কক্সবাজারগামী ট্রেন: পর্যটন খাতে সম্ভাবনা ও আশঙ্কা

0
298

দেশের প্রধানতম পর্যটন নগরী কক্সবাজার। ছুটির অবসরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ স্বভাবতই কক্সবাজারকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয়। তবে দীর্ঘদিন এখানে কাজের সুবাদে থাকার কারণে আমি দেখেছি এখানকার খরচ তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। এমনকি ভালোভাবে হিসেব করলে দেখা যায় কক্সবাজারে আসলে একটি পরিবারের যে পরিমান খরচ হয় সেই একই পরিমান অর্থ ব্যয় করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ঘুরে আসা যায়। অন্যদিকে দূরত্বের কারণে অনেকেই ছুটি পেলেও খরচ ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কক্সবাজারে যেতে পারে না। অনেকেই মনে করতো যদি কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতো তাহলে কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হতো। কারণ তুলনামূলক ভাবে ট্রেনের ভাড়া কম থাকে। পাশাপাশি ট্রেনে ভ্রমন নানা কারণে আমারদায়ক বিধায় অনেকেই ট্রেনকেই যাতায়াতের জন্য সেরা মাধ্যম মনে করে।কিন্তু এতোদিন কক্সবাজারের সাথে রেল যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। কক্সবাজার রেল যোগাযোগ চালু হলো। এতে করে কক্সবাজারের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় সূচিত হবে বলে মনে করি। পর্যটনখাতে আয়ও বাড়বে। সেই সাথে এদিকে আরও বেশি কর্মসংস্থান হবে।

অর্থনীতির পরিভাষায় যোগান বৃদ্ধি পেলে দাম কমার কথা। যেহেতু ট্রেন যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম, তাই এটা স্বাভাবিক ভাবে ধরে নেওয়া যায় পযর্টকদের একটি বিরাট অংশ কক্সবাজার যাওয়া আসার ক্ষেত্রে রেলপথ বেছে নিবে। আর এটা হলে বাস এবং বিমানের যাত্রী সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। ফলশ্রুতিতে বাস এবং বিমান উভয়েই যাত্রী ধরে রাখতে হলে ভাড়ার পরিমান কমানো ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। সেই কমানোর পরিমান ঠিক কত হবে সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিভিন্ন অফার দেওয়া,দাম কমানো সহ নানা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা ছাড়া গ্রাহক ধরে রাখা সম্ভব নয়। যেহেতু যোগাযোগের তিনটি ভিন্ন মাধ্যমই এখন কার্যক্রম শুরু করেছে, তাই স্বভাবতই অপেক্ষাকৃত কম খরচে যে মাধ্যমে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে সেটাই বেছে নিবে।

অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, এমনকি অনেক অল্প বয়সী মানুষও আছে যারা দীর্ঘ পথ বাসে ভ্রমন করতে পারে না। অসুস্থবোধ করা,বমি হওয়া থেকে শুরু করে নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। তাছাড়াও দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমনেও অনেকের মধ্যে অনীহা দেখা দেয়। ট্রেন সেটাকে অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। ট্রেনের মধ্যে হেটে বেড়ানো যায়। চা কফি খাওয়া যায়। টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে, বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে পিকনিকের আমেজে যাওয়া যায়। অন্যদিকে অল্প সময়ে ভ্রমনের জন্য বিমান প্রধান মাধ্যম হলেও ঢাকা সহ অন্যান্য এয়ারপোর্ট থেকে কক্সবাজারের বিমান ভাড়া অনেক বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য সেটা বহন করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে ট্রেন হয়ে উঠবে তাদের প্রথম পছন্দ কারণ কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসেব মতে ট্রেনের ভাড়া হবে বাসের প্রায় অর্ধেক বা তারও কিছু কম। ফলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেশের অন্যান্য রুটের তুলনায় এই রুটে সারা বছরই যাত্রী পাবে এবং সঠিক ভাবে সেবা দিতে পারলে রেলওয়ের ভালো আয় হবে। কিন্তু সেবার মান অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

এটাতো গেলো সম্ভাবনার কথা। কিন্তু এই ট্রেন যোগাযোগ চালুর পর আমি কিছু আশঙ্কাও করছি। পযর্টকের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় হোটেল মোটেলে যায়গার সংকুলান হবে না। এক শ্রেণীর মানুষ এটাকে পুজি করে হোটেল মোটেলের ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে। একই সাথে অন্যান্য সেবা খাত যেমন, খাবারের হোটেল,প্রয়োজনীয় পণ্য,লোকাল গাড়ি ভাড়া সব বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। পরিবেশ দূষণের হার বাড়তে পারে। সেই সাথে সমুদ্র সৈকত এলাকায় অপরাধ প্রবণতাও বাড়তে পারে এবং সৈকতের পরিবেশও নষ্ট হতে পারে। যে পরিমান ধারণ ক্ষমতা আছে তার অধিক পযর্টকের আগমনে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে। আর দেশের অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান সেন্টমার্টিন যেহেতু কক্সবাজারেই তাই সেখানেও যেতে চাইবে অনেকে। ফলে সেন্টমার্টিনের জন্যও তা হবে ভয়াবহ।

অন্যদিকে ট্রেন চালুর পর গণপরিবহনের ভাড়া কমানো বা যাত্রী কমে যাওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি চক্র ভয়বহ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সেটা হতে পারে মানুষকে ট্রেন থেকে বিমুখ করা। এটা করার জন্য তারা চক্রান্ত করে ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে। সারা দেশের বিভিন্ন রুটে নানা সময়ে পাথর মারার ঘটনা আমরা দেখে থাকি। এটা কেউ পাগলামী করার জন্য মারে না বরং এর পেছনে নিশ্চই গোপন অভিসন্ধি থাকে। এখানেও তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সব জায়গায় ভালো এবং খারাপ মানুষ থাকে। নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখার জন্য, যাত্রী যেন কমে না যায় সেটা মাথায় রেখে কোনো দুষ্কৃতিকারী যদি ট্রেনের জানালায় পাথর ছুঁড়ে মারে,কাউকে হতাহত করে, ভয় দেখায়, তবে তারা অনেকটাই সফল হবে। ট্রেন থেকে হতাহতের ভয়ে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এতে করে এক শ্রেণীর মানুষ নিশ্চই লাভবান হবে যারা যাত্রী সেবা দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া উচিত এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে প্রথমেই একই ধরনের সেবাদানকারীদের উপর পরোক্ষ ভাবে হলেও দোষ যাবে। এটা করতে পারলে শুরুতেই তারা সচেতন হবে এবং ভুলেও যদি কারো মনে এই ধরণের অভিসন্ধি থেকে থাকে তো তারা সেই পথ থেকে ফিরে আসবে। অন্যদিকে দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে যারা টিকেট নিয়ে দালালি করবে।

পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যাদের অর্থনীতি একটি বড় অংশ পযর্টন নির্ভর। মরিশাচ,থাইল্যান্ড,ইন্দোনেশিয়া,ভূটান,মালদ্বীপ তার মধ্যে অন্যতম।তারা পযর্টনকে সত্যিকার অর্থে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে বলেই আজ ওই সব দেশে পযর্টকদের আনাগোনা অনেক বেশি। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিবছর ওই সব দেশে হাজার হাজার পযর্টক ভ্রমন করতে যাচ্ছে। তাদের মতামত আমরা নানা সময়ে দেখতে পাই। ওই সব দেশে গিয়ে তারা যেমন হসপিটালিটি পেয়ে থাকে,যেমন পরিবেশ পেয়ে থাকে তার ছিটেফোটাও আমরা আমাদের পযর্টনকেন্দ্রগুলোতে দিতে পারি না। ফলে বিদেশী পযর্টকরা যেমন আমাদের এখানে আসতে আগ্রহ হারায় তেমনি দেশীয় পযর্টকদের এক বিরাট অংশই বিদেশমুখী হয় বিশেষ করে যাদের আর্থিক সংগতি আছে।

সুতরাং পযর্টন শিল্প বলে আমরা যেটাকে আখ্যায়িত করি সেখানে পযর্টন শব্দটি থাকলেও শিল্প খুব একটা নেই বলাই চলে। শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলেই কেবল এ খাত হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত লাভজনক এবং দেশ এই খাত থেকে অনেক বেশি লাভবান হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হতে পারে ঈর্ষনীয়। সে ক্ষেত্রে যাতায়াত ভাড়া,হোটেল ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পযর্টক বৃদ্ধিপেলেই একশ্রেণীর মানুষ সেটাকে পুজি করে হোটেল,মোটেল ভাড়া বাড়িয়ে দেয়, গাড়ি ভাড়া বাড়ায়, খাবারের দামও বাড়ায়। এসব নিয়ে নানা সময়ে আমরা নিউজ হতে দেখি কিন্তু আশানুরুপ পদক্ষেপ নিতে দেখি না। যদি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়,নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা যায় তবে এ খাত হয়ে উঠতে পারে অপার সম্ভাবনাময়। একই সাথে কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত ছাড়া আর কোনো বিনোদন মাধ্যম নেই। নেই কোনো সিনেপ্লেক্স,নেই কোনো মাল্টিপ্লেক্স,নেই কোনো বলার মত শিশুপার্ক বা অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্র। ফলে দেশী বিদেশী পযর্টকরা এখানে এসে খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই বিষয়গুলো কঠোর নজরদারীতে আনা জরুরী।

কক্সবাজারে বর্তমান যে পরিস্থিতি আছে তাতেও বলা যেতে পারে সরকার এখান থেকে মাসে শত কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারী ভাবে তেমন কোনো সুযোগ সুবিধাই এখানে দেওয়া হচ্ছে না বলে পযর্টকরা মনে করে। বীচ এরিয়াতে নেটওয়ার্কের অবস্থাও খুবই দুর্বল। তারা চাইলেও ঘরে রেখে আসা প্রিয়জনদেরকে ভিডিও কলে বা লাইভের মাধ্যমে সমুদ্র দেখাতে পারে না। অথচ চাইলেই পুরো জোনটাকে ফ্রি ওয়াইফাই জোন করে দেওয়া যায়। আর সরকারি ভাবে এটা করতে পারলে দারুণ প্রসংশাও পাবে বলে আমি মনে করি। লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পযর্ন্ত এই তিন চার কিলোমিটার এরিয়ায় ১০০০ টি রাউটার লাগালে এবং প্রতিটির জন্য মাসে ১ হাজার টাকাও যদি খরচ হয় তবে মাসে ইন্টারনেট বাবদ খরচ হতো ১০ লাখ টাকা। যেখানে সরকার শত কোটি টাকা মাসে রাজস্ব পাচ্ছে সেখানে পযর্টকদের জন্য এক দুই কোটি টাকা তারা খরচ করতে পারবে না এটা অন্তত কল্পনাও করা যায় না। এর বাইরে বীচ এরিয়াতে যে লাইটগুলো আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম আলো দেয়। যে আলোতে বীচের সৌন্দর্য দেখা যায় না। এখানে স্টেডিয়ামের মত তিন পয়েন্টে তিনটি ফ্ল্যাড লাইট স্থাপন করতে পারলে পুরো এরিয়া আলোকোজ্জল হয়ে উঠতো এবং বীচ হয়ে উঠতো নিরাপদ এবং আকর্শনীয়। এমনকি এই সব ক্ষেত্রে যা খরচ হতো সেটাও সরকার চাইলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই পূরণ করতে পারতো।

এই শহরে যাতায়াতের জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশা বা টমটমই একমাত্র বাহন কিন্তু সেটার ভাড়ার কোনো বিধিনিষেধ নেই। যার কাছ থেকে যত হাকিয়ে নিতে পারে। পুরো জিম্যি করে রাখা হয় পযর্টকদের। ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ ব্যাটারি চালিত টমটমে যাওয়া আসার জন্য ভাড়া নেওয়া হয় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা! পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতেও তারা ভাড়া দেড়শো থেকে দুইশো টাকা দাবী করে। যেখানে যেতে তাদের মাত্র দশ থেকে বার মিনিট সময় লাগে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পযর্টন এই দেশে কখনোই শিল্পের পর্যায়ে পৌছাতে পারবে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেওয়া।

#জাজাফী

৮ নভেম্বর ২০২৩

লেখাটি দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে ১৭ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে। প্রকাশিত লেখাটির লিংক (ইপেপার) ওয়েবসাইটের লিংক