দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা যে লেখকের লেখায় জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে তিনিই প্রকৃত লেখক। আর সে কারণেই ওই লেখকের মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও অনেক। সাগরে চলাচলরত জাহাজ যেন দিক হারিয়ে না ফেলে তাই বিভিন্ন দ্বীপে বাতিঘর নির্মান করা হয়। তেমনই একটি বাতিঘর আছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়াতে। এটাতো গেল পানির সমুদ্র। পানি ছাড়াওতো সমুদ্র হয় যেটাকে আমরা বলি জ্ঞানের সমুদ্র। জ্ঞানের সমুদ্রেও কেউ কেউ বাতিঘর হয়ে ওঠেন। যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যাকে অনেকেই আমাদের চিন্তার বাতিঘর বলে আখ্যায়িত করেন। কথা প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন “যে ক’জন মানুষের সাহচর্যে এসে আমি ঋদ্ধ হয়েছি, জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে শিখেছি, সমাজ নিয়ে প্রচলিত চিন্তার বাইরে এসে ভাবতে শিখেছি, তাদের মধ্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম অগ্রগণ্য”।
সমাজে এমন কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাদের কাজ ও চিন্তার বহুমুখিতা অনুকরণীয়। আজীবন শিক্ষাব্রতী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তেমনি একজন মানুষ। বিত্তবৈভব, ক্ষমতার মোহ তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। গবেষণা, লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনা, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অদ্বিতীয় কাণ্ডারি তিনি। মৃদুভাষী, নিরহঙ্কারী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রুচি ও ব্যক্তিত্বের এক অনন্য উদাহরণ। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের পাঠকপ্রিয়তা অর্জন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। স্বাধীনতার প্রায় একযুগ আগে থেকেই তিনি লেখালেখি করে আসছেন। অধ্যাপক, লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ, মার্ক্সবাদী দার্শনিক এই মানুষটি ক্রমে পরিণত হয়েছেন আমাদের পাওয়ার হাউজ অব নলেজ হিসেবে।
জন্ম ও শৈশব কৈশোরঃ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একসময়ে বিক্রমপুর নামে খ্যাত বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে১৯৩৬ সালের২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাফিজ উদ্দিন চৌধুরী এবং মাতার নাম আসিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন পিতা মাতার প্রথম সন্তান। বাবার বদলী চাকরির সুবাদে তিনি শৈশব থেকেই নানা স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন এবং বাস করেছেন রাজশাহী,ময়মনসিংহ,ঢাকা ও কলকাতায়। ফলে নানা সময়ে তাকে স্কুলও পরিবর্তন করতে হয়েছে। তার শৈশবের প্রথম দিকটা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। বাবা বদলি হয়ে রাজশাহী, কলকাতা, ময়মনসিংহ এবং এক সময় ঢাকায় আসেন। ছেলেবেলায় তিনি যেখানেই থেকেছেন সেখানে নদী পেয়েছেন। নদীর সঙ্গে তাঁর শৈশবের সম্পর্কটা মধুর।
শিক্ষাজীবনঃ
তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছিল গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। এর পর বাবার সাথে যখন রাজশাহীতে চলে গেলেন তখন রাজশাহীতে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি কিছুদিন কলকাতায় বসবাস করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পরিবারের সাথে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরিতে ভর্তি হন। সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ১৯৫০সালে প্রথম বিভাগে স্কলারশিপ সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। ওই সময় সেন্ট গ্রেগরি স্কুলটা কলেজ হয়ে গেল, তিনি সেখানেই ভর্তি হলেন। কলেজটা পরে নটর ডেম কলেজ নামে পরিচিত হয়েছে।
১৯৫২ সালে নটরডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় নবম স্থান সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেই সময়ে তাদের বাসা ছিল বেগমবাজারে। সিরাজুল ইসলাম তখন রমনা দিয়েই যাতায়াত করতেন। একুশের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। এরপর ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি, বিক্ষোভ হয়েছে। ’৫২-তে এসে এটা প্রবল আকার ধারণ করে। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে যে মিছিল হয়েছিল তাতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি কলেজে পড়তেন। ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্বে ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরের সামনে আমতলায় যে জমায়েত হয়েছিল সেখানেও তিনি গিয়েছিলেন। পুলিশ ছাত্রদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ল, যে অভিজ্ঞতা আগে কখনো তাদের ছিল না। পুকুরের পানিতে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আমতলার পেছনের রেললাইন দিয়ে তিনি সেদিন বাসায় চলে যান। ওইদিন গুলিতে কয়েকজন ভাষাসংগ্রামী শহীদ হন। তিনি সহ অন্যান্যরা মিছিল নিয়ে সদরঘাটে গিয়ে দেখেন সাধারণ মানুষ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। ঢাকা শহরে এ রকম কখনো ঘটেনি। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পুরান ঢাকার মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। এ আন্দোলন ছিল রমনা ও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। কিন্তু পুলিশের গুলি চালানোর পর আবহাওয়াটা বদলে গেল। তারা দেখলেন পুরান ঢাকার মানুষ এ আন্দোলনে আসছে। তারা নানাভাবে ছাত্রদের সাহায্য করছে। একুশের ঘটনায় নবাববাড়ী মুসলিম লীগের যে ঘাঁটি সেই ব্যবধানটা ভেঙে গেল। বুঝলেন এটা মধ্যবিত্তেরই আন্দোলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেন নতুন জীবন পেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা ছিল একেবারে খোলামেলা। তিনি হেঁটে হেঁটে ক্লাস করতে যেতেন। এত সুন্দর গাছপালা। গাড়িঘোড়ার ভিড় নেই। তাঁর জীবনটা খুব আনন্দের ছিল। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। তিনি সহ অন্যান্যরা আজিমপুর কলোনিতে ছাত্রসংঘ এবং একটি পাঠাগার গড়ে তুললেন। মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষাটা ছিল একেবারে লেখাপড়াকেন্দ্রিক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে নিয়মিত নির্বাচন হতো। সেবার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ওই ইলেকশনে দাঁড়িয়ে গেলেন। নিয়ম ছিল, ছাত্র সংসদের সদস্য হবে ফার্স্ট ইয়ার থেকে। হল সংসদ নির্বাচনে রাজনীতি চলে এলো। এর আগে হল নির্বাচন হতো পারস্পরিক চেনাজানা, জেলার আনুগত্যের ভিত্তিতে। একদিকে মুসলিম লীগের পক্ষের ছাত্র এবং তার বিরুদ্ধের ছাত্র। ওই সময় সলিমুল্লাহ হলে গণতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট গড়ে ওঠে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন তখন গঠিত হয়েছে মাত্র। অনেকে বলে থাকেন, যুক্তফ্রন্টের ধারণাটা এখান থেকে তৈরি হয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও এই ধারার সাথে ছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচনে তিনি ও তার দল বিপুল ভোটে জিতলেন।
ওই সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ মানে মাইক্রোফোনে চেঁচামেচি, লিফলেট ছাপানো, বিভিন্ন ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ইত্যাদি। মেয়েদের সংখ্যা কম ছিল, তাদের কোনো হল ছিল না। মেয়েরা বর্তমান প্রেসক্লাবের পাশে অবস্থিত চামেলি হাউসে থাকত। তারা বিভিন্ন হলের সঙ্গে অনাবাসিক শিক্ষার্থী ছিল। তখন একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ হলো। আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে। আবার ’৫৪ নির্বাচন হবে এ রকম সম্ভাবনা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ছাত্রজীবনে চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক জীবন পেয়েছিলেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান সহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার সাবসিডিয়ারির বিষয় ছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি। ১৯৫৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারও সুযোগ পেয়েছেন। ইংরেজী সাহিত্যে গবেষণার জন্য তিনি পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লীডস ইউনিভার্সিটিতে এবং পরবর্তীতে লেস্টার ইউনিভার্সিটিতে।
জোসেফ কনরাড, ই এম ফরস্টার ও ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসের অশুভের উপস্থিতিকে পিএইচডির বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি; সাহিত্যের সীমানা থেকে ক্রমশ তিনি এই অশুভের সন্ধান করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিস্তৃত পরিসরে।
সংসার জীবনঃ
১৯৬২ নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ছিলেন এবং ১৯৮৯ সালে ক্যানসারের কাছে হার মেনে মৃত্যুবরণ করেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দুটি মেয়ে রওনাক আরা চৌধুরী ও শারমীন চৌধুরী। রওনাক সমাজবিজ্ঞান থেকে পাস করেছেন। অন্য মেয়ে শারমীন ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন, তিনি বুয়েটের মানববিদ্যা বিভাগের ইংরেজি শাখার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
পেশাগত জীবন
ছাত্রজীবন শেষ হবার আগেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে এমএ পরীক্ষা দিয়েই মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন। সপ্তাহে ছয় দিন সেখানে থাকতেন। সপ্তাহশেষে বাসায় চলে যেতেন । মুন্সীগঞ্জে খুব ভালোই কাটত। তারপর কিছুদিন জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন ছিল। চাকরির পদের সংখ্যা খুব সীমিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যদি পদত্যাগ, অবসর বা পরলোগ গমন করতেন তখন অন্যরা সুযোগ পেতো। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন ১৯৫৭ সালে। তখন কোনো কোনো শিক্ষক কিছুদিন শিক্ষকতা করে সিভিল সার্ভিসে চলে যেতেন। এর ফলে বিভাগে পদশূন্য হতো। তা ছাড়া সিভিল সার্ভিস অনেক আকর্ষণীয় ছিল। ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মুজিবুল হক সিভিল সার্ভিসে যাওয়ায় তার স্থলে যোগ দিলেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দুই বছরের সিনিয়র। কয়েক মাস পর তিনিও সিভিল সার্ভিসে চলে যান। তখন তার জায়গায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢুকলেন। দুটো কারণে এই চাকরিটা তিনি পছন্দ করেছিলেন। তার বাবা সব বাবার মতো চাইতেন, তার ছেলে সিভিল সার্ভিসে যাবে। সেই সময়ে ওটাই নিয়ম ছিল। সিরাজু ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষকতার মূল কারণ ছিল এ চাকরির কোনো বদলি নেই। দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল গ্রন্থাগারটা। তখন ঢাকার সব পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার ছিল। আর ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনা তার খুব ভালো লাগতো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই শিক্ষকতা জীবন খুব উপভোগ করছিলেন।
১৯৫৯ সালে ১০ মাসের জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা করেন। গন্তব্য ইংল্যান্ডের লিডস ইউনিভার্সিটি। সেখানেই তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইংলিশ স্টাডিজ শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। জ্ঞানের অন্বেষণে থাকা সিরাজুল ইসলামের পড়া ও শেখার পরিধি ক্রমাগত ভাবে বৃদ্ধিপেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তিনি ১৯৬৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের নিমিত্তে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে১৯৬৮ সালে তিনি তার কাঙ্খিত পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি তার পিএইচডির অভিসন্দর্ভের বিষয় হিসেবে বেছে নেন দ্য এনিমি টেরিটরি, ট্রিটমেন্ট অব এভিল, ইন দ্য নভেলস অব জোসেফ কনরাড, ইএম ফর্স্টার এন্ড ডিএইচ লরেন্স। যুক্তরাজ্যের মত একটি উন্নত দেশে সব রকম সুযোগ সুবিধার মধ্যে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি ইচ্ছে করলে সেই দেশেই ভালো পজিশনে চাকরি করতে পারতেন কিংবা ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য দেশেও ভালো সম্মানিতে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন মাতৃভূমিতে এবং যোগ দিয়েছেন নিজের প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মেধা ও পরিশ্রমের ফলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত ভাবে পদন্নোতি লাভ করতে থাকেন। দেশ যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। রাজনৈতিক উত্তেজনা চারদিকে। নির্বাচন আর পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার নিয়ে সবাই সোচ্চার,সেই সময়ে ১৯৭০ সালে তিনি আবার পদন্নতী লাভ করে ইংরেজি বিভাগে রিডার পদ লাভ করেন। সেই সাথে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। স্বাধীনতার পর আবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলল। সদ্য স্বাধীন দেশ। সবার মধ্যে অনেক আকাঙ্ক্ষা। সেই সময়ে ইংরেজী বিভাগের ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ স্যার ভিসি হয়ে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাগ্য আবার বদলে গেলো। তিনি রিডার থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। যেটা তার ধারণার মধ্যেই ছিল না।
১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অধ্যাদেশ হাতে পেয়েছিলেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্বায়ত্তশাসন চলে এলো। নির্বাচন চলে এলো। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অবস্থানটা বরাবরই ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাঁর আনুগত্য ছিল না। তিনি কখনো চিন্তাই করেননি উপাচার্য হবেন। তিনি সিনেট, সিন্ডিকেট ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। সিনেট তিনজনের ভিসি প্যানেল দেয়, তার নামও আসছে। তিনি নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তিনজনের প্যানেলের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ ভোট পান। তখন প্রশ্ন এলো তিনি কি সত্যি সত্যিই উপাচার্য হতে চান? এরশাদের শাসনামলে তিনি কি পারবেন? সেটা কি শোভন হবে? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী তখন জীবিত। তার ধারণা ছিল, এই পদটা তার না। পরে আরও একটি সুযোগ আসে। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেখাপড়া করতে চেয়েছিলেন, প্রশাসনিক কাজ করতে চাননি। ফলে উপাচার্য হওয়া থেকে দূরে থেকেছেন।
পেশাগত জীবনে তিনি আরও নানা পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখযোগ্য হিসেবে আমরা বলতে পারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর কোষাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৮৫ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি বুক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন।১৯৮৪ সালে তিন বছরের জন্য তিনি কলা অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন।১৯৮৬ সালে তিনি উদ্যোগ নিয়ে সেন্টার ফর এডভান্সড রিসার্চ ইন হিউম্যানিটিজ প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০১ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ। এর দুই বছর পর ২০০৩ সালে সরকার তাকে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং ২০০৮ সালে তাকে প্রফেসর ইমেরিটাস অভিধায় ভূষিত করা হয়। তিনি একই সাথে বাংলা একাডেমির ফেলো।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীঃ
মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল বাঙ্গালীদের জন্য বড় বিপদের সময়। ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমিতে ভবিষ্যতের বাংলা সম্পর্কে একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সভা করেছেন, মিছিলে গিয়েছেন।তাদের একটা সংগঠন ছিল সংগ্রামী লেখক শিবির। এর পক্ষ থেকে তিনি সভা-সমিতি করতেন। ২৫ মার্চ রাত ৮টার দিকে ইকবাল হলের ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসে বলল, পাকিস্তান আর্মি চলে এসেছে, মনে হয় ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটবে। একথা শুনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি তখন জগন্নাথ হলের উল্টো দিকে কোয়ার্টারে থাকতেন। রাতের জগন্নাথ হলের ছাত্রদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে এসব কাহিনী আসতে থাকল। ছেলেরা কেউ কেউ তার বাসায় এসে আশ্রয় নিল। ২৬ মার্চ সকালে কারফিউ দিল। পরে ২৭ তারিখ কারফিউ ভাঙলে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।সেই সময়ে তিনি নানা জায়গায় থেকেছেন। তিনি মনে করেন এ জন্য বেঁচে গেছেন।
আর্মিরা তাঁর ঠিকানা জানত না। আর্মিদের হত্যার তালিকায় তারও নাম ছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এক আত্মীয় ছিলেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে। তিনি তাকে সতর্ক করেছিলেন। টিক্কা খান যাওয়ার আগে সিরাজুল ইসলাম সহ ছয়জন শিক্ষকের নামে চিঠি দিয়ে গেলেন। সেখানেও তাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তখন তিনি বুঝতে পারেন, দেশ স্বাধীন না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আসা হবে না। ৭ ডিসেম্বর ওয়ারীতে গিয়ে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ওখানে কি কাণ্ড ঘটেছে সেটা তিনি জানতেনই না। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জেনেছেন ওই দিন এ জাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল। ওই কয়েক দিন বেশ উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিলেন। তারপর ১৬ ডিসেম্বর স্যারেন্ডার হলো। ১৭ তারিখ এক সহকর্মী তাকে বললেন, আপনি বেঁচে আছেন এখনো! স্বাধীনতা যখন এলো তখন একটা মিশ্র অভিজ্ঞতা হলো। তিনি দেখলেন তার অনেক পরিচিত চেনা-জানা মানুষ মারা গেছেন। বিজয়ের পর মনে হলো অনেকটা যেন রোগমুক্তি। যেন বিরাট অসুখ থেকে সেরে উঠলেন।
স্বাধীনতার উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ব্যহত হলেও পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তিনি আবার পদন্নতী লাভ করে হয়ে যান হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট।১৯৭৩ সালে তিনি ৩ বছরের জন্য চেয়ারম্যান মনোনীত হন। মেধা ও মননে অগ্রবর্তী মানুষটি ক্রমাগত ভাবে জ্ঞানের ভূবনে হয়ে ওঠেন মহীরুহ। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবস্থান ছিল বিতর্কিত। যখন সারা দেশ একজোট হয়ে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে লড়াই করতে নেমেছে তখন তিনি সেগুলোকে পাশকাটিয়ে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া চালিয়ে গিয়েছেন এবং টিচার্স লাউঞ্জে আড্ডা দিয়েছেন। অথচ একই সময়ে অন্যান্য শিক্ষকেরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়ে ক্লাস বর্জন করেছে। কথিত আছে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে আখ্যা দিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনিই নানা সময়ে বলেছেন সুবিধাবাদী হলে তিনি আর বুদ্ধিজীবী থাকেন না।
সম্পাদক জীবনঃ
শিক্ষকতার পাশাপাশি তার নেশা পত্রিকা সম্পাদনা। কেননা তিনি ভেবেছেন পত্রিকা সম্পাদনার ভার হাতে থাকলে অন্যের লেখার সঙ্গে নিজের লেখালেখিটাও সচল থাকবে। পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি দেখেছেন সেখানকার শিক্ষকরা ক্লাসে পড়াতে আসেন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে। লাইব্রেরিতে গিয়ে শিক্ষকরা প্রচুর পরিশ্রম করে প্রতিটি ক্লাসে লেকচারকে অনন্য করে তোলেন। আর সেই ক্লাস লেকচারগুলোই পরবর্তীতে বই হিসেবে বের হয়। এই জ্ঞানপ্রক্রিয়া তাকে উদ্বুদ্ধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ’ এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’ সম্পাদনা করেন। তিনি আনোয়ার পাশা রচনাবলী (তিন খণ্ড) ও Dhaka University Convocation Speeches (দুই খণ্ড) সম্পাদনা করেছেন।
লেখার টেবিল থেকে মিছিলের রাজপথ—সর্বত্রই তিনি ছিলেন ও আছেন। বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ কিংবা নির্বিচার বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার এক নাম। তার সম্পাদিত পত্রিকা পরিক্রম, সাহিত্যপত্র, সাপ্তাহিক সময় উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন সচিত্র সময় (১৯৯১),সাপ্তাহিক সময় (১৯৯৩-৯৫)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্প্রতিক দুটো বই অবিরাম পথ খোঁজা (প্রথমা প্রকাশন, তৃতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৯) এবং পিতার হুকুম (প্রথমা প্রকাশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৮)।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমষ্টি-মানুষের উত্থান চান। তিনি জানেন, মানুষের মাঝে আছে ‘স্বাধীনতার স্পৃহা, সাম্যের ভয়’। দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি মানুষের মনোজাগতিক উন্নতির মাধ্যমে মানবিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এ জন্য বিভিন্ন সময় সাহিত্যপত্র, সময়-এর মতো রুচিশীল কাগজ সম্পাদনা করেছেন। গত দুই দশক বিরতিহীনভাবে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত। পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন লেখকদের প্রকাশ-বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতের পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র’-এর উদ্যোগে সমসাময়িক বিষয়ে আয়োজিত হয়ে চলেছে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারক বক্তৃতা’।
পুরস্কার ও সম্মাননাঃ
আলোকের দিশারী এই মানুষটি সারা জীবন বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। নানা সময়ে তিনি সম্মানজনক একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে লেখক সংঘ পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। এর পরের বছর ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পদক পান। এক বছর বিরতী দিয়ে ১৯৭৮ সালে তার হাতে ওঠে আব্দুর রহমান চৌধুরী পদক যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত। এর পর তিনি ১৯৮০ সালে লেখিকা সংঘ পদক পান। ১৯৮৩ সালে মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পদক পান। ১৯৮৮ সালে স্বীয় গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। একই বছর তিনি অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার পান। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৬ সালে শিক্ষায় একুশে পদকে সম্মানিত করেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিভিন্নভাবে তার শ্রম ও সাহিত্যের জন্য মূল্যায়িত হয়েছেন। তিনি যে বিপুল মানুষের সম্মান ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন তা সন্দেহাতীত। এছাড়াও অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে আবদুর রহমান চৌধুরী পদক(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), আব্দুর রউফ চৌধুরী পুরস্কার (২০০১), ঋষিজ পদক (২০০২), শেলটেক পদক (২০১৭) এবং প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২১ সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সাহিচর্চার এবং উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য জীবনের শুরুটা কথাসাহিত্য দিয়ে আর পরিণতি প্রবন্ধ-গবেষণাতে। এখনো অনেকে ভোলেননি তাঁর গল্পগ্রন্থ ভালমানুষের জগৎ বা শিশু–কিশোরদের জন্য লেখা দরজাটা খোলো বইয়ের কথা। তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন গল্প দিয়ে। ছোট গল্পের বইও আছে তার। শিশু-কিশোরদের জন্য গল্পের বইও লিখেছেন। পরে তিনি সরে এসেছেন প্রবন্ধে। সরে এসেছেন কথাটা পুরোপুরি বলা যাবে না। কারণ তার প্রবন্ধে রয়েছে গল্পের ধরন,কৌতুহল ও আনুষ্ঠানিকতা।যেন সংলাপে মত্ত হয়েছেন আপনজনের সাথে। পাশাপাশি তিনি উপন্যাসও লিখেছেন। তার প্রবন্ধে সাহিত্যের খ্যাতিমান নায়ক নায়িকারা নতুন রুপে মূল্যায়িত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যকে সফল ভাবেতুলে ধরেছেন এ দেশের পাঠকের সামনে। ব্যতিক্রম চিন্তা চেতনা এবং নতুনত্ব তার সব লেখারই বৈশিষ্ট্য। উপস্থাপন ও দৃষ্টিভঙ্গিজনিত কারণে এই চিন্তা চেতনা ও নতুনত্ব চিন্তাশীল পাঠকের কাছে খুবই সহজে ধরা পড়ে।
অন্যান্য লেখকরা সবাই যখন সাহিত্য জীবনের শুরুতে কবিতায় হাতেখড়ি নিয়েছেন তিনি তা করেননি। তিনি কখনো কবিতা লেখেননি। গল্প লিখেছেন, উপন্যাস যে লেখেননি, তা-ও নয়; কিন্তু ও পথে এগোনো হয়নি। কবিতাতে প্রথম বাধাটি ছিল ছন্দ মেলাতে পারবেন না—এই ভয়; দ্বিতীয় বাঁধা কল্পনাক্ষমতা শক্তিশালী নয়—এই বোধ। অন্যদিকে তিনি এক সাক্ষাৎকারে গল্প লেখা তথা কথাসাহিত্যের চর্চা নিয়ে বিস্তারিত্ আলাপ করেছেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কেন তিনি ওইদিকে অগ্রসর হননি বরং সাহিত্য সমালোচনার দিকে এগিয়েছেন বা প্রবন্ধের দিকে ঝুকেছেন।তিনি বলেন “আমি দেখেছি, আমার লেখাতে বৃত্তের উপমা বেশ ভালোভাবেই আছে; আমি বড় হয়েছি এবং রয়ে গেছি একটি বৃত্তের মধ্যেই। সে বৃত্তটা মধ্যবিত্তের। সেখানে আমার জন্য গল্প-উপন্যাসের পর্যাপ্ত উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় কারণটা সাহিত্যের মান সম্পর্কে ধারণা। সাহিত্য পঠন-পাঠনের দরুন কথাসাহিত্যের উৎকর্ষের যে মানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে, ভয় হয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে পারার চেষ্টাটা হবে পণ্ডশ্রম। আবার তৃতীয় একটা কারণও থাকতে পারে। সেটা হলো, সাহিত্যের শিক্ষকতার কারণে বিশ্লেষণপ্রবণতার বৃদ্ধি। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের জন্য সংশ্লেষণ শক্তির দরকার; সেটার ঘাটতি ঘটেছিল বলেও হয়তো ধারণা। সে তুলনায় প্রবন্ধে দেখেছি স্বাধীনতা বেশি। নিজের চিন্তা ও উপলব্ধির কথা বলা যায়, অভিজ্ঞতারও ব্যবহার চলে; মানটাও থাকে নিজস্ব। তবে মননশীল ও সৃষ্টিশীল রচনার মধ্যে যে দুর্লঙ্ঘ্য কোনো প্রাচীর আছে, তা-ও সত্য নয়। মননশীল রচনাতেও সৃষ্টিশীলতা আনা সম্ভব। ওই দুইকে মেলানোর চেষ্টাটাও আমার ছিল”।
প্রায় ছয় দশক আগে ১৯৬৪-তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ অন্বেষণ। এরপর সম্প্রতি প্রকাশিত বিদ্যাসাগর ও কয়েকটি প্রসঙ্গ পর্যন্ত তাঁর যে প্রাবন্ধিক অভিযাত্রা, তাতে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে নতুন আবিষ্কার-উন্মোচনের পাশাপাশি আছে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি বিষয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
কুমুর বন্ধন, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ-এর সমান্তরালে তাঁর হাতেই লেখা হয়েছে শেকস্পীয়রের মেয়েরা, ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন, ইংরেজি সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায়, প্রতিক্রিয়াশীলতা: আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে–এর মতো জিজ্ঞাসাবাহী বই। মার্ক্সীয় আদর্শে অবিচল আস্থা তাঁর। গবেষণাগদ্য থেকে সাময়িক প্রসঙ্গে লেখা কলাম; সবকিছুতেই তাঁর এই কাঠামোর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে জ্ঞানবিশ্বের সমসাময়িক অন্যান্য চর্চা নিয়ে তাঁর আগ্রহের অন্ত নেই। তাই উপমহাদেশের নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদদের চিন্তাকাঠামো নিয়ে ‘ঔপনিবেশিক ভারতে ইতিহাসের গতিবিধি’ আর প্রাচ্যবাদী ভাবনাবলয় নিয়ে ‘এডওয়ার্ড সাঈদ কেন গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। নীরদ সি চৌধুরীর ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি নিয়ে লিখতে ভোলেননি ‘কৃষ্ণসাহেবের ক্ষোভ’ ও ‘লড়াই’ নামের প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের মতোই উদার আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস তাঁর আর জাতীয়তাবাদ বিষয়ে অসাধারণ দুটো বই বাঙালীর জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তিও তাঁরই লেখা।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন হোমারের অডিসি, এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, ইবসেনের বুনোহাঁস, হাউসম্যানের কাব্যের স্বভাব। সম্পাদনা করেছেন একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার রচনাবলি।
প্রকাশিত বই
১. ছোটদের শেকস্পীয়র (১৯৬২) [আহমদ পাবলিশিং]
২. অন্বেষণ (১৯৬৪) [রোদেলা]
৩. ইবসেনের ‘বুনো হাঁস’ (১৯৬৫) [জাগৃতি প্রকাশনী]
৪. হাউসম্যানের ‘কাব্যের স্বভাব’ (১৯৬৫) [মুক্তধারা]
৫. Introducing Nazrul Islam (1965) Nazrul Islam: Poet and More (1994) [Nazrul Institute]
৬. দ্বিতীয় ভুবন (১৯৭৩) [বর্ষাদুপুর]
৭. নিরাশ্রয় গৃহী (১৯৭৩) [রাত্রি]
৮. আরণ্যক দৃশ্যাবলী (১৯৭৪) [বাংলা একাডেমি]
৯. অনতিক্রান্ত বৃত্ত (১৯৭৪) [সূচীপত্র]
১০. The Moral Imagination of Joseph Conrad (1974) [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা]
১১. এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব (১৯৭৫) [গ্লোব লাইব্রেরী]
১২. প্রতিক্রিয়াশীলতা, আধুনিক ইংরেজী সাহিত্যে (১৯৭৫) [মুক্তধারা]
১৩. শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ (১৯৭৫, ২০০৬) [সাহিত্য বিলাস]
১৪. The Enemy Territory, Evil in D. H. Lawrence (1976 [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা]
১৫. আমার পিতার মুখ (১৯৭৬, ১৯৯১) [অন্যপ্রকাশ]
১৬. বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক (১৯৭৬, ২০০৬) [সাহিত্য বিলাস]
১৭. কুমুর বন্ধন (১৯৭৭, ২০০০) [মুক্তধারা]
১৮. উপরকাঠামোর ভেতরেই (১৯৭৭) [মুক্তধারা]
১৯. তাকিয়ে দেখি (১৯৭৮) [মুক্তধারা]
২০. বেকনের মৌমাছিরা (১৯৭৮) [টচখ]
২১. স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি (১৯৭৯) [ডানা প্রকাশনী]
২২. একই সমতলে (১৯৮০) [ব্র্যাক প্রকাশনী]
২৩. ঊনিশ শতকের বাংলাগদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ (১৯৮০) [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা]
২৪. আশির দশকে বাংলাদেশের সমাজ (১৯৮১) [ডানা প্রকাশনী]
২৫. স্বাধীনতার স্পৃহা ও সাম্যের ভয় (১৯৮১) [টচখ]
২৬. বাঙালী কাকে বলি (১৯৮২) [আহমদ পাবলিশিং হাউজ]
২৭. বাঙালীকে কে বাঁচাবে (১৯৮৩) [আহমদ পাবলিশিং হাউজ]
২৮. বৃত্তের ভাঙা-গড়া (১৯৮৪) [আহমদ পাবলিশিং হাউজ]
২৯. মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৮৫) [বাংলাএকাডেমি]
৩০. টলস্টয়, অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি (১৯৮৫) [রোদেলা]
৩১. নেতা, জনতা ও রাজনীতি (১৯৮৬) [স্বরবৃত্ত]
৩২. গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ (১৯৮৭) [বিজয় প্রকাশ]
৩৩. শেষ মীমাংসার আগে (১৯৮৮) [অঙ্কুর]
৩৪. দরজাটা খোলো (১৯৮৯) [নবরাগ]
৩৫. উদ্যানে এবং উদ্যানের বাইরে (১৯৮৯) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৩৬. শ্রেণী, সময় ও সাহিত্য (১৯৯০) [গ্লোব লাইব্রেরী]
৩৭. ভালোমানুষের জগৎ (১৯৯০) [দিব্যপ্রকাশ]
৩৮. কেউ বলে বৃক্ষ কেউ বলে নদী (১৯৯০) [পল্লব পাবলিশার্স]
৩৯. হোমারের ওডেসি (১৯৯০) অনুবাদ [অন্বেষা]
৪০. বাবুলের বেড়া-ওঠা (১৯৯০) [নালন্দা]
৪১. স্বপ্নের আলোছায়া (১৯৯১) [সময়]
৪২. রাষ্ট্র ও কল্পলোক (১৯৯১) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৪৩. দ্বিজাতি তত্ত্বের সত্যমিথ্যা (১৯৯২) [বিদ্যাপ্রকাশ][
৪৪. লেনিন কেন জরুরী (১৯৯২) [নালন্দা]
৪৫. আপনজন (১৯৯৩) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৪৬. অপরিচিত নায়ক পরিচিত দুর্বৃত্ত (১৯৯৪) [আহমদ পাবলিশিং]
৪৭. বাঙালীর জয়-পরাজয় (১৯৯৪) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৪৮. লিঙ্কনের বিষণœমুখ (১৯৯৪) [অন্বেষা]
৪৯. এর পথ ওর প্রাচীর (১৯৯৫) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৫০. ভয় পেয়ো না বেঁচে আছি (১৯৯৫) [অনন্যা]
৫১. মাঝখানের মানুষেরা (১৯৯৫) [আফসার ব্রাদার্স]
৫২. দুই বাঙালীর লাহোরযাত্রা (১৯৯৬) [জাগৃতি প্রকাশনী]
৫৩. পতঙ্গ ভৃত্য ও দৈত্য (১৯৯৬) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৫৪. রাষ্ট্রের মালিকানা (১৯৯৭) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৫৫. ঊপনিবেশের সংস্কৃতি (১৯৯৮, ২০১১) [শুদ্ধস্বর]
৫৬. শেক্সপীয়রের মেয়েরা (১৯৯৮) [চিত্রা প্রকাশনী]
৫৭. ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন (১৯৯৯) [চিত্রা]
৫৮. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ (২০০০) [UPL]
৫৯. বাঙালীর সময়-অসময় (২০০০) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৬০. পুঁজিবাদের দুঃশাসন (২০০১) [নবরাগ]
৬১. আত্মপ্রতিকৃতি নয় (২০০২) [ঐতিহ্য]
৬২. Middle Class and the Social Revolution in Bengal: An Incomplete Agenda (2002) [UPL]
৬৩. ইংরেজি সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায় (২০০২) [গ্লোব লাইব্রেরী]
৬৪. ভূতের নয়, ভবিষ্যতের (২০০২) [ঐতিহ্য]
৬৫. বন্ধ করো না পাখা (২০০৩) [ঐতিহ্য]
৬৬. আমার আপন তিনজন (২০০৪) [মওলা ব্রাদার্স]
৬৭. শেষ নেই (উপন্যাস) (২০০৪) [ঐতিহ্য]
৬৮. ভরসার জায়গাজমি (২০০৪) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৬৯. প্রভুর যত ইচ্ছা (২০০৫) [অন্যপ্রকাশ]
৭০. কণার অনিশ্চিত যাত্রা (উপন্যাস) (২০০৬) [অন্যপ্রকাশ]
৭১. বিচ্ছিন্নতার সত্য-মিথ্যা (২০০৬) [অন্যপ্রকাশ]
৭২. গণতন্ত্রের অমসৃণ পথ (২০০৬) [সূচীপত্র]
৭৩. গণতন্ত্রের সন্ধানে (২০০৬) [বিজয় প্রকাশ]
৭৪. দ্বন্দ্বের মেরুকরণ (২০০৬) [বিজয় প্রকাশ]
৭৫. পিতৃতান্ত্রিকতার বিপক্ষে (২০০৭) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৭৬. হস্তান্তর নয়, রূপান্তর চাই (২০০৭) [নবরাগ]
৭৭. আলোতে অন্ধকার, অন্ধকারে আলো (২০০৭) [বিজয় প্রকাশ]
৭৮. ১৮৫৭ এবং তারপরে (২০০৮) [অন্যপ্রকাশ]
৭৯. দুই যাত্রায় এক যাত্রী (২০০৮) [পার্ল পাবলিকেসন্স]
৮০. অখণ্ড সেই বৃত্তে (২০০৯) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৮১. বিরূপ বিশ্বে সাহসী মানুষ (২০১০) [জাগৃতি প্রকাশনী]
৮২. দীক্ষার খবরাখবর (২০১১) [অন্বেষা]
৮৩. কত মূল্য লইবে ইহার (২০১১) [অন্বেষা]
৮৪. দুই যাত্রায় এক যাত্রী (দ্বিতীয় খণ্ড) (২০১১) [পার্ল পাবলিকেসন্স]
৮৫. বাংলাসাহিত্য ও বাঙালী মধ্যবিত্ত (২০১২) [গ্লোব লাইব্রেরী]
৮৬. ছত্রভঙ্গের পূর্বাপর (২০১২) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৮৭. পার হতে সংশয় (২০১৩) [শুদ্ধস্বর]
৮৮. রাষ্ট্রতন্ত্রের সমাজদ্রোহিতা (২০১৩) [অন্বেষা] ৮৯. রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মতোই (২০১৩) [জাগৃতি প্রকাশনী]
৯০. বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি (২০১৪) [বিদ্যাপ্রকাশ]
৯১. নজরুলকে কোন পরিচয়ে চিনবো (২০১৪) [সংহতি প্রকাশন]
৯২. রাষ্ট্র ও সমাজের মাঝখানে (২০১৪) [পার্ল পাবলিকেসন্স]
বিশেষত্বঃ
বিনয়, সাদামাটা জীবন, নিয়মানুবর্তিতা, সমাজতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা, রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশ ও দশের প্রয়োজনে কলম হাতে অবিচল থাকা জ্ঞানতাপস এই শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ক্লাসরুম শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন এক ‘আদর্শ’। ঝড়-বৃষ্টি-বাদল-রাজনৈতিক উত্তাপ কোনো কিছুই ক্লাসরুমের ৫৫ মিনিটের নির্দিষ্ট সময়ের ওপর প্রভাব ফেলেনি।
এক লক্ষ্যস্থির শিক্ষকজীবনকে বহুগুণে, বহু মানে, বহু বৈচিত্র্য-বৈভবে আলাদা করে, তিলে তিলে সৃজনশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে আমাদের জ্ঞানরাজ্যে, চিন্তার জগতে এক মহীরুহ হয়ে উঠলেন ক্রমশ। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জ্ঞানজগতের নিশ্চিত, উত্তাপহীন, ক্ষমতাবৈভবহীন, সাদামাটা জগতেই বছরের পর বছর এক অন্তহীন আনন্দের সমুদ্রে অবগাহন করলেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রাজনৈতিক স্বার্থেই কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়েছেন স্বেচ্ছায়।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর এই শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনের যে-সব অধ্যাপক আমাদের কালে চিন্তাজগতে আজীবন আমুণ্ডুপদনখ ক্রিয়াশীল থেকেছেন, তরুণ সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষের সামনে সম্ভাবনার স্বপ্নকে সাধ্যমতো উঁচু করে রেখেছেন, দেশবাসীর অর্থনৈতিক অসঙ্গতির অশ্রুময় ব্যবধানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ক্ষান্তিহীন থেকেছেন- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন এঁদের সামনের সারিতে। সূর্যের কাছ থেকে যেমন ধার নিয়ে চলে বিভিন্ন গ্রহ, তেমনি তাঁর কাছ থেকে আলো নিয়ে চলে বিভিন্নস্থরের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র চিন্তক ও দৈনিকের সম্পাদক’।
তাঁর লেখা পড়ে দেখা যায়, তাঁর দায় দেশ ও দেশের প্রতি, ‘রাষ্ট্রের পক্ষে তিনি চিন্তায় ও কাজে, লেখায় ও কথায় লড়ে যাচ্ছেন একজীবন। দীর্ঘ সংগ্রামের মাঝখানে কোনো বিভাজন রেখা রাখেননি।’ নৈতিকতার স্বার্থে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিলিয়ে দিচ্ছেন মেধা ও মনন! সমাজের প্রয়োজনে যেখানেই প্রতিবাদ করতে হয়েছে সেখানেই তিনি দাঁড়িয়েছেন অনড় অবিচলতায়। তাই তাকে আমরা দেখতে পাই ওসমানী উদ্যান বাঁচাও নাগরিক আন্দোলনে, লালন শাহ সমাধি সুরক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বে। দেখতে পাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত সামাজিক আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনে, পরিবেশ আন্দোলনে, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার মতো জনঘনিষ্ঠ আন্দোলনের প্রথম কাতারে। তার এই সমাজঘনিষ্ঠ দলদাসহীন সক্রিয়তাও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে শুধু ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, অনন্যও বটে।
প্রথমত তার লেখার প্রসাদগুণ যে কোনো পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। যে কোনো বিষয় একটি সাধারণ বিন্দুসম জায়গা থেকে লিখতে শুরু করেন তিনি। লেখায় তার ভাবনার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে যায় আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সংগ্রাম, রাষ্ট্র ইত্যাদি। ছোট ছোট বাক্য, সহজ উদাহরণ, ঘনিষ্ট আলাপনে পাঠককে ধীরে ধীরে চিন্তার গভীরতম স্তরে নিয়ে যান অবলীলায়।
ব্যক্তিগত ভাবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে নানা কথা চালু আছে দেশে। তিনি সমাজতন্ত্রের সেই কূটতর্কের মধ্যে কখনোই প্রবেশ করেননি। তিনি সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে জীবন মানের উন্নয়নকেই সমাজতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সব সময় তিনি বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে তার চিন্তাকে সুতীক্ষ্ন ভাবে ধরে রেখেছেন।
সহায়ক রচনাবলীঃ
- ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’, পৃ-২৩৭
- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী- ‘আমার আপন তিনজন’, পৃ-১১৭-১৮, বন্ধুর মুখচ্ছবি
- “অনন্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী”। প্রথম আলো। ২৩ জুন ২০২১।
- একুশে পদকপ্রাপ্ত সুধীবৃন্দ ও প্রতিষ্ঠান । সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পৃষ্ঠা১০। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪
- বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান, প্রধান সম্পাদক : সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর, ২০০৮
- “শেলটেক পদকে ভূষিত তিন গুণী”। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ৫ নভেম্বর ২০১৭।
- প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬
- একান্ত সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০২১
— জাজাফী
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২