বসন্তের গল্প শুনবেন? ভালোবাসা দিবসের গল্প? প্রেম আসা না আসার গল্প? এই গল্পটা আমার বন্ধু মাহমুদের। নির্ঝর আবাসিক এলাকায় আমাদের বাসা।মাহমুদও ওখানেই থাকে। ওর বাবা লেফটেনান্ট কর্নেল আমার মাম্মামের ব্যাচমেট।কিভাবে কিভাবে যেন আমরা একই কোয়ার্টারে বাসা পেয়ে গেলাম।তখন আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ি।ছুটে বড়াই কলোনীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।আমি কিছুটা ভাবুক আর ও খুব চঞ্চল।১১ই ফেব্রুয়ারি ছিলো মাহমুদের জন্মদিন।সেই পার্টিতে আসেপাশের সব আন্টিরা এসেছিলেন তাদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে।জন্মদিনের কেক কাটার পর সবাই একে একে মাহমুদকে খাইয়ে দিচ্ছিল।এমন সময় রুমানা আন্টি আসলেন।পরনে হলুদের আবরণযুক্ত সিল্কের শাড়ী।খোপায় জবা ফুল নয়তো অন্য কোন ফুল ঠিক মনে নেই।বাম হাতে একটা দামী ঘড়ি আর ডান হাতে স্বর্ণের বালা।বয়স মাম্মামের মতই।ব্রিগেডিয়ার আতিক আংকেলের স্ত্রী।আমি আগেও অনেকবার দেখেছি কিন্তু মাহমুদ সম্ভবত সেবারই প্রথম দেখলো।
তিনি যখন মাহমুদকে কেক খাওয়াতে গেলেন তখন আমরা থ হয়ে গেলাম।মাহমুদ কেক না খেয়ে রুমানা আন্টির মুখের দিকে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আন্টি কেক হাতে নিয়ে বললেন হা করো কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।শেষে রুমানা আন্টি ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললেন এই যে রাজপুত্র কি ভাবছো?কোথায় হারিয়ে গেছো?মাহমুদ বললো দেখছি,অবাক চোখে দেখছি পৃথিবীর সৌন্দর্য! আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।বলে কি ছেলে? রুমানা আন্টি বললো বাব্বাহ কবি কবি ভাব ছেলের। তা পৃথিবীর সৌন্দর্য কোথায় দেখলে?মাহমুদ তখন অবাক করে দিয়ে বললো এই যে তোমার মধ্যে।আচ্ছা তুমি এতো সু্ন্দর কেন? জানো আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি!
আমরাতো সবাই ভীষণ রকম চমকে উঠলাম আর রুমানা আন্টি হো হো করে হেসে উঠলেন তার পর মাহমুদের আম্মুকে ডেকে বললেন আপা আপনার ছেলে কি বলে শোনেন! সে নাকি আমার প্রেমে পড়েছে। মাহমুদের আম্মু হেসে উঠে বললেন এ আর নতুন কি? এখন পযর্ন্ত মনে হয় ও বিশজনের প্রেমে পড়েছে।রুমানা আন্টি বললেন ছেলেতো দেখছি বিশ্বপ্রেমিক হবে।সেদিন অনেক আনন্দ হলো।রুমানা আন্টি চলে যাবার সময় ওকে বললেন আমাদের বাসায় এসো কিন্তু প্রিয় রাজপুত্র।কে জানতো কথাটা মাহমুদ মনের মধ্যে পুষে রাখবে।পরদিন ১২ই ফেব্রুয়ারি স্কুল ছুটির পর ও বললো চল আজ রুমানা আন্টির বাসায় যাবো। আমরা তখন সেমস এ পড়ি। বিএএফ শাহীন কলেজের ইংলিশ মিডিয়ামে।একই ভবনের সেভেন্থ ফ্লোরে রুমানা আন্টিদের বাসা আর আমাদের নাইন্থ ফ্লোরে।ওর খুব ইচ্ছে গোলাপ ফুল কিনে নিবে কিন্তু কোথায় পাবে গোলাপ? শেষে নিজের খাতার পাতা ছিড়ে সেখানে রংপেন্সিল দিয়ে সুন্দর অসুন্দর মিলিয়ে গোলাপের ছবি আকলো। উদ্দেশ্য রুমানা আন্টিকে দিবে।
যথারীতি লিফটে উঠে নিজেদের বাসার নাম্বার না চেপে রুমানা আন্টির ফ্লোর নির্বাচন করলাম।গেটের সামনে দাড়িয়ে কলিংবেল চাপতেই কিছুক্ষণের মধ্যে একটি মেয়ে দরজা খুলে দিলো। ওটা রোদেলা আপু।স্কলাস্টিকাতে স্ট্যান্ডার্ড এইটে পড়ে।আমাকে খুব ভালো করেই চেনে।কিন্তু মাহমুদকে চেনে না কিংবা মাহমুদও তাকে চেনে না। সে পড়াশোনা নিয়ে খুব বিজি থাকে তাই বাইরে বের হয় কম।আমি মাঝে মাঝে আসি বলে দেখা হয় কথাও হয়।আমাদেরকে দেখে রোদেলা আপু বললেন আরে পুচকু কেমন আছো? এখন যে আসোই না। আজ কি মনে করে? আমি বললাম আপু ভাবলাম তোমাদেরকে দেখে যাই।দেখলাম মাহমুদ অপলোক তাকিয়ে আছে রোদেলা আপুর দিকে।বুঝলাম ও ব্যাটা আবার নতুন করে প্রেমে পড়েছে। রুমানা আন্টি বাসাতেই ছিলো।তিনি জানতে চাইলেন রোদেলা কে এসেছে রে? রোদেলা আপু আমাদের কথা বললো।আন্টি তখন আমাদের সামনে আসলেন।জানতে চাইলেন কি খবর।
মাহমুদকে দেখে বললেন এই যে রাজপুত্র তুমি তবে আজ আমাকে দেখতে চলেই আসলে! মাহমুদের সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই।সে বললো পাষ্ট ইজ পাষ্ট।ফরগেট দ্যাট মেমোরি,আই অ্যাম ইন আ নিউ রিলেশানশীপ! যা ভেবেছিলাম তাই।রুমানা আন্টি হো হো করে হেসে উঠে জানতে চাইলেন তুমি এ কেমন প্রেমিক যে গতকালই আমাকে পছন্দ করে আজই ভুলে গেলে? তা তোমার নতুন প্রেমিকা কে শুনি? মাহমুদ জানালো একটু আগে যে রাজকন্যাটা আমাদেরকে দরজা খুলে দিলো সে!আন্টি এবার রোদেলা আপুকে ডাকলেন।রোদেলা আপু সামনে আসতেই তিনি বললেন নাও তোমার প্রেমিককে বরণ করে নাও।রোদেলা আপু প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না পরে আন্টি বললেন মাহমুদ গতকাল আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে আর আজ দেখা করতে এসে যখন তোমাকে দেখেছে তখন আমাকে ভুলে গিয়ে তোমার প্রেমে পড়েছে।
সব শুনে রোদেলা আপুও হাসতে শুরু করলো।মাহমুদ এসবে পাত্তা দিলো না।ফিফথ গ্রেডে পড়লে কি হবে ভাব দেখে মনে হয় সে ও লেভেল দিয়েছে আরো বছর খানেক আগে।সেদিন এক ঘন্টা ধরে জমিয়ে আড্ডা দিলাম।এরমাঝে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমরা রোদেলা আপুদের বাসায় আছি।ফিরে আসার আগে রোদেলা আপু মাহমুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো তুইতো এখনো পুচকে! এখনি প্রেম করবি? তাও আবার আমার মত বড় আপুর সাথে! তাই হয় নাকি।মাহমুদ বললো আমাকে পুচকে বলবে না।আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি।আর হ্যা দেখবে আমি যখন বড় হয়ে যাবো তখনো তোমার বিয়ে হবে না।মাহমুদের কথা শুনে রোদেলা আপু বললো তুইকি আমায় অভিশাপ দিচ্ছিস?সামনে ১৩ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন কি করবি সেদিন? ও কিছু বললো না।
আমরা বেরিয়ে এলাম।মনে মনে ভাবলাম ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে সে না জানি আবার কাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে।তবে পরদিন সে আর কি করেছিল আমি জানতে পারিনি।পরবর্তী জীবনে তার প্রেমে পড়া চলতেই থাকে। ক্লাস সেভেনে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।ও ভর্তি হলো সিলেট ক্যাডেট কলেজে।তবে আমাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকলো।পরে জানতে পারলাম ক্লাস টুয়েলভের সময় ভ্যাকেশানে এসে এক জুনিয়রকে ও প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু সে বলেছিল ভাইয়া আপনিতো আমার চেয়ে বেশ বড় তাই আমি রিলেশানে যেতে চাইছি না।আমি চাই সম বয়সী কারো সাথে রিলেশান করতে।
এ নিয়ে আমাদের অনেক গল্প হতো।বিশেষ করে ভ্যাকেশানে একসাথে আড্ডা দিতে দিতে এসব কথাই হতো বেশি।ওকে বললাম তাহলে এবার তুই সমবয়সী কারো সাথে প্রেম কর।যে কথা সেই কাজ।ভেবেচিন্তে একজনকে পছন্দ করলো।ওর নাম প্রিয়তী।বুঝে শুনে তাকে প্রেম নিবেদন করলো কিন্তু সেই কপালের দশা। প্রিয়তী বললো দ্যাখ মাহমুদ সমবয়সীতে প্রেম হয়না যাষ্ট বন্ধুত্ব হয়।আমার বাবা মা যখন আমাকে বিয়ে দিতে চাইবে তুই তখনো স্ট্যাবলিশড হতে পারবি না ফলে আমাদের প্রেম বৃথা হয়ে যাবে।শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে লাভ কি?এটা শোনার পর মাহমুদ আর প্রেমের ব্যাপারে কথা তোলেনি।আমরাও আর ওকে ঘাটাইনি।
বয়স বাড়তে বাড়তে ৪৮এ ঠেকলো,চাকরিতে বেশ সুনাম অর্জন করলো পরিবার থেকে বিয়ের কথা বললো কিন্তু সে অনঢ়। কিছুতেই সে বিয়ে করবে না।অনেকে অনেক কথা বললো কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না।তার জীবনে বসন্ত আসে বসন্ত যায় পহেলা ফাল্গুন নিয়ে তার কোন মাতামাতি নেই,১৪ই ফেব্রুয়ারি নিয়ে তার কোন মাতামাতি নেই।আমরাও সবাই চুপ থাকলাম।ও ওর মত করে থাকুক।কিন্তু হঠাৎ গতবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডের আগে ওকে খুব চঞ্চল দেখাচ্ছিল।আমি বললাম কিরে মাহমুদ কাহিনী কি?এতো উচ্ছল কেন এবার?মনে হচ্ছে নতুন করে বসন্ত এসেছে জীবনে।সে হাসলো তার পর বললো দোস্ত এবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে একজনকে প্রোপোজ করবো বলে ভাবছি।আমি বললাম কে সে? ও বললো না।শুধু বললো কালকে সাথে থাকিস।
আমি অপেক্ষায় থাকলাম।পরদিন বিকেলে মাহমুদ আমাকে ফোন করলো।আমি রেডি হয়ে ওর সাথে দেখা করলাম।আমরা তখন উত্তরাতেই থাকি।সাত নাম্বার সেক্টরের ওখানে উত্তরা হাইস্কুলের সাথে লাগোয়া পার্ক।আমি আর মাহমুদ অপেক্ষা করতে লাগলাম ওর প্রেমিকা আসবে বলে।একটু পর একটা অষ্টাদশী কন্যা এসে হাজির হলো।সুন্দর দেখতে।মেয়েটিকে আমি চিনি।সে আমাকে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলো।সালাম দিয়ে বললো আংকেল কেমন আছেন?আমি বললাম ভালো আছি। তোমার আম্মু কেমন আছে?সে বললো আম্মু ভালো আছে।একদিন আসেন বাসায়।আম্মু আপনার কথা বলে।আমি বললাম ঠিক আছে আসবো।
ভাবলাম আমি দাড়িয়ে থাকলে ওদের কথা বলতে অসুবিধাহবে তাই একটু চা খেয়ে আসি বলে ওদের একাকী রেখে বেরিয়ে গেলাম। মিনিট পাচেক পরেই মাহমুদের ফোন।আবার পার্কে ঢুকলাম।পার্কের বেঞ্চিতে মাহমুদ মনমরা করে বসে আছে।বললাম রুমকি কোথায়?আমার মুখে রুমকি নামটা শুনে মাহমুদ চমকে গেলো।জানতে চাইলো ওর নাম যে রুমকি তুই আগেই জানতি? ও যে তোকে আংকেল বলে ডাকলো তুই আগেই চিনতি? আমি বললাম হ্যা চিনতামইতো। এমনকি ওর মা কেও চিনি।ওর মাকে তুই প্রোপজ করেছিলি মনে আছে? মাহমুদ জানতে চাইলো ওর মায়ের নাম কি? আমি বললাম প্রিয়তী! যে তোকে বলেছিল সমবয়সীদের মধ্যে প্রেম হয় না।ওকে আরো বিমর্ষ দেখালো।জানতে চাইলাম তুইকি রুমকিকেই প্রেমের প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলি কিংবা দিয়েছিস? সে বললো দিয়েছি এবং রিজেক্ট হয়েছি।সে শেষপযর্ন্ত বলেছে আপনিতো আমার আংকেল হন,আম্মুকে আপনার কথা বলেছি আম্মু বলেছে আপনি নাকি তাকেও প্রোপজ করেছিলেন।এখন আপনি আমাকেও প্রোপোজ করতে চাইছেন!
আমি বললাম তুই এসব চিন্তা বাদ দে।মনে কর তোর জীবনে বসন্ত হয়তো এসেও আসেনি,তোর জীবনে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হয়তো এসেও আসেনি।তার পর দু্ই বন্ধু বাসার দিকে হাটতে শুরু করলাম।
গল্পঃ বসন্ত এসেও আসেনি,
লেখাঃ জাজাফী (Zazafee)
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
আরও পড়ুনঃ