ছোট্ট আলীমের মন খারাপ।তার কোন বন্ধু নেই।যাওবা একটা বন্ধু ছিল সেও তার বাবা মায়ের সাথে অন্য কোথাও চলে গেল।অবশ্য আলীমের ক্লাসে কিছু বন্ধু আছে কিন্তু ক্লাস শেষ হলেইতো তারা যার যার বাড়িতে চলে যায়।শুধু মাত্র নিরব নামের বন্ধুটি ওর সাথে সাথে বাড়ি ফেরে।নিরবের বাসা ছিল ওদের বাসার পাশেই।দুজনের মধ্যে দারুন বন্ধুত্ব ছিল।কিন্তু বাবা বন বিভাগের কর্মকর্তা হওয়ায় হুট করে নিরবকে অন্য যায়গায় চলে যেতে হলো।আলীমের বাবাও বন বিভাগের কর্মকর্তা।হয়তো একদিন তাকেও আবার বদলী হয়ে চলে যেতে হবে।কিন্তু আলীম এখন যেখানে আছে সেখানে আশেপাশে ওর বয়সী আর কেউ নেই।যারা আছে তারা সবাই অনেক বড় নয়তো খুবই ছোট।আলীমের এক মাত্র বন্ধু ছিল নিরব।এখন সে চলে যাওয়ার পর আর কোন বন্ধু নেই যার সাথে সে স্কুল থেকে ফিরবে,বিকেলে খেলবে,পরদিন একসাথে আবার স্কুলে যাবে।
আলীম এখন আকাশ দেখে মজা পায়না,টিভিতে কার্টুন দেখেও মজা পায়না।বন্ধুহীন জীবন ছোট্ট আলীমের অসহ্য লাগে।ওর মন খারাপ দেখে বাবা মা চিন্তা করে কি করে ওর জন্য একটা বন্ধু এনে দেওয়া যায়।নতুন যে অফিসার আসবেন তিনি কিছুদিন হলো বিয়ে করেছেন,তার কোন ছেলে মেয়ে নেই।আলীমের জন্য তাদেরও মন খারাপ হয়ে যায়।প্রতিদিন যখন মন মরা করে স্কুলে যায় আবার মন মরা করে স্কুল থেকে ফেরে তখন বাবা মায়েরও খুব খারাপ লাগে।
আলীমের ছোট মামা ফোন করে একটা বুদ্ধি দেয়।খেলার সাথী হিসেবে ওর জন্য একটা ছোট্ট তুলতুলে খরগোশ কিনলে কেমন হয়? যে বুদ্ধি সেই কাজ।বাবা একটা সুন্দর তুলতুলে খরচগোশ কিনে আনে।আলীম খুব খুশি হয় আর স্কুল শেষে সেই খরগোশের সাথে খেলা করে।বন্ধুর অভাব অনেকটাই পুরণ হয়ে যায়।কিন্ত এক বিকেলে বাসায় ফিরে দেখে তার আদরের খরগোশটা নেই।খরগোশটা বাগানে খেলছিল কোন ফাকে শেয়ালে ধরে নিয়ে গেছে।আবার আলীমের মন খারাপ হয়।সে মনে করে যারা তাকে ছেড়ে চলে যায় তারা কোন ভাবেই তার বন্ধু নয়।
আলীমের ছোট মামা আবার একটা বুদ্ধি দেয়।ওর জন্য একটা কাকাতুয়া পাখি কেনার কথা বলে।পাখিটাকে কথা শেখালে আলীমের সাথে গল্প করতে পারবে।কাকাতুয়া পাখি মানুষের ভাল বন্ধু হয়।সত্যি সত্যি পরদিন ছোট্ট আলীমের জন্য বাবা একটা কথা বলা কাকাতুয়া কিনে আনে।সেটা আলীমের ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়।পাখিটা আলীমকে ডাকে আলীম আলীম কেমন আছ তুমি।পাখির মিষ্টি কথা শুনে আলীমের খুব ভাল লাগে।সে আবার একটা বন্ধু পেয়ে আগের দুঃখ ভুলে যায়।
কিন্তু আগের মতই একদিন আলীম স্কুলে যাওয়ার সময় পাখিটাকে খাবার দিয়ে খাচার দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায়। ফলে খোলা দরজা দিয়ে পাখিটা উড়ে চলে যায়।ফিরে এসে ছোট্ট আলীম দেখে খাচাটা শুন্য,সেখানে কাকাতুয়াটা নেই।তার মনটা আবার দুঃখে ভরে ওঠে।সে তার বাবাকে বলে যারা ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তারা কোন ভাবেই ওর বন্ধু নয়।নিরব চলে গেল,খরগোশটা চলে গেল এবার কাকাতুয়াটাও চলে গেল।ওরা কেউ আমার বন্ধু নয়।আমি এমন এক বন্ধু চাই যে কোন দিন ছেড়ে যাবেনা আমাকে।আমি ছেড়ে যেতে চাইলেও সে আমাকে ছেড়ে যাবেনা।
বাবা তখন ছোটমামাকে ফোনে কথা গুলো বললো।ছোটমামার অনেক বুদ্ধি কিন্তু এমন বন্ধু সে কোথায় পাবে যে কোন দিন ছেড়ে যাবেনা।সে ভাবতে থাকে কিন্তু কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারেনা।এক সপ্তাহ কেটে যায় কিন্তু সেরকম বন্ধু আর খুজে পাওয়া যায়না।ছোট্ট আলীমও খুব মন খারাপ করে থাকে।একদিন সে বাগানের বেঞ্চিতে বসে ছিল।এমন সময় সাদা পোশাকের একজন বৃদ্ধ মানুষ তার সামনে এসে দাড়াল।তার গায়ে ছিল সাদা পাঞ্জাবী,পরনে ছিল লুঙ্গী।তাকে দেখে ছোট্ট আলীমের একটুও ভয় লাগলোনা।লোকটা আলীমের পাশে বসলো তার পর বললো দাদু ভাই তোমার কি মন খারাপ? ছোট্ট আলীম তখন সব খুলে বললো এবং এমন একজন বন্ধু চাইলো যে কোন দিন তাকে ছেড়ে যাবেনা।
সেই বুড়ো দাদুটি হেসে দিয়ে বললেন ও এই কথা?আমার কাছেইতো আছে সেইবন্ধু।যে কোন দিন তোমাকে ছেড়ে যাবেনা।তুমি নিজে ছেড়ে যেতে চাইলেও সে তোমাকে ছেড়ে যাবেনা।দাদুর কথা শুনে ছোট্ট আলীমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে বললো আমাকে দাওনা সেই বন্ধু এনে।বুড়ো দাদু তার কাধে ঝোলানো ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুজলো।আলীম বললো দাদু ওই ছোট্ট ব্যাগেইকি সেই বন্ধুকে লুকিয়ে রেখেছ?বুড়ো দাদু বললেন হ্যা এই ব্যাগেই আছে সেই বন্ধু।আলীম খুব অবাক হয়ে বললো এতোটুকু ছোট্ট ব্যাগে অমন সুন্দর বন্ধু থাকে?যে কোন দিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা?
সাদা পাঞ্জাবী পরা সেই দাদু আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে আলীমের জন্য অকৃত্রিম এক বন্ধুকে বের করে ওর হাতে দিলেন।আলীম ভাল করে নেড়ে চেড়ে দেখলো তার পর বললো তুমি কি সত্যি বলছো এই বন্ধু কোন দিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা? দাদু তখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন সত্যি বলছি সে কোন দিন তোমাকে ছেড়ে যাবেনা।আলীম তার বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘরে চলে গেল।ছোট্ট আলীমের সেই বন্ধুটি ছিল একটি সুন্দর বই।একটা একটা করে বইয়ের পাতা উল্টে পড়তে পড়তে আলীম মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখলেন আলীম হাসিখূশি মনে বই পড়ছে।কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন আমাদের রাজপুত্রটাকে আজকে খুব খুশি দেখাচ্ছে যে।
আলীম বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো জানো বাবা আমি আজকে আমার সত্যিকারের বন্ধু খূজে পেয়েছি। যে কোন দিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা,একটা দাদু বলেছে এটা।বাবা সেই বন্ধুকে দেখতে চাইলে ছোট্ট আলীম হাতে ধরে রাখা সুন্দর বইটি দেখালো।বইটা হাতে নিয়ে বাবা দেখতে পেলেন সত্যিকারের বন্ধুর খোজ দেওয়া সেই দাদুটি পলান সরকার।
ছোট্ট আলীম একটু একটু করে বড় হলো।ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলো এবং অবাক হয়ে দেখলো তার সেই বন্ধু তাকে ছেড়ে যায়নি।অন্যদের যখন আপনজনের জন্য বন্ধুদের জন্য মনখারাপ হতো তখনো আলীম তার বন্ধুকে পাশে পেতো।এর পর ভার্সিটি শেষ করে একদিন আলীম মনে করলো তার বন্ধুর কথা সবাইকে জানানো দরকার।সে তখন বড় হয়ে নিজেই একটা বই লিখলো নাম দিলো রক ক্যাডেট।সেটি হয়ে উঠলো আরো অনেকের আজীবনের বন্ধু।ছোট্ট আলীম বুঝেছিল বইয়ের চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ হতে পারেনা।বই কখনো ছেড়ে যায়না।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭