পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে ঠিক তখন বাংলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষ নামের অমানুষ কারো কারো জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। আজও কিছু নরপিশাচ তাদের হিংস্র থাবায় খুবলে খাচ্ছে নারী ও কন্যা শিশুকে।এ যেন করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের নির্মমতা। শুধু মাত্র জুন মাসে সারা দেশে ৩০৮ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে যা আমরা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ পরিষদের প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারি। এই ৩০৮ জনের মধ্যে ১০১ জন নারী এবং বাকি সব কন্যাশিশু!পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিনিয়ত নারী ও কন্যাশিশু খুন,ধর্ষন নির্যাতনের খবর চোখে পড়ে যা সত্যিই বেদনা দায়ক। স্বাধীন বাংলাদেশে যে হারে নারী ও শিশু ধর্ষিতা হচ্ছে বোধকরি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানিদেরকেও ওরা হার মানিয়ে দিয়েছে। মহিলা পরিষদ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা দেশের প্রথম শ্রেণীর ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক মাসের সংবাদ থেকে তথ্য নিয়ে করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে হানা দিয়ে আমাদের অগনিত প্রিয়জনকে চিরতরে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু একদিন না একদিন নিশ্চই করোনা নামের এই ঘাতক বিদায় নেবে এবং আমার আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবো। কিন্তু আফসোস বছরের পর বছর ধরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্ষক,নির্যাতক নামের এই সব নরাধমেরা সমাজের জন্য করোনা ভাইরাসের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।করোনা ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার জন্য আমরা কিছু নিয়ম অনুসরণ করলেই রক্ষা পেতে পারি কিন্তু এই সব ধর্ষক,খুনী,নির্যাতক নামের করোনা ভাইরাস থেকে কি করে সমাজের নারী ও কন্যা শিশুরা নিরাপদ থাকবে তা আজও আমরা কেউ জানি না। নারী ও কন্যা শিশুরা নিজ গৃহে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,বাইরে নির্যাতিত হচ্ছে, সমাজের যে যেখানেই থাকুকনা কেন কোন না কোন ভাবে সে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যেন নারীদের জন্মই হয়েছে নির্যাতিত হওয়ার জন্য। কত আইন হলো,কত সংগঠন হলো, নারী অধিকার নিয়ে কত সভা সেমিনার হলো, কত আন্দোলন হলো কিন্তু কিছুতেই এই সব খুনী,ধর্ষকদের দমিয়ে রাখা গেলো না। কাল হোক বা পরশু হোক বা দুবছর পর হোক করোনা ভাইরাসের টিকা আবিস্কার হবে এবং একদিন তা সমুলে নিপাত যাবে কিন্তু এই সব নির্যাতন কারী থেকেই যাবে। এমন একটি সামাজিক টিকা দরকার যার মাধ্যমে সমাজ থেকে নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনকারী এবং ধর্ষকদের সমুলে উৎপাটন করা যাবে।
মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন সত্যিই উদ্বেগজনক। মাত্র এক মাসে সারা দেশে ৬৯ জন ধর্ষণ ও ২৫ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে সাত জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৫ জনকে। শুধু এখানেই শেষ নয় বরং এর বাইরে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে তিনজন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ছয় জন। মানুষ যেখানে করোনার ভয়ে শিথিয়ে আছে সেখানে কিকরে নির্ভয়ে এই সব নরপিশাচেরা জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়! ওদের নির্যাতনের ধরনও আলাদা আলাদা। এই এক মাসে অ্যাসিড আক্রান্তের শিকার হয়েছে এক জন। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে চার জন। এমনকি অপহরণ করা হয়েছে মোট ১৪ জনকে। আবার একজনকে পতিতালয়ে বিক্রি ও করা হয়েছে!
এসিড নিক্ষেপ,শ্লীলতাহানি,যৌন নির্যাতন করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি বরং এই সময়ে বিভিন্ন কারণে ৬২ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে অন্তত পাঁচ জনকে। আমরা শিশু সুরক্ষা সেল করেছি, নারী নির্যাতন বন্ধে কত কাজ করছি কিন্তু কিছুতেই এসব থামছে না।দরিদ্র পরিবারের শিশু এবং কিশোরী রুটি রুজির জন্য অপেক্ষাকৃত ধনীদের বাসায় কাজ করতে আসে। সেখানেও তারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গত এক মাসে দুই জন গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করা হয়েছে এবং এক জন গৃহপরিচারিকাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।
করোনায় জীবনযাত্রার অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতন কমেনি বরং বেড়েছে অনেক বেশি। এই এক মাসে যৌতুকের কারণেও নির্যাতন করা হয়েছে সাত নারীকে। আমরা আইন করে যৌতুক বন্ধের চেষ্টা করেছি ঠিকই কিন্তু তার পরও হরহামেশাই যৌতুকের বলি হতে হচ্ছে নারীকে। শারীরিক নির্যাতন, উত্ত্যাক্ত করা কোন কিছুই থামেনি। আর এসব কারণে আত্মহত্যার পরিমানও বেড়েছে।এবং প্রতিটি আত্মহত্যাকেই একটি হত্যাকান্ড হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। জুন মাসের পরিসংখ্যন বলছে এই সময়ে বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১৭ জন নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। ৩৪ জন নারী ও কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিবাহ আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল তার ওপর করোনাকালে যে কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে সরকারি বিধি নিষেধ থাকলেও প্রতিবেদন অনুযায়ি গত মাসে অন্তত বাল্যবিবাহ হয়েছে এক কন্যাশিশুর।
পরিসংখ্যন অনুযায়ি করোনাকালে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। কিন্তু সব তথ্য গণমাধ্যম পর্যন্ত পৌঁছায় না। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ দ্রুত গ্রেফতার এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরী। অন্যথায় এই সব ঘাতক,নরপিশাচদের থাবায় আগামীতে আরও বহু প্রাণ ঝরে যাবে এবং নির্যাতন,ধর্ষনের শিকার হবে অগণিত নারী ও কন্যা শিশু।