Tuesday, May 21, 2024
Homeনিবন্ধবিদেশে উচ্চশিক্ষা নাকি মেধা পাচার

বিদেশে উচ্চশিক্ষা নাকি মেধা পাচার

প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে এটি দেখে আমরা আনন্দিত হচ্ছি যে আমাদের শিক্ষার্থীরা, আমাদের সন্তানেরা বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ‍সুযোগ পাচ্ছে। তবে আমি এ নিয়ে প্রকারান্তে ভীষণ ভাবে ভীত হয়ে পড়েছি। আমার মনে কেবলই প্রশ্ন উকি দিচ্ছে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নাকি মেধা পাচার হচ্ছে?  কারণ আমি দেখছি এই যে আমাদের যে শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাচ্ছে তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা আমাদের জন্য কাজে আসছে বাকি ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা আমাদের দেশের জন্য কোনো কাজেই আসছেনা শুধুমাত্র প্রতি বছর কত সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে তার সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া। আমি দেখেছি যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে তাদের সিংহভাগ শিক্ষার্থী সেই দেশে অথবা উন্নত কোনো দেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করেছে। 

এটি অবশ্যই সবার কাম্য যে প্রত্যেকেই চায় নিরাপদ ও উন্নত জীবনযাপন করতে। ফলে তারা চাইবে তারা তাদের সুবিধামত দেশে বসবাস করতে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি এই যে যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে তারপর উচ্চশিক্ষা শেষে সেই দেশে বা উন্নত কোনো দেশে বসতি গেড়েছে এবং সেখানেই সেটেলড হয়েছে তারা কিন্তু তাদের উপার্জনের টাকা রেমিটেন্স আকারে দেশে পাঠাচ্ছে না বরং তারা যে দেশে অবস্থান করছে সেখানেই থাকছে। ফলে তাদের এই উচ্চশিক্ষা, এই মোটা বেতনের চাকরি দিয়ে বাংলাদেশের কোনো লাভ হচ্ছে না।  ইউনেস্কোর “ গ্লোবাল ফ্লো অব টার্শিয়ারি লেভেল স্টুডেন্ট” শিরোনামের এক প্রতিবেদন অনুযায়ি শুধুমাত্র ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় অন্তরায় এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে না পারা, মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারা।শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অপরাজনীতি, শিক্ষকদের রাজনীতিসহ নানাবিধ কারণে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছাত্রাবস্থায় মেধাবীদের এক বিশাল অংশ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে। একসময় তারা চলেও যায়। এতে করে তারা শুধু বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে তা-ই নয়, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে অপার সম্ভাবনাময় মেধাও। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশে যদি তার যোগ্যতা অনুসারে কর্মক্ষেত্র ও নিরাপত্তা না পান, তখন তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবেই। প্রসঙ্গ যখন সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎ, নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য কেউ যদি বিদেশে গমন করেন, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি? আমরা মাঝে মধ্যেই তাদের কটাক্ষ করে বলে থাকি, তারা স্বার্থপরের মতো দেশের স্বার্থ বিবেচনা না করে বিদেশে পাড়ি জমায়। আদতে মেধাবীরা দেশ ছাড়তে চান না, পরিস্থিতি তাদের দেশ ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো ডলারের পরিমাণ ছিল ৯৮.৮ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (২০২২-২৩), এটি ১৫৩.১ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে, ৩২১ মিলিয়ন ডলার ( প্রায় ৩,৫৩,০২৫,০০০,০০০ টাকা ) উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল৷ ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে, আন্তর্জাতিক ছাত্র পাঠানোর দেশগুলির তালিকায় বাংলাদেশ ১৪ তম থেকে ১৩ তম স্থানে উঠে এসেছে৷মার্কিন দূতাবাস ১৪-১৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিক্ষা সপ্তাহ (IEW) উদযাপনে মঙ্গলবার ঘোষণা করেছিল। তাদের তথ্য মতে গত এক দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি হয়েছে, যা ২০১১ সালে ৩,৩১৪ থেকে বেড়ে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১০৫৯৭ পর্যন্ত এসেছে। স্বাধীনতার পরপরই, বাংলাদেশ ১০৭৪-১৯৭৫ শিক্ষাবর্ষে ৪৮০ জন শিক্ষার্থীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। এদিকে সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া বিদেশী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশীদের অবস্থান শীর্ষ ২৫-এ। ২০১৭ সালে দেশটির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন ৬ হাজার ৪৯২ শিক্ষার্থী। এছাড়া ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ৮ হাজার ৯৮৬, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১১৬ ও কানাডায় ২ হাজার ২৮ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে পড়তে যান।

বিদেশে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত ১২ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় চার গুণ। ইউনেস্কোর ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকসের (ইউআইএস) তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন ১৫ হাজার বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ হাজারে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিকভাবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার সম্ভাবনা দেখছে, সেখানে বাংলাদেশসহ কিছু দেশ থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর এ প্রবাহ আগামী বছরগুলোয় আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।নিম্ন জীবনমান, দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তাও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করছে। বিদেশে পড়তে যাওয়া এসব তরুণের অধিকাংশই ধনী পরিবারের। আর তাদের পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি, যাদের অনেকেই পাঠ শেষে আর দেশে ফেরেন না।

৭০-৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী দেশে  না ফেরায় দেশ উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  যা বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতি ও আত্মাসমাজিক উন্নয়নে বিরাট ধাক্কা। পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পিছনে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর শিক্ষা  ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা আর একজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর পিছনে ১৫ লাখ টাকার ব্যয় করছে সরকার। আবার তারা যখন উন্নত বিশ্বে ডিগ্রি অর্জন করতে যায়, তখনও দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রচার হয়। যদিও এই ব্যয়ের পুরোটা ভার বাংলাদেশ বহন করে কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে না ফেরায় সুফল ভোগ করছে উন্নত বিশ্ব। এ-কথা সত্য যে,  বিদেশ থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরণ করে । কিন্তু এর সিংহভাগ আসে প্রবাসী শ্রমিকদের  আয় থেকে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অধিকাংশ  চিকিৎসা, প্রকৌশলী, শিক্ষক ও  শিক্ষার্থীরা দেশের অর্থনীতিতে তেমন একটা  অবদান রাখছে না। তারা উন্নত জীবনযাপন আশায় সে-সব দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।গত কয়েক দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলো পাচার হয়ে যাওয়া মেধা ফিরিয়ে আনতে এবং মেধা পাচার ঠেকাতে নানার রকমের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু  বাংলাদেশে এখনো তেমন কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। ফলে চরম মেধা শূণ্যতায় ভুগছে দেশ।

দেশে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ শ্রেণীর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দেশে পড়াশোনা করাতে চাইছেন না। ফলে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একটি বড় অংশ পড়াশোনার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিদেশযাত্রায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। কারণ এ শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র অংশই ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসছে। এটি একধরনের মেধা পাচার। দেশে ভালো কর্মসংস্থান নেই। আবার শিক্ষার্থীরা দেশে ফেরত আসার তাগিদও অনুভব করছেন না।প্রাকৃতিক  সম্পদের প্রাচুর্যতা  ছাড়াও একটি দেশে শুধু মানব সম্পদের সঠিক ব্যবহার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড মতো দেশগুলো  শুধুমাত্র মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে।

উন্নত দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি আর স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের মেধাবী সন্তানরা সেসব দেশকে আরও শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী করেন। আর দেশ হারায় তার সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, দক্ষ ও যোগ্য নাগরিককে। সম্ভাবনাময় এ তুখোড় প্রজন্মকে হারিয়ে নিজ দেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতি যাত্রায় বাধার সম্মুখীন হয়।শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অপরাজনীতি, শিক্ষকদের রাজনীতিসহ নানাবিধ কারণে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছাত্রাবস্থায় মেধাবীদের এক বিশাল অংশ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে। একসময় তারা চলেও যায়। এতে করে তারা শুধু বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে তা-ই নয়, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে অপার সম্ভাবনাময় মেধাও

২১ নভেম্বর ২০২২

Most Popular