দেখতে দেখতে ছয়টা বছর পেরিয়ে গেলো।মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নামের আগে এক্স শব্দটি জুড়ে দেওয়া হবে।কম বেশি সবার মনটাই বিষন্ন।ক্যাডেট থেকে এক্স ক্যাডেট হওয়ার ক্ষণিক বেদনা সবাইকে বিমর্ষ করে রেখেছে।কলেজ ক্যান্টিনের দিকে হাটছে আরেফিন।।মনের মধ্যে উথালপাতাল ভাবনা।বাংলা সিনেমার দৃশ্য চোখে ভাসছে!নায়ক দুঃখের সময় লাল পানি খেয়ে দুঃখ ভুলে থাকতে চেষ্টা করে।ক্যাডেট থেকে এক্স ক্যাডেট হওয়াটাওতো দুঃখ। কিন্তু এই দুঃখের দুটি ভিন্ন রং।নতুন কিছুর হাতছানি আছে সামনে সেটাও একরকম আনন্দের।তার পরও ক্ষণিকের দুঃখ ভুলে থাকার জন্য কিছু একটা করা দরকার। বাংলা সিনেমার নায়কের মত না হোক কোকাকোলাতো খাওয়া যাবে এই ভাবনা থেকেই ক্যান্টিনের দিকে যাওয়া।
হাউস থেকে বেরিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাটতে থাকে আরেফিন।পা যেন আর চলতেই চায় না।আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।নিশ্চই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সবাই কিছু না কিছুতে ব্যস্ত।চলে যাবার তাড়া আছে সবার মধ্যে।হতে পারে কেউ কেউ আগেই ক্যান্টিনে গিয়ে বসেছে।আরেফিন ক্যান্টিনে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো কোথাও কেউ নেই।সবাই যেন ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেছে।কি আর করা একটা কোক খেয়ে কিছুটা শান্ত হতে হবে ভেবে সে যখন একটু এগিয়েছে তখন দেখতে পেলে টেবিলের উপর কাচের বোতলে একবোতল কোক।ক্যাপ খোলা।তার মানে কেউ খেতে বসেছিল কোন কারণে উঠে গেছে।আরেফিন ভাবলো তাহলে আর কুপন খরচ করে লাভ কি! ফ্রিতে যখন পাইলাম এই ভেবে সে বোতলটা হাতে তুলে নিলো।
বোতলের গায়ে একটা কাগজে সর্তক বার্তা লেখা।এই কোক কেউ খাবি না এটাতে আমি থুথু দিয়ে রেখেছি।নিচে সৈকতের নাম লেখা।মনে মনে সৈকতকে গালি দিয়ে বললো শালা বাটপার থুথু দিয়ে রেখে গেছে। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। সে পকেট থেকে কলম বের করে নিচে লিখে দিলো “ যেহেতু এই কোকে থুথু দেওয়া এবং আমি খেতে পারছি না তাই আমিও থুথু দিয়ে গেলাম” নিচে নিজের নাম লিখে দিলো আরেফিন।এর পর একটু দূরে একটা টেবিলে সে একটা কোক নিয়ে খেতে থাকলো।সৈকত ফিরে আসলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।ও আসলে ওয়াশরুমে গিয়েছিল।রেখে যাওয়া কোক বহাল তবিয়তে আছে দেখে সে স্বস্তি পেলো।
সৈকত কোকের বোতলটা নিয়ে যখন খেতে যাবে তখন দেখতে পেলো নিজের লেখার নিচে আরো কিছু লেখা। সে ভালো করে পড়ে দেখে তার আক্কেল গুড়ুম! একটু দূরেই আরেফিন সব দেখে মিটমিট করে হাসছিলো।এক্স ক্যাডেট হওয়ার দুঃখের দিনেও খানিকটা আনন্দ হচ্ছে।আরেফিন যেহেতু নাম লিখে রেখেছিল তাই ক্যান্টিনে আরেফিনকে দেখে সৈকত এগিয়ে গেলো।কোকের বোতল সেখানেই পড়ে থাকলো।সৈকত ওর কাছে গিয়ে বললো শালা তুই এইডা কি করলি? আমিতো এমনি এমনি ওখানে লিখছিলাম ওটাতে থুথু আছে যেন কেউ না খায় আর তুই শালা সত্যি সত্যিই থুথু দিলি?
সৈকতের কথা শুনে আরেফিন থ! বলেকি এই ছেলে। থুথু না দিয়েই থুথু দিয়েছি লিখে রেখেছে! আর সেটা দেখেই কিনা সে নিজের কুপন খরচ করে কোক কিনেছে! আরেফিন বললো আরে কি বলিস তুই? আমি থুথু দেবো কেন? আমিতো এমনিতেই থুথু দিয়েছি লিখে রেখেছি তোর লেখা দেখে।সৈকত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কোক খাবে বলে ফিরে আসলো।এসে দেখতে পেলো কোকের বোতল ফাঁকা পড়ে আছে।বোতলের গায়ে লাগানো কাগজটাও নেই।পাশে জাফর দাড়িয়ে আছে! সৈকত জাফরকে বললো শালা আন্ধা নাকি তুই? কোন কিছু না দেখেই পুরো কোক টুকু শাবাড় করে দিলি?এই কাগজটাতে কি লেখা দেখিসনি?
জাফর কোকের স্বাদ নিয়ে আয়েশ করে বসলো। তার পর বললো দেখেছি বলেইতো আরো বেশি আগ্রহ নিয়ে খেয়েছি।তোদের সামান্য থুথু দেওয়া কোকই যদি না খেতে পারি তবে কিসের বন্ধুত্ব হলো?ওখানে থুথু না দিয়ে বিষ দিলেও খেয়ে ফেলতাম। বন্ধুদের দেওয়া বিষওতো অমূল্য। জাফরের এমন কথা শুনে সৈকতের চোখটা ছলছল করে উঠলো।সে জাফরকে জড়িয়ে ধরলো।অন্য টেবিলে বসে থাকা আরেফিনও ছুটে আসলো।তিন বন্ধু একে অন্যকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।ক্যান্টিন বয়রা আরো একবার দেখলো বন্ধুত্বের শক্তি।ক্যান্টিনের দেয়ালে দেয়ালে ধ্বনিত হলো ক্যাডেট লাইফের মর্মবাণী।
দূর থেকে কারো একজনের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো দরজা দিয়ে ঢুকছে সিফাত।
মূখে করুণ সুরে গাইছে জাজাফীর সদ্য লেখা গানের লাইন লাইন
“স্টিশানে থামলো গাড়ি এবার যেতে হবে
ছয় বছরের প্রেম তবুও হৃদয় মাঝে রবে।
ফিরবে না আর একজীবনে খাকি পরার দিন
যে খাকিতে জমে গেছে ভালোবাসার ঋণ।
ছয় দাগের ওই অ্যাপুলেটে রাখি যখন হাত
স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে নিরব অশ্রুপাত”।
১৮ মে ২০১৯
নিরব অশ্রুপাত
—জাজাফী
আরও পড়ুনঃ তিন শহরের টানে।