“রাইফেল,রোটি,আওরাত” এই একটি নাম উচ্চারণের সাথে সাথে যে মানুষটির কথা মনে পড়ে তিনি আনোয়ার পাশা। সার্থক এই ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের ভাষায় এমন মাধুর্য আনয়ন করেন যে সেটা হয়ে ওঠে কল্পনার বাইরে বাস্তবতারই একটি দৃশ্য কল্প। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক আনোয়ার পাশার “রাইফেল,রোটি,আওরাত ঠিক সেরকমই একটি উপন্যাস। শেষ হয়েও হইলনা শেষ টাইপের উপন্যাসটায় সমাপ্তি টানা হয়েছে কিছু অভাবনীয় কথামলার সমন্বয়ে, “পুরোনো জীবন টা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে। বেশী দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ। কেটে যাবে
গল্পকার কেবল গল্প লিখেই ক্ষান্ত হন না। তিনি বরং নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান। লেখকের মনে আশার বাণী সেই সাথে কিছুটা সংশয়ও বটে। আশার বাণী দেখেই বুঝা যাচ্ছে যুদ্ধের ভয়াবহতা তখনো শেষ হয় নি। যে কোন ধরণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সাধারনত উক্ত বিষয় নিয়ে সাহিত্যকর্ম কিংবা লেখালেখি শুরু হয়। ঘটনা চলাকালীন অবস্থায় সে ঘটনা নিয়ে সার্থক সাহিত্য তৈরী করা বেশ কঠিন। রবীঠাকুরের ভাষায়, “প্রত্যক্ষের একটা জবরদস্তি আছে – কিছু পরিমাণে তাহার শাসন কাটাইতে না পারিলে কল্পনা আপনার জায়গাটি পায় না।” এখানেই অনন্য আনোয়ার পাশা। ‘প্রত্যক্ষের জবরস্তি’র শিকার হননি তিনি, বরং সে শাসনকে পাশ কাটিয়ে তার শৈল্পিক মনটাকে ঠিক জায়গায়ই রেখেছেন। আর তার সে ‘শৈল্পিকতা’র পাশে ঠিকই জায়গা দিয়েছেন সে সময়ের ইতিহাসকে, ঘটনাপ্রবাহকে।
১৪ই ডিসেম্বর বদর বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানো শহীদ আনোয়ার পাশার “রাইফেল, রোটি, আওরাত” – সেই কালের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে বসে লেখা আমাদের সমগ্র ইতিহাসে খুব সম্ভব এটাই একমাত্র উপন্যাস। এর রচনাকাল ৭১ এর এপ্রিল থেকে জুন মাস। । একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় আমাদের ইতিহাস চর্চার অবস্থা খুবই করুণ; প্রত্যেকের আমলে নিজ নিজ চাহিদা মত ইতিহাসের বিকৃতি, নিজেদেরকে সে সময়ে উল্লেখযোগ্য আসনে বসানোর বিকৃত মানসিকতা আমাদেরকে, মানে এই প্রজন্মকে শুধু ভুল ইতিহাসই শিক্ষা দেয় নি, বরং দিয়েছে ইতিহাসের প্রতি চরম অনীহা। যেহেতু বইয়ের রচনাকাল যুদ্ধচলাকালীন সময় তাই এই দিক থেকে এই বইয়কে একটা উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবেই ধরা যায়। সে সময়টাকে এত বাস্তবতার সাথে আর কোন উপন্যাসে কেউ তুলে ধরতে পারেন নাই, যেটা আনোয়ার পাশা করতে পেরেছেন।
লেখক নিজে যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, তিনি উপন্যাসের কাহিনী তাই তুলে এনেছেন বাংলাদেশের শত আন্দোলনের প্রানকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল থেকেই। বইয়ের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । লেখক সুদীপ্ত শাহীন চরিত্রে প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে ঘটনার পর ঘটনা বর্ননা করে গেছেন। তার চোখেই আমরা দেখতে পাই আমাদের যুদ্ধটাকে। জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হলের ভয়াবহ অবস্থাটাও আমরা দেখতে পাই তার চোখে। লাশের সারির মাঝে দাড়িয়ে বাস্তবতাকে পাশকাটানো যায়না। এই কঠিন বাস্তবতাকে অত্যন্ত নিখুত ভাবে উপস্থাপনের পান্ডিত দেখিয়েছেন আনোয়ার পাশা। এখানে যেমন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনিরুজ্জামান, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সহ আরো অনেক বিখ্যাত শিক্ষকদের কথা আছে তেমনি আছে ‘অধ্যাপক খালেক, মালেক ‘ এর মত চরিত্র। এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সে সময়ের শিক্ষিত পাকিস্থানি দালালদের কথা। অবশ্য এটাও দেখিয়েছেন, এই দালালরাও পাকি বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায় নি।
“বাংলাদেশীরা সব হিন্দু হয়ে গিয়েছে” – এই অজুহাতে পাকিরা আমাদের উপর হামলে পড়েছিল। এর প্রমান বর্তমানে অনেক পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইপত্রে ও পাওয়া যায়। আফসোস হয় সেই সব লেখক জেনারেল পদবীধারীদের জন্য।ইতিহাসের কলংকজনক অধ্যায়ে তাদের নামটাও লেখা থাকবে। এই উপন্যাসে লেখক এই দিকটিও তুলে ধরেছেন চরম দক্ষতার সাথে। সুদীপ্তকে যখন খাকি পোশাকের জওয়ান “কুত্তা” বলে সম্বোধন করে তখন সে বলে উঠে,
‘হাম কুত্তা নেহি হ্যায়, হাম মুসলমান হ্যায়।’
‘তোম যো মুসলমান হ্যায় উ তো ভোল গিয়া।’
ক্ষণজন্মা সুলেখক আনোয়ার পাশার জন্ম ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ডাবকাই গ্রামে। পিতা হাজী মকরম আলী। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু এখানেই কর্মরত ছিলেন। আর সব মানুষের মতই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন সবসময়। এখানেই বলেছেন, “বাঙ্গালীর অস্ত্রের শক্তি আজ সীমিত হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার সম্পদ তো অফুরন্ত। সেই প্রীতি ভালোবাসার সঙ্গে এবার অস্ত্রের সম্মেলন হয়েছে – এবার বাঙ্গালী দুর্জয়…।” কিন্তু দুনিয়াকে যিনি পরিচালনা করেন তিনিইতো চিত্রনাট্য সাজিয়ে রেখেছেন।তার সাজানো চিত্রনাট্যকে এড়িয়ে অভিনয় করার মত কুশীলব কে আর আছে,সাধ্য কার। আর সে জন্যই আনোয়ার পাশাও তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ দেখে যেতে পারেননি । “রাইফেল, রোটি, আওরাত” – তার জীবনের শেষ বই – প্রত্যক্ষ আর সাক্ষাৎ ঘটনাবলীকে উপন্যাসে রূপ দেয়ার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত।
একবার আমার ছোট বোন আমাকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কোন উপন্যাসের নাম বলতে বলেছিল, আমি নির্দ্বিধায় বলেছিলাম আনোয়ার পাশার লেখাটির কথা। নতুন কেউ যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পড়া শুরু করতে চায় তাদেরকে আমি সবসময় দুটো উপন্যাসের কথাই বলব, এক, “রাইফেল – রোটি- আওরাত” আর দুই, হুমায়ূন আহমদের “জোছনা জননীর গল্প”।
………………………………………………………………………………..
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
উত্তরা,ঢাকা-১২৩০