়ামে শোরগোল পড়ে গেল।ইবন তখন বলতে শুরু করলো।আমার বাবা মা যে আমাকে ভালবাসে না তার প্রমান দেই।আমি যখন খুব ছোট তখন বাবা একদিন আমাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুকুরের মাঝে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।আমি একটু একটু করে পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম। অনেক পানি খেয়েছি।তার পর বাবা আমাকে উঠিয়েছে। এভাবে আমাকে অনেক দিন বাবা ভরা পুকুরে ছুড়ে মেরেছে।বাবা যদি ভালবাসতো তবে নিশ্চই আমাকে পুকুরে ছুড়ে মারতো না। এর পর ভাইয়ার একটা সাইকেল ছিল।বাবা আমাকে সেই সাইকেলে উঠিয়ে ধরে না থেকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিত।

আমি কতবার যে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি তার কোন ঠিক নেই। বাবা আমাকে ভালবাসলে নিশ্চই ওভাবে ধাক্কা দিত না।বাবা আমাকে কাধে করে নারকেল গাছের অনেক উপরে নিয়ে ছেড়ে দিত। আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে নেমে আসতাম। বাবা আমাকে ভালবাসলে ওরকম করতে পারতো না।মাও আমাকে ভালবাসে না।মাকে যদি বলতাম আম্মু দুধ দাওতো সে আমার সামনে গুড়ো দুধের কৌটা,চিনি আর গ্লাস এনে রেখে দিত।ভালই যদি বাসবে তবে সে দুধ গুলিয়ে দিত।আমি স্কুলে যাওয়ার সময় সে আমার জুতার ফিতা বেধে দিত না,পাশে দাড়িয়ে শুধু বলে দিত। আম্মু যদি আমাকে ভালই বাসবে তবে সে জুতার ফিতা বেধে দিত।

আমার বন্ধুদের সবার আম্মু আব্বু তাদেরকে ভালবাসে,সব করে দেয় কিন্তু আমার আব্বু আম্মু আমাকে ভালবাসে না। সব আমাকেই করতে হয়।আমি আমার আব্বু আম্মুর সাথে তাই কথাই বলি না। সে জন্যই প্যারেন্টস ডের কথাও তাদের বলিনি।“এটুকু বলে ইবন মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেল। সেদিন আর সে অনুষ্ঠানে থাকেনি।সবাই ছোট্ট ইবনের কথা গুলো শুনে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিল।শুধু বাংলা মিস ছাড়া।ইবনের বলা কথা গুলো ইবনের বাবা মার কানেও চলে গেল কিন্তু তারা কিছু বললো না।

তারা জানে ইবন তাদের উপর অনেক রেগে আছে কিন্তু কোন ভাবেই তারা তার রাগ ভাঙ্গাতে পারেনি।পরদিন ক্লাসে যাওয়ার পর বাংলা মিস বললেন আজ আর তোমাদেরকে আমি কিছু পড়াবো না। আমি কিছু প্রশ্ন করবো তোমরা হ্যা অথবা না বলবা কিংবা হাত উচু করবা।সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলো।এমনকি ইবনও খুশি হলো।বাংলা মিস বললেন তোমাদের মধ্যে কে কে সাতার কাটতে পারো হাত উচু করো।দেখা গেল ইবন ছাড়া আর কেউ সাতার কাটতে পারে না।এর পর বাংলা মিস জানতে চাইলেন তোমাদের মধ্যে কে কে সাইকেল চালাতে পারো হাত উচু করো।

এবারও ইবন হাত উচু করে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সে ছাড়া আর কেউ সাইকেল চালাতে পারেনা।বাংলা মিস একে একে প্রশ্ন করতেই থাকলেন। কে কে গাছে উঠতে পারো হাত উচু করো,কে কে জুতার ফিতা বাধতে পারো হাত উচু করো,কে কে গুড়ো দুধ গুলিয়ে খেতে পারো হাত উচু করো। দেখা গেল প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই কেবল মাত্র ইবন ছাড়া আর কেউ কিছু পারে না।বাংলা মিসের মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো।তিনি ইবনের কাছে এসে কাধের উপর হাত রাখলেন। ওর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললেন ইবন তুমি কি কিছু বুঝেছ?ইবন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র।

সে মাথা দুলিয়ে বললো হ্যা সে বুঝেছে এবং সে বাংলা মিসকে বললো মিস আমি কি বাসায় যেতে পারি?বাংলা মিস তাকে ছুটি দিয়ে দিলেন।ইবনের গাড়িটা গেটের বাইরেই পার্ক করা ছিল।ড্রাইভার আংকেলকে বলে সে সোজা বাসায় চলে গেল।আব্বু আম্মু দুজনেই বাসায় ছিলেন।ইবন দৌড়ে গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো আই লাভ ইউ আম্মু। তুমিই পৃথিবীর সেরা আম্মু।তার পর মাকে ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বললো আব্বু আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমিই পৃথিবীর সেরা বাবা।তুমি আমাকে যত ভালবাসো পৃথিবীর কোন বাবাই তার সন্তানদের অতোটা ভালবাসে না।ইবনের কথা শুনে বাবা মার চোখে অবিরাম আনন্দ অশ্রু ঝরতে লাগলো।বিগত তিন বছর ইবন বাবা মার সাথে কথা বলে নি।স্কুল থেকে ফেরার পর ইবন সেই যে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে বাবা তাকে আর ছাড়েইনি।সেদিন সে বাবাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়েছে।

জাজাফী

১৫ জুন ২০১৬

 

125 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Most Popular