কর্মব্যস্ত জীবনে নিজেকে একটু স্বস্তি দিতে অনেকেই ছুটি পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন।ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে একটি কমন প্রশ্ন হলো পাহাড় না সাগর? মানে পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসেন নাকি সাগরে। কারো কাছে পাহাড় ভালো লাগে, আবার কারো কাছে সমুদ্র। কিন্তু এমনওতো মানুষ আছে যাদের একই সাথে পাহাড় এবং সাগর দুটোই ভালো লাগে।সেই সব মানুষের জন্য দুটি আলাদা এলাকায় গিয়ে আলাদা ভাবে পাহাড় আর সাগর দেখার সময় করে ওঠা যেমন কঠিন, তেমনি খরচও যোগান দেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়। কিন্তু কেমন হতো যদি একই জায়গায় পাহাড়ের সাথে সাথে সাগরের দেখা মিলতো। হ্যা কক্সবাজার এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মেরিন ড্রাইভ ধরে সামনে প্রায় নব্বই কিলোমিটার জুড়ে একদিকে পাহাড় আরেকদিকে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ আছে। তবে এই পাহাড়গুলোতে চড়ার খুব একটা সুযোগ নেই। শুধুমাত্র হিমছড়িতে থাকা পাহাড়ে পযর্টকরা উঠতে পারেন। যদি কারো এর চেয়েই উঁচু পাহাড়ে উঠতে ইচ্ছে করে এবং পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সাগর দেখতে ইচ্ছে করে, তাহলে তাদের জন্য আকর্ষণীয় পযর্টন কেন্দ্র হতে পারে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া। বিশাল সাগরের জলরাশির মাঝে দুটি দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি কক্সবাজার শহরের উত্তর- পশ্চিম কোণায় স্ব-মহিমায় দণ্ডায়মান এ দ্বীপাঞ্চল। বাঁকখালী নদীর কিছু অংশ এবং বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় মহেশখালী। আবার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী-মহেশখালী সংযোগ ব্রিজ হয়ে সড়ক পথেও যাওয়া যায় মহেশখালী।
মহেশখালী কক্সবাজার জেলার একটি দ্বীপ উপজেলা। কক্সবাজার থেকে এটি মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রায় ৩৬২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, ধলঘাটা নামে তিনটি দ্বীপ রয়েছে। ১৮৫৪ সালে গড়ে ওঠে এই দ্বীপটি। তবে জনশ্রুতি আছে ১৫৫৯ সালের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়। বৌদ্ধ সেন মহেশ্বর থেকেই প্রায় ২০০ বছর আগে এই জায়গায়র নামকরণ হয়। যা মহেশখালী দ্বীপ নামেও পরিচিত। পান, মাছ, শুঁটকী, চিংড়ি, লবণ এবং মুক্তার উৎপাদনে সমগ্র বাংলাদেশে এই উপজেলার সুনাম রয়েছে। কক্সবাজার থেকে ৪-৫ ঘন্টা সময় ব্যায় করলেই মহেশখালী দ্বীপ থেকে ঘুরে আসা যায়।
মহেশখালীর দক্ষিণ প্রান্তের নয়ন জুড়ানো জেটিদ্বয় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য সারিসারি পানের বরজ আর সুপারি বাগান, পাহাড়ি কাঠ, ফল-ফলাদির বাগান, লবণের মাঠ, মাছের ঘেরের নয়নাভিরাম দৃশ্য, ফসলের সবুজ-শ্যামল মাঠ ও প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য সবাইকে আনমনা করে। সোনাদিয়ার শুঁটকি উৎপাদন ক্ষেত্র ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের হৈ-হুল্লোড়, সৈকতে ঝুড়ি হাতে শামুক কুড়ানো বালক-বালিকাদের চপলতা, ধান ও লবণ চাষিদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফাঁকে-ফাঁকে ক্লান্তি নাশী ভাটিয়ালী এবং আঞ্চলিক গান আর ভরা জোয়ারে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ মনকে আন্দোলিত করে। মহেশখালী জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে অনেক বড় মাপের অবদান। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ চিংড়ি উৎপাদিত হয় মহেশখালীতে। পোশাক শিল্পের পরেই চিংড়ি দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক খাত। মহেশখালীতে উৎপাদিত বাগদা, লইল্যা চিংড়ি ও কাঁকড়া এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সু-স্বাদু মাছ রফতানি করে সরকার বার্ষিক কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে।
মহেশখালি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ। এ দ্বীপের মৈনাক পর্বতের উপরে রয়েছে আদিনাথ মন্দির। এ দ্বীপের কারুকার্য এখানে আসা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এছাড়াও বছরের ফাল্গুন মাসে এখানে আদিনাথ মেলা অনুষ্টিত হয়। এখানে রয়েছে বেশ কিছু বৌদ্ধ বিহার, জলাবন ও নানা প্রজাতির পশুপাখি। এছাড়াও আছে রাখাইন পাড়া ও স্বর্ণ মন্দির। চাইলে ঝাউবাগান ও চরপাড়া বীচ থেকে ঘুরে আসতে পারবে যে কোনো পযর্টক। চলতি পথেই দেখতে পাবে পান গাছের বাগান আর লবণের মাঠ। মহেশখালীর পানের সুনাম সারা বাংলাদেশ ব্যাপী। তাই যারা কখনো পান খায়নি তারাও এখানে এসে মিষ্টি পান খেতে ভোলে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি যেন সোনাদিয়া-মহেশখালী দ্বীপ। মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এ দ্বীপ সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের কাছে সব সময় আকর্ষণীয় বিষয়। সারি সারি নয়নাভিরাম প্যারাবন আর এর পাশ ঘিরে অসংখ্য ছোট বড় খাল জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে। সোনাদিয়া দ্বীপে সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা সুউচ্চ বালিয়ারীর তুলনা দেশে দ্বিতীয়টি নেই। দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমিতে পানির কিনার ঘেঁষে লাল কাঁকড়া, সবুজ বনানী ও জীববৈচিত্র্যে ভরা এ দ্বীপটি যেন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে টানে। এছাড়াও সুবিশাল প্যারাবন ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ পাহাড়ী বনাঞ্চল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত করেছে। তবে সোনাদিয়া দ্বীপকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে ১৯৯৯ সালে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্র্যাল এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ দ্বীপের পরিবেশের মান উন্নয়নে ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বনায়ন কার্যক্রম।
সনাতন ধর্মীয় পুরোহিতদের মতে মহাদেব মহেশের নামানুসারে মহেশখালীর নামকরণ। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে মহেশখালী মূলত: কোন দ্বীপ ছিল না, কোন মহা প্রাকৃতিক পরিবর্তন বা দুর্যোগের কারণে মূল ভূখ- হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ দ্বীপের সৃষ্টি। টেকনাফ হতে সিলেট পর্যন্ত দেশের পূর্বাঞ্চলে টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহের অবিচ্ছেদ্য অংশই দ্বীপ মহেশখালীর দক্ষিণ থেকে উত্তর জুড়ে অবস্থিত। যেখানে রয়েছে মুসলিম, হিন্দু ও রাখাইন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সংমিশ্রণে বাঙ্গালী জাতিসত্তার এক অপূর্ব সম্মিলন।দেশের মূল ভূখ- থেকে বিছিন্ন জনপদ মহেশখালী শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে ধীর পায়ে। স্কুল-কলেজ, কাওমী ও আধা-সরকারি মাদ্রাসাসমূহের পাশাপাশি অবরোধবাসিনী নারী সমাজকে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিতকরণের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা মাদ্রাসা ও মহিলা কলেজ।
রয়েছে প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর অসংখ্য মসজিদ, মন্দির ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দৃষ্টি নন্দন ক্যাং। মহেশখালী প্রাকৃতিকভাবে চমৎকার ভৌগোলিক সৌন্দর্য নিয়ে গঠিত ও অবস্থিত। বলতে গেলে এমন দ্বীপমালা পৃথিবীতে বিরল। আয়তনের দিক থেকে মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর এবং হংকং এর প্রায় কাছাকাছি। মহেশখালীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চারপাশে সমুদ্র ও জলরাশি, যেন ভাসমান বিশাল এক জাহাজ বহর আর উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ও উঁচু পর্বতমালা, মনে হয় যেন জাহাজ বহরের সু-উচ্চ পাল। কাছ থেকে আর দূর থেকে যেখান থেকে দেখুন না কেন সমুদ্র ঘেঁষে উঁচু পাহাড় যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী ও নান্দনিক দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষকে অনায়াসেই আকৃষ্ট করবে।
মহেশখালীর সোনাদিয়া বিখ্যাত শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য। তদুপরি সোনাদিয়া আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবেও ভ্রমণ বিলাসী মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অর্থনীতির আর একটা বড় খাত হলো লবণ। এ দ্বীপে উৎপাদিত লবণ দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। বলা যায়, প্রায় এককভাবে বাংলাদেশের সমস্ত লবণ কক্সবাজার জেলায় উৎপাদিত হয়।যাঁরা সাগরপথে ট্রলার বা স্পিডবোটে চড়ে কোথাও যাননি, তাঁদের জন্য মহেশখালী ভ্রমন হবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য। স্পিডবোটে বা ট্রলারে চড়ে বাঁকখালী চ্যানেল পার হওয়ার সময়টা দারুণ। সকালবেলা দূরে রোদ আর নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। সুবিশাল পাহাড় আর অপরূপ দৃশ্যের এই দ্বীপ।
পযর্টন ও অর্থনৈতিক ভাবে অপার সম্ভাবনাময় মহেশখালী দ্বীপের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহালদশা, স্বাস্থ্য খাতে অরাজকতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এ অঞ্চলের মানুষকে ব্যথিত করে।ফলে পযর্টন শিল্পের প্রসারও সেভাবে ঘটছে না। শহরের সাথে এই দ্বীপের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌকা বা স্পিড বোট। প্রসব বেদনায় কাতর মহিলারা ছটফট করতে থাকে নৌকা কিংবা স্পিড বোটে। অনেক সময় বাচ্চা প্রসব হয়ে যায় নৌকা কিংবা স্পিড বোটে।অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমি মহেশখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে না পারলে পযর্টন শিল্পের এই অপার সম্ভাবনাময় দ্বীপটি থেকে আমরা সেভাবে সুফল ভোগ করতে পারবো না।আজকে যারা কক্সবাজারকে সত্যিকারের আকর্ষণীয় পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার গালভরা বুলি আওড়ান, তাদের ভেবে দেখা উচিত শুধুমাত্র একটি সৈকত, হিমছড়ির একটি মরা ঝর্ণা ও ডুলাহাজারার একটি নাম মাত্র সাফারী পার্ক দিয়ে তারা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মন জয় করা সম্ভব নয়।
এই শহরে নেই কোন আনন্দ-বিনোদনের সু-ব্যবস্থা। এমতাবস্থায় কক্সবাজারকে সত্যিকারের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে নতুন নতুন পর্যটন স্পট সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষত: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগর তনয়া মহেশখালীকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করতে হবে এবং মহেশখালীর পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। দ্বীপ অঞ্চলটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা যেতে পারে। মহেশখালীর রাখাইন পল্লী ও ক্যাং সমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কার, রাখাইনদের হস্তশিল্প ও সংস্কৃতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র রাখাইন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তাকে একটি পর্যটন স্পটে পরিণত করা যেতে পারে।
মহেশখালীর পর্যটন সম্ভাবনার অন্যতম প্রতিবন্ধক হলো দুর্গম যোগাযোগ ও অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উল্লেখ্য যে, আদিনাথ স্পটে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক আগমন করে থাকে। আসা-যাওয়ার পথে তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। মহেশখালীর প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কক্সবাজার-মহেশখালী চ্যানেলে পর্যাপ্ত স্পিডবোট, নৌকা, লঞ্চ ও সী-ট্রাক চালু পূর্বক অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মহেশখালী থানা প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে আদিনাথ অঞ্চলে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা যেতে পারে। অবিলম্বে বাঁকখালী ও মহেশখালী চ্যানেলের ভরাট হওয়া নদী ড্রেজিং এর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মহেশখালীতে স্থলপথে যাতায়াতের প্রধান সড়ক গোরকঘাটা-জনতাবাজার সড়কের ২৭ কি. মি. রাস্তা পূর্ণাঙ্গরূপে পাকা করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর পর্যটন সম্ভাবনার এক নবদ্বার উন্মুক্ত করবে। অভাগা দ্বীপাঞ্চলবাসীর সুবিধার্থে না হলেও মহাভাগ্যবতী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানীগুলোর ব্যবসায়িক সুবিধার্থে মহেশখালীর সাথে কক্সবাজার শহরের সরাসরি স্থল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে যমুনা কিংবা পদ্মাসেতুর ন্যায় একটি সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে।কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার আরেকটি পযর্টন স্পট হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপের মোট আয়তন ৭ বর্গকিলোমিটার। জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুতুবজোম ইউনিয়নে এর অবস্থান। এ দ্বীপের দুটি গ্রামে বর্তমানে প্রায় ১৭শ’ লোকের বসবাস। বাঁকখালী নদীর মোহনায় মহেশখালী পয়েন্ট থেকে স্পিডবোটে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপ। বর্তমানে ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি এফরেস্টেশন এ্যান্ড রিফরেস্টশন প্রকল্পের মাধ্যমে সোনাদিয়া দ্বীপের বনায়ন কার্যক্রম চালু আছে। এছাড়াও জলপাই রঙের সামুদ্রিক কাছিম ও পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়েছে। অসংখ্য খাল ও প্যারাবনের সারি গিয়ে মিলেছে দ্বীপের মূল ভূখন্ডে। যাওয়ার পথে নদী ঢেউ আর প্যারাবনের বাতাসের দোল খাওয়ার দৃশ্য যে কারও মন কেড়ে নেবে। একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে হবে এ দ্বীপে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় প্যারাবনের একটি বিরাট অংশ সোনাদিয়া দ্বীপে দেখা যায়। সোনাদিয়ার প্যারাবন বাইন বৃক্ষসমৃদ্ধ। দেশে বিদ্যমান ৩ প্রজাতির বাইন গাছই এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া প্যারাবনে গেওয়া হরিগোজা, নুনিয়া, ঝাউ ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদও রয়েছে। প্যারাবনের ভেতরে সুন্দরবনের মতো ছোট ছোট নদীর দু’পাশে নয়নাভিরাম দৃশ্যও চোখে পড়ে।
সোনাদিয়ার প্যারাবন চর, খাল ও মোহনা নানা প্রজাতির মাছ ও অমেরুদন্ডী প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। দ্বীপটির প্যারাবনসংলগ্ন খালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন- বাটা, কোরাল, তাইল্যা, দাতিনা, কাউন ও পোয়া পাওয়া যায়। সোনাদিয়া দ্বীপ ভ্রমণে প্রায় ১৪ কিলোমিটার প্রশস্ত সৈকত, সৈকত ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল ঝাউবন, সুউচ্চ বালিয়ারী, জালের মতো ছোট-বড় অসংখ্য খালবেষ্টিত ম্যানগ্রোভ বন, বিস্তীর্ণ ল্যাগুন্যাল ম্যাডফ্লাট, কেয়া নিসিন্দার ঝোপ, বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি চোখে পড়বে। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে অবস্থিত সুউচ্চ বালিয়ারীর তুলনা যেন দেশে দ্বিতীয়টি নেই। সমুদ্র ও সৈকত থেকে ঝাউবনের দৃশ্য অপূর্ব শোভাবর্ধন করে। সৈকত এবং বালিয়ারীর বিপন্ন জলপাই বর্ণের সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ারও উপযোগী স্থান এটি। স্থানীয়রা জানান, এখানে সামুদ্রিক সবুজ কাছিমও ডিম পাড়তে আসে। সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমিতে পানির কিনার ঘেঁষে বিচরণ করতে দেখা যায় লাল কাঁকড়া।
শীতকালে সোনাদিয়া দ্বীপে নানা ধরনের স্থানীয় ও জলচর পাখির আগমন ঘটে। চর এবং খালের ধারে জলচর পাখির বেশি সমাগম ঘটে। এখানে ৭০ প্রজাতির জলচর পাখির দেখা মেলে। ডিসেম্বর থেকে ফেরুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সোনাদিয়ায় জলচর পাখি বিশেষত দেশী-বিদেশী কাদাখোচা পাখির মেলা বসে এখানে। এই দ্বীপটিকে আকর্ষনীয় পযর্টনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি রাত্রী যাপনের সুন্দর ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কক্সবাজার সদর থেকে মহেশখালী পযর্ন্ত কেবল কারের ব্যবস্থা করলে পযর্টকদের আগ্রহ বাড়বে। ফলে এখান থেকে সরকারের বড় অংকের আয় হবে যা পযর্টন শিল্পকে আরো এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। তবে দ্বীপের অনন্য বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে অবশ্যই এখানে বড় বড় হোটেল মোটেল করা যাবে না। তার বদলে কটেজ তৈরি করা যেতে পারে এবং সেটা অবশ্যই সরকারি ভাবে। যেহেতু কক্সবাজার শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় তাই পযর্টকরা অনায়াসেই মহেশখালী ঘুরে শহরে ফিরে আসতে পারবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা ঠিক করতে পারলে সারা বছরই এই অঞ্চলটি হতে পারে পযর্টকদের জন্য শীর্ষ পছন্দের যায়গা।
-জাজাফী
২১ নভেম্বর ২০২৩