জীবন মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য এটা একটি অমোঘ সত্য এবং এর কোন পরিবর্তন নেই।জন্ম হলে তাকে একদিন মৃত্যুবরণ করতেই হবে।মৃত্যু বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আজ আমার মনে হলো মৃত্যু অনেক রকম হতে পারে।এই অনেক রকমের মধ্যে আমি অবশ্যই রোগে ভুগে মরা,স্বাভাবিক মৃত্যু,বৃদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া,দুর্ঘটনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এসব বলছিনা কারণ এর প্রতিটিই মানুষের অন্ত্যিম মৃত্যু।আমি ভেবে দেখলাম অন্ত্যিম মৃত্যু ছাড়াও মানুষ মরতে পারে বহুভাবে।মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে,মানুষের মানসিক মৃত্যু ঘটতে পারে। একই ভাবে রাজনৈতিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক,মানসিক মৃত্যুও হতে পারে।
আমার সামনে যে মানুষটি ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনি জীবিত হয়েও যে মৃত নন তা আমি জানিনা।অন্ত্যিম মৃত্যু হলে সেটা সাধারণ ভাবে বুঝা যায় কেননা তখন তার সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় ফলে আমরা তাকে শেষ বিদায়ের জন্য সাজিয়ে দেই এবং চিরবিদায় জানিয়ে দেই।কিন্তু জীবিত থাকতেই যখন একজন মানুষ নানা রকম মৃত্যুবরণ করে তখন বুঝে ওঠা কঠিন যে তিনি কোন না কোন মৃত্যুবরণ করেছেন।রাজনৈতিক মৃত্যু কিভাবে হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবতে বসে সবার আগে এক সময়ের স্বৈরশাসক প্রবল প্রতাপশালী জেনারেল এরশাদের কথা মনে পড়লো।তিনি যখন নিজে একটি দল করেছিলেন এবং সেই দল নিয়ে প্রবল প্রতাপে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তখন তিনি রাজনৈতিক ভাবে জীবিত ছিলেন।স্বৈরশাসক হিসেবে তার পতন হওয়ার পর থেকে তিনি যখন পরগাছা হয়ে গেলেন তখন থেকেই তিনি মূলত বাহ্যিক জীবনে জীবিত থাকলেও রাজনৈতিক ভাবে মৃত বলে মনে হয়। মৃতরা চাইলেই যেমন কিছু করতে পারে না আসলে কিছু করারও থাকে না।মানুষ মারা গেলে তার সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় তখন তার নিজের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করতে হলে অন্যের মূখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।ঠিক একই ভাবে এরশাদ সাহেবও এখন তেমনই অন্যের মূখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তিনি নির্বাচনের আগে সিএমএইচে গিয়ে ভর্তি হন কারণ তিনি জানেন না তিনি যাদের মদদপুষ্ট তারা ক্ষমতাসীন হবে নাকি হেরে যাবে। যদি তারা কোন ভাবে পা পিছলে যায় তাহলে অবধারিত ভাবেই এরশাদ সাহেবের কপালে দুঃখ রয়েছে।আর এ কারণেই তিনি সাবেক সেনানায়ক ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার দরুণ সিএমএইচে আশ্রয় নেন।অনেকটা ব্যাঙের শীত নিদ্রার মত। শীত শেষ হলেই ব্যাঙ যেমন গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে তেমনি তিনিও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলেন।এটাকে আমার মনে হয়েছে রাজনৈতিক মৃত্যু।
সাম্প্রতিক সময়ে আরো অনেকেই রাজনৈতিক মৃত্যুবরণ করেছেন।ড.কামাল হোসেন কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না বা মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমি এই তালিকায় রাখতে চাইনা কেননা তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে একটি জোট করেছেন।এ তালিকায় রাখা যেতে পারে ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদাকে যিনি ক্ষমতার লোভে দল বদল করেছেন।এই দলবদলও এক প্রকার রাজনৈতিক মৃত্যু বলে আমি মনে করি।একই ভাবে এ কিউ এম বদরুদ্দৌজা চৌধুরী বা অন্যান্যদের মধ্যে যারা শুরু থেকে যে দলের সাথে ছিলেন পরবর্তীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অন্য কোন দল গড়েছেন কিংবা অন্য দলে ভীড়েছেন তারা মূলত রাজনৈতিক মৃত্যুবরণ করেছেন।
মানুষের নৈতিক মৃত্যু ঘটেছে বহু আগে।এখনকার দিনে আমাদের সমাজের অধিকাংশই নৈতিক ভাবে মৃত।নীতি ও আদর্শহীন মানুষ পৃথিবীর আলো-বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবিত অবস্থায় কিন্তু তার নৈতিকতা নেই বলে তিনি বা তারা নৈতিক ভাবে মৃত।একটা মানুষের সুখী হওয়ার জন্য খুব বেশি কিছুর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।খুব ভালো ভাবে বলতে গেলে বলতে পারি থাকার জন্য একটি বাড়ি,চলাফেরার জন্য একটি গাড়ী আর শিক্ষা চিকিৎসা সহ অন্যান্য কারণে কিছু টাকা থাকলেই সুখী হওয়ার কথা।এ জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার দরকার আছে বলে মনে করি না।কিন্তু কয়েক বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান কিংবা আরাফাত রহমানের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকা যেভাবে উল্লেখ করেছে তাতে অবাক হয়েছি।একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবার কতটুকু সুযোগ সুবিধা পায় যে যার দরুণ খরচ বাচিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব?এমনটি যখন ঘটে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাকে নৈতিক মৃত্যু বলে ভাবা যেতে পারে।তারেক রহমান বা তার পরিবার আর্থিক কেলেঙ্কারীর সাথে আদৌ জড়িত কি জড়িত না সেটা খুজে বের করা বা সেটার ফয়সালা দেওয়ার আমি কেউ নই।যে কেউ যখন অস্বাভাবিক ভাবে টাকার পাহাড় গড়তে থাকে তখন নৈতিক ভাবে তার যদি অধঃপতন ঘটে থাকে তাহলে তিনি বা তারা নিশ্চই নৈতিক মৃত্যুর শিকার।
হরহামেশাই আমরা এমন মৃত ব্যক্তিদের দেখি।পরীক্ষায় ভালো নম্বর দেওয়ার নাম করে যে শিক্ষক তার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছেন তিনি নৈতিক ভাবে মৃত।যে অফিসার ফাইল আটকে রেখে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে তিনিও নৈতিক ভাবে মৃত।একই ভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অগণিত নৈতিক মৃত মানুষ ঘুরছে।
অর্থনৈতিক ভাবেও মানুষ মৃত হয়ে থাকে।রাস্তায়,ফুটপাথে যারা ঘুমায়,সারাদিন খায় কিংবা খায়না তারা অর্থনৈতিক ভাবে মৃত।মৃত মানুষ যেমন অন্যের দোয়া ও আশীর্বাদের আশায় থাকে এই মানুষগুলোও সেভাবেই অন্যের দয়া প্রার্থী।মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারাও অর্থনৈতিক ভাবে মৃতদের কাতারেই পড়ে।মানুষ যখন অর্থনৈতিক ভাবে মৃত্যুবরণ করে তখন তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে।তারা জৈবিক ভাবে বেচে থাকার জন্য সব কিছু করতে পারে।সমাজে তখন অপরাধের পরিমান বেড়ে যায়।যারা নৈতিক ভাবে মৃত তাদের মত ভয়াভহ হয়ে না উঠলেও এরাও সমাজের জন্য ক্ষতিকর।এদের মাধ্যমে সন্ত্রাস,চোরাচালানী,ছিনতাই,মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে থাকে।
উন্নত ও সুখী জীবনের আশায় আমরা ভীষণ পরিশ্রম করি।বাড়ী গাড়ী টাকাপয়সা করি।ছেলে মেয়েকে ভালো স্কুল কলেজে পড়াই,ভালো পোষাক কিনে দেই।এসব করতে গিয়ে আমরা জীবিত থেকেও মৃত্যুবরণ করি।এই মৃত্যুকে আমরা বলতে পারি কর্পোরেট মৃত্যু।খুব ভোরে পরিবার যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন আমরা উঠেপড়ি অফিসের উদ্দেশ্যে।কিংবা হতে পারে আমরা যখন ঘুম থেকে উঠি তখন বাচ্চারা স্কুলে চলে যায় ফলে তাদের মুখ দেখা হয়না।তারপর আমরাও অফিসে ছুটি।সারাদিন কাজে ডুবে থাকি,উন্নতি করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা প্রচুর কাজ করি।দায়িত্ব পালন করি।দিন শেষে রাত নামে আমরা ঘরে ফিরি ক্লান্ত হয়ে।কিন্তু যখন ঘরে ফিরিতখন দেখা যায় আমাদের বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে।কিংবা তারা না ঘুমালেও আমরা এতোটাই ক্লান্ত থাকি যে তারা মনে করে ক্লান্ত মানুষটিকে একটু বিশ্রাম করতে দেই।এই ভেবে তারাকাছে আসে না কিংবা আমরাই ক্লান্ত থাকার দরুন তাদেরকে কাছে ঘেসতে দেইনা।
এতে করে আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যায়।উৎকর্ষতার নাম করে আমরা যা অর্জন করি তার চেয়ে হারাই অনেক বেশি।বাড়ি গাড়ি হলেও আমরা বাস্তবে সুখ খুজে পাই না।পরিবারের সাথে আমাদের সময় কাটানো হয়না।পছন্দ মত সিনেমা দেখতে পারিনা,ঘুরতে যেতে পারিনা,গল্প করতে পারিনা,পড়তে পারিনা।সন্তান ও পরিবার সামলাতে গিয়ে মেয়েরাও হয়তো একটু মনের মত সাজগোজও করতে পারে না।আর এভাবেই একদিন বাড়ি গাড়ী সম্পদের মালিক হতে হতে আমরা দৈহিক ভাবেও মৃত্যুবরণ করি।তার মানে হলো আমরা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের উন্নতির কথা চিন্তা করে অবিরাম নিরলস ভাবে কাজ করতে গিয়ে কর্পোরেট মৃত্যুর শিকার হই। এসবের বাইরেও যে একটা জীবন থাকতে পারে তা আমরা কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনা।আমরা কখনো কখনো নিজেদের উন্নয়নের কথা ভাবতে গিয়ে অন্যকে ঠকাই।অথচ দুদিনের জীবনে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হবেনা তেমন কিছুই।দৈহিক মৃত্যুর আগেই আমরা এভাবেই প্রতিনিয়ত নানা ভাবে মৃতদের কাতারে নাম লেখাচ্ছি।
মানুষ যখন অন্ত্যিম মৃত্যু তথা দৈহিক ভাবে মৃত্যুবরণ করে তখন তার দ্বারা কারো ক্ষতি হয়না কিন্তু বাকি সব মৃত্যুই ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।তাই আমি চাই জীবিত থেকেও নানারকম মৃতদের কাতারে শামিল না হয়ে বরং জীবনে একবারই মৃত্যুবরণ করি। যে মৃত্যুর নাম অন্ত্যিম যাত্রা।যখন আমাকে বিদায় জানাতে ব্যস্ত সারা পৃথিবী।
–জাজাফী
১৯ নভেম্বর ২০১৮