Thursday, May 2, 2024
Homeনিবন্ধঅনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরী।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরী।

মানুষের জীবনে কৈশোরকাল অনেকটা বসন্তের মত। এই সময়েই অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। বসন্তে যেমন গাছে গাছে নতুন জীবন ফিরে আসে, তেমনি মানুষ কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করে। এই সময়ে জীবনের একটি ভীত তৈরি হয়। কিন্তু সবার ভাগ্যে এই সময়টা ভালোভাবে পার করা সম্ভব হয় না। যেমন রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরী। এদের শৈশব সংকীর্ণ গলিতে এবং স্যাঁতস্যাঁতে ও অন্ধকারাচ্ছন্ন তাঁবুতেই কেটে যাচ্ছে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলা সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে থাকতে বাধ্য হয়েছে। যার অর্ধেকেরও বেশি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী। এসব শরণার্থীদের কেউ কেউ আশ্রয়শিবিরে বাস করছে। আবার অনেকে স্বাগতিক বাংলাদেশী কমিউনিটির আশ্রয়ে রয়েছে। সেই সব কিশোর কিশোরীদের কয়েকজনের জীবনের গল্প সবার সাথে তুলে ধরতে চাই।

কিশোর কিশোরীদের নিয়ে লিখতে গেলে সঙ্গত কারণেই তাদের আসল নাম পরিচয় প্রকাশ করা ঠিক নয় বলেই ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়। আজ থেকে চার বছর আগে মিয়ানমার থেকে অসংখ্য মানুষ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। যাদের সিংহভাগ ছিলো কিশোর কিশোরী। তাদেরই একজন জোবায়ের (ছদ্মনাম)। সে যখন বাংলাদেশে আসে, তখন সে শরণার্থী শিবিরের বাইরে যেতে ভয় পেতো। তার মন থেকে সহিংসতার স্মৃতি মুছে যায়নি। বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও সবসময় তার মধ্যে আতংক কাজ করতো। ১৪ বছর বয়সী জোবায়েরের বেশিরভাগ দিন কাটতো খুপরি ঘরের ভেতরে নির্জনে। পরিবারে তার কাছাকাছি বয়সী আরও ছয়টি ভাই বোন আছে। সবাই মিলে একটি খুপরি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অথচ কদিন আগেও যার জীবন ছিলো হাসি আনন্দে পরিপূর্ণ। স্কুলে যেতো,বন্ধুদের সাথে খেলতো। নদীর পানিতে নেমে সাঁতার কাটতো। এখানে আসার পর তার আর কিছুই করার সুযোগ নেই। শিক্ষার সুযোগও ছিলো না।

তার বয়সী ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরী আশ্রয়শিবিরে আসার পর শিক্ষার সুযোগ পায়নি। পরবর্তী সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নানাবিধ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর তাদের অনেকেই কিছু কিছু শিখতে শুরু করেছে। গত কয়েক বছরে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ থিয়েটার আর্টস দ্বারা পরিচালিত ইউনিসেফ সমর্থিত সামাজিক কেন্দ্রে যুব নেতৃত্ব এবং পিয়ার-টু-পিয়ার বিভিন্ন কর্যক্রমে তার মত কিশোর কিশোরীরা অংশ নিয়েছে। জীবনে নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগবে এমন দক্ষতা অর্জন এবং সমমনা বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ক্যাম্পে থাকা সামাজিক কেন্দ্রগুলো। ক্যাম্পে থাকা কিশোরদের মধ্যে যারা সামাজিক কেন্দ্রের সুবিধা নিচ্ছে তাদের দিন একরকম কাটছে কিন্তু যারা এর বাইরে তাদের দিন সম্পূর্ন আলাদা। খোলা আকাশের নিচে থাকলেও রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরীদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া নিষেধ। যদিও অনেকেই নানা ভাবে বাইরে গিয়ে কাজ করছে। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরায় তারা পরিচয় লুকিয়ে কাজ করছে। মেয়েদের সেই সুযোগ কম থাকায় তারা খুব একটা বাইরে যাচ্ছে না। কিন্তু কিশোরদের এই সুযোগ রয়েছে। আর যারা ক্যাম্পেই অবস্থান করছে তারা সাধারণত বন্ধুদের নিয়ে ক্যারাম খেলে,তাস খেলে বা আড্ডা দিয়ে সময় পার করে। দেশী বিদেশী নানা সংস্থার মাধ্যমে পরিবার প্রতি সহযোগিতা করা হয় ফলে অনেকের মধ্যেই একরকম গা ছাড়া ভাব দেখা যায়। কিন্তু অনেক কিশোর কিশোরী আছে যারা বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তারা তাদের আয়ের পরিমান বৃদ্ধির জন্য লুকিয়ে বাইরে গিয়ে পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত হয় বলেও দেখা যায়।

শরণার্থী কিশোর-কিশোরিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ নিরসনের লক্ষে ইউনিসেফ রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় কমিউনিটির কিশোর-কিশোরী৬দের বয়ঃসন্ধিকালীন বিকাশ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি সামাজিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে সামাজিক সংহতি উৎসাহিত করাও সামাজিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য। এই সব সামাজিক কেন্দ্রে অনেক বাংলাদেশী কিশোর কিশোরীও সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে। যেন দেশ থেকে বিতাড়িত শরণার্থী হিসেবে থাকা রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরীরা মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে পারে। তেমনই এক বাংলাদেশী কিশোরী সদস্য মানসুরা (ছদ্মনাম)। বয়স ১৫ বছর। গত দুই বছরে রোহিঙ্গা কমিউনিটির মেয়েদের সাথে তার মত বাংলাদেশী কিশোরী সদস্যরা দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। তারা প্রায়শই তাদের জীবন নিয়ে একে অন্যের সাথে গল্প করে। মানসুরার মতো সহজে বিশ্বাস করা যায় এমন অনেক কিশোরীকে পেয়ে রোহিঙ্গা কিশোরীরা তাদের লড়াই এবং প্রতিদিন কীভাবে তারা তাদের দেশকে মিস করছে সেই কষ্টের গল্প বলে।মানসুরা বলে, “একদিনের জন্যও বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারি আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তারা তাদের ঘরবাড়ি থেকে দূরে রয়েছে। এটা ভাবতেও খুব কষ্ট হয়”।

মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তখনই সবচেয়ে নিগ্রহীত হয়, নির্যাতনের শিকার হয়। ইউনিসেফ বাংলাদেশের ইমার্জেন্সি ম্যানেজার মাইকেল জুমা বলেন, “কিশোর কিশোরীরা যখন তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তারা যৌন নির্যাতন, পাচার ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সহ বিশেষ করে শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।এটি মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যয়কর একটি অভিজ্ঞতা, যা তাদের সুরক্ষা ও বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে”। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১৫ বছরের কম বয়সী অসংখ্য রোহিঙ্গা মেয়ে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে নানা সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। 

বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি। বাল্যবিবাহের ফলে নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়। বাল্যবিবাহ রোধে বিশ্বব্যাপী জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আইন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক আন্দোলন চলমান থাকলেও ফাঁকফোকর দিয়ে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো বাল্যবিবাহের এই হার রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক বেশি। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার পরিধি ব্যাপকহারে বেড়েছে ৷ অন্তত ৯০ শতাংশ বিয়ে শুধু অভাবের তাড়নায় হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষক ও সমাজকর্মীরা। একবার ভেবে দেখুন একটি কিশোরীকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র তার প্রতিদিনের খাবারের জোগাড় হবে এই আশায়। বাবা মা কতটা অসহায় হলে কেবল মাত্র খাবারের জোগাড় হবে,পেটে ভাতে বেঁচে থাকবে এই চিন্তা থেকে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারে।

কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরলে যে দৃশ্যটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে তা হলো বাচ্চা কোলে অসংখ্য কিশোরী। এ বিষয়ে যাদের পূর্ব ধারণা নেই তারা মনে করবে হয়তো বোনের কোলো তার ছোট ভাই বা বোন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কিশোরীদের কোলে থাকা শিশুটি তার নিজের সন্তান! যে নিজেই কৈশোর পেরোয়নি সে এখন আরেক শিশুর মা! মোহাম্মদ সেলিম নামে একজনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি মিয়ানমারের কারারুপাং এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কুতুপালং ক্যাম্পে ঠাঁই নিয়েছেন। তারা যখন মিয়ানমার বসবাস করতেন তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার প্রচলন ছিল। যার মুল কারণই হল নিরাপত্তা। বাংলাদেশে আসার পরও সেটিই বড় কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। তার মতে, “যদি আমার বোনটাকে আমি বিয়ে না দেই, তাহলে সে এদিক ওদিক চলাফেরা করবে আর ওরা ওর গায়ে হাত বাড়াবে। তাই আমরা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে করে সে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকবে। বাজারে যাবে না, এদিক ওদিক যাবে না। অধিকাংশ সময় সম্মান বাঁচাতে এটা করতে বাধ্য হতে হয়”।

তেমনই এক কিশোরীর ছদ্মনাম আকলিমা। বয়স ১৩ বছর। চোখের সামনে বাবা মাকে নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখেছে সে। তারপর কিছুদিন জীবন নিয়ে পালিয়ে থেকে একসময় দাদির সাথে তিন দিন অবিরাম হেটে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে এই দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাবা মা ছাড়া আকলিমাকে দেখার মত কেউ ছিলো না। সেই বাবা মা নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর দাদিই ছিলো একমাত্র আপনজন। কিন্তু শরাণার্থী শিবিরে থাকা দাদির পক্ষেও তার খরচ বহন করা সম্ভব ছিলো না। ফলে কয়েক মাস আগে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে! ১৩ বছর বয়সে যে কিশোরীর প্রজাপতির মত ডানা মেলে পৃথিবী দেখার কথা,স্কুলে যাওয়ার কথা,ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বিভোর থাকার কথা, সেই কিশোরী এখন কারো স্ত্রী হিসেবে সংসার শুরু করেছে। হয়তো কদিন বাদেই সন্তানের মা হবে। ডয়েচেভেলের সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মেয়েটি আক্ষেপ নিয়ে বলেছিল শুধুমাত্র পেটে ভাতে বেঁচে থাকার জন্য দাদি বাধ্য হয়ে তাকে বিয়ে দিয়েছেন! বিয়ে হয়েছে ফলে তার কাপড়,খাবার সব কিছুর দায়িত্ব স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীর লোকদের। যদি এসবের চিন্তা না থাকতো তবে সে এই বয়সে বিয়ে করতো না। সুযোগ পেলে সে লেখাপড়া করতো।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন আকলিমার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। হয়তো তাদের কারো নাম জরিনা, কারো নাম মর্জিনা বা নাফিসা হতে পারে। কিন্তু তাদের সবার ভাগ্য একই রকম। আকলিমার মতই আরেক কিশোরীর নাম জোবেদা। তারও বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। বয়স এখন ১৬ বছর। যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আরো কম ছিল। তাছাড়াও আইনগত ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স দুই থেকে তিন বছর বাড়িয়ে দেখানো হয়। হয়তো সে ক্ষেত্রে বিয়ের সময় আকলিমা বা জোবেদাদের প্রকৃত বয়স ১০ থেকে ১২ বছরও হয়ে থাকতে পারে।

ওরা জানে না ওদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত কেমন হবে। শুধু জানে বিয়ে করার কারণে খাবারের সংকট কাটাতে পেরেছে। শরণার্থী শিবিরে পরিবার হিসেব করে ত্রাণ দেয়া হয় ৷ তাই নিজের সংসার হওয়ায় ত্রাণ এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে ৷ মেয়েদের জন্য খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিবার তাদের বিয়ে দেওয়াই একমাত্র সমাধানের পথ হিসেবে মনে করে। এতে কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক অনেক ক্ষতি হতে পারে জেনেও তারা তা আমলে নেয় না। এমনও পরিবার আছে, যাদের সদস্য সংখ্যা দশ এগারো জন। ছোট বাসায় দেখা যায় দুইজন যুবক ছেলে আর দুইজন যুবক মেয়ে। তখন তাদের দুইটা আলাদা রুম দিতে হয় যা তাদের পক্ষে সম্ভব না। ফলে তারা মনে করে ওদের যদি বিয়ে দিতে পারি তাহলে কিছুটা সুবিধা হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ৷ এসব প্রতিষ্ঠানের গড়া স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসুতি মায়েদের এবং শিশুদের জন্য চিকিৎসা সেবার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে৷ কুতুপালং ক্যাম্পে দু’বছর ধরে কাজ করছেন ড. রোমানা ইসলাম৷ অল্পবয়সি মেয়েদের গর্ভধারণ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি ৷ কখনো কখনো দিনে ২৫ থেকে ৩০ জন কিশোরী অন্তঃসত্ত্বার চিকিৎসা করেন তিনি ৷ তার মতে, ‘‘বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা প্রথমত অপুষ্টিতে ভোগে৷ যেহেতু তারা নিজেরাই ছোট এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট এবং অপরিনত হয়৷ অনেকসময় তাদের ডেলিভালির সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়৷ তারা নিজেরা নিজেদের যত্নতো নিতেই পারে না, সন্তানের যে পরিমাণ যত্ন নেয়া দরকার, সেটাও নিতে পারে না”। অন্যদিকে এদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মহারও বাড়ছে, জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই। 

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা কিশোর কিশোরীদের শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য একটি দেশে সহায় সম্বলহীন জীবনে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত বাবা মায়ের সাথে কিংবা বাবা মা ছাড়া এতিম হিসেবে ঝুপড়িতে থেকে একটি কিশোর বা কিশোরীর পক্ষে পড়াশোনা করা কি সম্ভব? ক্যাম্পে থাকা কিশোর কিশোরীদের অবর্ননীয় সেই বেদনার কথা লিখে শেষ হবে না। জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান  ইউনিসেফ এবং তাদের অংশীদার বেসরকারি সংস্থাগুলো ২ হাজার ৮০০ শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে কক্সবাজার ক্যাম্পে সাড়ে ৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কিশোর কিশোরীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। করোনার ভয়াবহতার কারণে ২০২০ সালের মার্চে দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে বন্ধ হয়ে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিচালিত স্কুলগুলোও। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরীরা দীর্ঘ সময় শিক্ষার কোনোও সুযোগই পায়নি। আর ওই সময়ে বাল্য বিবাহের হার বেড়েছে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও বেশি ঘটেছে। যদিও পরবর্তীতে শিক্ষা কার্যক্রম আবার চালু হয়েছে।

ইউনিসেফ ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৭৪,০০০-এর অধিক রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীদের সাক্ষরতা, সংখ্যাগণনা, জীবন দক্ষতা এবং বৃত্তিমূলক দক্ষতা প্রশিক্ষণসহ শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। নূর নামে ষোল বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা কিশোর ইউনিসেফ সমর্থিত বহুমূখী শিশু ও কিশোর-কিশোরী কেন্দ্রে দক্ষতা বিকাশের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল। শরণার্থী শিবিরগুলোর সর্বত্র যেসব সৌর প্যানেল রয়েছে সেগুলো স্থাপন ও মেরামত করতে শিখছে নূর। ফলে সে এখন তার বাড়ির সৌর প্যানেল নিজে নিজেই মেরামত করতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা ১২ বছরের মেয়ে রাজিয়া। তার এবং তার ছোট বোন ফেরদৌস ও সাদেকার ইউনিসেফের ওয়ার্ল্ড ভিশন সেন্টারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে সেরা সময় কাটে। সেখানে তারা সেলাই, হস্তশিল্পের কাজের পাশাপাশি ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষা এবং গণিতসহ জীবন ধারণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও শেখে। শরণার্থী হিসেবে থাকা রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরীরা নানা কারণে মাদক পাচার থেকে শুরু করে অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে।অনেক সময় তাদেরকে জোর করে এসব কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাচারের শিকারও হতে হচ্ছে। 

জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, শরণার্থীদের অন্তত ৬০ ভাগই ১৬ বছরের কম বয়সী কিশোর কিশোরী। উখিয়া,কুতুপালং সহ অন্যান্য শরণার্থী শিবিরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কিশোর কিশোরী রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কিশোর কিশোরী সহিংসতায় তাদের বাবা, মা অথবা দু’জনকেই হারিয়েছে। অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরী বিভিন্নভাবে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভয় ও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কয়েক শত শিশু কিশোর কিশোরী সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে, যেখানে নাচ, গান এবং অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে তাদের মন থেকে ভয়াবহ স্মৃতিগুলো মুছে দিতে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু চাইলেই কি আর এমন বেদনার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলা যায়? তেমনই এক কিশোরীর ছদ্মনাম জামিলা। তার বয়স এখন ১৫ বছর। যখন শরণার্থী হয়ে এসেছিল তখন বয়স ছিলো ১২ বছর। আপনজন বলতে কেউ নেই তার। অভিভাবক হিসেবে সে রাশিদা বেগম নামে একজনকে পেয়েছে। যিনি মায়ানমারে জামিলাদের প্রতিবেশী ছিল।

কিশোর কিশোরীর বিকাশে পরিবার এবং শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।কিন্তু একজন শরাণার্থী কিশোর বা কিশোরীর ক্ষেত্রে এ দুইটিরই কমতি দেখা যায়। রোহিঙ্গা কিশোর কিশোরীরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। এটি তাদেরকে হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে। শিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকলে, পাচার, বাল্য বিবাহ, শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ কম থাকা এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজেদের পরিচয় প্রকাশের যথাযথ জায়গা এবং সুযোগ না থাকায় এসব শরণার্থী কিশোর কিশোরীদের অনেকেই একটি হারানো প্রজন্মের অংশ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। নিজেদের পড়াশুনা, লেখালেখি, খেলাধুলা এবং সৃজনশীল দিকগুলো বিকশিত করার স্বাধীনতা রয়েছে তাদের জন্য এমন নিরাপদ জায়গা করে দেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা হতে পারে যদি তাদেরকে নিরাপদে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়। এ জন্য শুধু বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছে বা প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয় পাশাপাশি মায়ানমারকেও সদিচ্ছা প্রকাশ করতে হবে এবং পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে জাতিগত এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি “ পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক”।

৩০ অক্টোবর ২০২৩

ইমেইল: [email protected]

লেখাটি দৈনিক খবরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ১০ নভেম্বর ২০২৩ । প্রকাশিত লেখার লিংক ইপেপারের লিংক

Most Popular